You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.09 | পূর্ববাংলার সংগ্রাম ও বামপন্থীরা- শফিকুল হাসান | দর্পণ - সংগ্রামের নোটবুক

পূর্ববাংলার সংগ্রাম ও বামপন্থীরা
শফিকুল হাসান

‘পূর্ববাংলার সংগ্রাম প্রসঙ্গে গত সপ্তাহের দর্পণে প্রকাশিত বালিগঞ্জের জনৈক কমরেডের সমালােচনা ও প্রশ্নসমূহের জবাব দিতে গিয়ে আমি উক্ত প্রশ্নকর্তাকে অনুরােধ করবাে কোনাে রচনা বা বক্তব্য সম্পর্কে সমালােচনা মন্তব্য বা প্রশ্ন করার পূর্বে ঐ রচনা বা বক্তব্যের সম্পূর্ণটুকু গভীর মনােযােগ সহকারে অধ্যয়ন করে তার মূল বক্তব্য সম্যকভাবে উপলব্ধি করেই সে সম্বন্ধে আপনার অভিমত ব্যক্ত করুন এবং সে সম্বন্ধে যথাযথ প্রশ্ন তুলে ধরুন। আমার অসম্পূর্ণ বক্তব্য পড়েই আপনি যে সব প্রশ্ন করেছেন তার উত্তর উক্ত রচনার শেষাংশেই দেয়া হয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতি দর্পণে প্রকাশিত আমার অন্যান্য রচনাগুলােতে অবশ্যই আপনার সকল প্রশ্নের জবাব আপনি পাবেন। তবুও আপনার কয়েকটি বক্তব্য নিয়ে আমি আলােচনা করতে চাই।
আপনি লিখেছেন, ‘সত্যিকারের ফিউডাল বলতে যা বােঝায় (ইউরােপ বা চীনে) দু’বাংলাতেই তা নেই। জানতে চেয়েছেন আমরা চারুবাবুর ব্যক্তি হত্যা রাজনীতি করছি কি না এবং গ্রামে গ্রামে গেরিলা ট্রেনিং-এর ঘাঁটি নির্মাণ করছি কি না। এ প্রসঙ্গে আমরা বলবাে, ইউরােপ বা চীনে যে ধরনের সামন্ত প্রভুরা ছিল দু’বাংলায় সে ধরনের সামন্ত প্রভুরা নেই সত্য, কিন্তু আমাদের দেশের কৃষক সমাজের উপর (যারা জনগণের পঁচাত্তর ভাগ) বর্তমানে যে শােষণ চলে আসছে তা কি ঐ সামন্ততান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে না? জোতদার, মহাজন, ইজারাদার, তহশীলদার, মজুতদার, ঠিকাদার ও তাদের দালালশ্রেণী রূপে ক্ষয়িষ্ণু সামন্তশ্রেণী আজ শতধা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সামন্তবাদের এ অপভ্রংশ শ্রেণীই রাষ্ট্রীয় সহায়তায় (পুলিশ-মিলিটারি আইন, আদালত) সামন্তবাদী কায়দায় মেহনতি কৃষক সমাজকে ক্রমাগত শােষণ করে যাচ্ছে- এ কথায় এরা সম্মিলিত ও যুক্ত প্রচেষ্টায় মুমূর্ষ সামন্তবাদী শােষণকে বাঁচিয়ে রেখেছে। জনগণের উপর শতধা বিভক্ত এ সামন্তশ্রেণীর শােষণ এবং দালাল ধনিক শ্রেণীর সহযােগিতায় সাম্রাজ্যবাদীদের নয়া ঔপনিবেশিক শােষণের প্রত্যক্ষ উপস্থিতির কারণেই এ দেশ নিঃসন্দেহে একটি ‘আধা সামন্ততান্ত্রিক ও আধাঔপনিবেশিক দেশ’।
এই আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা ঔপনিবেশিক দেশের গ্রামগুলােতে শ্রেণী সংগ্রামের ভিত্তিতে মার্কসলেনিন ও মাও চিন্তাধারা প্রচার করে জনগণকে সশস্ত্র করে গেরিলা ট্রেনিং-এর যে কোনাে প্রচেষ্টা এ সকল স্থানীয় শােষক শ্রেণীর মাঝে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে না? তারা কি জনগণের এ সশস্ত্র অভ্যুত্থানে ভীত হয়ে তাদের রক্ষীবাহিনী পুলিশ-মিলিটারি আইন ও আদালতের সাহায্য চাইবে না? পুলিশ মিলিটারি তথা বুর্জোয়া রাষ্ট্রশক্তি কি জনগণের এ বিপ্লবী ক্রিয়াকর্মকে ধ্বংস করার সর্বাত্মক ফ্যাসিবাদী প্রচেষ্টা চালাবে না? এ সশস্ত্র হানাদার পুলিশ ও মিলিটারির গুপ্তচর তথা মিত্র হিসেবে যারা কাজ করবে তারা কি বিপ্লবী জনগণ ও বিপ্লবের শত্রু প্রতিবিপ্লবী শ্রেণী নয়? বিপ্লবী জনগণ ও বিপ্লবের স্বার্থে এ সকল ঘৃণ্য প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী গণবিরােধী শ্রেণী শত্রুদের গেরিলা পদ্ধতিতে খতম করে গ্রামে গ্রামে মুক্ত অঞ্চল সৃষ্টি করার ও পরে গ্রাম থেকে শহরগুলােকে দখল করার এ মহান তত্ত্বকে আপনি কি ব্যক্তিহত্যার রাজনীতি