You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.09.17 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | পাটের নির্ধারিত মূল্যঃ পাট চাষীদের ভবিষ্যত | খোলাবাজারে পরীক্ষার খাতা ও প্রশ্নপত্র | একবার না পারিলে - | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৭ই সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার, ১লা আশ্বিন, ১৩৮০

পাটের নির্ধারিত মূল্যঃ পাট চাষীদের ভবিষ্যত

দেশের প্রতিটি অঞ্চল থেকে পাটের ন্যায্যমূল্য পাওয়া না পাওয়া নিয়ে নানা প্রকার সংবাদ ভেসে আসছে। প্রতিদিনের পত্র -পত্রিকা গুলোতে বিভিন্ন জেলার পাট চাষীদের দুর্ভোগের কাহিনী প্রকাশিত হচ্ছে। কাহিনীর বিষয়বস্তুতে কোন পার্থক্য নেই। সেই একই কথাঃ সরকার কর্তৃক বেঁধে দেওয়া মূল্যে চাষীরা পাট বিক্রি করতে পারছেনা। পাটের মৌসুমের শুরু থেকেই দুঃখজনক ব্যাপারটি ঘটে আসছে। লক্ষ লক্ষ পাটচাষি পরিবার রক্তের মূল্যে উৎপাদিত পাটের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেনা। সরকার পাটের মূল্য ধার্য করেছেন প্রতি মণ পঞ্চাশ টাকা। অথচ গ্রামাঞ্চলে পাট বিক্রি হচ্ছে তিরিশ থেকে চল্লিশ টাকার মধ্যে। এহেন দুরবস্থা থেকে দুঃখী চাষীদের মুক্তিদানের কথা আমরা সরকারকে বলেছিলাম। বহু পূর্বেই আমরা পাটের নির্ধারিত মূল্য যাতে চাষিরা পেতে পারে তার নিশ্চিত ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলাম। আমরা তখনই সন্দেহ পোষণ করেছিলাম যে, যদি পাট চাষীরা তাদের পাটের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে তারা ভবিষ্যতে পাট উৎপাদন থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হবে। অথচ আমরা জানি আমাদের রাষ্ট্রীয় মোট আয়ের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা পাট বিক্রি থেকে অর্জিত হয়। তাছাড়া একটি নির্দিষ্ট জমিতে পাট উৎপাদনে যে খরচ হয় তা যদি তার বিক্রয় মূল্যে সম্মানজনক লভ্যাংশ না থাকে তাহলে পাট উৎপাদনের জন্য চাষিরা মোটেই আগ্রহী হবে না। সেক্ষেত্রে তারা ধান বা অন্যান্য বিকল্প ফসল উৎপাদনের দ্বারা জীবন নির্বাহের চিন্তা করবে। এবং অনিবার্য ভাবে বাংলাদেশের আর্থিক মেরুদন্ড স্বর্ণসূত্র পাট একদিন বিলুপ্তির পথে চলে যাবে।
সাম্প্রতিক একটি খবরে জানা গেছে, হবিগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নীলফামারী, জয়পুর প্রভৃতি এলাকায় পাট চাষীরা পাটের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং সাধারণ কৃষকদের হতাশা চরমে পৌঁছেছে। এ সকল এলাকায় প্রচুর পরিমাণ পাট উৎপন্ন হয়। অথচ উৎপাদিত পাটের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় তাদের সকল উৎসাহ হতাশা পর্যবসিত হয়েছে। টাঙ্গাইল, ভৈরব, কুড়িগ্রাম, ঝিকরগাছা, ফরিদপুর, কামারখালী, রাজবাড়ী প্রভৃতি এলাকা থেকেও সম্প্রতি সংবাদ এসেছে যে, সেখানে পাট চাষীরা তাদের পাশের বেঁধে দেওয়া মূল্য পাচ্ছে না বরং বেঁধে দেওয়া পঞ্চাশ টাকার পরিবর্তে এ সকল এলাকায় তিরিশ থেকে চল্লিশ টাকার মধ্যে প্রতি মণ পাট বিক্রি হচ্ছে। পাট চাষীদের জীবনের গতি সম্পর্কে দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও পত্রিকাগুলো সরকারকে অবহিত করে আসছে। কোন কোন রাজনৈতিক দল পাটের নিম্নতম মূল্য পঞ্চাশ টাকা থেকে আরও বাড়িয়ে দেওয়ার দাবিও জানিয়েছে। আমরা বেঁধে দেওয়া পঞ্চাশ টাকা মূল্য সুনিশ্চিত করার দাবি করেছি। কেননা আমরা জানি যে মূল্য বাঁধা হয়েছে সেটাই চাষিরা পাচ্ছে না এবং পাবার কোন কার্যকরী ব্যবস্থাও গৃহীত হয়নি। চাহিদার পরিমাণের সরকারি পাট ক্রয় কেন্দ্রের অভাব ও নির্ধারিত মূল্য চাষীদের হাতে পৌঁছে দেবার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের অভাব মিলে চাষীদের জীবনে এই দুরবস্থা নেমে এসেছে। এ কারণে সীমান্ত এলাকার পাট অধিক মূল্য পাবার আশায় সরাসরি ভারতে চালান হয়ে যাচ্ছে। আমরা সরকারকে তাই পুনরায় অনুরোধ করবো -নির্ধারিত মূল্য যাতে চাষিরা পেতে পারে তার জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা অবিলম্বে গ্রহণ করা হোক। দেশ থেকে পাট চাষ অদূর ভবিষ্যতে বন্ধ হয়ে যাক এটা সরকারের চাননা আমরাও তেমনি চাইনা।

খোলাবাজারে পরীক্ষার খাতা ও প্রশ্নপত্র

পরীক্ষার্থীদের পৌষ মাস আর বাঙালি জাতির সর্বনাশ হ’ল কিনা জানিনা। কিন্তু তবু একথা সত্যি যে চলতি মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার খাতা ও প্রশ্নপত্র খোলা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। গতকালকের স্থানীয় একটি দৈনিকে শিক্ষা সংসদ কর্তৃপক্ষের সরবরাহকৃত খাতার ফটোস্ট্যাট কফিসহ প্রকাশিত খবর অনুসারে খোলা বাজারে প্রাপ্ত এসব খাতার প্রত্যেকটির মূল্য দশ টাকা। অবশ্য প্রশ্ন পত্রের দাম নাকি অনির্ধারিত এবং সেজন্য যার কাছে যে দাম পাওয়া যায় সে মূল্যেই বিক্রি হচ্ছে।
এতদিন আমাদের জানা ছিল পরীক্ষার খাতা ও প্রশ্নপত্র অত্যন্ত গোপনীয় এবং মূল্যবান বস্তু বিধায় এগুলোকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণের নিয়ম। কিন্তু চলতি পরীক্ষার মৌসুমে যেন আমাদের নতুন অভিজ্ঞতা জন্মালো। নিত্যব্যবহার্য চাল, ডাল, তেল, নুন-এর মত পরীক্ষার খাতা এবং প্রশ্নপত্রও খোলাবাজারে বিক্রি হয়। শুধু তাই নয়, পরীক্ষা শুরু হওয়ার কিছু পূর্বে পরীক্ষা কেন্দ্রের প্রবেশ দ্বারেও নাকি এসব ফেরি করে বিক্রি হয়েছে।
স্বভাবতঃই প্রশ্ন ওঠে এর জন্য দায়ী কে? দোষী কারা? প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে ‘এসব খাতা কেমন করে বাইরে এলো সে সম্পর্ক অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরীক্ষাকেন্দ্রের কর্মচারীগণই নাকি এই কারচুপির সাথে জড়িত। এর পাশাপাশি শিক্ষা সংসদের কর্মকর্তাগণও যে সমান ভাবে জড়িত সে কথা এসে যায় না কি? স্বাধীনতা-উত্তরকালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষাগুলোতে যে ন্যক্কারজনক কেলেংকারি হয়ে গেছে এবং তার জন্য বিদেশিদের কাছ থেকে আমাদেরকে যে অসমান কুড়াতে হয়েছে সে কথা নতুন করে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। এবং সেজন্য সরকার সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কঠোর মনোভাব পোষণ করেছিলেন। বলাবাহুল্য, তার ফলে অনেকটা সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা শেষ হয়েছিল। কিন্তু চলতি পরীক্ষাতে আবারো যে ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি জবাব দেবেন?
শিষ্য বা ছাত্রকে প্রকৃত জ্ঞান দানের ব্যাপারে শিক্ষকদের চরম আত্মত্যাগের ঘটনা বাংলাদেশের বিরল নয়। এবং সেই ত্যাগের মহান আদর্শেই শিক্ষার্থীরা সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন করেছে। কিন্তু আজকের দিনে শিক্ষকমন্ডলী এবং সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে সংযুক্ত কর্মকর্তাদের মাঝে কি সেই আদর্শবাদের দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে?
শিক্ষা ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলের এই উদাসীনতা জাতীয় জীবনে কতখানি আত্মঘাতী মূলক কাজ সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে কি? সুতরাং এহেন অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা ক্ষমার অযোগ্য বলে আমরা মনে করি। কেননা কোন জাতিকে ধ্বংস করার জন্য সে জাতির জ্ঞানগত শিক্ষাকে ধ্বংস করলেই যথেষ্ট, -অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। জ্ঞানের পরীক্ষা নিরূপণে তাই এই অসৎ পথে আশ্রয় এবং প্রশ্রয় জাতিকে নিঃসন্দেহে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেবে।
সুতরাং বিষয়টিকে হালকা করে দেখার প্রশ্ন ওঠেই না বরং এ বিষয়টিকে একটি জাতীয় সমস্যা মনে করে ভবিষ্যতে যাতে কোন প্রকার এরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে সরকারকে অত্যন্ত কঠোর মনোভাব নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে বলে আমরা মনে করি। নচেৎ জাতির পায়ে কুঠারাঘাতই করা হবে।

একবার না পারিলে –

পারিব না এ কথাটি বলিও না আর। একবার না পারিলে দেখো শতবার। বাল্যকালে এ কবিতার সঙ্গে প্রায় সকলেরই পরিচয় রয়েছে। এ কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে কিনা আমরা জানি না তবে ওই একবার না পেরে শতবার দেখার কারবার সারবার আবার শুরু হয়ে গেছে। তথাকথিত হতাশ রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেকেই আবার নতুন করে একটা কিছু করা যায় কিনা ভাবছেন। আর ভাবনার ফলশ্রুতি স্বরূপ নতুন দল গঠনের কথাও বিবেচনা করা হচ্ছে।
হতাশ ও তথাকথিত ‘বিপ্লবী’ রাজনীতিবিদদের মধ্যে একজন ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন যে, ‘তিনি ৯০ দিন জেলের বাইরে থাকতে পারলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করতে সক্ষম হবেন। কথাটি শুনতে খুবই ভালো। টেকদার। পল্টনের ফাঁকা ময়দানে দাঁড়িয়ে এসব কথা নিশ্চিত নির্ভাবনায় বলা যায়। কথা বলতে তো টাকা খরচ করতে হয় না। সুতরাং যা পারো বলে নাও।
প্রসঙ্গতঃ বলা যেতে পারে -বিগত দেড় বছর পর্যন্ত অনেক হবু বা গবু নেতারাই অনেক কথা বলেছেন এবং এখনও বলছেন। কিন্তু ভবি ভুলবার নয়।
তথাকথিত হবু বা গবু নেতা অথবা বিপ্লবী নেতাদের কথাবার্তার ধারা থেকে একটি মাত্র জিনিসেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, পায়ের তলায় তারা মাটি এখনো খুঁজে পাননি। যদি পেতেন তাহলে এতটা হাঁকডাক আর হম্বিতম্বি করতেন না বা নতুন দল গঠনের কথাও চিন্তা করতেন না।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বুঝতে বাকি নেই যে, হবু বা গবু নেতারা শুধু কথারই জাহাজ মাত্র। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই তারা কথার তুবড়ি ছাড়ছেন। ছাড়তে ছাড়তে এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছেন যে, এখন ছাড়ার জায়গা নেই। সবই ফাঁকা। খাঁ-খাঁ করছে সবকিছু।
একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, দেশে বিরোধী দলের প্রয়োজন রয়েছে। সরকারি কার্যক্রম এর সুষ্ঠু ও গঠনমূলক সমালোচনা বিরোধী দলেই করে থাকেন। এবং পারস্পরিক সমালোচনা ও আলোচনার মাধ্যমেই দেশ এগিয়ে যাবে। এটা হল নীতির কথা। আদর্শের কথা। কিন্তু আমাদের হবু আর গবু নেতারা সে পথ মারাতে নারাজ। তারা সবসময়ই খড়গ হস্ত। কাটকাট মারমার ধ্বনিই তাদের কণ্ঠে। আর তা করতে গিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে আরম্ভ করে হরেক রকমের অকাজ কুকাজ করতেও আপত্তি নেই। অবশ্য এ কথা কারো অজানা নয় যে, তথাকথিত দেশ প্রেমিক নেতাদের (?) দেশপ্রেমের উৎস কোথায়। কোন অদৃশ্য সূতোর টানে তারা সবসময়ই জন্ডিস রোগীর মত সবকিছু হলদে দেখছেন। সুতরাং এই অবস্থা আর মানসিকতার পরিবর্তন না হলে একবার কেন শত বার দেখলেও কিছু হবে না। সম্ভবতঃ বাংলাদেশের সাধারণমানুষ তথাকথিত বিপ্লবী নেতাদের সস্তা কথায় ভুলবে না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন