You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.01 | নয়াদিল্লীর সামনে শুধু অন্ধকার | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

নয়াদিল্লীর সামনে শুধু অন্ধকার

ছ’মাসের মধ্যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে বাংলাদেশে। শরণার্থীরা ফিরে যেতে পারবেন নিজেদের বাড়ীঘরে। অনুমান করেছিলেন নয়াদিল্লী। একথা যখন ভাবছিলেন কেন্দ্রীয় সরকার তখন শরণার্থীর সংখ্যা ছিল পঁচিশ লক্ষ। এখন তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় চল্লিশ লক্ষ। পুণর্বাসন মন্ত্রী খাদিল করের ধারণা, অদূরে ভবিষ্যতে শরণার্থীদের সংখ্যা আশী লক্ষে পৌছলেও অবাক হবার কিছু নেই। এখন দেখা যাচ্ছে, নয়াদিল্লী প্রতিপদে হিসাবে ভুল করেছেন। একবার তারা ভাবলেন, শরণার্থীদের সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে রাখা হবে। পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলাের উপর চাপ এত বেশী পড়ল যে, কর্তৃপক্ষ মত পাল্টালেন। তারা সীমান্ত রাজ্যগুলাের ভিতরে শিবির খােলার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাতেও শেষ রক্ষা হল না। এখন ভিন্ন রাজ্যেও শরণার্থী পাঠাবার আয়ােজন চলছে। এদিকে বাংলাদেশের অবস্থা সঙ্গীন। পাকিস্তানি সৈন্য এবং স্থানীয় এক | শ্রেণীর ধর্মান্ধ শয়তান পাইকারী হারে বাঙ্গালী তাড়াচ্ছে। লুঠপাট এবং ধ্বংসলীলা অবাধে চলছে। যতদিন দিন যাচ্ছে সন্ত্রাস তত বাড়ছে। সাধারণ মানুষ আর টিকে থাকতে পারছেন না। ওরা এপারে পাড়ি জমাচ্ছেন। স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টি তাে দূরের কথা, যারা ওখানে আছেন তারাও দলে দলে দেশ ছাড়ছেন। ইয়াহিয়ার উপর বিশ্ব চাপ সৃষ্টির বহু চেষ্টা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি নিজে বিদেশী সরকারগুলাের কাছে চিঠি লিখেছেন। ভারতীয় দূতেরা বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। ফল পাওয়পা গেছে কতটুকু? ইয়াহিয়ার মানসিক পরিবর্তনের লক্ষণ নেই। তিনি আগের মতই উদ্ধত এবং শয়তানি দাবা খেলায় মত্ত।
পাক-বেতার সংবাদ দিয়েছে, আসল শরণার্থীদের ফেরত নেবার জন্য কর্তৃপক্ষ পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলগুলােতে শিবির খুলেছেন। ইয়াহিয়া বলছেন—নকলদের তিনি ফেরত নেবেন না। এই নকলের দলে অবশ্যই পড়বেন হিন্দু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকরা। ওদিকে বাংলাদেশে কায়েম হতে চলেছে ইসলামাবাদের ঘাতক এবং স্থানীয় ধর্মান্ধদের সন্ত্রাসের রাজত্ব। ওটা সাম্প্রদায়িক এবং জাতীয়তাবাদী বাঙালী বিরােধী। এদের খপ্পরে অনেক শরণার্থীই স্বেচ্ছায় পড়তে চাইবেন না। যারা যাবেন তারা মুসলীম লীগ এবং অন্যান্য সাম্প্রদায়িক দলে নাম লিখিয়ে গা বাঁচাবেন। যাঁরা তা পারবেন না তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য ভারতেই থাকবেন। তাদের সামনে বাংলাদেশের রুদ্ধ দরজা খুলতে পারেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এবং তাঁদের সৈন্যদল। এদের সংগ্রামহবে দীর্ঘস্থায়ী। এ সংগ্রামের শেষ পরিণতি এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক দৃষ্টির বাইরে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এই অপ্রিয় সত্য যে না বুঝেন, এমন নয়। তিনি ছুটাছুটি করে বেড়াচ্ছেন। একবার নিজের চোখে দেখে গেছেন শরণার্থীদের অবস্থা। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই আবার তিনি আসবেন পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলােতে। এত হাঁক ডাক এবং দৌড়াদৌড়িতে আসল সমস্যার সমাধান হবে কতখানি? বৃহৎ শক্তিগুলােকে তিনি হুশিয়ারী দিয়েছেন, অবস্থার গুরুত্ব তারা না বুঝলে নিজের পথ বেছে নেবে ভারত। পাকিস্তানে সাহায্য প্রেরণ বন্ধ করতে বৃটিশ সরকার নারাজ। আমেরিকাও মনে হয়, বৃটেনের পদাঙ্ক অনুসরণকারী। তার উপর সংযম রাখার জন্য ভারতকে অযাচিত উপদেশ দিয়েছেন মার্কিন কর্তৃপক্ষ। সােভিয়েট রাশিয়ার সুর নরম। আরব রাষ্ট্রগুলাে জেগে জেগে ঘুমুচ্ছে। যুদ্ধের জন্য ইসলামাবাদ খরচ করছেন দৈনিক প্রায় দেড় কোটি টাকা। সংগ্রামের তীব্রতা যত কমবে তাদের খরচার পরিমাণও তত নীচের দিকে যাবে। এদিকে শরণার্থীদের ভরণ-পােষণে ভারতের দৈনিক ব্যয়ও প্রায় দেড় কোটি টাকার কোঠায় পৌছে গেছে। যতদিন যাবে পাকিস্তানের খরচার পরিমাণ তত নিম্নগামী হবে। অথচ ভারতের খরচার পরিমাণ বাড়বে। এপর্যন্ত নগদে এবং জিনিসপত্রে বৈদেশিক সাহায্য বাবদ নয়া দিল্লী পেয়েছেন মাত্র বার কোটি টাকা। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত তার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। এধরনের সাহায্য থেকে পাকিস্তানও বঞ্চিত হবে না।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১ জুন ১৯৭১