বা সন্ত্রাসবাদ বলে উড়িয়ে দিতে চান? শ্রেণী সংগ্রামের এ তত্ত্বানুসারে শােষক শ্রেণীর বর্তমান শ্বেত সন্ত্রাসের বদলে মেহনতি জনতার বিপ্লবী লাল সন্ত্রাস অবশ্যই সৃষ্টি হবে শুধুমাত্র জনগণের শ্রেণীশত্রু ঐ সকল স্থানীয় শােষকদেরই ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তুলবে, জনগণকে নয়। বরং তাদের শত্রুদের নির্মূল হতে দেখে তাঁরা উল্লসিত হবেন এবং স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়েই বিপ্লবী সংগ্রামে এগিয়ে যাবেন। তাছাড়া যে সকল গেরিলা ইউনিট এ সব শ্রেণী সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করবেন ভবিষ্যতে তারাই আরাে সুশৃঙ্খল হয়ে উন্নততর ট্রেনিং-এর। মাধ্যমে গড়ে তুলবেন জনগণের গণফৌজ- যে গণফৌজ ব্যতীত কোনােক্রমেই সশস্ত্র প্রতিক্রিয়াকে প্রতিরােধ করা এবং শহর বা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা সম্ভব নয়। আশা করি কমরেড চারু মজুমদারের শ্রেণী সংগ্রামের এ মহান তত্ত্বের ব্যাপক তাৎপর্য ও বিশালতা সম্বন্ধে বালিগঞ্জের কমরেড অতঃপর একটি সুস্পষ্ট ধারণা পােষণ করতে সক্ষম হবেন। অবশ্য প্রতিক্রিয়াশীলা তাদেরই শ্ৰেণীস্বার্থে বিপ্লবকে প্রতিহত করতে, বিপ্লবী নেতৃত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করতে এ মহান তত্ত্বকে বিকৃত করে অপব্যবহারের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার নিত্যনতুন অপকৌশলে সামগ্রিক পরিস্থিতিকে ঘােলাটে করে তুলবে (যেমন করেছে কলকাতায়); কিন্তু তার জন্য নিশ্চয়ই বিপ্লবী নেতৃত্ব বা ঐ মহান তত্ত্ব দায়ী নয়, বরং এরূপ বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিকে প্রতিটি বিপ্লবী কমরেডের দৃঢ়ভাবে মােকাবিলা করা উচিত।
আর এক স্থানে আপনি লিখেছেন, “তােহার সঙ্গে যত মতবিরােধই থাক, সংযুক্ত মাের্চা গড়ে তুলুন। দেখুন কমরেড, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তি ও জনগণতন্ত্রের যে দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ চলছে তা নিঃসন্দেহে একটি বিপ্লবী যুদ্ধ। বিপ্লবী যুদ্ধে ব্যক্তিগত কোনাে বিদ্বেষের স্থান নেই। সকল বিপ্লবী জনগণই এ বিপ্লবী গণযুদ্ধের মুক্তিযােদ্ধা। জনগণের এ গণযুদ্ধে সকল জনগণকেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। বিপ্লবী দ্বার রুদ্ধ করার মতাে ক্ষমতা (বিশেষত বিপ্লবীদের জন্য) কারাে নেই। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের নিয়মানুযায়ী পূর্ববাংলার জনগণের রাজনৈতিক পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি সমগ্র জনগণের জন্যই বিপ্লবী দ্বার উন্মুক্ত রেখেছেন। জনগণ বলতে পূর্ববাংলার কৃষক শ্রমিক বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী ও দেশপ্রেমিক জাতীয় ধনিক শ্রেণীকে তারা বুঝিয়েছেন এবং এ জনগণের শত্রু হিসেবে তারা সাম্রাজ্যবাদী সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী, সামন্তবাদী, পুঁজিবাদী ও ফ্যসিবাদী শ্রেণী এবং তাদের তাবেদার দালাল বাহিনীকে চিহ্নিত করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি পূর্ববাংলার বিপ্লবী জনগণ তাদের এ শত্রুদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হবেন এবং সে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে একমাত্র সংগ্রামের মাধ্যমে (ইউনিটি থ্র স্ট্রাগল)। ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবী সংগ্রামের মাধ্যমেই তাঁরা গড়ে তুলবেন স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা।

সূত্র: দর্পণ
০৯.০৭.১৯৭১