পূর্ববাংলার বামপন্থীদের সম্পর্কে
শফিকুল হাসান
গত সংখ্যার দর্পণে প্রকাশিত শ্রীপ্রবীর বসু কর্তৃক আমার লেখা পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে বামপন্থীদের ভূমিকা’ শীর্ষক নিবন্ধের সমালােচনা পড়লাম। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনার জন্য সমালােচনা ও আত্মসমালােচনার মাধ্যমে অবশ্যই আমাদের ভুল ত্রুটিগুলাে শুধরে নিয়ে একটি সঠিক বিপ্লবী পথকে আঁকড়ে ধরতে হবে। প্রবীরবাবু তাঁর সমালােচনায় সে প্রচেষ্টাই করেছেন এবং তাঁর এ প্রচেষ্টাকে আমি অভিনন্দন জানাই। কিন্তু তিনি আমার বক্তব্যের বিপ্লবী সমালােচনা করলেই আমি খুশি হতাম এবং বিপ্লবী জনগণও উপকৃত হতেন। যে কোনাে বিপ্লবী সমালােচনাই অনুসন্ধান ও তদন্ত ব্যতীত সম্ভব নয়। প্রবীরবাবুর অনুসন্ধান ও তদন্তহীন সমালােচনা তাই একটি মনগড়া ভাববাদী অবাস্তব এবং অবিপ্লবী বক্তব্যে পরিণত হয়েছে। চেয়ারম্যান মাও বলেছেন, “যে তদন্ত করে না, সমালােচনা করার অধিকার তার নেই। সুতরাং নীতিগতভাবে প্রবীরবাবুর সমালােচনার জবাব দেবার ইচ্ছা না থাকলেও পূর্ববাংলার সামগ্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সম্যক ও বাস্তব বিশ্লেষণের যারা সুযােগ পাননি তাদের উদ্দেশে এবং উল্লিখিত পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অবাস্তব মােহমুক্তির কামনায়ই আমি এ সমালােচনার জবাব দেবার প্রয়ােজন বােধ করছি।
প্রবীরবাবুর সমালােচনার জবাব দিতে গিয়ে প্রথমেই আমি বলবাে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে বামপন্থীদের ভূমিকা নিবন্ধে আমি পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি তােহা সাহেবদের পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) বা অন্য কোনাে রাজনৈতিক পার্টির নীতি ব্যাখ্যা করিনি, নিজের চোখের সম্মুখে পূর্ববাংলার ঘটে যাওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনায় বামপন্থীদের দাবিদার বিভিন্ন পার্টির ভূমিকাকে বর্ণনা করেছি মাত্র এবং এ ঐতিহাসিক বর্ণনাকে মনগড়াভাবে বিভিন্ন পার্টির নীতি ও কর্মসূচি হিসেবে মনে করা নিছকই অবাস্তব কল্পনাপ্রসূত এবং অরাজনৈতিক হবে। প্রবীরবাবুর অবগতির জন্যই জানাতে চাই যে, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) এবং পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি উভয় রাজনৈতিক দলের নেতৃবর্গকে ব্যক্তিগতভাবে আমি জানি এবং তাদের সঙ্গে আমার পরিচয়ও আছে। পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে সাধারণ একজন কর্মী হিসেবে যােগ দেবার পূর্বে আমি তােহা সাহেবদের কমিউনিস্ট পার্টিরই কর্মী ছিলাম। শুধু আমি নই, পূর্ববংলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় সকল সদস্য কর্মী ও সমর্থকরাই এককালে তােহা সাহেবদের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য কর্মী ও সমর্থক ছিলেন। রুশপন্থী সংশােধনবাদীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদ লেনিনবাদ ও মাও সে তুং-এর চিন্তাধারাকে পার্টির মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। পাক ভারত যুদ্ধের পর উনিশশ ছেষট্টি সালে আইয়ুব সরকারের চীন ঘেঁষা নীতিকে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি প্রগতিশীল বলে আখ্যা দেন এবং তাদের প্রতি কর্মে সমর্থন জানিয়ে নিজেরা কার্যত নিষ্ক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। কেন্দ্রীয় কমিটির এ নিষ্ক্রিয়তাবাদী ভূমিকা এবং প্রতিক্রিয়াশীল সরকারকে সমর্থন পার্টির বিভিন্ন কর্মী বিশেষ করে পাবনা ও চট্টগ্রাম জেলা কমিটি তীব্রভাবে সমালােচনা করেন এবং সমগ্র জনগণকে রাজনৈতিক সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ করে শােষক ও শাসক শ্রেণীকে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত করে, বুর্জোয়া রাষ্ট্র যন্ত্রকে সমূলে বিধ্বস্ত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে জনগণকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার মূল বিপ্লবী দায়িত্বকে এড়িয়ে যাবার প্রচেষ্টায় কেন্দ্রীয় কমিটির এ নিষ্ক্রিয়তাবাদকে তাঁরা নয়া সংশােধনবাদী কার্যকলাপ রূপে অভিযুক্ত করেন। কেন্দ্রীয় কমিটি তাদের এ ভূমিকাকে পার্টির সিদ্ধান্ত বিরােধিতার অভিযােগে ১৯৬৮ সালে মতিন, আলাউদ্দিন, আবুল বাসার ও দেবেন শিকদারসহ চট্টগ্রাম, পাবনা, কুমিল্লা, রংপুর, নােয়াখালী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, যশাের এবং বগুড়া জেলা কমিটির বহু সদস্যকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করে দেন। এ সকল বিপ্লবী কর্মীরা মাে. তােহার কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হয়েও শহর ও গ্রামে শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীকে বৈপ্লবিক রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করতে সচেষ্ট হন এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ১৯৬৯ সালের মধ্যেই এঁরা মার্কসবাদ লেনিনবাদ ও মাও সে তুং-এর চিন্তাধারাকে ভিত্তি করে কৃষক শ্রমিক ও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে গড়ে তােলেন পূর্ববাংলার মেহনতি জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি। এ পার্টির প্রতিটি সদস্য কর্মী ও সমর্থকগণ নিঃসন্দেহে মার্কসবাদ লেনিনবাদ ও মাও সে তুং-এর চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। শুধু তাই নয় ১৯৭০ সালে পার্টির বিশেষ কংগ্রেসে শ্রদ্ধেয় কমরেড চারু মজুমদারের প্রয়ােগ পদ্ধতিকে পার্টির রণনীতি রণকৌশলের অন্যতম মূল উপাদান হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু প্রবীরবাবু আমাকে শুধুমাত্র মার্কসবাদী বলে উল্লেখ করেছেন এবং বিপ্লবী মার্কসবাদী লেনিনবাদী পথকে অনুসরণ না করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। সঠিকভাবে সামগ্রিক সংবাদ না জেনে মনগড়া যে কোনাে মন্তব্যই যে বিভ্রান্তিকর এবং অসত্য তা আশা করি এবার থেকে প্রবীরবাবু উপলব্ধি করবেন।
বস্তুত মােহাম্মদ তােহার পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) এবং পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে মূল নীতি ও লক্ষ্য সম্পর্কে কোনাে পার্থক্যই ছিল না। উভয় পার্টিই সাম্রাজ্যবাদ সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ বিরােধী এবং মার্কসবাদ লেনিনবাদ মাও সেতুং-এর চিন্তাধারা ও কমরেড চারু মজুমদারের প্রয়ােগ পদ্ধতি অনুসারে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবী চিন্তায় বিশ্বাসী। কিন্তু প্রয়ােগের ক্ষেত্র নির্ধারণে তাদের মাঝে ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মােহাম্মদ তােহারা পাকিস্তানভিত্তিক কৃষি বিপ্লবের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন আর পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পাটি গ্রহণ করে পূর্ববাংলাভিত্তিক। পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের সামগ্রিক সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ভৌগােলিক অবস্থান ও জনগণের শ্রেণী চেতনা এবং সর্বোপরি বিপ্লবী পার্টির প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ইত্যাদি কতগুলাে বাস্তব অবস্থার কারণেই পাকিস্তানভিত্তিক কৃষি বিপ্লবী পরিচালনা করার পরিকল্পনাকে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির একজন কর্মী হিসেবে আমি অবাস্তব ও অসম্ভব এবং অতীত অভিজ্ঞতার সারসঙ্কলনহীন বলে মনে করি। বাস্তবে পূর্ববাংলার সামগ্রিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারি কিছু কিছু অবস্থার সঙ্গে মিল থাকলেও পূর্ববাংলার ব্যাপক বিপ্লবী পরিস্থিতি কোনােক্রমেই ভারতের অনুরূপ ছিল না এবং পশ্চিম পাকিস্তানের পরিস্থিতির সঙ্গে তার কোনাে বাস্তব সম্পর্কই ছিল না।
পাকিস্তান তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের পর আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা ঔপনিবেশিক পূর্ববাংলার জোতদার শ্রেণীর অধিকাংশই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে ঐ সকল সামন্ত শ্রেণীর (বিশেষত হিন্দু সামন্তশ্রেণী) দেশত্যাগের ফলে পূর্ববাংলার যে ধনী ও মাঝারি কৃষক শ্রেণীর বিকাশ ঘটে তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিস্বরূপ গত তেইশ বছরে পূর্ববাংলায় একটি বিরাট মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়। শ্রেণীগতভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মাঝে সীমিত হলেও বিপ্লবী চেতনা বিদ্যমান। ফলে শশাষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার অধিকাংশ আন্দোলনই এ বিরাট সংগ্রামী মধ্যবিত্তশ্রেণী দ্বারা পরিচালিত হতাে। কিন্তু সংগ্রামী নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা মধ্যবিত্ত জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর নেই, বিপ্লবী নেতৃত্ব পরিচালনা করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব হচ্ছে সর্বহারা কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর। কিন্তু পূর্ববাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তৎকালীন অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই সেখানে কোনাে বিপ্লবী নেতৃত্বের উপস্থিতি ছিল না। পূর্ববাংলার ধনিক ও সামন্তশ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ এ সুবর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে তাদের নেতৃত্বে সমবেত করতে সক্ষম হয়। এ পরিস্থিতির জন্য আমি কোনােক্রমেই পূর্ববাংলার মধ্যবিত্ত জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীকে দোষারােপ করবে না, বরং এর মূলে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির নিষ্ক্রিয় ভূমিকাই সম্পূর্ণরূপে দায়ী। এ কারণেই পরবর্তীকালে পার্টিতে মতান্তর ও ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছিল। অন্যদিকে পাকিস্তানের বৃহৎ পুঁজিপতিরা (যারা সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি) তাদের পুঁজিবাদী শােষণের নিমিত্ত সাম্রাজ্যবাদীদের সহযােগিতায় পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পের বিকাশ ঘটাতে সচেষ্ট হয়। একই সঙ্গে সেখানে জনগণের উপর বিরাজ করতে থাকে প্রচণ্ড সামন্তবাদী শােষণ। ফলে সেখানে এক বিরাট সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়। পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে সজাগ ছিল এবং এ শ্রমিক শ্রেণী যাতে সংগঠিত হতে না পারে তার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। বেকারত্ব যাতে শ্রমিক শ্রেণীকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত করতে না পারে সে উদ্দেশে শােষক গােষ্ঠী বিনা প্রয়ােজনেই মরুভূমির উপর মঙ্গলা তারবেলা ওয়ার্সকে ইত্যাদি বালির বাঁধ নির্মাণ ও বিভিন্ন স্থানে রাজধানী স্থানান্তরের কর্মে তাদের নিয়ােজিত করে এবং অপেক্ষাকৃত বেশি পারিশ্রমিক প্রদানের মাধ্যমে (একজন সাধারণ শ্রমিকের দৈনিক মজুরি পূর্ববাংলায় ২.২৫ টাকা ও পশ্চিম পাকিস্তানে ৪.৫০ টাকা) এ সমস্যার মােকাবেলা করে আসছে। এমনকি সেখানে এখন পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী পার্টিও গড়ে উঠতে পারেনি।
পূর্ববাংলার জনগণকে সাম্রাজ্যবাদের সহযােগী পাকিস্তানি পুঁজিপতিরা (যারা সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি) যে শােষণ-নিপীড়ন চালিয়ে আসছে তার চরিত্র সম্পর্কে আলােচনা প্রয়ােজন। পাকিস্তানের বাৎসরিক আয়ের ৭৩ ভাগ সম্পদই পূর্ববাংলার মেহনতি জনগণ কর্তৃক উৎপাদিত, অথচ ব্যয়ের খাতে পূর্ববাংলার ভাগ্যে জুটততা বাৎসরিক বাজেটের মাত্র ১৪.৮ ভাগ। প্রবীরবাবু একে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু পূর্ববাংলার জনগণকে শােষণ করে শশাষক গােষ্ঠী কখনােই তা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের জন্য ব্যয় করেনি বরং বৃহ পুঁজি গড়ে তারা তাদের শােষণের পথকে আরাে প্রশস্ত করেছে মাত্র।
সুতরাং একে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য বলা কোনােক্রমেই সঠিক হবে না, বরং নিঃসন্দেহে ইহা একটি পুঁজিবাদী শােষণ। এখন প্রশ্ন হলাে এ শােষণের চরিত্র কী? এ প্রসঙ্গে আলােচনা করতে গেলে দেখা যায় যে, পাকিস্তানি পুঁজিপতিরা (যারা সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি) ইসলাম ভ্রাতৃত্ব ও সংহতি অর্থাৎ ধর্মকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে প্রথমেই আক্রমণ করে পূর্ববাংলার হিন্দু প্রধান সামন্ত ও পুঁজিবাদী শ্ৰেণীকে। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের নামে তাদের জমি সম্পত্তি দখল করে ক্ষমতাসীন এ পুঁজিবাদী শােষক শ্ৰেণী ইজারাদারী ও তহশিলদারী প্রথার মাধ্যমে সামন্তবাদী শােষণকেও নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে নিয়ে আসে এবং দুই বছরের মধ্যেই বাৎসরিক দেড় কোটি টাকা দেয় রাজস্বকে বাড়িয়ে সাড়ে আঠারাে কোটি টাকায় পরিণত করে। জোতদার মহাজন শ্রেণীগুলােও তাদের এ উলঙ্গ শশাষণ থেকে রেহাই পায়নি। তাছাড়া আইয়ুবী আমলে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে এক অদ্ভুত শাসনশােষণমূলক আইনের মাধ্যমে পূর্ববাংলার প্রায় সকল জোতদার মহাজন শ্রেণীকেই বেতনভুক্ত সরকারি আমলায় পরিণত করা হয়। এভাবে পুঁজিবাদীরা পূর্ববাংলায় জোতদারি ও মহাজনী শােষণকে সীমিত করে নিজেদের পুঁজির শােষণের কলেবর বৃদ্ধি করতে থাকে। অপরদিকে পূর্ববাংলার পুঁজিপতিদের (যারা প্রায় সবাই ছিল হিন্দু) বিতাড়িত করে তাদের কলকারখানাগুলােও পাকিস্তানি অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানি পুজিপতিরা দখল করে নেয়। এদের মধ্যে ঢাকেশ্বরী কটন মিল, চিত্তরঞ্জন কটন মিল, মােহিনী মিল, লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিল, চন্দ্রঘােনা পেপার মিল, দর্শনার সুগার মিল, সােনার বাংলা জুট মিল, তুলারাম জুট মিল ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য। এমনি করেই পূর্ববাংলার ৩৭৪টি বড় ও মাঝারি মিল ফ্যাক্টরির মধ্যে ৩৩৮ টিরই মালিক হয়েছে পাকিস্তানি তথা পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতিরা। এমনকি পাকিস্তানের মােট ৩৪টি ব্যাঙ্ক ও বীমা কোম্পানির ৩৩টির মালিক ছিল তারাই। শুধু তাই নয় পুঁজিবাদী কায়দায় তারা পূর্ববাংলার কুটির শিল্পসমূহ, যথা তাঁত শিল্প, বিড়ি শিল্প, মৃৎশিল্প, চামড়া, কাষ্ঠ ও লৌহ নির্মিত দ্রব্যাদি ইত্যাদিকে ধ্বংস করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। এসব কারণে বাঙালি সামন্ত ও পুঁজিবাদী শ্রেণী এক দারুণ সঙ্কটে নিপতিত হয়। আইয়ুবশাহীর যে কয়টি কার্যকলাপকে মাে. তােহা সাহেবরা প্রগতিশীল’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন পূর্ববাংলার সামন্ত ও পুঁজিবাদী শ্রেণীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি তথা পশ্চিম পাকিস্তানি বৃহৎ পুঁজিবাদীদের এ শােষণমূলক দ্বন্দ্ব তাদের মধ্যে অন্যতম। অবশ্য এ কথা অনস্বীকার্য যে, পূর্ববাংলার সামন্ত ও পুঁজিবাদী শ্রেণীর সীমিত শশাষণই পূর্ববাংলার বিরাট এক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশের মূল কারণ। কিন্তু কৃষক শ্রমিক তথা মেহনতি জনগণকে বিপ্লবী রাজনীতিতে ঐক্যবদ্ধ এবং সশস্ত্র করার পরিবর্তে সামন্ত ও উঠতি পুঁজিবাদী শােষণকে একচেটিয়া পুঁজিবাদী শশাষণের মাধ্যমে সাময়িকভাবে দমিয়ে রেখে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটানাে নিশ্চয়ই বিপ্লবীদের বৈপ্লবিক দায়িত্ব নয়, এ ধরনের কার্যকলাপ কখনােই মার্কসবাদী লেনিনবাদী হতে পারে না এবং একে প্রগতিশীল বলাও নিঃসন্দেহে ভুল।
রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে দেখা যাবে পাকিস্তানি ক্ষমতাসীন শােষকগােষ্ঠী পূর্ববাংলার কোনাে শ্ৰেণীকেই কোনােদিন রাজনৈতিক অধিকার দেয়নি। জনগণের পার্টি কমিউনিস্ট পার্টিকে করেছে অবৈধ, কেড়ে নিয়েছে সমগ্র পূর্ববাংলার জনগণের বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মতাদর্শের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা। ভারতের তথাকথিত গণতন্ত্রের মতাে কোনাে গণতন্ত্রও পূর্ববাংলায় কখনাে ছিল না। ১৯৫৪ সালে এবং ৭০ সালে তথাকথিত নির্বাচনের নামে শাসকগােষ্ঠী জনগণের সঙ্গে করেছে চরম প্রতারণা, তথাকথিত গণরায় কার্যকরী হয়নি কখনাে। বরং দু-দুবার সামরিক শাসন জারি করে দীর্ঘ চৌদ্দ বছর সেনাবাহিনীর দ্বারা ধনিক ও সামন্ত শ্ৰেণীসহ পূর্ববাংলার জনগণের প্রতিটি আশাআকাঙ্ক্ষাকে অঙ্কুরেই নির্মমভাবে নিষ্পেষণের মাধ্যমে হত্যা করে, অব্যাহত রেখেছে তাদের শােষণের লুণ্ঠন কার্য। শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ভাষার উপরও পুঁজিবাদী কায়দায় (প্রবীরবাবুর মতে সামন্তবাদী কায়দায়, কিন্তু সামন্তবাদী কায়দায় বিশ্বের এক অঞ্চলের ভাষা অন্য অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন ইতিহাস আমার জানা নেই) আক্রমণ করেছে, এমনকি ইংরেজ প্রভুরা যেমন ঘৃণাভরে ভারতীয়দের ‘নেটিভ’ ইত্যাদি বলে গাল দিত ঠিক তেমনি পুঁজিবাদী কায়দায় ইসলাম ভ্রাতৃত্বের ধ্বজাধারী পশ্চিম পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শশাষক গােষ্ঠী ও তাদের দালাল শ্রেণী পূর্ববাংলার জনগণকে বাস্টার্ড সানস অফ হিন্দুজ বলে ঘৃণা প্রদর্শন করে আসছে। এমনকি ধর্মের নামে সামাজিক জীবনকেও তারা অতিষ্ঠ করে তুলেছিল (মসজিদ নির্মাণ মিলাদ ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে জোর করে চাঁদা আদায় করা, স্বাস্থ্যগত কারণে অপরাগ হওয়া সত্ত্বেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে রােজা বা উপবাস করতে বাধ্য করা ইত্যাদি) পূর্ববাংলার জনগণের উপর পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল শশাষক শ্রেণীর (যারা সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি) এ সকল শােষণকে সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করে আমি বলবাে এটা নিঃসন্দেহে ঔপনিবেশিক শােষণ এবং ঔপনিবেশিক চরিত্রের শােষণ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রবীরবাবু আমাকে পাকিস্তান সাম্রাজ্যবাদ বলার অভিযােগে অভিযুক্ত করেছেন, যা আমি বলিনি। ঔপনিবেশিক শােষণ এবং ঔপনিবেশিক চরিত্রের শােষণ- এ দুয়ের মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। সবদিক চিন্তা না করেই তিনি আমাকে সঙ্কীর্ণতাবাদী বলেছেন। আশা করি এরপর প্রবীরবাবুর ভুল ভাঙ্গবে।
দ্বন্দ্ব নির্ধারণে চেয়ারম্যান মাও বলেছেন,
“When reactionary forces and its running dogs stand on one pole and the people stands on the other-thus forms the principal contradiction.’
পূর্ববাংলার জনগণ এখন প্রতিক্রিয়াশীল শােষকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের পক্ষ অবলম্বন করে পাকিস্তানি শােষকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা না করলে পূর্ববাংলার বর্তমান পরিস্থিতিতে চেয়ারম্যান মাও সে তুং এর নির্ধারিত দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণকেই অস্বীকার করা হবে। কিন্তু মােহাম্মদ তােহা সাহেবদের কমিউনিস্ট পার্টি বাস্তব পরিস্থিতিকে অস্বীকার করে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা অবলম্বন করায় জনগণ বিপ্লবী নেতৃত্বের অভাবে পূর্ববাংলার ধনিক ও সামন্তশ্রেণীর উগ্রজাতীয়তাবাদী প্ররােচনায় সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ বিভ্রান্ত এ জনগণকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে। ক্ষেপিয়ে তুলে এবং তাদের নিপীড়নের মুখে ঠেলে দিয়ে আপােসের পথে শশাষণের ক্ষেত্র ভাগের উদ্দেশে আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসনের দাবি তােলে। তােহা সাহেবদের কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের এ ভূমিকাকে প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ বলে অভিহিত করেন। কিন্তু জনগণ তখন সংগ্রামের পথে নেমেছে, শুধুমাত্র নিন্দাবাদেই তারা সন্তুষ্ট নয়, তাদের দাবি ছিল বাস্তব ও সুস্পষ্ট একটি কর্মসূচি। এমন এক জটিল পরিস্থিতিতে পূর্ববাংলার বিপ্লবীরা নিম্নের কোন ভূমিকাটি গ্রহণ করবে তা নিয়ে বহু বিতর্কের সৃষ্টি হয়-
(এক) ভবিষ্যতে পাকিস্তানভিত্তিক বিপ্লব সম্পন্ন করার উদ্দেশ্য পাকিস্তানি ক্ষমতাসীন শােষক পুঁজিবাদী শ্ৰেণীকে প্রকাশ্যে সমর্থন করে আওয়ামী লীগ তথা পূর্ববাংলার সামন্ত ধনিক শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত সংগ্রামকে বানচাল করা।
(দুই) ভবিষ্যতে পাকিস্তানভিত্তিক বিপ্লব সম্পন্ন করার উদ্দেশে বর্তমান এ সংগ্রামে নিষ্ক্রিয় থেকে পরােক্ষভাবে শাসক গােষ্ঠীর সহযােগিতা ও আওয়ামী লীগের বিরােধিতা করা।
(তিন) আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে পাকিস্তানি শােষকদের থেকে পূর্ববাংলা মুক্ত করে ভবিষ্যতে পূর্ববাংলাভিত্তিক বিপ্লব করা।
(চার) পূর্ববাংলার জাতীয় স্বাধীনতা ও জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার উদ্দেশে একই সঙ্গে পাকিস্তান ও পূর্ববাংলার প্রতিক্রিয়াশীল শ্ৰেণীকে উৎখাত করে বর্তমানেই বিপ্লবী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
তােহা সাহেবদের পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) দ্বিতীয় পথ গ্রহণ করেন এবং পাকিস্তানভিত্তিক বিপ্লবের এক অবাস্তব এবং অসম্ভব পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি বাস্তব অবস্থার সামগ্রিক বিশ্লেষণ করে পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তি ও জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশে চতুর্থ পথটি বেছে নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার এগারাে দফাভিত্তিক একটি কর্মসূচিও জনগণের সম্মুখে তুলে ধরেন। কমরেড চারু মজুমদারের প্রয়ােগ পদ্ধতিকে রণকৌশল হিসেবে গ্রহণ করে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলারা একই সঙ্গে সামন্ত ও সেনাবাহিনীর শ্রেণী শত্রুদের খতম করতে শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে প্রবীরবাবু বলেছেন, তিনি নাকি শুধু তােহা সাহেবদের শ্রেণীশত্রু খতমের সংবাদই শুনেছেন। বাস্তবে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলারাই যশাের জেলাতে প্রথম শ্রেণীর শত্রু খতম অভিযান শুরু করেন, তাদের প্রথম এ্যাকশান ব্যর্থ হয়, কিন্তু দ্বিতীয় এ্যাকশনে যশােরের কালীগঞ্জ থানার কুখ্যাত অত্যাচারী জোতদার মুসলিম লীগের থানা প্রধান চান্দ আলীকে খতম করে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টিই প্রথম পূর্ববাংলায় শ্রেণী সংগ্রামের সূচনা করেন। ৩য় এ্যাকশন ঘটে পাবনা জেলার চর অঞ্চলে।
পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির এ তিনটি এ্যাকশনের পর তােহা সাহেবদের পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) তাদের খতম অভিযান শুরু করেন এবং খুলনা যশাের ময়মনসিংহ ও নােয়াখালীতে শ্রেণীশত্রুদের খতম করতে সক্ষম হন। ইতিমধ্যে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলাদের শ্রেণীশত্রু খতম অভিযান চট্টগ্রাম, নােয়াখালী, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, বগুড়া, রংপুর, পাবনা ও যশােরের আরাে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। পাবনা শহরের গুণ্ডাপ্রধান অত্যাচারী বদমাইশ, আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য আহাম্মদ রফিককে খতম করার পর ক্ষিপ্ত আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যেই তাদের ফ্যাসিস্ট বাহিনীকে বিভিন্ন এলাকার কমিউনিস্টদের উপর লেলিয়ে দেয় এবং পাবনা শহরের পার্টি সমর্থক ডা. দাক্ষীও একজন ছাত্রকে হত্যা করে। ফলে পাবনা, নােয়াখালী, কুমিল্লা ও বগুড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্যে কয়েক দফা সশস্ত্র সংঘর্ষেরও সূত্রপাত্র হয়। পুলিশ এবং ই পি আর বাহিনী শ্রেণীগত চরিত্রের কারণেই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে ও কমিউনিস্টদের উপর ব্যাপক নিপীড়ন চালাতে থাকে, পার্টির গেরিলারা সশস্ত্রভাবেই তাদের মােকাবেলা প্রতিহত করতে সক্ষম হন। ঢাকা শহরে এ পার্টির গেরিলা যােদ্ধারা গত মার্চ মাসের ছয় এবং নয় তারিখে সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ করে যথাক্রমে একজন সশস্ত্র সেনা ও ক্যাপ্টেনকে খতম করে এবং তাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়। ফলে সেনাবাহিনীও উক্ত পার্টির উপর তাদের বর্বর আক্রমণ অত্যাচার চালাবার চেষ্টা করে। এভাবেই পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি তাদের ও তাদের শ্রেণী শত্রুদের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট সীমারেখা টানতে সক্ষম হন।
অপরদিকে বাস্তব অবস্থা ও পরিস্থিতিকে সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ না করেই তােহা সাহেবরা পূর্ববাংলার পরিস্থিতি ভারতের অনুরূপ, পূর্ববাংলার বিপ্লব ভারতের বিপ্লবেরই অংশ, সুতরাং কমরেড চারু মজুমদার যখন স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক ভারতবর্ষ কায়েম করবেন তখন সে সঙ্গে পূর্ববাংলাও মুক্ত হয়ে যাবে। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য আমদানি করেন এবং তার অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ জনগণের আস্থা হারাতে থাকেন। বস্তুত নিজেদের এলাকার জনগণকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলােকে নিজস্ব এলাকার পরিস্থিতি অনুযায়ী গেরিলা পদ্ধতিতে সশস্ত্র জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা করার দায়িত্ব অতি সন্তর্পণে এড়িয়ে গিয়ে মােহাম্মদ তােহারা পূর্ববাংলার বিপ্লবের দায়িত্বও কমরেড চারু মজুমদারের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। এরাই উনিশশাে ছেষট্টি সালে নকশালবাড়ির বিপ্লবী অভ্যুত্থানকে হঠকারিতা বলেছিল, আবার পিকিং রিভিউতে মহান চীনের সমর্থন দেখার সঙ্গে সঙ্গেই মত পাল্টিয়ে বিপ্লবী কাজ বলে অভিনন্দন জানিয়েছেন, এরাই আইয়ুব ইয়াহিয়ার চীন ঘেঁষা নীতিকে সরিয়ে রেখেছেন, এরাই পাকিস্তানি শাসক ও শােষক চক্রের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করে সমঝােতার মাধ্যমে একটি অবৈধ ঘােষিত কমিউনিস্ট পার্টির বৈধ মুখপাত্র ‘গণশক্তি’ প্রকাশ করার অনুমতি পেয়েছিলেন এবং কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক পরিচালিত সে পত্রিকায় পাকিস্তানি বৃহৎ পুঁজিবাদী তেইশটি পরিবারের দুই পরিবার এম এম ইস্পাহানী ও ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক লিমিটেডের প্রচার বিজ্ঞাপন মুদ্রিত হতাে, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পাটির বিরুদ্ধে প্রচার করতে গিয়ে তারা উক্ত পার্টির গােপন কার্যকলাপ, এমনকি প্রেস ও লাইব্রেরির সন্ধান এ পত্রিকা ‘গণশক্তি’তে প্রকাশ করে পার্টির বিপ্লবী কর্মীদের পুলিশ ও মিলিটারিদের বর্বর হামলার শিকার করার মতাে জঘন্য কাজে তারাই লিপ্ত হয়েছিলেন। তাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রফেসার আসহাবউদ্দিনের হুলিয়াও তােহা-ইয়াহিয়া গােপন সাক্ষাতের পর সমঝােতার মাধ্যমেই প্রত্যাহৃত হয়েছিল।
প্রবীরবাবু তার সমালােচনায় মওলানা ভাসানী সম্পর্কে আমার বিভ্রান্তিকর মােহের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আমি স্পষ্টভাবেই মওলানা ভাসানীকে জাতীয় বুর্জোয়া বলে উল্লেখ করেছি। চেয়ারম্যান মাও সে তুং বলেছেন, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে জাতীয় বুর্জোয়াদের একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে, তারা তাদের দোদুল্যমান চরিত্রের জন্য কিছু অংশ বিপ্লবীদের মিত্র অথবা শত্ৰু উভয়ই হতে পারে। সুতরাং বিপ্লব শুরু হওয়ার পূর্বেই তাদেরকে প্রতিবিপ্লবী শ্রেণীশত্রু বলার কোনাে অবকাশ নেই। মওলানা ভাসানী তাঁর রাজনৈতিক পার্টি ন্যাপে অবৈধ ঘােষিত কমিউনিস্ট পার্টিকে তাদের দুঃসময়ে আশ্রয় দিয়ে, তার কৃষক ফ্রন্ট, শ্রমিক ফ্রন্ট, ছাত্র ফ্রন্ট, এমনকি রাজনৈতিক পার্টি ন্যাপকে কমিউনিস্টদের প্রকাশ্যে ব্যবহার করতে গিয়ে তিনি কি বিপ্লবীদের মিত্র হিসেবে পরিচয় দেননি? তাঁর এ বিপ্লবী মিত্রের পরিচয় পেয়েই মহান চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং স্বয়ং দু’বার মওলানা ভাসানীকে তার দেশে আমন্ত্রণ করেছেন। গত নির্বাচনে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলেও মওলানা ভাসানীই এককভাবে সে সিদ্ধান্তকে বাতিল করে দিয়ে বিপ্লবীদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন। এর জন্য হাজী দানেশ নূরুলহুদা কাদের বক্সের মতাে বহু প্রভাবশালী সদস্যের পদত্যাগকেও তিনি পরােয়া করেননি। এহেন মওলানা ভাসানীকে হঠাৎ প্রতিবিপ্লবী বলে তাকে শত্রু শিবিরে ঠেলে দেবার অর্থ কী? আমি জানতে চাই মােহাম্মদ তােহারা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব করছেন, না সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করছেন? বিপ্লব পরিচালনা করার দায়িত্ব কি জাতীয় বুর্জোয়াদের, না বিপ্লবীদের? দৃষ্টিভঙ্গি ও বাস্তব কর্মসূচির অভাবে বিপ্লব পরিচালনায় ব্যর্থ হয়, বিপ্লব না করার অপরাধে জাতীয় বুর্জোয়াদের প্রতিবিপ্লবী বলে দোষারােপ করা কি নিজেদের অক্ষমতা ও ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দেবার ব্যর্থ প্রয়াস নয়? তােহা সাহেবদের মতাে প্রবীরবাবু, মুজিবুর ও ভাসানীকে একই প্রতিক্রিয়াবাদী সারিতে ফেলেছেন কিন্তু তা মােটেও সঠিক নয় কেননা মুজিবুর বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং তাদের সহযােগী পূর্ব বাংলার প্রতিক্রিয়াশীল ধনিক ও সামন্ত শ্রেণীর পরিচালক, সুতরাং শেখ মুজিব প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রতিবিপ্লবী সন্দেহ নেই; কিন্তু পূর্ববাংলার রাজনৈতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে যার সামান্যতম জ্ঞান আছে তিনি নিশ্চয়ই জানেন মওলানা ভাসানীর সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ বিরােধী একটি শক্তিশালী ভূমিকা আছে।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর সমর্থন প্রসঙ্গে প্রবীরবাবুর সমালােচনার জবাব দিতে গিয়ে আমি বলবাে বিপ্লবী যুদ্ধ পরিচালনা করার পূর্বেই আন্তর্জাতিক সমর্থনের আশায় হা-পিত্যেশ করা কোনােক্রমেই আমাদের উচিত নয়। যে রাজনৈতিক সংগঠন নিজেদের জনগণকে পরিচালনা করতে অক্ষম সে অথর্ব পার্টিকে সমর্থন করার কী অর্থ থাকতে পারে যেমন করছে মস্কোর সংশােধনবাদীরা? কিন্তু তাতে কি জনগণের শ্রেণীচেতনা বিন্দুমাত্র প্রভাবান্বিত হয়?
প্রবীরবাবু বলছেন, সামন্ততান্ত্রিক ও ক্ষয়িষ্ণু ধনতান্ত্রিক সমাজের প্রকৃতিই হলাে জনগণের এক অংশকে আরেক অংশের সঙ্গে কোনাে না কোনােভাবে লড়িয়ে যাওয়া। আশ্চর্য! তিনি কি বলতে চান পূর্ববাংলার জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে লড়াই করছে। তিনি কি পাকিস্তানেরই (পশ্চিম পাকিস্তানের) বর্বর অত্যাচারী সেনাবাহিনীকে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বলতে চান! আর এটা যদি সামন্ত ও ধনিক শ্রেণীর ষড়যন্ত্রই হয় তবে কি বলতে হবে পূর্ববাংলার ধনিক ও সামন্ত শ্রেণী অর্থাৎ আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে, কেননা সেনাবাহিনীর আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল তারাই!
পূর্ববাংলার জনগণ পাকিস্তানি শােষক ও শাসকদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি ও জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবী যুদ্ধ পরিচালনা করছে। তার মানে এই নয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গেও তাদের বিরােধ আছে, যেমন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে কোনােক্রমেই মার্কিন জনগণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম বুঝায় না। তবে ‘শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী বৈপ্লবিক জনযুদ্ধের পথেই’ যে পূর্ববাংলার জনগণের শােষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির একমাত্র পথ প্রবীরবাবুর এ বক্তব্যে আমি সম্পূর্ণ একমত।
দর্পণে প্রকাশিত শফিকুল হাসানের দুটি প্রবন্ধ পড়লাম। পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ যতটুকু জানি, সেই বিচারে, এম এ মতিন, শিকদার, আলাউদ্দীন প্রমুখ কমরেডদের পরিচালিত পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির যে বিশ্লেষণ (পূর্ব ও পশ্চিমের পার্থক্য) নিঃসন্দেহে সঠিক মনে করি। না, ব্যক্তিগত কল্পনা নয়এটাই বাস্তব। তবুও কয়েকটি বিষয় জানতে চাই তার কাছে। জানালে এ দেশের বিপ্লবী জনগণ খুবই উপকৃত হবেন।
(এক) দাঙ্গা ও সামন্ত শ্রেণীর দেশত্যাগ প্রভৃতির ফলে সামন্ত অবস্থার ভাঙন ঘটে; ফলে মাঝারি ও ধনী কৃষকের উদ্ভব ও মধ্যবিত্তের বিকাশ। শ্রেণীগতভাবে মধ্যবিত্ত নগণ্য হলেও শােষণ শাসনের ফলে তার বিপ্লবী চেতনা বিদ্যমান (বিশেষত বিপ্লবী যুব ছাত্ররা, যারা অগ্রগামী অংশ, তারা তাে এই শ্রেণী থেকেই এসেছেন)। অতএব, এদের সংযুক্ত মাের্চা গঠন করে গ্রামাঞ্চলে মাকর্সবাদ-মাও সে তুং চিন্তাধারা জনগণের মধ্যে প্রচার করে ঘাটি অঞ্চল গড়ে গেরিলা প্রস্তুতি নিচ্ছেন? না, চারুবাবুর ব্যক্তিহত্যার রাজনীতি নিচ্ছেন? কেননা এই ব্যক্তিহত্যা সন্ত্রাসবাদ- মার্কসবাদ নয়। তাছাড়া সত্যিকারের ফিউডাল বলতে যা বােঝার (ইউরােপ ও চীনে) তা দু’বাংলাতেই নেই। এরা কিছু জমির সাময়িক মালিকমাত্র, নিলাম হয়ে গেলেই সব নিঃস্ব। আর একটা প্রধান কথা বাংলার কৃষি অর্থনীতি কিছু কিছু জমি নিয়ে এক একজন ছােট জোতদার বা ধনী কৃষকদের মাধ্যমে পরিচালিত। এরা কি শ্রেণী শক্রর পর্যায়ে পড়ে? সর্বোপরি এদের ব্যক্তি বিশেষকে হত্যা করলে রাষ্ট্রযন্ত্রের কণাটুকুও খসে না। সিস্টেমের পরিবর্তনই আসল উদ্দেশ্য কমিউনিস্টদের। সেটা সম্ভব রাষ্ট্রযন্ত্র যার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে তাকে আঘাত করে। পশ্চিমী যে সব মালিকরা রয়েছে বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে বরং তাদের আঘাত করা চলতে পারে, কিন্তু সেটা মুখ্য লক্ষ্য নয়। সশস্ত্র প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবী আক্রমণ এটাই বিপ্লবীদের কাজ। তা সম্ভব ব্যাপক মাও চিন্তাধারা প্রচার করে জনগণের মধ্য মিশে গিয়ে তাদের সশস্ত্র করে গ্রামে ঘাঁটি (গেরিলা ট্রেনিং গােপনে সংগঠিত করে গড়ে শহরগুলােকে দখল করা। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পরিকল্পনা নেয়া। এ বাংলায় ব্যক্তিহত্যা ও স্কুল-কলেজ আক্রমণ, মূর্তি ভাঙা ধারাকে। বিশ্বজোড়া চীন বিরােধী যে প্রচার বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে হচ্ছে তার সঠিক মূল্যায়ন করবেন না? অথচ আপনাদের দেশের জনতা এখন প্রতিক্রিয়াশীল ভারতীয় সেনাদের তাদের প্রধান সহায়ক ও বন্ধু মনে। করছেন। ঔপনিবেশিক ও আধা ঔপনিবেশিক দেশগুলােতে বুর্জোয়াদের মধ্যে বিরােধ বাধানাে বৃটিশ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের (সি আই এ-এর) বড় চক্রান্ত। এই চক্রান্তের জালে বাঁধা মজিবুর রহমান। কিন্তু আজকের আমেরিকা-বৃটেনের গােপনে ও প্রকাশ্যে অস্ত্র দেয়ায় আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা মনের দিক থেকে মার্কিন বিরােধী হতে বাধ্য; এই অবস্থায় তাদের মধ্যে সঠিক রাজনীতি দিয়ে সশস্ত্র করে এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে বলে মনে করি।
আপনার অভিমত কি?
জনৈক কমরেড
বালিগঞ্জ
সূত্র: দর্পণ
২৫.০৬.১৯৭১