বাংলাদেশ প্রসঙ্গে
কণা সেন
দর্পণে শ্রীপ্রবীর বসুর প্রবন্ধটি পড়ে যুগপৎ বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়ে এই পত্রাঘাত করতে বাধ্য হচ্ছি। শ্রীবসু তার ইয়াহিয়া-ইন্দিরা ও বাংলাদেশ প্রবন্ধের একেবারে শেষ অনুচ্ছেদের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘মুজিবর ইন্দিরা এবং বিচিত্র বাঙালি প্রেমের নির্লজ্জ ভণ্ডামীর উপরে এটিই আশার কথা পূর্ববঙ্গের পথ ভিয়েতনামের পথে যাবেই। কারণ এই সেদিন অবধি পাক সরকারের ভাড়া করা গুণ্ডা আনসার, ইস্ট পাক রাইফেলস আর বাঙালি রেজিমেন্ট দিয়ে আর যাই হােক, মুক্তিযুদ্ধ হতে পারে না, নতুন মুক্তিফৌজ লাল পতাকা নিয়ে আসছে।
দেখা যাচ্ছে, শ্রীবসুর দৃষ্টিঙ্গিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সবটাই ভণ্ডামী! কিন্তু নতুন মুক্তিফৌজ লাল পতাকা নিয়ে কোথা থেকে আসছে, সে কথা তিনি বলেন নি। উগ্র জাতীয়তাবাদ না হয় খারাপ কিন্তু আন্তর্জাতিকতার এত অন্ধ মােহই কি ভালাে! তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা এই, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হলে বামপন্থীদের হাতে চলে যাবে এ যুদ্ধের নেতৃত্ব। খুবই সম্ভব সেটা। কিন্তু সে কথাটা এমন বিকৃত করে ঘুরিয়ে বলা কেন? দুই মাসের উপর সে দেশে যা চলেছে সেটা যদি তার মতে মুক্তিযুদ্ধ না হয়, তবে সেটা কী? প্রবল প্রতিরােধ, লাখাে লাখাে মানুষের অবলীলায় আত্মদান আর পাক ফৌজের গােলায় শ্মশান হয়ে যাওয়া দেশটার ছবি কি শ্রীবসুর চোখে প্রহসনের মতাে ঠেকছে? দেশের সমস্ত মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে যখন শত্রুর অস্ত্রের মুখে দলে দলে এগিয়ে গিয়ে প্রাণ দিচ্ছে তখন অতীতে তারা পাক সরকারের ভাড়াটে গুণ্ডা ছিল, কি ই পি আর ছিল, কি বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল—শ্রীবসুর সেই হিসাব দাখিলের বহর দেখে আমার গল্পের সেই পণ্ডিত মশাইকে মনে পড়ছে, যিনি ডুবন্ত ছােট্ট ছেলেটিকে জল থেকে তুলবার চেষ্টা মাত্র না করে তার দুষ্টুমির ফিরিস্তি দিয়ে চলেছেন!
শেখ মুজিবের চরিত্র বিশ্লেষণেও শ্রীবসু সেই একই ভুল করেছেন। বঙ্গবন্ধু মুজিবের রাজনৈতিক ভূমিকাকে কষ্ট কল্পনার সাহায্যে অবিশ্বাস্যভাবে উপস্থিত করেছেন তিনি। দর্পণের পাঠকদের বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন। তথাকথিত নানা যুক্তির সাহায্যে মুজিবকেও তিনি প্রতিক্রিয়াশীল শােষক গােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছেন। শুধু তাই নয়, সবচেয়ে যা বেদনাদায়ক, মুজিবকে ছােট করতে গিয়ে পূর্ববাংলার অবিস্মরণীয় ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সােনার বাংলা পর্যন্ত সমস্তই তিনি ব্যঙ্গ করে নস্যাৎ করে দিতে চেয়েছেন। আমরা সত্যি দুর্ভাগা! এসব ইতিহাস তাে আমাদের দেশে তৈরি হয়নি। আন্তর্জাতিক মােহ মুক্ত হয়ে বুকের রক্ত ঢেলে নিজের ভাষাকে, নিজের দেশকে নিজের বলে ভাবতে, ভালােবাসতে আমরা শিখিনি। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা তা আমাদের শেখান না। তাই তার মূল্যও আমরা বুঝিনে।
কিন্তু গণতন্ত্র আর ভােটাভুটির মূল্যটা তাে কিছুটা বুঝি! যে দেশের একটি রাজনৈতিক দল সাধারণ নির্বাচনে শতকরা ৯৮.৭টি আসন দখল করে নেয় তার নেতা কি জঙ্গি শাসক আগা মহম্মদ ইয়াহিয়া খান নিজের গদি হাবার ভয়ে দেশদ্রোহী আখ্যা দিতে পারেন, কিন্তু শ্রীবসুর মতাে একজন শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী মানুষ কী করে এ কথা বলেন, মুজিবরের আওয়ামী লীগ পূর্ববঙ্গের উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মুখপাত্র হিসেবে শ্রমিক-কৃষক শােষণ ব্যবস্থায় অবাঙালির সঙ্গে বাঙালিকে এক পংক্তিতে বসাতে চাইল। ছয় দফা দাবি তার সাক্ষ্য।
মুজিবুরের ছয় দফা দাবি ইতিহাসের ম্যাগনাকার্টা। তার মধ্যে বাঙালির স্বাধীকার রক্ষার ঘােষণা স্পষ্টভাষায় বলা হয়েছে। শ্রমিক-কৃষকদের কথা আলাদা অক্ষরে কিছু বলা হয়নি-শ্রীবসুর আক্ষেপ কি সেই জন্যই? কিংবা দেশের কল্যাণকে ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবে মুজিব কিছু ভাবেননি অর্থাৎ শ্রমি সাচ্চা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট নেতা হয়ে উঠতে পারেননি বলেই কি শ্রীবসু তাঁকে প্রতিক্রিয়াশীল শােষক গােষ্ঠীর সঙ্গে এক আসনে বসিয়ে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন? তা তিনি যাই ভাবুন, আর একটা বিশেষ মতবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের একচ্ছত্র অধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে যতই রাজনৈতিক মতলবাজ বলে বােঝাতে চেষ্টা করুন, ইতিহাস তার সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ ফলাফল যাই হােক, মুজিবুর, মুজিবুরই থাকবেন। তার বাঙালিয়ানা স্বজাতি প্রীতি, সারল্য এবং অফুরন্ত নেতৃত্বের ক্ষমতা নিয়ে তিনি চিরকাল দেশপ্রেমিক মুক্তি সংগ্রামীদের প্রেরণাস্থল হয়ে থেকে অভিনন্দিত হবেন। এতবড় প্রাপ্তি শ্রীমুজিবেরও কল্পনার অগােচরে ছিল। তাঁর ছােট সুখ, ছােট সাধ, ছােট আশা’ আজ বাংলাদেশের সােনালী সবুজ পতাকায় আগুন হয়ে জ্বলছে! পাক জঙ্গিশাসকচক্র হয়তাে শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচতে দেবে না। কিন্তু তিনি এপার বাংলার বাঙালিদের জন্য যা রেখে যাবেন তাকে যথাযােগ্য মর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করতে পারলে আমরাই উপকৃত হব। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসের চেয়েও আমাদের দরকার প্রতিবেশী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করা এবং সর্বপ্রকার কেতাবী মতবাদের প্রভাবমুক্ত হয়ে আপামর জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধের এই ইতিহাসের যথাযােগ্য মূল্যায়ন করা।
সূত্র: দর্পণ
১১.০৬.১৯৭১