লীগ বিরােধী সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট গঠনে শেখ মুজিবের ভূমিকা
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বৎসর খানেক আগে ১৯৪৬ সালে। সর্বভারতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে মুসলিম লীগের নির্বাচনী ইস্যু ছিল পাকিস্তান। উক্ত ইস্যুতে সর্বভাতীয় মুসলিম জনসাধারণের নিকট থেকে ম্যান্ডেট চাওয়া হয়। সে নির্বাচনে মুসলিম লীগ জয়ী হয় বিপুল ভােটে। বিশেষ করে অবিভক্ত বঙ্গদেশে। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ ক্ষমতায় আরােহণ করে এবং বছরের পর বছর বেশ মৌজে দুধে-ভাতে দিন কাটাতে থাকে। অপরদিকে ক্ষমতায় আরােহণের অনধিক তিন বৎসরের মধ্যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারত ডােমিনিয়নের সংবিধান রচনা ও সে সংবিধান জারি করে। শুধু তাই নয়, কংগ্রেস ব্রিটিশ প্রদত্ত ‘ডােমিনিয়ন স্ট্যাটাস’কে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করে এবং সগৌরবে ঘােষণা করে ‘ভারতীয় রিপাবলিক’। এ ঘটনারও ছয় বছর পর ১৯৫৬ সালের ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের একটি সংবিধান জারি হয় এবং পাকিস্তান ডােমিনিয়নের স্থলে হয় “ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’। ক্ষমতায় আরােহণের পর মুসলিম লীগের অযােগ্য শাসন, নির্লজ্জ স্বজনপ্রীতি, সাম্প্রদায়িক মানসিকতার লালন ও প্রসার এবং পাকিস্তানে আগত মােহাজেরদের পুনর্বাসনের নামে তাদের অবাধ আর্থ-সামাজিক বিকাশ সাধারণের চোখে ধরা পড়ে নগ্নভাবে। প্রশাসন যন্ত্রে অবাঙালিদের ছিল প্রাধান্য। সশস্ত্রবাহিনিতে পাঞ্জাবের প্রাধান্য, সিভিল সার্ভিসেও তাই। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এ ধরনের নানারূপ বৈষম্য তাে ছিলই কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল অসহনীয়। দুর্ভিক্ষ ছিল প্রতিবছরের অভিশাপ। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে পূর্ব পাকিস্তান অবহেলিত। এরূপ মনমানসিকতার উপর আঘাত হানা হয় ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে আজ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কাল কাশ্মীর উত্তেজনা, তার পরদিন কাশ্মীর যুদ্ধ- এই নিয়ে অপদার্থ মুসলিম লীগ শাসকেরা নিজেদের ব্যর্থতার গ্লানি শত চেষ্টা সত্ত্বেও জনসমক্ষে চাপা দিয়ে রাখতে পারে না। বাংলা ভাষায় কথা আছে, যার এককান কাটা সে যায় রাস্তার একপাশে দিয়ে যার দুই কান কাটা সে চলে মধ্য সড়ক দিয়ে। মুসলিম লীগ
পৃষ্ঠাঃ ৭৯
অনুরূপ বেহায়াপনা দেখিয়ে ছাড়লাে তাই নয়। তারা বিশ্বজোড়া উপহাসের বস্তুতে পরিণত হয়। পূর্ব বাংলার একমাত্র অর্থকরী ফসল তখনকার দিনে ছিল পাট। কৃষকের ঘরে নতুন পাট উঠলে তার প্রধান ক্রেতা অবাঙালিরা পাটের বাজার মন্দা অজুহাতে হাত গুটিয়ে বসে থাকে। অর্থকরী ফসল পাট কৃষকের গলার হয় ফাঁস, সমগ্র বাঙালি জাতির আত্মহত্যার জন্যে গলার দড়ি। এই পাট নিয়ে খেলা চলেছে বছরের পর বছর। পাটচাষীরা হয়েছে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর। পেটের দায়ে গরু ছাগল ঘরের চালের টিন বিক্রি করে শেষে গৃহিণীর অতি আপন সম্পদ তার ঘটিবাটি এমনকি কলসিতে পড়ে হাত। চোখের নিমিষে কতিপয় পরিবার গড়ে তুললাে টাকার পাহাড়। অবশিষ্ট দেশ- সমগ্র দেশ নিমজ্জিত হয় কুৎসিত অর্থনৈতিক দুর্বিপাকে।
১৯৫০ সাল।
শুরু হলাে কোরিয়া যুদ্ধ। সে যুদ্ধে প্রচন্ড সশস্ত্র আগ্রাসন চালিয়েও দক্ষিণ কোরিয়ার মার্কিন সমরসজ্জায় শক্তিশালী আমেরিকার তাঁবেদার সরকার সিংম্যানরি উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট শাসনকে একটুও কাবু করতে পারেনি। অবশেষে মার্কিনী যুদ্ধাবাজদের পান্ডা যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ব্যক্তিগত সম্মানের হানি এমন সব আবােল তাবােল বক্তব্য নিয়ে হাজির হলেন। তিনি এই বলে হুমকি দিলেন- প্রয়ােজনে উত্তর কোরিয়ার উপর আণবিক বােমা নিক্ষেপে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না। তার হুমকির বিরুদ্ধে উঠলাে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ। -বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদসভা ও শােভাযাত্রা। প্রতিবাদ ওঠে আমাদের দেশেও। গঠিত হয় পূর্বপাকিস্তান শান্তি কমিটি। কোরিয়াসহ সকল প্রকার যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তি কমিটি দেশব্যাপী শান্তির পক্ষে ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করেন। শত শত মানুষ যুদ্ধবিরােধী শান্তির আবেদনে করেন স্বাক্ষরদান। মুসলিম লীগ সরকার কেরিয়া যুদ্ধকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাবার পাঁয়তারা করে। যুদ্ধের দরুণ পাটের দাম অস্বাভাবিকভাবে চড়ে গেল। সরকারের ফরিয়াদের হাতে বেশ পয়সাকড়ি আমদানি ও চলাচল শুরু হয়। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন দিলে কিছু কিছু আসনে মুসলিম লীগ প্রার্থীরা বিপুল ভােট পাবেন এরূপ আশা করেছিলেন এবং দেশে একটা নির্বাচন দিবেন বলে ভাবছিলেন। কোরিয়া যুদ্ধ চার পাঁচ বছর চললাে। মাস কয়েক আপস আলােচনার পর অবশেষে ১৯৫৪ সালের জুলাই মাসে জেনেভায় চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে তার ঘটে পরিসমাপ্তি। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে পূর্ব-পশ্চিমে ৩৮ ডিগ্রি বরাবর সীমারেখা চিহ্নিত হয়।
পৃষ্ঠাঃ ৮০
সৃষ্টি হয় দুই কেরায়াি, দুই রাষ্ট্র। উত্তরে সমাজতান্ত্রিক কোরিয়া, দক্ষিণে ধনতান্ত্রিক কোরিয়া।
পাটের বাজার তখনও গরম। আর পাকিস্তান গরম ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৫১ সালে রাওয়ালিপিন্ডিতে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে হত্যা, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন- এসবই সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। নির্বাচন দেয়া-না-দেয়া নিয়ে মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে মতানৈক্যের ঝড় বয়। ইতিমধ্যে ১৯৫৩ সালের ১৭ই এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করে তার স্থলে পাকিস্তানের ইঙ্গ-মার্কিন মুরব্বিরা প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসালেন ওয়াশিংটনই পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত যিনি প্রচন্ড মার্কিন ঘেঁষারূপে পরিচিত আমেরিকার ‘জনিবয়’ বগুড়ার মােহাম্মদ আলীকে। ইঙ্গমার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাসরূপে মােহাম্মদ আলীর অখ্যাতি আগে থেকেই ছিল। তিনি কোরিয়া যুদ্ধ, গরম পাটের বাজার, লিয়াকত হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের দ্বিতীয় স্থপতির অপসারণ ঘটিয়ে মােটামুটি ইঈ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গ্রহণযােগ্য একটি নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করে দিলেন। পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার পাঁচ বছরের মেয়াদ ১৯৫২ সালেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে লাঞ্ছিত মুসলিম লীগ সরকার নির্বাচন দিতে সাহস পাননি, এক বছর পিছিয়ে দিয়েছেন। ছাত্রহত্যাকারী সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে দেশবাসীর মােকাবিলায় ভয় পেয়েছিলেন। সেই এক বছরও শেষ হয়ে গেল ১৯৫৩ সালে। কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন অছিলায় বারবার নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার লজ্জাকর ও পরাজিত মনােবৃত্তি প্রকাশ করেন। শেষে বুকের বিপুল সাহস সঞ্চয় করে আল্লাহর নামে নির্বাচনের আর একটা তারিখ ঘােষণা করেই বসলেন। এ ঘােষণা দিতে তারা বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের ৮ই থেকে ১২ই মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন তারিখ ধার্য হয়।
শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারবিরােধী দল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তানে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শেখ মুজিবকে বারবার গ্রেফতার করা হচ্ছে, জেলে পাঠানাে হচ্ছে। জলদগম্ভীর ভাষায় মওলানা ভাসানী দেশব্যাপী শেখ মুজিবের মুক্তি দাবিসহ বিভিন্ন কল্যাণকর এবং জনপ্রিয় ভাত-কাপড়ের দাবিদাওয়া উত্থাপন করে চলেছেন। বিক্ষুব্ধ জনতা, বিশাল বিশাল জনসভা। কঠোর ভাষায় বক্তৃতা, সরকারের কড়া সমালােচনা। নির্বাচন ঘােষিত হবার ফলে
পৃষ্ঠাঃ ৮১
দেশব্যাপী রাজনীতির হাওয়া ধীরে ধীরে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে এক বিশাল সাইক্লোনের রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। জনাব এ. কে. ফজলুল হক ছিলেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের এ্যাডভােকেট জেনারেল। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে অনেকের মতাে হক সাহেব যােগদান করেছিলেন। তার গায়ে তখনও এ্যাডভােকেট জেনারেল পােশাক। তাই বক্তৃতা তেমন করলেন না। আলাপ-আলােচনায় অংশ নিয়ে এটুকু শুধু বললেন আমার আশীর্বাদ থাকলাে, আমিও আপনাদের পথেই আসছি। কিন্তু তিনি শুধু কথাই দিলেন, আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগদান করলেন না। যতদিন পারা যায় নির্বাচনের আগে চাকরি করে যেতে থাকলেন। দেশে তখন রাজনৈতিক ধারা বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত হচ্ছিল। প্রথম ধারায় মুসলিম লীগ তার সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি, হিন্দুবিরােধী দাঙ্গার রাজনীতি এবং ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছিল। দেশের জন্য কোন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, যার প্রতি জনগণের সমর্থন লাভ করা যায় তা মােটেই ছিল না। বাস্তবে যা দেখা গেল তা ছিল গণবিরােধী ও প্রগতিবিরােধী। কাজেই মুসলিম লীগ পাকিস্তান অর্জন করলেও তার লীগ সরকার সংগঠনের জন্য সঞ্চয় করেছিল অনাস্থা, ঘৃণা ও বিক্ষোভ।
আওয়ামী মুসলিম লীগ তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। লক্ষ মানুষেরও জনসভা। বস্তুনিষ্ঠ কিন্তু গরম গরম বক্তৃতা। পাট-তামাক-ইক্ষুর ন্যায্য মূল্য দাবিসহ কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র ও নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের বেঁচে থাকার দাবিদাওয়া নিয়ে বিশাল বিশাল সভা-শােভাযাত্রা-আন্দোলন। সকল আন্দোলনের পুরােধা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান। মাঝে মাঝে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী সময় ও সুযােগ পেলেই যােগদান করতেন পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে। কারণ ‘গণতন্ত্র ছিল তার প্রাণের দাবি। তার চিন্তায় মূল কথা ‘গণতন্ত্র এবং শেষ কথা ‘গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্রই ছিল ঐতিহাসিকভাবে সংগ্রামী দাবিদাওয়ার কেন্দ্রবিন্দু।
ইতিমধ্যে শেরে বাংলা ফজলুল হক কৃষক শ্রমিক পার্টি কে.এস.পি. নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে ফেললেন। এ সম্পর্কে তখন বাজারে অনেক গুজব ছিল। কিন্তু তার পার্টি গঠনের আনুষ্ঠানিকতা উদযাপিত হয়েছিল খুবই অনাড়ম্বরভাবে। পূর্ব পাকিস্তানের জোতদার তালুকদার চাকলাদার শিকদার হাওলাদার ও ধনী চাষীদের একটা বিরাট অংশ এবং সামাজিকভাবে
পৃষ্ঠাঃ ৮২
বহু সংস্কারপন্থী ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন শিক্ষিত ও আধা শিক্ষিতরা এসে ভিড় জমালেন আবুল কাশেম ফজলুল হকের নেতৃত্বে। রাজনৈতিক দল না হলেও পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ ছিল গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শান্তি ও সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ দল মত নির্বিশেষে একটি শক্তিশালী নির্দলীয় দেশপ্রেমিক যুবক-যুবতীদের প্লাটফরম, গণসংগঠন। জনাব মাহমুদ আলীকে সভাপতি ও অলী আহাদকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৯৫১ সালে বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকার এক বহরে অনুষ্ঠিত সভায় প্রথম কমিটি গঠিত হয়। তার সহসভাপতি ছিলেন মােহাম্মদ তােয়াহা। এছাড়া প্রধান প্রধান নেতৃবৃন্দের মধ্যে কে. জি. মুস্তাফা, তসদ্দক আহমদ, আখলাকুর রহমান, ইমাদুল্লা, সরদার আবদুল হালিম, মােহাম্মদ সুলতান, খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস, আবদুল মতিন, গাজীউল হক, বরিশালের আবদুল করিম, রংপুরের কাজী আবদুল হালিম, ময়মনসিংহের কাজী বারী, আবদুর রহমান প্রমুখ। খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াসকে সভাপতি, সরদার আবদুল হালিমকে সাধারণ সম্পাদক এবং গােলাম মর্তুজা, মােহাম্মদ ফজলুল হক, মৃণাল বারুরী, ইয়ার মােহাম্মদ খান, মীরজাহান, কালীদাস চক্রবর্তী, প্রাণেশ সমাদ্দার ও আশরাফ আহমদ প্রমুখকে সদস্য করে ঢাকা নগর যুবলীগ গঠিত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের নেতা ও কর্মীর প্রায় অধিকাংশেরই রাজনৈতিক সংগঠন ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। কিছু কর্মী ছিলেন গণতন্ত্রী দলের সমর্থক। কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য এরূপ কর্মীও যুবলীগের আন্দোলনে শরিক ছিলেন। কৃষক শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আগত বিপুল সংখ্যক নির্দলীয় ও দেশপ্রেমিক সমাজসেবী তরুণ কর্মী যুব লীগের বিরাট আন্দোলনের পতাকাতলে সমবেত হয়েছিলেন। নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসছে ততই সাধারণ মানুষ মুসলিম লীগের ভরাডুবি দেখার জন্য খুবই আশান্বিত ও উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। মুসলিম লীগের কবজা থেকে পাকিস্তানকে উদ্ধার এবং তার জনগণকে লীগশাহীর নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাবার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা বিরােধী দলগুলােকে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করার লক্ষ্যে তুমুল গুঞ্জরণ শুরু হয় সমগ্র দেশব্যাপী। ট্রেনে বাসে নৌকা লঞ্চে কোর্ট কাচারিতে অফিস আদালতে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র বিপুল প্রত্যাশা ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনী মাের্চা গঠন হলে মুসলিম লীগের ভরাডুবি সুনিশ্চিত। জনসাধারণের রাজনৈতিক চেতনার স্তর আমাদের দেশে বরাবরই উঁচু। নির্বাচন সম্পর্কে দেশবাসী অভিজ্ঞ। নির্বাচনের গ্রামার ও অঙ্ক তারা ভাল বােঝেন। ভােটদান সম্পর্কে দেশবাসী সিদ্ধহস্ত এবং প্রায় নির্ভুল। তাদের সে বিপুল অভিজ্ঞতা সঞ্চিত মতামত ছিল এই যে আওয়ামী মুসলিম লীগ যদি পূর্ব
পৃষ্ঠাঃ ৮৩
পাকিস্তান যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র। ইউনিয়ন, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্ট পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করে অন্যতম শরিক দল হিসাবে শেরে বাংলা ফজলুল হক প্রতিষ্ঠিত কে.এস.পি.কে নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ মাের্চা- লীগ বিরােধী সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। নির্বাচনে অবতীর্ণ হন তবে তাঁরা শতকরা ৯০ থেকে ৯৯ ভাগ আসনে জয়ী হবেন। রাজনৈতিকভাবে মুসলিম লীগ হবে নিশ্চিহ্ন। এরূপ রাজনৈতিক দূরদর্শিতা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল সর্বত্র। কিন্তু দুঃখের বিষয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রশ্নে আওয়ামী মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে কিছু সদস্য সংখ্যায় বেশি না। হলেও লীগবিরােধী সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট গঠনের ব্যাপারে বারবার বিঘ্নের সৃষ্টি করেছেন। একথা সত্যি সেদিন যারা মুসলিম লীগবিরােধী সেইসব রাজনৈতিক দল যেমন কে.এস.পি, গণতন্ত্রী দল, জাতীয় কংগ্রেস- তাদের মধ্যেও ঐক্য সম্পর্কে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না, তা নয়। তবে একটিমাত্র দল এক ভাগ প্রকাশ্য টিম। অপর ভাগ আন্ডারগ্রাউন্ড পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি মুসলিম লীগবিরােধী। সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট গঠনের জন্যে যেরূপ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন তেমনি প্রমাণ দিয়েছেন রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের যথার্থতা। যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রশ্নে প্রথম প্রথম শেখ মুজিবের মনেও বিভ্রান্তি ছিল। কিন্তু সকল মহলে আলাপ-আলােচনা ও ঘােরাঘুরি শেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, তার রাজনীতির শ্রেষ্ঠতম মিত্র হলেন কমিউনিস্ট পার্টি ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহ। মওলানা ভাসানী যুক্তফ্রন্টের পক্ষে এসেছিলেন আগেই। এবার এলেন শেখ মুজিব। তাদের উভয়ের সাথে যােগ দিলেন ছাত্র-যুবক বিশাল কর্মীবাহিনি। এদিকে কমিউনিস্ট পার্টিকে যুক্তফ্রন্টের শরিক দলরূপে গ্রহণের পক্ষে সর্বপ্রান্ত থেকে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
