You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.09.23 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | জাতিসংঘের ভুট্টোর উক্তিঃ দিল্লি চুক্তির পরিপন্থী | বাড়ি ভাড়া প্রসঙ্গে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৩শে সেপ্টেম্বর, সোমবার, ৭ই আশ্বিন, ১৩৮০

জাতিসংঘের ভুট্টোর উক্তিঃ দিল্লি চুক্তির পরিপন্থী

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো সাহেব আবার হম্বিতম্বি শুরু করেছেন। এবার তিনি জাতিসংঘের দুয়ারে ধর্ণা দিয়েছেন। এবং হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে, ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি না দেয়া হলে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে না। ভুট্টো সাহেব আরো বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি না দেয়া হলে পাকিস্তানে গোলমাল দেখা দেবে। জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নেও নাকি ভুট্টোর পাকিস্তান বাগড়া দেবে। চীন আগের মতো এবারও এব্যাপারে ভেটো দেবে বলে জনাব ভুট্টোর বিশ্বাস। অথচ কী আশ্চর্য, ভুট্টো সাহেব দিল্লি চুক্তির কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। জাতিসংঘে ভুট্টো সাহেব যেসব কথা উচ্চারণ করেছেন তা সবাই দিল্লি চুক্তি বাস্তবায়নের পরিপন্থী। দিল্লি চুক্তি মোতাবেক দু’দেশের মধ্যে সবেমাত্র লোক বিনিময় শুরু হয়েছে আর এমনি মুহূর্তে ভুট্টো সাহেব বাংলাদেশ প্রশ্ন যেসব মন্তব্য করেছেন তা বেফাঁস উক্তি ছাড়া আর কি হতে পারে। জনাব ভুট্টো কি একথাটিও বিস্তৃত হয়েছেন যে তার পরম সুহৃদ দিল্লি চুক্তিকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। লোক বিনিময় শুরু হওয়াতে উপমহাদেশে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের এ ধারণারই উদয় হয়েছিল যে, এবার বুঝি সত্যি সত্যিই এই উপমহাদেশের ঘোলাটে পরিস্থিতির অবসান হচ্ছে। শান্তিপূর্ণ বন্ধুত্বের পরিবেশ রচিত হতে আর দেরি নেই। কিন্তু জাতিসংঘে জনাব ভুট্টোর সাম্প্রতিক কাণ্ডকারখানার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের মনে সন্দেহের জন্ম হয়েছে যে ভুট্টো সাহেবের মতিগতি আগে যা ছিল, এখনও তাই আছে। সিমলা চুক্তির আলোকে সম্পাদিত দুটি চুক্তির শর্তাবলী বাস্তবায়ন বিষয়ে ভুট্টো সাহেবের তেমন কোন মাথা ব্যথা নেই। যখন যা খুশি তা তিনি অব্যাহত গতিতে করেই যাবেন। যেন এতে কোনো হেরফের নেই; নেই কোনো ব্যত্যয়।
প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর এ ধরনের উক্তি সম্পর্কে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, দিল্লী চুক্তি বাইরে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর প্রশ্ন উত্থাপন করে কোন ফায়দা হবে না। তিনি বলেছেন, এর সাথে বাংলাদেশের জাতিসংঘ-ভুক্তির প্রশ্নকে জড়িত করার মনোবৃত্তি নিতান্তই দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, দিল্লী চুক্তিতে যুদ্ধাপরাধী সমস্যা সমাধানের একটা সুস্পষ্ট কাঠামো দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের জাতিসংঘভুক্তির প্রশ্নেও পাকিস্তান বিরোধিতা করবে বলে যে হুমকি দিয়েছে তাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হতে পারবে কি পারবে না, তা জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল, এতে পাকিস্তানের করার কিছুই নেই। হ্যানয় থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে কলকাতায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানও ভুট্টোর হুমকি সম্পর্কে কড়া মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল কি দিল না, তাতে আমাদের কিছুই আসে যায়না। আমরা পাকিস্তানের স্বীকৃতির তোয়াক্কা করি না। নীতি বিসর্জন দিয়ে আমরা জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত হতে চাই না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্বের ১০৭ টি দেশ এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় সব কয়টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করেছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশকে যদি জাতিসংঘের বাইরে রাখা হয়, তাহলে জাতিসংঘই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি ভুট্টোর মন্তব্যকে দিল্লি চুক্তির প্রতি অবমাননাকর উক্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে, পাকিস্তানের দোসর চীনও দীর্ঘ তেইশটি বছর জাতিসংঘের বাইরে ছিল, তাতে কি চীনের কোন ক্ষতি হয়েছে? জনাব ভুট্টো সম্ভবতঃ এই সত্যটি অনুধাবন করতে সক্ষম হননি। নইলে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের ব্যাপারে বাগড়া দেয়াটাকে তেমন আমল তিনি দিতেন না। চীন যদি জাতিসংঘের বাইরে থেকেও টিকে থাকতে পারে তাহলে বাংলাদেশেও তা পারবে -এ সত্যটি স্মরণে রাখার জন্য আমরা ভুট্টো সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দিল্লি চুক্তির বরখেলাফ যদি এমনিভাবেই ভুট্টো সাহেব করতে থাকেন, তাহলে যে হিতে বিপরীত পরিণতি ডেকে আনবে না তাই বলি কি করে। কাজেই বলি, জনাব ভুট্টোঃ ভাবিয়া করিও কাজ -করিয়া ভাবিও না।

বাড়ি ভাড়া প্রসঙ্গে

অবশেষে বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত ব্যাপারে সরকার প্রেসনোট প্রকাশ করেছেন। এই প্রেসনোটে ১৯৬৩ সনের ঘর ভাড়া নিয়ন্ত্রণ অর্ডিন্যান্সের বিধিসমূহের প্রতি বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়াদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে ১৯৬৩ সনের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ অর্ডিন্যান্স প্রচলিত রয়েছে এবং বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়া উভয়কেই উক্ত অর্ডিন্যান্স মেনে চলতে হবে।
উক্ত অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী একটি বাড়ি বা বাসার প্রচলিত ভাড়া হবে ভাড়াটে বাসা বা যে বাড়ির যে অংশটুকু ভাড়া নিয়েছেন তার বাজারদরের শতকরা পনেরো ভাগের সমান হবে সারা বছরের ভাড়া এবং কোন বাড়িওয়ালাই প্রচলিত ভাড়ার চাইতে অধিক ভাড়া নিতে পারবেন না। যদি কোন বাড়ির মালিক ভাড়াটের কাছ থেকে বেশি বা কম ভাড়া নিতে চান তাহলে তাকে ভাড়া নেওয়ার তারিখ থেকে ছ’মাসের মধ্যে কন্ট্রোলারের কাছে আবেদন করতে হবে। প্রেসনোটে আরো বলা হয়েছে, কোন বাড়ির মালিকই ভাড়াটের কাছ থেকে এক মাসের ভাড়ার অতিরিক্ত কোনো অগ্রিম, প্রিমিয়াম বা সেলামি অথবা অন্য কোন প্রকারের অর্থ দাবি করতে পারবেন না বা আদায় করতে পারবেন না। এছাড়া প্রকাশিত সরকারি প্রেসনোটে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বাড়ির মালিক ও ভাড়াটের মধ্যে কোন রকম পূর্ব চুক্তি সম্পাদন ছাড়া কোন ভাড়াটেকে বৈধ কারণ ছাড়া উচ্ছেদ করা যাবে না এবং ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করতে হলে বৈধ কারণ দর্শীয়ে দেওয়ানী আদালতের মাধ্যমে করতে হবে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, বেশ কিছুদিন থেকে দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় বাড়িওয়ালাদের দৌরাত্ম সম্পর্কে বিভিন্ন খবর প্রকাশিত হয়ে আসছিল । এবং এ সম্পর্কে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বাড়িওয়ালাদের দৌরাত্ম্য দমনের প্রেক্ষিতে এবং ভাড়াটিয়াদের জন্য উদ্ভূত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রয়োজনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বহু নিবন্ধও প্রকাশ করেছেন। সুতরাং এমতাবস্থায় প্রকাশিত প্রেস নোটটি উদ্ভূত সমস্যার পরিপূর্ণ সমাধান না ঘটালেও তা অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের পথ করে দিতে সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করছি।
আমরা আগেও বলেছি, আজও বলছি, বিশেষ করে ঢাকাতে বর্তমানে বাড়িভাড়া পূর্বের চাইতে আরো বেশি বেড়ে গেছে যে তা উল্লেখের অবকাশ নেই। গত সপ্তাহে জাতীয় সংসদ কক্ষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মহোদয়ও স্বীকার করেছেন যে বর্তমানে বাড়ি ভাড়া দু’শভাগ বেড়ে গেছে। সুতরাং এ থেকেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে আর কষ্ট হয় না যে কোন কোন বাড়ির ভাড়া ‘বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ অর্ডিন্যান্স’ অনুসারে ‘প্রচলিত ভাড়ার’ চাইতে অনেক বেশি ভাড়ায় পৌঁছেছে সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। স্বভাবতঃই এক্ষণে প্রশ্ন ওঠে তাহলে এ ধরনের বিষয়গুলোর কি হবে?
এমতাবস্থায় আমরা মনে করি, সরকারকে কেবল প্রেসনোট প্রকাশ করে ক্ষান্ত হ’লে চলবে না বরং সরকারি বিধি বিধানকে সঠিক বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতেই এদিকটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। এবং সেইসঙ্গে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়া উভয়ের কাছে আমাদের বক্তব্য, বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত উদ্ভুত সমস্যা আন্তরিকতা ও খোলা মন নিয়ে মিটিয়ে ফেললে যেমনটা উভয়ের পক্ষে যেমনটা কল্যাণকর হবে তেমনি সে মঙ্গল গোটা সমাজেও প্রতিফলিত হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন