You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975 | বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি - সংগ্রামের নোটবুক

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিকে বাকশাল বা একদলীয় শাসনব্যবস্থা হিসেবে এর কট্টর সমালােচকদের কর্তৃক চিহ্নিত ও সে মর্মে অপপ্রচার চালানাে হয়, যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা বঙ্গবন্ধুর আসল উদ্দেশ্য ছিল না। তাই, বাকশাল সম্বন্ধে বাস্তবে তা আদৌ সত্যি নয়। সেটি ছিল মহল বিশেষের উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা মাত্র। প্রকৃতপক্ষে, দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচি ছিল অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতির এমন কোনাে দিক নেই, যা এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচিতে ৫টি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্বারােপ করেন। সেগুলাে হলাে-দুর্নীতি উচ্ছেদ, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানাে এবং জাতীয় ঐক্য।
দুর্নীতি উচ্ছেদ : বঙ্গবন্ধু দুর্নীতিকে সমাজ ও সরকারের এক নম্বর চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন :১
আমি [কৃষককে] সার দিতে পারি নাই।…যে সার আমি দিয়েছি তার কমপক্ষে থার্টি পারসেন্ট ব্লাক মার্কেটিং এ চুরি হয়ে গেছে। আমি যে ফুড দেই তার কুড়ি পারসেন্ট চুরি হয়ে যায়। আমি যে মাল পাঠাই গ্রামে-গ্রামে তার ২০%-২৫% চুরি হয়ে যায়। সব চুরি হয়ে যায়।…লেট আস ডিসকাস দিস মেটার। দেয়ার শ্যাল বি এ ফ্রি এন্ড ফেয়ার ডিসকাশন।
করাপশনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘…শুধু নিজেরা ঘুষ খাওয়াই করাপশন নয়।…করাপ্ট পিপলকে সাহায্য করাও করাপশন, নিপােটিজমও কিন্তু ‘এ টাইপ অব করাপশন’, স্বজনপ্রীতিও কিন্তু করাপশন।২
করাপশন কারা করে, সে সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন :৩
আমরা শতকরা ২০ জন শিক্ষিত লােক। তার মধ্যে সত্যিকার অর্থে আমরা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। শিক্ষিতদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন। আমি এই যে দুর্নীতির কথা বললাম, তা কারা করে? আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক? না। তাহলে ঘুষ খায় কারা? ব্লাকমার্কেটিং করে কারা? বিদেশী এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান দেয় কারা? হাের্ড করে কারা? এই আমরা যারা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। এই আমাদের মধ্যেই রয়েছে ঘুষখাের, দুর্নীতিবাজ।
বঙ্গবন্ধু চতুর্দিকে করাপশন দেখে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলেন :৪
এতাে চোর যে কোথা থেকে পয়দা হয়েছে, জানি না। পাকিস্তান সব নিয়ে গেছে, কিন্তু এই চোর রেখে গেছে। এই চোর তারা নিয়ে গেলে বাঁচতাম।
বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘােষণাকালে জনগণের উদ্দেশে বলেন, “এক নম্বর কাজ …দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। তবে সরকারী আইন করে কোন দিন দুর্নীতিবাজদের দমন করা সম্ভব নয় এ কথা তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ঘরে ঘরে আপনাদের দুর্গ গড়তে হবে। সে দুর্গ গড়তে হবে দুর্নীতিবাজদের খতম করবার জন্যে, বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের দুঃখ মােচন করাবার জন্যে।৫ তিনি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জনগণকে ‘মােবিলাইজ’ হওয়ার পরামর্শ দিয়ে সামাজিক বয়কট গড়ে তােলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই দুর্নীতিবাজদের যদি খতম করতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ দুঃখ চলে যাবে। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি : বিপ্লব কর্মসূচির অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি। খাদ্য ঘাটতি পূরণে বঙ্গবন্ধু সরকারকে বছরে ২০ থেকে ৩০ লক্ষ টন খাদ্য আমদানি করতে হয়। বিশ্ববাজার থেকে তা সংগ্রহ করতে উচ্চ মূল্য দিতে হয়। এরপরও খাদ্য উদ্বৃত্ত ধনী দেশসমূহ থেকে যথাসময়ে খাদ্যসংগ্রহ সম্ভব হয়নি। এজন্য অনেক সময় তাদের সঙ্গে দেনদরবার করতে হয়। এ সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু বলেন:৬
ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে দুনিয়া ঘুরতে হয়েছে। খাবার বাইরে থেকে আনতে হয়েছে …ভিক্ষুকের জাতের কোন ইজ্জত আছে? দুনিয়ায় জীবনভর ভিক্ষা পাওয়া যায়? খেতে-খামারে, কলে-কারকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারােপ করে বঙ্গবন্ধু বলেন :৭
যে মানুষ ভিক্ষা করে, তার যেমন ইজ্জত থাকে না, যে জাতি ভিক্ষা করে, তারও তেমনি ইজ্জত থাকে না। …আমি সেই ভিক্ষুক জাতির নেতা থাকতে চাই না।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ওপর গুরুত্বারােপ করে বঙ্গবন্ধু বলেন :
…আমাদের দেশে এক একর জমিতে যে ফসল হয়, জাপানের এক একর জমিতে তার তিন গুণ বেশী ফসল হয়। কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সেই জমিতে …দ্বিগুণ করতে পারব না? আমি যদি দ্বিগুণ করতে পারি তাহলে আমাদের খাদ্য কিনতে হবে না, ভিক্ষা করতে হবে না।৮
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেন, যথা :
এক. জমির সিলিং ১০০ বিঘা নির্ধারণ;
দুই. প্রতিটি থানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ;
তিন. পর্যায়ক্রমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ;
চার. কৃষকদের নিকট ফার্টিলাইজার পৌছানাে;
পাঁচ. খাল কেটে কৃষিজমিতে চাষের ব্যবস্থা। পাম্প সরবরাহ না করা পর্যন্ত বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে কিংবা কুয়া কেটে সেখান থেকে কৃষিকার্যে পানির ব্যবস্থা করা;
ছয়, কৃষির ক্রমান্বয়ে যান্ত্রিকীকরণ এবং কৃষি ও শিল্পের প্রসার। উৎপাদন ও বণ্টন প্রক্রিয়ায় কৃষক ও শ্রমিকের অংশগ্রহণের সুযােগ থাকা;
সাত সমবায় পদ্ধতিতে চাষাবাদ। জমির মালিকানা থাকবে এবং কিছুতেই তা নেওয়া হবে না, বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট তা জানিয়ে দেন। উৎপাদিত ফসলের এক অংশ জমির মালিক, একভাগ কৃষক ও এক অংশ সরকার পাবে। সমবায় হবে কম্পলসারি;
আট, গ্রামে-গ্রামে ৫০০ থেকে ১০০০ পরিবার নিয়ে মাল্টিপার্পাস ভিলেজ কো-অপারেটিভ; ৬৫ হাজার গ্রামের প্রত্যকটিতে ৫ বছরে ১টি করে এরূপ বহুমুখী সমবায় স্থাপন। প্রত্যেকটি বেকার, প্রত্যেকটি কর্মক্ষম মানুষ এর সদস্য হবে। সরকারের কাছ থেকে অর্থ, ফার্টিলাইজার, টেস্ট রিলিফের বরাদ্দ, ওয়ার্কস প্রােগ্রামের বরাদ্দ তাদের কাছে যাবে। কৃষি সমবায়ের মতাে এর উৎপাদিত পণ্যও জমির মালিক, কো-অপারেটিভের সদস্য ও সরকারের মধ্যে বণ্টিত হবে। এরপর বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য, আস্তে আস্তে
ইউনিয়ন কাউন্সিলে যারা টাউট আছে, তাদেরকে বিদায় দেওয়া হবে।’
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ : জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ছিল বিপ্লব কর্মসূচির ৩ নম্বর এজেন্ডা। সে-সময়ে বছরে ৩০ লক্ষ করে লােক বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ঐ হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০ বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে মােট জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৫ কোটির মতাে। এজন্য সরকারকে যেমন প্রতিবছর অতিরিক্ত খাদ্য আমদানি করতে হবে, অপরদিকে বঙ্গবন্ধু আশঙ্কা করেন, ২৫-৩০ বছর পর বাংলায় চাষাবাদের জন্য কোনাে জমি অবশিষ্ট থাকবে না। পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে যে, ‘বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে এ কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “সেই জন্য আজকে আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে হবে।৯ এজন্য আবশ্যক জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ।
প্রশাসন ঢেলে সাজানাে : স্বাধীনতাপরবর্তী পুরাতন ব্যবস্থাধীনে দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে উপলব্ধি করেন যে, ব্রিটিশ-পাকিস্তানি আমলের প্রশাসন ব্যবস্থা স্বাধীন দেশের সমাজ-চাহিদার অনুপযােগী এবং বাংলাদেশকে ঘিরে তার যে রাজনৈতিক স্বপ্ন তার বাস্তবায়নও তা দ্বারা কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই, তিনি। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কেন্দ্রীভূত, জনগণের কল্যাণে অসহায়ক, প্রভুত্বমূলক ও সমন্বয়হীন আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্থলে রাজনৈতিক নেতৃত্বাধীন, জনগণের সকল অংশের অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ, জবাবদিহি, উন্নয়নকামী, বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচির ডাক দেন। তিনি ঘােষণা করেন :১০

ইডেন বিল্ডিংস (সচিবালয়] বা গণভবনের মধ্যে আমি শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা রাখতে চাই না। আমি আস্তে আস্তে গ্রামে, থানায়, ইউনিয়নে, জেলা পর্যায়ে এটা পৌছিয়ে দিতে চাই, যাতে জনগণ সরাসরি তাদের সুযােগ-সুবিধা পায়।
এ লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ ছিল নিম্নরূপ :
এক, সকল সাব-ডিভিশন বা মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা। প্রত্যেক জেলার জন্য একজন জেলা গভর্নর নিযুক্ত করা। রাজনৈতিক দলের সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা ও সকল শ্রেণি-পেশার সদস্যদের সমন্বয়ে একটি এডমিনিস্ট্রেটিভ বা প্রশাসনিক কাউন্সিল গঠন।
দুই. প্রতি থানায় একটি করে এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল। একজন চেয়ারম্যান এর প্রধান থাকবেন। রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মচারী, যুর প্রতিনিধি, কৃষকের প্রতিনিধি, শ্রমিকের প্রতিনিধি, মহিলাদের প্রতিনিধি থাকবেন। এক বছরের মধ্যে নতুন থানা প্রশাসন। গঠনে হাত দেওয়া হবে বলে বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করেন।
তিন, একটি মামলা বিশেষ করে ফৌজদারি মামলার বিচার কীভাবে বংশানুক্রমে প্রলম্বিত হয়, সে সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুর যথেষ্ট জানা ছিল। তার দীর্ঘ কারাজীবনে তিনি দেখেছেন কীভাবে একজন কয়েদি বিচারহীনতার শিকার হয়। ফিফটি ফোর’-এর মতাে মামলায় এক বছর দুবছর হাজত খাটার পর শেষ পর্যন্ত ১ মাস জেল হয়। তাই, বিচারকার্যের দীর্ঘসূত্রিতা দূর ও জনগণের দোরগােড়ায় বিচারিক সুবিধা পৌছানাের লক্ষ্যে বিচার ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। থানায় ট্রাইব্যুনাল স্থাপন, যাতে মানুষ এক কিংবা দেড় বছরের মধ্যে বিচার পায়। থানার মানুষ অতি সহজে নৌকা ভাড়া করে, পায়ে হেঁটে এসে বিচার পাবে মর্মে বঙ্গবন্ধু আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
চার, প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা-প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সরকারি কর্মচারী সবাই হবে জনগণের সেবক, ‘আমরা জনগণের মাস্টার নই।
পাঁচ, সমাজের জ্ঞানী-গুণিজনদের ‘পুল গঠন করে রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় তাদের সম্পৃক্ত করা।
ছয়. আর্মির সদস্যরাও দেশ-জাতির উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণে নিয়ােজিত হবে। এ সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু বলেন: আই ওয়ান্ট মাই আর্মি-এ পিপলস আর্মি। আই ডু নট ওয়ান্ট মাই আর্মি টু ফাইট এগেনস্ট এ্যানিবডি, বাট আই ওয়ান্ট মাই আর্মি টু ডিফেন্ড মাই সেলফ এন্ড এ্যাট দি সেম টাইম টু ওয়ার্ক।
সাত, আর্মি থেকে শুরু করে যেখানেই ভালাে লােক আছে তাদের এক জায়গায় করে কাজে লাগানাে।
আট. সরকারের সকল বিভাগের মধ্যে সমন্বয় এবং প্রত্যেক কাজই নিজের কাজ হিসেবে দেখা।
নয়, প্রশাসন ব্যবস্থা হবে সহজ, সরল ও সােজাসুজি। বঙ্গবন্ধু বলেন,১২
সােজাসুজি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে জেলার কানেকশন রাখতে চাই। তেমনি … জেলার সঙ্গে থানার, থানার সঙ্গে ইউনিয়নের কানেকশন রাখতে হবে।
দশ, সরকারের তরফ থেকে জেলা, থানাসহ প্রশাসনের যেখানেই অর্থ, তা টেস্ট রিলিফের টাকা হােক, প্রকল্পের টাকা হােক, কিংবা ওয়ার্কস প্রােগ্রামের টাকা বা কৃষকের জন্য ফার্টিলাইজার হােক, গভর্নর বা প্রশাসকের রুমে বড়ােবড়াে করে সে বিষয়ে চার্ট টাঙ্গিয়ে রাখা (যাকে বলা হয় সিটিজেন চার্টার), যাতে মানুষ দেখতে ও জানতে পারে কোন খাতে কত টাকা আসছে এবং কীভাবে তা ব্যয় বা বিতরণ হচ্ছে।
জাতীয় ঐক্য : বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ছিল জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। জাতীয় ঐক্য ছাড়া মহৎ কোনাে অর্জন সম্ভব হয় না। বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতিকে একই মন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন বলে ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের পক্ষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। এমনকি এজন্য ৩০ লক্ষ লােক আত্মাহুতি দিতে পর্যন্ত কুণ্ঠাবােধ করেনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তুলতেও অনুরূপ ঐক্য একান্ত আবশ্যক ছিল। এ লক্ষ্যে ৬ই জুন স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিবিদ, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল নামে একটি জাতীয় দল গঠন করা হয়। সকল বিভেদ-দ্বন্দ্ব ভুলে এবং বিধিনিষেধ কাটিয়ে সবাই যাতে বাংলাদেশকে ভালােবেসে একযােগে, একমনে কাজ করতে পারে, তার জন্যই এ দলের সৃষ্টি। একটিমাত্র জাতীয় দল গঠন করা হলেও, জনগণের ভােটাধিকার প্রয়ােগের সুযােগ রয়েছে (বিস্তারিত, অধ্যায় : ছয় দ্রষ্টব্য)। বঙ্গবন্ধু তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচি গ্রহণকালে উল্লিখিত পদক্ষেপের পাশাপাশি শিক্ষক ও শিক্ষিত সম্প্রদায়, ছাত্র, যুবক, সরকারি কর্মচারী, শ্রমিক প্রমুখের উদ্দেশে কিছু কথা বলেন, যা প্রণিধানযােগ্য।
শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু এক বক্তব্যে বলেন :১৩
আমি দেখে খুশী হয়েছি, আপনারা নকল-টকল বন্ধ করেছেন একটু। কিন্তু একটা কথা আমি বলব। আমি পেপারে দেখেছি যে, এবারে প্রায় এক পার্সেন্ট…, দুই পার্সেন্ট…, তিন পার্সেন্ট পাস।…আমার আকুল আবেদন, ফেল করাবেন না … আপনাদের কর্তব্য আছে, ছেলেদের মানুষ করতে হবে। ফেল করানােতে আপনাদের তেমন বাহাদুরি নাই…আপনারা লেখাপড়া শেখান …শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনুন, রাজনীতি একটু কম করুন। …নকল করতে দেবেন না। তবে, … মেহেরবানী করে আপনাদের কর্তব্য পালন করুন। ছেলেদের মানুষ করবার চেষ্টা করুন। …আমি বুদ্ধিজীবীদের কিছু বলি না। তাদের সম্মান করি। শুধু এই টুকুই বলি যে, বুদ্ধিটা জনগণের খেদমতে ব্যয় করুন।
ছাত্রদের লেখাপড়া করার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ছাত্র সমাজের লেখাপড়া করতে হবে, লেখাপড়া করে মানুষ হতে হবে। জনগণ টাকা দেয় ছাত্রগণকে মানুষ হবার জন্য …আমরা যেন পশু না হই…।১৪ উল্লেখ্য, সমাজ-চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে একমুখী, অভিন্ন ও গণমুখী শিক্ষা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার স্বাধীনতার পরপর বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদাকে চেয়ারম্যান করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। সে সম্বন্ধে ইঙ্গিত করে বঙ্গবন্ধু বলেন :১৫
ছাত্র লেখা-পড়া করবে নূতন সিস্টেমে। আমরা একটা নূতন এডুকেশন সিস্টেম করতে বলেছি। কেরাণী পয়দা করে লাভ হবে না, মানুষ পয়দা করতে হবে…।
১৯৭৪ সালে কমিশন তার রিপাের্টও জমা দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের বিয়ােগান্তক ঘটনার পর ঐ রিপাের্ট আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। যুব সমাজকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য :১৬
আমার যুবক ভাইয়েরা, যে কো-অপারেটিভ করতে যাচ্ছি গ্রামে গ্রামে, এর ওপর বাংলার মানুষের বাঁচা নির্ভর করবে। আপনাদের ফুলপ্যান্টটা একটু হাফপ্যান্ট করতে হবে। পাজামা ছেড়ে একটু লুঙ্গী পড়তে হবে। আর গ্রামে গ্রামে যেয়ে এই কো-অপারেটিভকে সাকসেসফুল করার জন্য কাজ করতে হবে।
সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু যেসব বক্তব্য রাখেন, তার মাধ্যমেও তার দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচির আসল লক্ষ্য ফুটে ওঠে। বঙ্গবন্ধু বলেন:১৭
সরকারী কর্মচারীদের বলি, মনে রেখাে, এটা স্বাধীন দেশ। এটা বৃটিশের কলােনী নয়। পাকিস্তানের কলােনী নয়। যে লােককে দেখবে, তার চেহারাটা তােমার বাবার মত, তােমার ভাইয়ের মত। ওরই পরিশ্রমের পয়সায় তােমরা মাইনে পাও। ওরাই সম্মান বেশী পাবে। কারণ, ওরা নিজেরা কামাই করে খায়।… তাদের আপনারা কি …ফেরত দিয়েছেন, কতটুকু দিচ্ছেন? …আত্মসমালােচনা করুন।
শ্রমিকদের প্রতি কঠোর পরিশ্রম ও উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন :১৮
শ্রমিক ভাইয়েরা, আমি শ্রমিক প্রতিনিধি করেছি। আপনাদের প্রতিনিধি, ইন্ডাজট্রিজ ডিপার্টমেন্ট, লেবার ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধি বসে একটা প্ল্যান করতে হবে। সেই প্ল্যান অনুযায়ী কি করে আমরা বাঁচতে পারি, তার বন্দোবস্ত করতে হবে।
এছাড়া ন্যাশনাল প্ল্যানিং-এর মতাে স্থানীয় পর্যায়েও যাতে পরিকল্পিতভাবে কাজ হয়, তার জন্য সেখানেও প্ল্যানিং-এর ব্যবস্থা করার ওপর বঙ্গবন্ধু গুরুত্বারােপ করেন। একই সঙ্গে তিনি যারা স্বচ্ছল তাদেরকে যথানিয়ম ট্যাক্স প্রদান ও অন্যান্য উপায়ে জাতীয় আয় বৃদ্ধির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
তথ্যনির্দেশ
১. বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, শফিকুল আজিজ মুকুল (সংকলিত), বাকশাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু, পৃ. ৬২-৬৩
২. ১৯৭৫ সালে ২১শে জুলাই জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঐ, পৃ. ৮৬
৩. ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঐ, পৃ. ৪১; আরাে ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঐ, পৃ. ১৭
৪. ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঐ, পৃ. ৩৯
৫. ঐ, পৃ. ৩৮-৩৯
৬. ঐ, পৃ. ৩৯
৭. ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঐ, পৃ, ১৯-২০; ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঐ, পৃ. ৩৯
৮. ঐ, পৃ. ৩৯
৯, ঐ, পৃ. ৪০; আরাে ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঐ, পৃ. ১৯
১০. ১৯৭৫ সালে ২১শে জুলাই জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঐ, পৃ. ৮৫
১১. বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঐ, পৃ. ৬১-৬২
১২. ১৯৭৫ সালে ২১শে জুলাই জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঐ, পৃ. ৭৫
১৩. ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঐ, পৃ. ৪৫-৪৬
১৪. ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঐ, পৃ. ২২
১৫. বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঐ, পৃ. ৬৫
১৬. ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঐ, পৃ. ৪৬।
১৭. ঐ, পৃ. ৪৭
১৮. ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঐ, পৃ. ১৮

রেফারেন্স – বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব: কী ও কেন, হারুন-অর-রশিদ