উপরােক্ত রাজনৈতিক পটভূমিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ডাকা হলাে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন। স্থান অলকা হল, ময়মনসিংহ। তারিখ ১৯৫৩ সালের ১৪ই নভেম্বর। বিশেষ অধিবেশনে মুখ্য আলােচ্য বিষয় ছিল আসন্ন নির্বাচনে দলের নির্বাচনী নীতি নির্ধারণ। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর এবং প্রস্তাবিত MEDO বা মিডলইস্ট ডিফেন্স অর্গানাইজেশন গঠন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ যুদ্ধবিরােধী এবং বিশ্বশান্তির সপক্ষে দলীয় নীতি নির্ধারণী প্রস্তাব বিবেচনা ইত্যাদি।
পূর্ব রাতে সাবজেক্ট কমিটির সভায় তুমুল আলােচনা ও বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়।। দলে প্রবীণ নেতাদের অধিকাংশই ছিলেন পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে ইঙ্গ-মার্কিন। সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে। অনুরূপভাবে তাঁরা আসন্ন নির্বাচনের প্রশ্নে আওয়ামী মুসলিম লীগের একলা চলার নীতির প্রতি শুধু সমর্থন নয়, একেবারে সে নীতি যেন আঁকড়ে ধরলেন। ওদিকে কোনাে কোনাে বিষয়ে অভ্যর্থনা কমিটির
পৃষ্ঠাঃ ৮৪
সভাপতি জনাব আবুল মনসুর আহমদ ও সম্পাদক হাশিমুদ্দিন আহমদের মধ্যে মতভেদ প্রকটরূপ ধারণ করে। আবুল মনসুর আহমদ জনাব সােহরাওয়ার্দীর সুপারিশ একবাক্যে সমর্থন করতেন। এবার তার সাথে যােগ দিলেন সর্বজনাব আবদুস সালাম খান, আবদুল জব্বার খদ্দর, খয়রাত হােসেন, এ্যাডভােকেট লকীয়তউল্লাহ ও এ্যাডভােকেট আমিনুল হক চৌধুরী এবং এ্যাডভােকেট মজিবর রহমান প্রমুখ। শহীদ সােহরাওয়ার্দীর যুক্তি ছিল কাশ্মীর সমস্যা এবং সমগ্র বিশ্বে কমিউনিস্টদের ‘তথাকথিত’ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য আমেরিকার বন্ধুত্ব এবং তাদের অস্ত্র-ডলার সাহায্য জরুরি প্রয়ােজন। মুসলিম দেশসমূহ দুর্বল। সেখানে পাকিস্তানের মিত্র পাওয়া গেলেও তারা দুর্বল মিত্র, কোনাে কাজের নয়। ক্ষমতার মানদণ্ডে তারা নিজেরাই জিরাে। আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা শেখ মুজিব এ সম্পর্কে রাতের এক ফাঁকে মওলানা সাহেবের মনােভাব জেনে এসে আমাকে পরামর্শ দিলেন আগামীকাল সকালের অধিবেশনে উত্থাপনের জন্য দুইটি প্রস্তাব মুসাবিদা করে রাখতে। প্রস্তাব দুটির একটি আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে লীগবিরােধী সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট গঠনের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের আহ্বান, অপরটি পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল দাবি এবং যুদ্ধবিরােধী ও বিশ্বশান্তির পক্ষে আওয়ামী মুসলিম লীগের সমর্থন ঘােষণা। প্রস্তাব দুটো আমাকেই উত্থাপন করার জন্যে মুজিব বলে গেলেন। প্রস্তাবের সমর্থন করবেন তিনি স্বয়ং।
যে বাড়িতে আমি ছিলাম সেখানে মধ্যরাতের পরে হঠাৎ করে জনাব আবুল। মনসুর আহমদ উপস্থিত হলেন দু’তিনজন সঙ্গী নিয়ে। কলকাতায় প্রথম প্রকাশের দিন থেকেই আমরা উভয়েই দৈনিক ইত্তেহাদে একসঙ্গে চাকরি করেছি। তিনি ছিলেন প্রধান সম্পাদক, আমি যুগ্ম বার্তা সম্পাদক। আমার উপর তার অগাধ স্নেহ ও গভীর আস্থা। তাঁর অনুমান এই দুটি বিতর্কিত প্রস্তাব সম্পর্কে আমি নিজে কিছু করছি। বললেন : কাউন্সিলরদের মধ্যে যেরূপ মতবিরােধ দেখে এলাম তাতে এ প্রস্তাব তুললে খামাখা দলাদলি বাড়বে, নির্বাচনের আগে সংগঠন দুর্বল হবে এবং উভয়কুল হারাবাে। কাজেই বিষয়টা চিন্তায় রেখ। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম এ সম্পর্কে সােহরাওয়ার্দী সাহেবের সুস্পষ্ট অভিমত কী। তিনি সংক্ষেপে বললেন : নিগেটিভ এটিচ্যুড। এই বলে মুচকি একটু হাসি দিয়ে তিনি চলে গেলেন।
পরদিন সকালবেলা।
অলকা হলে সম্মেলন উদ্বোধনের আয়ােজন সমাপ্ত। মঞ্চের উপর শহীদ সােহরাওয়ার্দী চেয়ারে আসন নিয়েছেন। পাশের চেয়ারে উপবিষ্ট অভ্যর্থনা
পৃষ্ঠাঃ ৮৫
কমিটির সভাপতি আবুল মনসুর আহমদ। অধিবেশনের মূল সভাপতি মওলানা ভাসানী তখনও আসন গ্রহণ করেননি। সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত টেবিলের উপর একগুচ্ছ ফুল বুকে ধারণ করে শােভা পাচ্ছে একটি সুদৃশ্য ফুলদানি। আমরা মওলানা ভাসানীর প্রতীক্ষায় উদগ্রীব। মঞ্চের বিপরীতে দোতলায় গ্যালারিযুক্ত ব্যালকনি। তাতে দর্শক সমর্থক বসেছেন ঠাসাঠাসি করে। হলের মধ্যে তুমুল শ্লোগান ‘গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠন করাে, লীগশাহী খতম করাে’, ‘বিশ্বশান্তি জিন্দাবাদ’, ‘ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধবংস হােক’, ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ’, ‘মওলানা ভাসানী জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি। বলাবাহুল্য এই স্লোগানসমূহের উত্থাপক আওয়ামী মুসলিম লীগের তরুণ কর্মী ও নেতৃবৃন্দ। এরা প্রায় সকলেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের নেতা এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের জঙ্গী কর্মী ও সমর্থক। হঠাৎ আমার চোখে পড়লাে দোতলার গ্যালারিতে ভিড়ের মধ্যে বসে রয়েছেন কমরেড খােকা রায়। তার মাথার উপর গ্রেফতারী পরােয়ানা ও হুলিয়া ঝুলছিল। দ্রুতই চোখ সরিয়ে নিলাম।
তুমুল শ্লোগানের ভিতর দিয়ে মওলানা ভাসানী সম্মেলনের সভাপতির আসন গ্রহণ করলেন। তিনি একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। তাতে আসন্ন নির্বাচনের গুরুত্ব, পাকিস্তানকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধজোটে জড়িয়ে ফেলার বিরুদ্ধে শঙ্কা ও ক্ষোভ প্রকাশ, নির্বাচনে লীগশাহী খতম করে একটি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় দেশপ্রেমিক সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে জানমাল কবুল করে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান ছিল। রাত্রি জাগরণ হেতু মওলানা ভাসানীর গলা ভেঙ্গে যায়। তিনি ভাঙ্গা গলায় বক্তৃতা শেষ করলেন এবং বললেন দেশ ও জাতির সম্মুখে নির্বাচনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী লীগশাহী উৎখাত করতে যে সুযােগ এসেছে তাকে সফল করার জন্য আমি সম্মেলনের কাছ থেকে প্রস্তাব আহ্বান করছি। আমার আসন মঞ্চের নিকটেই ছিল। সভাপতির ঘােষণার সাথে সাথে আমি মঞ্চে উঠে মাইক নিয়ে আলােচ্য বিষয় সম্পর্কিত সর্বদলীয় লীগ বিরােধী যুক্তফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাঠ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে জনাব আবদুস সালাম খান লাফ দিয়ে মঞ্চে উঠে মাইকে মুখে মুখে বললেন : আমি খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাবের বিরােধিতা করছি। তার সাথে সাথে মঞ্চে উঠলেন খােন্দকার মােশতাক আহমদ, আবদুল জব্বার খদ্দর ও বগুড়ার মজিবর রহমান প্রমুখ। তাঁরা বললেন : আমরা খােন্দকার ইলিয়াসের প্রস্তাবের বিরােধিতা করছি এবং জনাব সালাম খানের
পৃষ্ঠাঃ ৮৬
প্রস্তাব সমর্থন করছি। এরূপ ঘটনার জন্যে যেন তারা সবাই তৈরি হয়েই ছিলেন। মওলানা ভাসানী আমার প্রস্তাবের কপি হাতে নিয়ে মাইকে ঘােষণা করলেন : খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস কর্তৃক উত্থাপিত একটি লিখিত প্রস্তাব কাউন্সিলের বিবেচনার জন্যে আমি সবেমাত্র পেশ করেছি। কিন্তু সে প্রস্তাব এখনাে সমর্থিতই হয়নি। যুক্তফ্রন্ট গঠনের পক্ষে তার প্রস্তাবটি ছাড়া আর কোনাে লিখিত প্রস্তাব আমার কাছে আসেনি।
সভাপতির এই ঘােষণার সাথে সাথে শেখ মুজিবুর রহমান দ্রুত লাফ দিয়ে মঞ্চে উঠলেন এবং মাইক নিয়ে আমার পেশকৃত প্রস্তাবের উল্লেখ করে তার প্রতি দৃঢ় সমর্থন ঘােষণা করলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রস্তাব সমর্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল গর্জন করে উঠলাে সমগ্র হল, ‘যুক্তফ্রন্ট গঠন করাে, লীগশাহী খতম করাে।’ সভাপতি মওলানা ভাসানী প্রস্তাবটি ভােটে দিলেন। প্রায় সমগ্র হল হাত তুলে উষ্ণ সমর্থন জানালেন। প্রস্তাবের বিপক্ষে যারা আছেন সভাপতি এবার তাদেরকে হাত তুলতে বললেন। তাতে যে কয়টি হাত উঠলাে তার মধ্যে। ছিলেন এ্যাডভােকেট আবদুস সালাম খান নিজে, এ্যাডভােকেট খােন্দকার মােশতাক আহমদ, এ্যাডভােকেট আলী আহমদ খান, এ্যাডভােকেট আবদুর রহমান খান, এ্যাডভােকেট লকীয়তউল্লাহ, এ্যাডভােকেট আমিনুল হক চৌধুরী, এ্যাডভােকেট মজিবর রহমান, রংপুরের এ্যাডভােকেট আবুল হােসেন, খয়রাত হােসেন এম.এল.এ. ফেনীর আবদুল জব্বার খদ্দর এবং আরও কয়েকজন। এই প্রস্তাব গৃহীত হবার পরে সভাপতি মওলানা ভাসানী পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত প্রস্তাব আহ্বান করলেন। সঙ্গে সঙ্গে খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তিসহ সকল যুদ্ধজোট ও মেডাে যার পুরাে নাম মধ্যপ্রাচ্য ডিফেন্স অর্গানাইজেশন প্রভৃতির বাতিল দাবি করে এবং বিশ্বশান্তির পক্ষে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়ন ও পরিচালনার আহ্বান জানিয়ে তার প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিব মঞ্চে উঠে এ প্রস্তাবও সমর্থন করলেন। মওলানা ভাসানী প্রস্তাবের পক্ষে ভােট নিতে যাচ্ছেন এমন সময় জনাব আবদুস সালাম খান উক্ত প্রস্তাব বিরােধিতা করলেন। মওলানা ভাসানী কর্তৃক পেশকৃত খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াসের প্রস্তাব ‘পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বর্জন করাে’, ‘বিশ্বশান্তি জিন্দাবাদ’, ‘ইঙ্গ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ প্রভৃতি স্লোগানের মধ্য দিয়ে সমগ্র সম্মেলন হল তুমুল হর্ষধ্বনি করে তার প্রতি দৃঢ় সমর্থন জ্ঞাপন করে।
দারুণ উত্তেজনা ও উদ্দীপনাময় মুহূর্তে আমি সহসা মাইক নিয়ে বলে ফেললাম : জনাব সােহরাওয়ার্দী, আপনি দেখুন আওয়ামী মুসলিম লীগ কাউন্সিলের
পৃষ্ঠাঃ ৮৭
সমর্থন কোন দিকে। আওয়ামী মুসলিম লীগ কাউন্সিল যেমন লীগ বিরােধী সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট গঠনের পক্ষে, তেমনি বিরােধী সাম্রাজ্যবাদ ও তার যুদ্ধজোটের। অতএব আওয়ামী মুসলিম লীগ সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট গঠন চায়, ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক জোট বাতিল চায় এবং বিশ্বশান্তির পক্ষে পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণের গ্যারান্টি চায়। সেদিন এ দুটো প্রস্তাবের পক্ষে রংপুরের মতিয়ুর রহমান। খুলনার শেখ আবদুল আজিজ, দেলদার আহমদ; যশােরের অধ্যাপক আবদুল হাই, রওশন। আলী, এ্যাডভােকেট মশিউর রহমান, আলমগীর, একরামুল হক, এ্যাডভােকেট আবদুল খালেক; ফরিদপুরের মােল্লা জালালউদ্দিন আহমদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী; ভৈরবের জিল্লুর রহমান; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এ. কে. এম রফিকুল হােসেন, অধ্যাপক কিউ কিউ জামান; চট্টগ্রামের আবদুল আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী; ময়মনসিংহের কাজী বারী, খালেক নেওয়াজ খান, হাতেম আলী তালুকদার, আবদুর রহমান; পটুয়াখালীর আলী আকবর, জয়নুল আবেদীন; ঢাকার দেওয়ান ইদ্রিস, আনােয়ার জং, সরদার আবদুল হালিম ও গােলাম মর্তুজা প্রমুখের উল্লাস ও উদ্দীপনার কথা মনে হলে আজো আনন্দ ও প্রেরণা অনুভব করি। আওয়ামী মুসলিম লীগ ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হয়েছে বলে যেসব নেতৃবৃন্দ ইতিপূর্বে গুজগুজ করতেন একমাত্র তারা বাদে সমগ্র সংগঠন উপরােক্ত কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এরূপ শক্তি সঞ্চয় করে যে, তারা মুসলিম লীগ সরকারকে হটিয়ে জনগণের সরকার কায়েমের হিম্মত রাখে। রাজনীতিতে আমাদের অভিজ্ঞতা নেতারা পিছিয়ে থাকছেন, আগে আছেন People। আর এই ইংরেজি শব্দের অর্থই হচ্ছে সংগ্রামী ও সঙ্ঘবদ্ধ জনগণ। Mass বা আম জনসাধারণ আর People বা সঙ্ঘবদ্ধ ও সংগ্রামী জনগণ সমার্থক নয়।
তাছাড়া, আওয়ামী মুসলিম লীগের কিছু সংখ্যক নেতার মাথায় মুসলিম লীগের ভূত চেপে বসেছিল। ব্যর্থতা, দুনীর্তিপরায়ণতা ও জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে সমালােচনা করলে তারা জবাব দিতেন ‘ইসলাম ইন ডেঞ্জার’ ‘ইসলাম খাতরা মে হ্যায়’। কিন্তু বড়ই বিস্ময়কর লেগেছিল যখন দেখি মুসলিম লীগের সেই রােগ আওয়ামী মুসলিম লীগের কতিপয় নেতাকে পেয়ে বসেছে। ইঙ্গমার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ও তাদের নগ্ন আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিংবা সমালােচনা করলে আওয়ামী মুসলিম লীগের সেই সব নেতা মুসলিম লীগের সুরে চিৎকার করতেন হায় হায়, আওয়ামী মুসলিম লীগেও দেখছি। কমিউনিস্ট ঢুকে গেছে।
পৃষ্ঠাঃ ৮৮
প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন বিরােধী দলের হাতে নাজেহাল হয়েছেন, বারবার ধিকৃত হয়েছেন। খাজা শাহাবুদ্দিন ও ফজলুর রহমানের কান কথায় বিশ্বাস করে তিনি সে ধিক্কার কুড়িয়েছেন। কিন্তু আমাদের নেতা শহীদ সােহরাওয়ার্দী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি কিংবা ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোন প্রস্তাব তুললে খুব চটে যেতেন। তিনিও কমিউনিস্ট আখ্যায়িত করে তার দলের জঙ্গী কর্মীদেরকে বিদ্রুপ করতেন, ভৎসনা করতেন। মিডলইস্ট ডিফেন্স অর্গানাইজেশন বা মধ্যপ্রাচ্য প্রতিরক্ষা চুক্তি গঠনের প্রস্তুতি সভায় পাকিস্তানের তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী জাফরউল্লা খান পাকিস্তানের যােগদান সম্পর্কে একরূপ নিশ্চয়তা দান করে এসেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন তাতে ক্ষুব্ধ হন। তিনি প্রকাশ্যে বলেই বসলেন যদি আমাদেরকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একজন প্রভু বা মুরব্বি সংগ্রহ করতেই হয় তাহলে আমাদের দুশাে বছরের অতি পরিচিত ও পুরাতন প্রভু ব্রিটিশই গ্রহণযােগ্য, আমেরিকা কখনােই নয়। কারণ ব্রিটিশকে আমরা চিনি জানি। তারাও আমাদের চেনে জানে। এটা তার কথার কথা নয়, আন্তরিক বিশ্বাস।
এ ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে নেপথ্যের ষড়যন্ত্রে পাঞ্জাবে প্রথমে খাদ্য দাঙ্গা, পরে কাদিয়ানী বিরােধী দাঙ্গা ভয়াবহরূপ পরিগ্রহ করে। সে দাঙ্গার অজুহাতে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন পদচ্যুত হলেন। তার স্থলাভিষিক্ত হন ওয়াশিংটনে নিয়ােজিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মােহাম্মদ আলী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যভার গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যে বগুড়ার মােহাম্মদ আলী সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা CENTO এবং আরাে প্রায় বছর খানেক পরে সাউথইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা SEATO গঠন করেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৪৯ সালে পাক-মার্কিণ সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। এইভাবে পাকিস্তানের মাথার উপর তিন তিনটি সামরিক চুক্তির। গজব- পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন CENTO এবং সাউথইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশন SEATO গঠন করে শুধু এ অঞ্চলের নয় সমগ্র এশিয়ার শান্তি, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ মার্কিন সেনাবাহিনির বুটের তলায় পিষ্ট করে দিলেন। রাজনীতিতে অসংখ্য ব্যর্থতার মধ্যে খাজা নাজিমউদ্দিনের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতা প্রশংসার দাবি রাখে। পক্ষান্তরে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর অসংখ্য সাফল্য ও গুণাবলীর মধ্যে তার জিরাে থিওরি (জিরাে প্লাস জিরাে=জিরাে), ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা নীতি আওয়ামী মুসলিম লীগেরও ক্ষতির কারণ হয় এবং দেশেরও ক্ষতির কারণ ঘটায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের মতাে প্রায় পঞ্চাশজন রাষ্ট্রনায়কের হত্যাকান্ডের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল পর্যন্ত
পৃষ্ঠাঃ ৮৯
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রক্তাক্ত হস্ত ইতিহাসের বিভীষিকা হয়ে রয়েছে। ব্রিটিশের নীতি কূটনীতি। আমেরিকার নীতি জল্লাদী নীতি।
ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় ফিরে আসার পর প্রথমে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মধ্যে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পদ্ধতি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কয়েক দফা আলােচনা বৈঠক হয়। যুক্তফ্রন্ট গঠন প্রক্রিয়া যে খুবই কঠিন আগে তত্ত্বগতভাবে জানতাম, কিন্তু বাস্তবে উপলব্ধি করিনি। প্রশ্ন উঠেছিল যুক্তফ্রন্টের শরিক হিসাবে কোন কোন দলকে রাখা হবে এবং কাদের রাখা, হবে না। তখন পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, পূর্ব পাকিস্তান কৃষক শ্রমিক পার্টি (কে.এস.পি.), পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল, পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস, পূর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, খেলাফতে রব্বানী পার্টি, তফশিলী ফেডারেশন প্রভৃতি। গণবিরােধী জালেম সরকারকে হটাতে নিপীড়িত জনগণ ও শােষিত শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনকে ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে যদি ঐক্যবদ্ধ করা যায়, তবে সামন্ত বুর্জোয়া উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন সম্ভব। কথাগুলাে শুধু কেতাবী নয় বাস্তবে দেখিয়ে দিয়েছে। পূর্ব ইউরােপীয় দেশ বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া, পােল্যান্ড ও যুগােস্লাভিয়া প্রভৃতি জনগণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বুলগেরিয়ার জর্জি দিমিত্রভ এই চেতনা বাস্তবায়নের একজন প্রধান কারিগর। ১৯৪২ সালে জর্জি দিমিত্রভ সকল প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক সংগঠনসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করে গঠন করেন ফাদারল্যান্ড ফ্রন্ট। এই ফ্রন্টের নেতৃত্বে প্রতিরােধও গড়ে তােলা হয় জার্মান নাৎসী বাহিনি ও ফ্যাসিস্ট প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে। তার সাফল্য প্রমাণ করেছে যে কৃষি প্রধান ও শিল্পে অনুন্নত দেশসমূহের মাল্টি-পার্টি সিস্টেমে সমমনা দল ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রামে শিল্প হলে তা যে কোন ক্ষমতাধর সরকার তাদের শক্তি যতই থাকুক না কেন, ঐক্যবদ্ধ জনতার শক্তির কাছে নতি স্বীকারের বাধ্য করা যেতে পারে। তার প্রমাণ হাতে কলমে দেখিয়ে দিয়েছে। আমাদের কালের বলকান অঞ্চলের রাজনৈতিক চিন্তাধারা; আর দেখিয়েছে বিশ শতকের ঘটনাবহুল ইতিহাস। স্বভাবতই ইউনাইটেড ফ্রন্ট, ন্যাশনাল ফ্রন্ট, ইউনাইটেড এলায়েন্স, ন্যাশনাল এলায়েন্স, পিপলস ডেমােক্র্যাটিক ফ্রন্ট বা ফাদারল্যান্ড ফ্রন্ট প্রভৃতি পলিটিক্যাল টার্মিনােলজিগুলাে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে অধনবাদী বিশ্বের সংগ্রামী অভিজ্ঞতাপ্রসূত আবিষ্কার, তার সােনালি ফসল। কষ্ট
পৃষ্ঠাঃ ৯০
হলেও সমাজতন্ত্রের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছা এ পথেও সম্ভব। ক্ষেত্র বিশেষ হয় দ্রুততর।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে যুক্তফ্রন্ট-এর ধারণার আমদানি ও প্রয়ােগের ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টি অগ্রদূত। তাঁরাই যে সর্বপ্রথম উদোগ গ্রহণ করেন একথা কারাে অস্বীকার করার উপায় নেই। রাজনীতিতে বৃহৎ পার্টি শােভেনিজম যেমন একটি কঠিন রােগ, তেমনি শ্রেণি সংকীর্ণতাও আর একটি কঠিন রােগ। এটা দেখা যায় জমিদার-জোতদার-তালুকদার এবং বুর্জোয়া ও পেটিবুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে সমধিক পরিমাণে। সর্বহারা শ্রমিক কিংবা দরিদ্র ভূমিহীন কৃষক কিংবা অকৃষক-অশ্রমিক খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে সহায় সম্বলের যত বেশি অভাব, হৃদয়ে উদারতা পরিধি এবং সয়ংগ্রামে সাড়া দিবার সাহস তাদের ততই অধিক। আমাদের শিক্ষিত ও সুখী মানুষের সমাজকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে যে বিষয়টি বােঝাতে হয় সেই একই জিনিস সর্বহারা কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষ অতি সহজে উপলব্ধি করে নিজের জীবনে সংগ্রাম ও বাস্তব অভিজ্ঞতার বিনিময়ে। যত সংগ্রাম ততই অভিজ্ঞতা। যত উন্নততর অভিজ্ঞতা, ততই বলিষ্ঠতর সংগ্রাম।
আমাদের পূর্ব বাংলায় এই ধারণাটার আমদানি ও তা চালু করা সহজ কাজ ছিল না। সমাজের উপর তলায় এতসব মান অভিমান ও ঠুনকো স্বার্থপরতা মাথায় ভারি করে রাখে যেগুলাে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সেখানে যুক্তফ্রন্টের নতুন চিন্তা ও নতুন চেতনা ঢুকাতে দিনরাত নিরলস প্রচেষ্টা চালাতে হয়েছিল। অন্যান্যের অভিজ্ঞতা থেকে শিখবার জন্যে পাঠ করতে হয় বেশ কিছু তত্ত্ব ও তথ্যসমৃদ্ধ রাজনৈতিক গ্রন্থ ও ইতিহাস। পাঠের অভ্যাস ও চর্চা আমাদের নেতৃবৃন্দের এক বিরাট অংশের মধ্যে খুবই অভাব। প্রায় নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না।
১৯৫৪ সালে ৮ই মার্চ থেকে ১২ই মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত আইনসভার নির্বাচনের আগে একটি ছােট্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ডাকসুর নির্বাচন সেটা। কিন্তু রাজনৈতিক মহলে সরগরম করার মতাে নির্বাচন। সেই নির্বাচনেই প্রথম ছাত্র লীগ-ছাত্র ইউনিয়ন মিলিতভাবে একটি যৌথ প্যানেলে মুসলিম লীগও সরকারপন্থীদের মােকাবিলা করে। শেখ মুজিবসহ বিরােধী দলীয় নেতৃবৃন্দের অনেকেই ছাত্র-যুক্তফ্রন্টের ফলাফল দেখে বিস্মিত হন এবং অনুপ্রাণিত হন। ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ অনেক আলাপ-আলােচনা ও চড়াই-উত্রাই পার হয়ে তবেই যৌথ নির্বাচনী প্যানেলের ভিত্তি রচনা করতে সমর্থ হয়। তার ফলেই এই অভূতপূর্ব ও প্রেরণাদায়ক সাফল্য। ডাকসু নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন-এর মধ্যে গড়ে ওঠা প্রথম ছাত্র-যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তার প্রতিপক্ষ
পৃষ্ঠাঃ ৯১
সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলােকে পর্যুদস্ত করে জয়লাভের ফলে আওয়ামী মুসলিম লীগের মধ্যে যারা যুক্তফ্রন্টবিরােধী ছিলেন তাদের অনেকের মাথায় অনুকূল চিন্তার ঢেউ খেলে যেতে থাকে। তবুও সংকীর্ণ বৃহৎ-দলীয় চিন্তা ইংরেজিতে যাকে বলে ‘বিগ পার্টি শােভেনিজম’ তার আওতা থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগের অনেক নেতাই মুক্ত হতে পারছিলেন না। সেই একই দোষে দুষ্ট ছিল কে.এস.পি. নেতৃবৃন্দ। তারা মনে করতেন শেরে বাংলা ফজলুল হক একাই তাদের নির্বাচনী বৈতরণী পার করে দেবেন। এরই মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির উপস্থাপিত যুক্তফ্রন্ট প্রস্তাব চিন্তাশীল নেতৃবৃন্দের অনেককেই ভাবিয়ে তােলে। ময়মনসিংহে আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনের আগে এই উভয় দলের মধ্যে কিছুসংখ্যক নেতা ও কর্মী দোদুল্যমানতার রােগে ভুগছিলেন। কেউ কেউ ভুগছিলেন বৃহৎ পার্টি শােভেনিজম কিংবা জবরদস্তনেতা রােগে। কিন্তু সবদিক বিবেচনা করে এদেশের রাজনীতির প্রধান শত্রু সাম্প্রদায়িকতা ও তার প্রধানতম হেফাজতকারী মুসলিম লীগের যদি ভরাডুবি সম্ভব হয়, তবে সেই ধাক্কায় সাম্প্রদায়িকতা দুষ্ট পঙ্কিল রাজনীতির কুষ্ঠগ্রস্ততা নির্মূল করে তার জায়গায় একটি সরস ও সজীব রাজনীতির উন্মেষ ঘটানাে সম্ভব। সে সম্পর্কে আস্থা দিন দিন বেড়ে উঠছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ নিশ্রুপ ছিল না। চোখের সামনে তাদেরই পােষ্য রাজনৈতিক সংগঠনগুলাে মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে সেইদিকে সজাগ দৃষ্টি ছিল বরাবরই। কাজেই তাদের চক্রান্তের হাত প্রসারিত হতে থাকে যুক্তফ্রন্টের সম্ভাব্য শরিকদলগুলাের মধ্যে। নেপথ্যে কখন কী ঘটনা ঘটে সব জানা সম্ভব নয়। তবে হঠাৎ করে জনাব এ. কে. ফজলুল হক বলে বসলেন, জনাব আবুল হাশিমের খেলাফত রব্বানী পার্টি এবং মওলানা আতাহার আলীর পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম পার্টিকে যুক্তফ্রন্টে গ্রহণ করতে না পারলে তিনি যুক্তফ্রন্টে যােগদান করবেন না। হক সাহেব নিজেও জানতেন যে তার বৃদ্ধ বয়সে ৩০৯ আসনে সভাসমিতি করে একদিকে মুসলিম লীগ অপরদিকে আওয়ামী মুসলিম লীগসহ সব প্রার্থীকে হারিয়ে তার দলের নিরঙ্কুশ বিজয় সম্ভব নয়। দুঃখের বিষয় একদা কলকাতায় আমরা যারা হাশিম-সােহরাওয়ার্দী নেতৃত্বে আস্থা এনেছিলাম তাদের অনেকের মধ্যেও হতাশা দেখা দেয়। এর পরিণতি দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক।
এরই একদিনের কথা।
কে. এম. দাস রােডে অবস্থিত শেরে বাংলা ফজলুল হকের গৃহের দ্বারপ্রান্তে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-যুবকদের একটি দল জনাব আবুল হাশিমকে আক্রমণ করে বসেছে। এতে তাঁর গাড়িটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘটনাক্রমে কমিউনিস্ট পার্টির
পৃষ্ঠাঃ ৯২
প্রকাশ্য টিমের সম্পাদক মির্জা আবদুস সামাদ, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মােহাম্মদ ইমাদুল্লা এবং ঢাকা নগর যুবলীগের সভাপতি ও ঢাকা নগর আওয়ামী মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি প্রগতিশীল সাপ্তাহিক পত্রিকা যুগের দাবীর সম্পাদক খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস হক সাহেবের সাথে আলােচনা করে ফিরছিলেন। ফিরবার পথে তারা এই ঘটনার সম্মুখীন হন। তাদের হস্তক্ষেপে জনাব আবুল হাশিম অক্ষত ও তার গাড়িটি অল্পের জন্যে রক্ষা পায়। যুক্তফ্রন্টের পক্ষে জনমত এতই তীব্র ছিল যে তার বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের মুসলিম লীগ নেতাদের মতােই ধিক্কারের সম্মুখীন হতে হয় দেশের সর্বত্র।
ডেটলাইন ঢাকা, ৪ঠা ডিসেম্বর, শুক্রবার, ১৯৫৩ সাল।
পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি জনাব এ. কে. ফজলুল হক অদ্য শুক্রবার আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে এক বৈঠকে মিলিত হন এবং আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট গঠন সম্পর্কে আলাপ আলােচনা শুরু করেন। সমগ্র পরিস্থিতি পর্যালােচনার পর নেতৃদ্বয় নিম্নলিখিত যুক্ত বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তারা ঘােষণা করেন : ‘আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করিবার জন্য এবং বর্তমান সরকারের স্থলে জনসাধারণের সত্যকার প্রতিনিধিমূলক সরকার গঠনের জন্য মুসলিম লীগের বিরােধী দুইটি প্রধান রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান কৃষক শ্রমিক পার্টি ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হইয়াছে।’ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও জনাব এ. কে. ফজলুল হক যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন। বিবৃতিতে আরাে বলা হয়: ‘জনসাধারণের সত্যকার প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের জন্য আমাদের সভাপতিত্বে গঠিত দুইটি প্রধান বিরােধী দল- পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান কৃষক শ্রমিক পার্টি ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হইতে পারিয়াছে- একথা জানাইতে পারায় আমরা অত্যন্ত আনন্দবােধ করিতেছি। আমরা এক্ষণে মুসলিম লীগের বিরােধী সকল রাজনৈতিক দলের সহিত সংযােগ স্থাপনের এবং ঐ সকল দলের সহযােগিতায় একটি সম্প্রসারিত সম্মিলিত ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা করিব। নির্বাচন পরিচালনার জন্য আমরা অতঃপর সিলেকশন কমিটি অথবা পার্লামেন্টারি বাের্ডের ন্যায় একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করিব এবং বিস্তারিত কার্যসূচি নির্ধারণ করিব! আমরা বিশ্বাস করি যে, পাকিস্তানের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে ভােটারগণ এই যুক্ত ফ্রন্ট কর্তৃক মনােনীত প্রার্থীদিগকে সমর্থন করিবেন এবং যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান
পৃষ্ঠাঃ ৯৩
প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গত কয়েক বৎসরে কুশাসনের দ্বারা দেশকে প্রায় দেউলিয়া এবং জনসাধারণকে দুর্দশাগ্রস্ত করিয়া ছাড়িয়াছে, তাহার মনােনীত প্রার্থীদিগকে পরাজিত করিবেন। উপরােক্ত বিবৃতি দানের পর জনাব এ. কে. ফজলুল হক এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে বলেন যে তিনি এবং মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সভাপতি মওলানা আতাহার আলীকে যুক্তফ্রন্টে যােগদানের অনুরােধ করে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন। মওলানা আতাহার আলী যুক্তফ্রন্টে যােগদানের অমত করবেন না বলে জনাব ফজলুল হক আশা প্রকাশ করেন। এইরূপে যুক্তফ্রন্টের মূল শরিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও কৃষক শ্রমিক পার্টির সঙ্গে একই ক্ষমতার অধিকারে আসন পেলেন হক সাহেব প্রস্তাবিত ও সমর্থিত খেলাফতে রব্বানী পার্টি এবং জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম। একইভাবে পরে গ্রহণ করা হলাে নেজামে ইসলাম পার্টিকে। তার নেতা কুমিল্লায় আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী। তার মার্কিন প্রীতি ছিল সর্বজন বিদিত।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অন্যতম কমরেড খােকা রায় তার তথ্যবহুল ‘সংগ্রামের তিন দশক’ গ্রন্থে লিখেছেন, নির্বাচন ঘােষিত হওয়ার পরে নির্বাচনী নীতি নির্ধারণ করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটির এক বৈঠক হয়েছিল। সে বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে পার্টির প্রাদেশিক নেতৃত্ব এই সিদ্ধান্তে উপনীতি হয়েছিলেন যে, লীগ সরকারের ৭ বৎসরের কুশাসনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যে-ভাবে মুসলিম লীগের শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল এবং ‘৫২ সনের ভাষা সংগ্রামের ফলে সরকার জনগণ থেকে যেভাবে। বিচ্ছিন্ন হয়েছিল, সে পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত গণতান্ত্রিক ও সরকার বিরােধী দল ঐক্যবদ্ধ হলে নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার সম্ভাবনা ছিল। তাই নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত গণতান্ত্রিক ও সরকার-বিরােধী দলগুলাের নিকট আহ্বান জানিয়েছিল। ঐ দলগুলাের ভিতর নেজামে ইসলামের রাজনৈতিক চত্রি স্বতঃসিদ্ধভাবেই গণবিরােধী ছিল। কোন কোন দলের নেতৃত্ব সুবিধাবাদীও ছিল।
কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান শত্রু সাম্রাজ্যবাদের সহযােগী প্রতিক্রিয়াশীল ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে নির্বাচনে পরাজিত করার জন্য সরকারবিরােধী
পৃষ্ঠাঃ ৯৪
সমস্ত শক্তির ব্যাপক ঐক্য গঠন কল্পে ঐসব নেতৃত্বের গণ-বিরােধী ও সুবিধাবাদী চরিত্র জেনেও, মুসলিম লীগ বিরােধী সাময়িক ঐক্য সৃষ্টি করা কমিউনিস্ট পার্টি রাজনৈতিকভাবে নীতিসম্মত বলে মনে করেছিল। কমিউনিস্ট পার্টিই সর্বপ্রথম নির্বাচনে লীগবিরােধী ব্যাপক যুক্তফ্রন্ট গঠনের আওয়াজ তুলেছিল। সংবাদপত্রে পার্টির প্রকাশ্য টিমের বিবৃতির মাধ্যমে লীগবিরােধী যুক্তফ্রন্ট গঠনের আওয়াজ জনসমক্ষে তুলে ধরা হয়েছিল। ঐ আওয়াজ মধ্যবিত্তদের ভিতর অনুকূল সাড়া জাগিয়েছিল। কিন্তু পার্টির যুক্তফ্রন্ট গঠনের নীতি সম্পর্কে পার্টির ভিতরেই মত বৈষম্য দেখা দিয়েছিল।…. শেষে এই মত বৈষম্যের ধকল সামলাতে হয়েছিল যুবলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মতাে অরাজনৈতিক সংগঠনকেও। মতবিরােধ আওয়ামী লীগেও ছিল। তবে আওয়ামী লীগের মধ্যে যে মতবিরােধ ঘটে তা ছিল একলা চলার দাবি নিয়ে। আর ঐক্য যদি করতেই হয় তবে তা হবে গণতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। তাদের আসন দিতে হবে কম, নির্বাচন পরিচালনায় খাঁটি ও সৎ কর্মী পাওয়া যাবে অনেক বেশি। কে.এস.পি.-কে শুধু আসনই ছেড়ে দিতে হবে না নির্বাচনে তাদেরকে জিতিয়ে আনার সকল দায়দায়িত্ব নিতে হবে এবং কর্মীও দিতে হবে। কমরেড খােকা রায় তার বইতে কমিউনিস্ট পার্টি শেষ পর্যন্ত যে সুপারিশ করে তা এই বলে উল্লেখ করেছেন… ঐ কমরেডরা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের বামপন্থী অংশ, গণতান্ত্রিক দল, কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গ নিয়ে সাচ্চা গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করার এক বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু, ঐ কমরেডদের ‘সাচ্চা গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করার প্রস্তাবের প্রকৃত অর্থ ছিল মুসলিম লীগ বিরােধী শিবিরে, এমনকি তদানীন্তন প্রধান গণতান্ত্রিক বিরােধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগেও বিভেদ সৃষ্টি করা। এতে লাভ হতাে জনগণের প্রধান শত্রু প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের।
কমিউনিস্ট পার্টির লীগ বিরােধী সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাবের পক্ষে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যিনি সর্বাধিক উৎসাহী ছিলেন তিনি হলেন শেখ মুজিব। এখানে বলা প্রয়ােজন, হক সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তায় দ্বিমত পােষণ করে মওলানা ভাসানী বৈঠক থেকে উঠে এসেছিলেন। ইতিমধ্যে ঢাকায় এলেন পাঞ্জাবের খ্যাতনামা প্রগতিশীল নেতা মিয়া ইফতেখার উদ্দিন। কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের অনুরােধে ‘যুগের দাবি’ প্রেসের উপরে দোতলায় অবস্থিত খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াসের বাসগৃহে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে মিয়া ইফতেখার উদ্দিনের এক গােপন বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। মিয়া সাহেব
পৃষ্ঠাঃ ৯৫
মওলানা ভাসানীকে নির্বাচনােত্তর রাজনীতি ব্যাখ্যা দান করে মুসলিম লীগের পরাজয় নিশ্চিত করার উপদেশ দিলেন। মিয়া সাহেব একই স্থানে কমরেড মণি সিংহের সঙ্গেও দেখা করেন। কমরেড খােকা রায় লিখেছেন, কিন্তু, ঐ কমরেডদের বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে পার্টির ভিতরে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল। সব বিভ্রান্তি দূর করার জন্য প্রাদেশিক নেতৃত্ব পার্টির বিভিন্ন জেলার নেতা ও বিশিষ্ট কমরেডদের নিয়ে একাধিক বৈঠক করে সেখানে পার্টির যুক্তফ্রন্টের নীতি ব্যাখ্যার ব্যবস্থা করেছিলেন। নির্বাচনী নীতি নিয়ে পার্টির অভ্যন্তরে একটা রাজনৈতিক ব্যাখ্যামূলক অভিযান চালানাে হয়েছিল। এর ফলে পার্টির নির্বাচনী নীতি সম্পর্কে কিছু কমরেডের যে বিভ্রান্তি ছিল সেগুলাে দূর হয়েছিল। সমস্ত পার্টি ঐক্যবদ্ধভাবে পার্টির নির্বাচনী নীতি প্রচারে নেমে পড়েছিল। কিন্তু গােলমাল বাধিয়েছিল নেজামে ইসলাম দল। ঐ ধর্মান্ধ দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক সংস্থা ধুয়া তুলেছিল যে কমিউনিস্টরা ধর্মবিরােধী। তাই তাদের যুক্তফ্রন্টে নেয়া যাবে না। কমিউনিস্টদের যুক্তফ্রন্টে নেয়া হলে নেজামে ইসলাম সে ফ্রন্টে থাকবে না’, ইত্যাদি। নেজামে ইসলামের ঐ বক্তব্যে একটা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল। ঐ পরিস্থিতি জটিলতর করে তুলেছিলেন ফজলুল হক সাহেব। তিনি ইতিমধ্যে নেজামে ইসলামের সাথে আলাদা এক আঁতাত গড়ে তুলেছিলেন। তাই তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গণবিরােধী নেজামে ইসলামের ঐ অসঙ্গত ও বিভেদমূলক বক্তব্য সমর্থন করেছিলেন। অন্যদিকে, আওয়ামী মুসলিম লীগ, গণতান্ত্রিক দল প্রভৃতি যুক্তফ্রন্টে কমিউনিস্ট পার্টিকে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে ছিল। এর ফলে, কমিউনিস্টদের যুক্তফ্রন্টে নেয়া হবে কি হবে না- সে প্রশ্ন নিয়ে এক সমস্যা দেখা দিয়েছিল।
সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি এগিয়ে এসে ঘােষণা করেছিল যে, কমিউনিস্ট পার্টিকে বাদ দিয়েও অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও বিরােধী দলগুলাে যদি যুক্তফ্রন্ট গঠন করে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় তা হলেও কমিউনিস্ট পার্টি মুসলিম লীগকে পরাজিত করার জন্য ঐ যুক্তফ্রন্টকে সর্বতােভাবে সমর্থন করবে। পার্টি আরাে বলেছিল যে, পার্টি নিজ শক্তি অনুসারে কয়েকটি কেন্দ্রে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। ঐ সব কেন্দ্রে পার্টি যুক্তফ্রন্টের সমর্থন কামনা করেছিল। কমিউনিস্ট পার্টির ঐ ঘােষণা পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক মহলে বিশেষভাবে অভিনন্দিত হয়েছিল।
যুক্তফ্রন্ট গঠনে নেজামে ইসলাম যে বাধার সৃষ্টি করেছিল, কমিউনিস্ট পার্টির ঐ ঘােষণায় সেটা দূর হয়ে গিয়েছিল। তারপর, আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিভিন্ন বিরােধী দলগুলাের ভিতর আলােচনা বিতর্ক ও দর কষাকষির মধ্য দিয়ে ২১
পৃষ্ঠাঃ ৯৬
দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে আওয়ামী মুসলিম লীগ, কে.এস.পি, গণতন্ত্রী দল ও নেজামে ইসলামকে নিয়ে মুসলিম লীগবিরােধী যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও শহীদ সােহরাওয়ার্দী ছিলেন যুক্তফ্রন্টের প্রধান নেতৃবর্গ। কংগ্রেস ও তফশীলী ফেডারেশন সহযােগী হিসাবে যুক্তফ্রন্টের সাথে হাত মিলিয়েছিল। ‘৫৪ সালের নির্বাচনী সংগ্রামে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ব্যাপক একতা গড়ে উঠেছিল। লীগবিরােধী যুক্তফ্রন্ট গঠনের মূল পরামর্শ ও প্রেরণা এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে। মুজিব-ভাসানী ছিলেন উক্ত প্রস্তাব সমর্থনে অগ্রগামী। কিন্তু মওলানা ভাসানীর কাছে আওয়ামী মুসলিম লীগের রক্ষণশীল ও সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা অংশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আওয়ামী লীগের শক্তি অবাস্তব আকারে বড় করে দেখিয়ে নির্বাচনে সবাইকে বাদ দিয়ে একলা চলার নীতি গ্রহণে চাপ দিতে থাকেন। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এই মহল পরিচিত ছিলেন ‘মার্কিন লবী’ বলে। তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দের একাংশ, বিশেষ করে আবদুল আউয়ালের উপদল ঘােরতরভাবে জড়িত ছিল। শুনেছি আবদুল মােমিন তালুকদারও তখন ছিলেন এই উপদলের সমর্থনে। কিন্তু আরেকটি উপদল ছিল কিছুটা প্রগতিবাদী। তার নেতৃত্বে ছিলেন কামরুজ্জামান ও এম, এ, ওয়াদুদ। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সুপারিশক্রমে নির্বাচন পরিচালনার উদ্দেশ্যে একটি লীগবিরােধী সর্বদলীয় কর্মী শিবির গঠনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। জনাব ফজলুল হক তাতে তেমন উৎসাহ দেখালেন না। কিন্তু মওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব কর্মী শিবির গঠনের প্রয়ােজনীয়তা ও যথার্থতা সম্যক উপলব্ধি করেন। আলােচনার পর্যায়ে শহীদ সােহরাওয়ার্দী কালবিলম্ব না করে কর্মী শিবির গঠন সমাপ্ত করার প্রশ্নে তার সম্মতির কথা মওলানা ভাসানীকে জানালেন। কৃষক শ্রমিক পার্টির সকলেই নেতা, তাদের কর্মী নেই। নেজামে ইসলাম পার্টি মক্তবের কিছু সংখ্যক নাবালক ছাত্রকে তাদের দলীয় কর্মী ও দলীয় শক্তি হিসাবে দেখিয়ে নির্ভাবনায় চলে যায়।
কারকুন বাড়ি লেনে অবস্থিত সাবেক আওয়ামী মুসলিম লীগ কার্যালয়ের সংলগ্ন একটি বাড়িতে তাজউদ্দিন আহমদ বাস করতেন। বিরাট দরজা, প্রশস্ত আঙ্গিনা, উঁচু দেয়ালে ঘেরা। কর্মী শিবির গঠনের সম্মেলন সেখানেই অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মূলত প্রধান সংগঠন যাদের নিয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় লীগ বিরােধী কর্ম শিবির। তার সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ
পৃষ্ঠাঃ ৯৭
খান ভাসানী, সহ-সভাপতি সৈয়দ আবদুর রহিম মােখতার, সাধারণ সম্পাদক খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের এম.এ. ওয়াদুদ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের এস.এ. বারী এ.টি এবং কোষাধ্যক্ষ জনাব ইয়ার মােহাম্মদ খান। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার ভিতর দিয়ে গঠিত হয় এই কর্মী শিবির। তেমনি উদ্দীপনার মধ্যে শেষ হয় সম্মেলনের কাজ। লীগবিরােধী সর্বদলীয় কর্মী শিবির তাদের প্রচার পদ্ধতিতে কিছু নতুন নতুন উপাদান সংযােজন করেন। যেমন রাত ১০টা থেকে ১১টার দিকে ঢাকা শহরের একতলা দোতলা তিনতলা চারতলার ছাদের উপর কর্মী সমাবেশ করে ১০টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে তুমূল গর্জনে স্লোগান দেয়া হয় ‘লীগবিরােধী যুক্তফ্রন্ট জিন্দাবাদ’, ‘কর্মী শিবির জিন্দাবাদ’, ‘হক ভাসানী সােহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নূরুল আমিনের ফাঁসি চাই’, ‘পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে’, ‘সাম্রাজ্যবাদ ধবংস হােক’, ‘বিশ্বশান্তি জিন্দাবাদ’। পরে যখন নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ হয় তখন দেখা গেল মুসলিম লীগ পেয়েছে ‘হারিকেন এবং যুক্তফ্রন্ট ‘নৌকা’। তখন আরও কিছু স্লোগান যুক্ত হয় যেমন ‘হারিকেন নিভিল হায় হায় করিল’, ‘লীগের বাতি নিভিল আন্ধারে ডুবিল’, ‘নৌকা চলিল হারিকেন বুজিল।
কর্মী শিবির যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে তাদের একটি ১৪-দফা দাবিনমা গ্রহণের জন্য পেশ করে। ইতিপূর্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ, কে. এস. পি. ও কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন দফা ঘােষিত হয়। এই দফাগুলাে একত্রিত করে তার মধ্য থেকে বাছাই করে একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বা নির্বাচনী ওয়াদা প্রণয়নের জন্য যাদের উপর দায়িত্ব দেয়া হলাে তারা হলেন জনাব আবুল মনসুর আহমদ, জনাব কমরুদ্দিন আহমদ, কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড খােকা রায় এবং কর্মী শিবিরের সাধারণ সম্পাদক খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস। কমরেড খােকা রায়ের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরােয়ানা ও হুলিয়া জারি থাকায় তার একটি ছদ্মনাম ব্যবহার করা হতাে। আজিমপুর কলােনির একটি ফ্ল্যাটে অবস্থানরত সরকারী প্রচার বিভাগের সহকারী পরিচালক খােন্দকার আবদুল হামিদের দোতলা ফ্লাটে বৈঠক চলে গােপনে। তার পাশের ফ্ল্যাটে ছিলেন প্রচার বিভাগের আরেকজন সহকারী পরিচালক বিখ্যাত সাংবাদিক কাজী মােহাম্মদ ইদরিস। তারা উভয়েই মেজবান এবং আমাদের সারা দিনের খানাপিনা দুই বাড়ি থেকেই আসতাে। একদা পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে কাজী মােহাম্মদ ইদরিস ও খােন্দকার আবদুল হামিদ উভয়েই ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঘােরতর বিরােধী ও বিশ্বশান্তির একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। সে বেশি দিনের কথা নয়। আজ পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ হয়েছে। কিন্তু
পৃষ্ঠাঃ ৯৮
সাম্রাজ্যবাদের কবজি শিথিল করে আজো শান্তির দাবি প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। বরঞ্চ মানব জাতির বিরুদ্ধে সাধারণ অস্ত্রের পাশাপাশি এসেছে পারমাণবিক মারণাস্ত্র। তার ব্যবহারে সারা বিশ্বের অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। এখানে বলা প্রয়ােজন দুইটি বিশ্বযুদ্ধে যে পরিমাণ বিস্ফোরক পদার্থ ব্যবহৃত হয়েছে তার কয়েক হাজার গুণ অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন বর্তমানের পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত এক একটি সাবমেরিন। বিশ্বের বিভিন্ন সাগর মহাসাগরে এরূপ অসংখ্য সাবমেরিন অধুনাকালে প্রতিনিয়ত টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের বিশ্বব্যাপী দাবির প্রতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কর্ণপাত করছে না। বর্তমান রিগান প্রশাসন স্বদেশের বিরূপ জনমতের তােয়াক্কা না করে নেভাদায় একটির পর একটি নতুন অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েই যাচ্ছে বেপরােয়াভাবে। স্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিকে ছদ্মনামে লিখিত খােন্দকার আবদুল হামিদের লেখাগুলাে আজ বেশি করে মনে পীড়া দেয়। একসময়ে কাজী মােহাম্মদ ইদরিস ও খােন্দকার আবদুল হামিদ উভয়েই মার্কসবাদের ছাত্র ছিলেন। উভয়েই শান্তি স্বাধীনতা ও প্রগতির আদর্শে লিখেছেন, সাধারণত কাজও করেছেন। কাজী মােহাম্মদ ইদরিসের কলম জীবনে মুহূর্তের জন্যেও তার বিবেকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। আর খােন্দকার আবদুল হামিদের কলম? তার কলম তাকে ডিগবাজি দিয়ে নিয়ে গেছে শান্তির শত্রু যুদ্ধবাজদের খপ্পরে, মানব জাতির শত্রু ফ্যাসিস্টদের কাতারে।
লীগবিরােধী যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা কর্মসূচি রচনায় খুব একটা সময় লাগেনি। তিন দিনের বৈঠকে চূড়ান্ত খসড়া তৈরি হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, যুবলীগ, গণতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় সকল দফাই ছিল গণমুখী ও দেশপ্রেমিক দফা, জনকল্যাণকর দফা। উপরন্তু সেসব দফায় ছিল বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি। ফ্রন্টের উল্লিখিত সংগঠনের কর্মসূচিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে, সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতার প্রশ্নে, যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নে প্রায় কাছাকাছি মনােভাব ব্যক্ত ছিল। কমরেড খােকা রায় ও খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াসের প্রস্তাব ছিল সবগুলাে দফার মধ্য থেকে যেগুলাে সাধারণ দফা আগে সেগুলােকে চিহ্নিত করে একে একে গ্রহণ করা হােক। তাতে কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। এতে মতবিরােধ সৃষ্টি হলাে জনাব আবুল মনসুর আহমদের সঙ্গে। তিনি ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কথাটা দফার মধ্যে সন্নিবেশিত থাকায় ছিলেন নারাজ। ২১-দফায় সাম্রাজ্যবাদের বিরােধিতার প্রশ্নে তার ঘাের আপত্তি ছিল এবং সে প্রশ্নে তিনি ছিলেন অনমনীয়। তার কথায় আমরা শেষ পর্যন্ত ঐক্য রক্ষার স্বার্থে সায় দিতে বাধ্য হলাম। সাম্রাজ্যবাদবিরােধী ও শান্তির পক্ষের দফাগুলাে ভারাক্রান্ত মনে বাদ দিতে হলাে। আমাদের জাতীয়
পৃষ্ঠাঃ ৯৯
স্বাধীনতার প্রশ্নে বিশেষ করে জাতীয় অর্থনীতি ও স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির বিকাশ সাধনে সর্বাপেক্ষা দুর্বল দিক সাম্রাজ্যবাদবিরােধী চিন্তা ও চেতনার দুর্ভাগ্যজনক অনুপস্থিতি। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচার অভিযানে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যে গণজোয়ার ও গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল, ২১-দফার মধ্যে যদি যুদ্ধের বিরুদ্ধে ও শান্তির সপক্ষে সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখা সম্ভব হতাে, তবে আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যাবলীর সমাধান বহুলাংশে সহজ হতাে। সজাগ জনমতের তীব্র প্রতিরােধের মুখে সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশকে গােনার মধ্যে রাখতে বাধ্য হতাে।
১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আইন সভায় মােট আসন সংখ্যা ছিল ৩০৯টি। মুসলিম অমুসলিম মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন- সব মিলিয়ে এই সংখ্যা। এর মধ্যে মুসলিম লীগ পেয়েছিল মাত্র ৯টি আসন। আর যুক্তফ্রন্টের শরিক দল এবং যুক্তফ্রন্টের সহযােগী সংগঠন কংগ্রেস ও তফশিলী ফেডারেশন মিলে পেয়েছিল ৩০০টি আসন। ছাত্র নেতা জনাব খালেক নেওয়াজের হাতে শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী জনাব নূরুল আমিন। লীগ মন্ত্রীদের প্রায় সবাই হয়েছিলেন কুপােকাত। এই নির্বাচনে ভরাডুবির হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আশ্রয় করে, সেদিনের মুসলিম লীগ আশ্রয় নিয়েছিল জালিয়াতি ও মিথ্যা প্রচারের। সে অপপ্রচারের নমুনা থেকে বােঝা যাবে তাদের অসহায় অবস্থা। লীগ নেতারা বলেছিলেন যুক্তফ্রন্ট ‘হিন্দু সমর্থিত’। তারা বলেছিলেন ‘হিন্দু সমর্থিত যুক্তফ্রন্টকে ভােট দিলে কোরান বরবাদ হয়ে যাবে, ইসলাম ডুবে যাবে।’ ‘যুক্তফ্রন্টকে ভােট দিলে বিবি তালাক হবে।’ আদমজী-বাওয়ানীদাউদ প্রভৃতি পাকিস্তানের বৃহৎ পুঁজিপতি গােষ্ঠী ডুবন্ত লীগ সরকারকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টায় মুক্ত হস্তে অর্থদান করেছিল, অর্থ ব্যয় করেছিল। সে বিপুল অর্থ মুসলিম লীগের নির্বাচনী কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল জলের মতাে। ভােট গ্রহণের মাত্র কয়েক দিন আগে সরকার হঠাৎ এক পুলিশী অভিযান চালায়। অভিযান চালায় লীগবিরােধী যুক্তফ্রন্ট কর্মী শিবিরের সাধারণ সম্পাদক খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াসের গেন্ডারিয়ার বাসভবনে। তিনি দুঃসাহসের সাথে পুলিশের চোখকে ধুলা দিয়ে বাসা থেকে লাফিয়ে সরে পড়েন। সে রাতের অভিযানে বিপুল সংখ্যক নেতা ও কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। অনেকে গ্রেফতারের হাত এড়িয়ে করেছিলেন আত্মগােপন। মুসলিম লীগের পেটোয়া গুন্ডাবাহিনির হাতে ঢাকার সরদার আবদুল হালিমসহ বহু নেতা ও কর্মী নিগৃহীত হয়েছেন। গুরুতররূপে আহত হয়েছেন।
পৃষ্ঠাঃ ১০০
কিন্তু এত করেও ক্ষমতাসীন গণবিরােধী ও সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ত অনুচর মুসলিম লীগ ভরাডুবির হাত থেকে উদ্ধার পেল না। সঠিক কর্মসূচি ও নেতৃত্বে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণ কখনও ভুল করে না। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধেও সেদিন ভুল করেনি। ইতিহাসের এটাই মহান শিক্ষা এবং জাতির চলার পথে অমােঘ দিক নির্দেশক।
রেফারেন্স – প্রসঙ্গ শেখ মুজিব, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস