You dont have javascript enabled! Please enable it! সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচির সাথে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাক্ষাৎকার - সংগ্রামের নোটবুক

সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচির সাথে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাক্ষাৎকার

চমকে দেয়ার মতাে আমন্ত্রণ এসেছিল জুলফিকার আলী ভুট্টোর তরফ হতে এবং বুঝে উঠার কোন উপায় ছিল না। আমাকে বলা হলাে যত শীঘ্র সম্ভব আমাকে রাওয়ালপিণ্ডি যেতে হবে। অবাক হলাম, কেন? প্রত্যেকটা সাংবাদিক কমপক্ষে একবার তাদের দ্বারা আহূত হবার স্বপ্ন দেখে যাদেরকে তারা অনুসন্ধান করবে। সেই ব্যক্তিত্বগুলাে হারিয়ে যায় বা নেতিবাচক সাড়া দেয়। কিন্তু স্বপ্ন যুক্তিহীন এবং সন্দেহে তার পরিসমাপ্তি। ভুট্টো কেন আমার সাথে সাক্ষাত করতে চেয়েছেন। ইন্দিরা গান্ধীর জন্যে কি আমার কাছে বার্তা দিতে চান? ইন্দিরা গান্ধীকে শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির সাথে চিত্রিত করার কারণে আমাকে শাস্তি দেবেন? প্রথম ধারণা দ্রুত নাকচ করলাম। শত্রুর সাথে যােগাযােগ করার জন্য তার বাহকের প্রয়ােজন নেই-এজন্যে সুইস বা রুশ কূটনীতিক আছেন। দ্বিতীয় ধারণাও বাতিল করে দিলাম। শিক্ষিত ও ভদ্রলােক বলে ভুট্টোর সুনাম আছে। এ ধরনের লােকেরা সাধারণত তাদের আমন্ত্রিত অতিথিকে হত্যা করে না। আমার তৃতীয় অনুমানটা হলাে, তিনি হয়তাে চান আমি তার সাক্ষাতকার গ্রহণ করি। আমার হৃদয় চমৎকারিত্বে পূর্ণ হলাে। বাংলাদেশের হতভাগ্য প্রেসিডেন্ট মুজিবুর রহমান সম্পর্কে আমার নিবন্ধ পাঠের পরই ভুট্টোর মনে হয়তাে বিষয়টা উদয় হয়েছিল। আমার। সন্দেহের উপর বিজয়ী হলাে আমার অনুসন্ধিৎসা এবং আমি আমন্ত্রণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলাম। আমন্ত্রণ গ্রহণ করেও তাকে জানতে দিলাম যে, তার অতিথি হলেও আমি সবার ক্ষেত্রে যে স্বাধীন বিচার বিবেচনায় লিখি, এক্ষেত্রেও তার কোন হেরফের হবে না এবং যে কোন ধরনের সৌজন্যে বা তােষামুদে আমাকে কিনে ফেলা সম্ভব হবে না। ভুট্টো জবাব দিলেন : অবশ্যই, তাই হবে এবং মানুষটি সম্পর্কে আমার প্রথম ধারণা হলাে তাতেই।
এ মানুষটি সম্পর্কে পূর্ব ধারণা করা যায় না। অসম্ভব গােছের। নিজের মর্জিতে এবং অদ্ভুত সিদ্ধান্তে পরিচালিত হন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান। ধূর্ত, শিয়ালের মতাে বুদ্ধিমান। মানুষকে মুগ্ধ করতে, বিভ্রান্ত করতেই যেন তার জন্ম। সংস্কৃতি, স্মরণশক্তি ও ঔজ্জ্বল্য দ্বারা লালিত তিনি। শহুরে আভিজাত্য তার জন্মাবধি। রাওয়ালপিণ্ডি বিমানবন্দরে দু’জন সরকারী অফিসার আমাকে স্বাগত জানিয়ে অত্যন্ত আবেগের সাথে বললেন যে, প্রেসিডেন্ট আমাকে এক ঘণ্টার মধ্যে স্বাগত জানাবেন। তখন সকাল দশটা। গত আটচল্লিশ ঘণ্টা আমি বিদ্রি কাটিয়েছি। আমি প্রতিবাদ করলাম; না এক ঘণ্টার মধ্যে। নয়। আমার একটা ভালাে গােসল এবং সুনিদ্রা প্রয়ােজন। অন্য কারাে কাছে এটা খুব অপমানজনক মনে হতাে। তার কাছে নয়। তিনি সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত সাক্ষাত মুলতবি

পৃষ্ঠাঃ ৪০
রাখলেন এই বলে যে, রাতে আহারটা আমার সাথেই করবেন বলে আশা করছেন। বুদ্ধিমত্তার সাথে সৌজন্য যােগ হলে তা অবদমনের সেরা অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। এটা অনিবার্য যে তার সাথে সাক্ষাত আন্তরিকতাপূর্ণ হবে।
ভুট্টো আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন হাসি ছড়িয়ে খােলা হাত বাড়িয়ে। তিনি দীর্ঘ, মেদবহুল। তাকে দেখতে একজন ব্যাংকারের মতাে, যে কাউকে পেতে চায় তার ব্যাংক একাউন্ট খােলার জন্যে। চুয়াল্লিশ বছর বয়সের চেয়েও অধিক বয়স্ক মনে হয় তাকে। তার টাক পড়ছে এবং অবশিষ্ট চুল পাকা। ঘন ভুরুর নিচে তার মুখটা বিরাট। ভারি গাল, ভারি ঠোট ভারি চোখের পাতা। তার-দু’চোখে রহস্যজনক দুঃখময়তা। হাসিতে কিছু একটা লাজুকতা।
বহু ক্ষমতাধর নেতার মতাে লাজুকতায় তিনি দুর্বল ও পঙ্গু। তিনি আরাে অনেক কিছু ইন্দিরা গান্ধীর মতাে। সবারই নিজের মধ্যে দ্বন্দ্ব। যতই তাকে পাঠ করা হােক, ততই অনিশ্চিত হতে হবে। দ্বিধায় পড়তে হবে। একটু ঘুরালে ফিরালে প্রিজমে যেমন একই বস্তু বিভিন্ন রূপে দেখা যায়, তিনি সেরকম। অতএব তাকে বহুভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এবং তার প্রতিটিই যথার্থ উদার, কর্তৃত্ববাদী, ফ্যাসিস্ট, কম্যুনিস্ট, নিষ্ঠাবান ও মিথুক। নিঃসন্দেহে তিনি সমসাময়িককালের সবচেয়ে জটিল নেতাদের একজন এবং তার দেশে এযাবত জন্মগ্রহণকারী নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। শুধুই একজন। যে কেউ বলবে, ভুট্টোর কোন বিকল্প নেই। ভুট্টো মরলে পাকিস্তান মানচিত্র। হতে মুছে যাবে।
তার ব্যক্তিত্ব ইন্দিরা গান্ধীর চেয়ে বাদশাহ হােসেনকেই বেশি মনে করিয়ে দেবে। বাদশাহ হােসেনের মতাে তিনি কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট একটি দেশকে পরিচালনা করছেন বলে অভিযােগ উঠে। বাদশাহ হােসেনের মতাে তিনি মাটির পাত্র হিসেবে লৌহপাত্র দ্বারা, অর্থাৎ সােভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রের মতাে দেশ দ্বারা দলিত মথিত বাদশাহ হােসেনের মতাে তিনি আত্মসমর্পণ না করতে বা কোন কিছু ছেড়ে না দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কোন প্রতিরক্ষা ব্যুহ ছাড়াই বন্দী শিল্পীর মতাে সাহসিকতার সাথে তিনি সবকিছু প্রতিরােধ করেন। অন্যভাবে তাকে দেখে জন কেনেডির কথা মনে পড়বে। কেনেডির মতাে তিনি প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়েছেন, যে কারণে তার কাছে কিছুই অসম্ভব ছিল না। এমনকি রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বিজয় করাও নয়। এজন্যে ব্যয় যাই হােক না কেন। কেনেডির মতাে তার একটি স্বচ্ছন্দ, মধুর ও সুবিধাভােগের শৈশব ছিল। কেনেডির মতাে ক্ষমতার দিকে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল জীবনের প্রারম্ভেই।
অভিজাত জমিদার পরিবারে তার জন্ম। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া-বার্কেলিতে এবং পরে বৃটেনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশােনা করেন। তিনি ডিগ্রী নিয়েছেন আন্তর্জাতিক আইনে। ত্রিশ বছর বয়সের পরই তিনি আইয়ুব খানের একজন মন্ত্রী হন, যদিও পরে তাকে অপছন্দ করেন। যখন তার বয়স চল্লিশের কিছু কম তখন আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রীদের একজন ছিলেন।

পৃষ্ঠাঃ ৪১
বেদনাদায়ক ধৈর্যের সাথে তিনি প্রেসিডেন্টের পদ পর্যন্ত পৌঁছেন। কিছু সহযােগীর দ্বারা এ পর্যন্ত আরােহণকে তিনি নিষ্কণ্টক রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ক্ষমতা প্রেমের চেয়েও অনেক বেশি আবেগের বস্তু। যারা ক্ষমতা ভালােবাসে তাদের পেট শক্ত, নাকটা আরাে শক্ত। বদনামে তাদের কিছু আসে যায় না। ভুট্টোও বদনামের তােয়াক্কা করতেন না। তিনি ক্ষমতা ভালােবাসেন। এ ধরনের ক্ষমতার প্রকৃতি আন্দাজ করা শক্ত। ক্ষমতা যে তার কাছে কি তা বুঝা যায় না। যারা সত্য বলে। এবং বয়স্কাউট সুলভ নৈতিকতা প্রদর্শন করে এমন রাজনীতিবিদদের থেকে সতর্ক থাকার উপদেশ দেন তিনি। তার কথা শুনে এ বিশ্বাস হবে যে তার লক্ষ্য অত্যন্ত মহৎ এবং তিনি সত্যি সত্যি একনিষ্ঠ ও নিঃস্বার্থ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু করাচীতে তার সমৃদ্ধ জাকজমকপূর্ণ লাইব্রেরি দেখলেই বুঝা যাবে যে, মুসােলিনী ও হিটলার সম্পর্কিত গ্রন্থাবলী সম্মানের সাথে রূপালী বাঁধাই এ সমৃদ্ধ। যে যত্নের সাথে এগুলাে সংরক্ষিত তাতে উপলব্ধি করা সহজ যে এগুলাের উপস্থিতি শুধু গ্রন্থ সংগ্রাহকের আগ্রহের কারণেই নয়। সন্দেহ ও ক্রোধ দানা বেঁধে উঠবে। তাকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে, তার সত্যিকার বন্ধু ছিলেন সুকর্ণ ও নাসের-এই দুই ব্যক্তিই সম্ভবত সদিচ্ছা দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন, কিন্তু তারা উদারনৈতিক ছিলেন না। ভুট্টোর গােপন স্বপ্ন একনায়ক হওয়া। রূপালী বাঁধাই এর গ্রন্থগুলাে থেকেই তিনি কি একদিন তার জ্ঞান আহরণ করবেন? স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং বিরােধীদলের কোন রাজনৈতিক অর্থ কখনাে ছিল না-এমন একটি দেশ সম্পর্কে অজ্ঞ পাশ্চাত্যের লােকেরাই এ ধরনের প্রশ্ন করে থাকেন। এ সবের বদলে সে দেশে বিরাজ করেছে দারিদ্র্য, অবিচার এবং নিপীড়ন।
ভুট্টোর সঙ্গে সাক্ষাতকার সমাপ্ত হয়েছে ছয় দিনে পাঁচটি পৃথক বৈঠকে। তার অতিথি হিসেবে তার সাথে কয়েকটি প্রদেশও সফর করেছি এ সময়ে। পাঁচটি বৈঠকে আলাপের সূত্রও হয়েছে কিছুটা বিচ্ছিন্ন। প্রথম সাক্ষাতকার বৈঠক হয় রাওয়ালপিণ্ডিতে, আমার উপস্থিতির দিন সন্ধ্যায়। দ্বিতীয় আলােচনা লাহােরের পথে বিমানে। তৃতীয় বৈঠক সিন্ধুর হালা শহরে। চতুর্থ এবং পঞ্চম বৈঠক করাচীতে। আমি সবসময় তার পাশে বসেছি, টেবিলেই হােক আর যাত্রাপথেই হােক এবং চাইলে আমি তার একটা চিত্রও আঁকতে পারতাম। ভুট্টোকে অধিকাংশ সময়ই দেখেছি পাকিস্তানী পােশাকে, হালকা সবুজ জামা এবং স্যাণ্ডেল পায়ে। সমাবেশে বক্তৃতার সময় মাইক্রোফোনের সামনে তিনি কর্কশভাবে চিৎকার করেন, প্রথমে উর্দু পরে সিন্ধীতে। বক্তৃতার সময় দু’হাত আকাশে ছুঁড়তে থাকেন। সবকিছুর মাঝে প্রকাশ করেন তার কর্তৃত্ব। হালার জনসমাবেশে অসংখ্য লােক যখন তার কথা শােনার জন্য অপেক্ষা করছে, শহরের। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গও সেখানে। কিন্তু তিনি কক্ষে বসে লিখছেন। যখন সভাস্থলে পৌঁছলেন তখন রাত। কার্পেটের উপর দিয়ে রাজপুত্রের মতাে পা ফেলে তিনি এগিয়ে মঞ্চে উঠলেন। রাজপুত্রের মতই আসন গ্রহণ করলেন এবং আমিও তার পাশে বসলাম-বেশ কিছু গোঁফওয়ালা লােকের পাশে আমিই একমাত্র মহিলা, যেন সুপরিকল্পিত একটা প্ররােচনা। আসনে বসে তিনি দলের নেতাদের, অভ্যর্থনা জানালেন। সবশেষে একজন

পৃষ্ঠাঃ৪২
দরিদ্র লােক, তার সাথে নিয়ে এলাে রঙ্গিন কাপড় ও মালায় সজ্জিত একটি বকরী। এটি তার সম্মানে কোরবানি করা হবে।
ইনিই হচ্ছেন আভিজাত্যের প্রতীক জুলফিকার আলী ভুট্টো। মুসলমান ভূট্টো, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি যাকে মৌলিকভাবে বদলাতে পারেনি। এটা কোন দুর্ঘটনা নয় যে, তার স্ত্রী দু’জন। অথবা ভুট্টো যখন সামরিক হেলিকপ্টারে উঠে কোথাও যান, তখন তার মাথায় একটা ক্যাপ থাকে-চৌ এন লাইএর দেয়া। চৌ এন লাই তার দীক্ষাগুরু। যখন উড়ে যান তখন উপর থেকে শুষ্ক অনাবাদী জমি দেখে, প্রাগৈতিহাসিক আমলের মতাে মাটির কুড়েতে কৃষকের আবাস দেখে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। এসব দেখে। তার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়, তিনি স্বগতােক্তি করেন, “আমাকে সফল হতেই হবে।” ইনি মার্কসবাদী ভুট্টো, যিনি পাকিস্তানকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধার পীড়ন হতে মুক্তি দিতে সচেষ্ট। সবশেষে ভুট্টো আমাকে তার করাচী ও রাওয়ালপিণ্ডির বাড়িতে আমন্ত্রণ করে তার। অবস্থানের পক্ষে যুক্তিগুলাে প্রদর্শন করেন-ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানকে কঠোরভাবে আক্রমণ করে। তার বাড়িগুলাে রুচিশীল সাজে সজ্জিত-প্রাচীন ইরানী গালিচা, মূল্যবান ধাতব পাত্রের সমাহার। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়ির প্রাচীরে তার সবচেয়ে ক্ষমতাধর আন্তর্জাতিক সহকর্মীদের উদ্ধৃতি সম্বলিত ফটোগ্রাফ। শুরু হয়েছে। মাও সে তুং দিয়ে। নৈশাহারের সময় আমরা মদপান করলাম। সম্ভবত ক্যাভিয়ার। উপস্থিত ছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী নুসরাত, সুন্দরী এবং ভদ্র আচরণ তার। পরে এলাে তার ছেলে। দীর্ঘ চুলবিশিষ্ট প্রাণবন্ত ছােট্ট বালক। এখন ভুট্টো আধুনিক, ধােপদুরন্ত, ইউরােপীয় কেতায়। ভুট্টো তুখােড় বক্তা, গ্রন্থ রচয়িতা, যিনি ইংরেজী জানেন উর্দুর চেয়েও ভালাে এবং পাশ্চাত্যের যে কোন লােককে আকৃষ্ট করার মতাে।
ভুট্টোর সাথে সাক্ষাতকার কেমন এলােমেলাে হয়ে গেল। ঠিক যেমনটা হয়েছিল কিসিঞ্জারের সাক্ষাতকারে-সাংবাদিকতার দৃষ্টিতে মানােত্তীর্ণ নয়, কিন্তু কূটনৈতিক চাতুর্যে পরিপূর্ণ ও আন্তর্জাতিক ধাচের। ইন্দিরা গান্ধী যে তাকে ভারসাম্যহীন লােক বলেছেন তা পাঠ করে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। অতএব ইন্দিরাও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। যখন তিনি পাঠ করলেন যে ভুট্টো তাকে একজন নগণ্য মহিলা, যার বৃদ্ধিশুদ্ধিও অতি সাধারণ, উদ্যোগে ও কল্পনাশক্তি শূন্য এবং যে তার পিতার অর্ধেক মেধাও পায়নি-বলে উল্লেখ করেছেন। ভুট্টো তার সাথে সাক্ষাতের ও হাত মিলানাের ধারণাকে বিরক্তিকর বলে মনে করেন। বলা নিপ্রয়ােজন যে, ইন্দিরারও ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তাকে মূল্যায়ন করতে ভুট্টো ঘৃণাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। আমি নিজেও ভুট্টোর এ ধরনের মন্তব্যে অস্বস্তি বােধ করেছিলাম এবং ভুট্টোকে নিবৃত্ত করতেও চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ভুট্টো আমার পরামর্শ নেননি এবং পরিবর্তে আরাে আপত্তিকর মন্তব্য যােগ করেছেন, যা আমি প্রকাশ করিনি এবং আমার নিজের এই সেন্সরশীপে খুব ভালাে ফল হয়নি। ফলটা ছিল নাটকীয়, বরং বলা যায় হাস্যকর। পরিণতিটা আমারই সৃষ্ট।

পৃষ্ঠাঃ ৪৩
ভুট্টো ও ইন্দিরা গান্ধীর তখন সাক্ষাত হওয়ার কথা, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য। নয়াদিল্লীর সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বিশেষ কিছু বাক্যে তিনি সতর্ক হয়ে আমাকে অনুরােধ জানালেন সাক্ষাতকারের পুরােটা তার কাছে পাঠাতে এবং আমি রােম থেকে টেলিগ্রামে তা পাঠালাম। সেটা পাঠ করে তিনি ঘােষণা করলেন যে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার বৈঠকটি হবে না। ভুট্টো হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে আমাকে খুঁজতে লাগলেন। অবশেষে তার ইতালিস্থ রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে সন্ধান পেলেন আদ্দিস আবাবায়। সেখানে আমি গিয়েছি হাইলে সেলসির সাক্ষাতকারের জন্য। আমাকে সবচেয়ে আপত্তিকর অনুরােধটাই করা হলাে।
হ্যা, আমাকে লিখতেই হবে। ভুট্টো আমাকে দ্বিতীয় একটা রিপাের্ট লিখতে বলেছিলেন, যাতে আমি লিখি যে, ভুট্টোর সাথে কখনােই সাক্ষাতকার নেয়া হয়নি, বরং আমি এ ধরনের কল্পনা করেছিলাম। আমাকে বলতে হবে, ইন্দিরা গান্ধীর সম্পর্কে মন্তব্য আসলে ভুট্টোর নয়, আমারই কল্পনা এবং আমি ভেবেছিলাম, ভুট্টো এরকমই বলতে পারেন। প্রথমে আমি বুঝতেই পারিনি ব্যাপার কি। “আপনি কি বলছেন মিঃ অ্যামব্যাসেডর?” “আমি বলছি”, “আপনার লিখা উচিত যে, আপনি নিজে এসব উদ্ভাবন করেছেন, বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কিত অংশটুকু।” আপনি কি পাগল, মি. অ্যামব্যাসেডর? আপনার প্রধানমন্ত্রীও কি পাগল হয়ে গেছেন?” “মিস ফ্যালাচি, আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন। ষাট কোটি মানুষের জীবন নির্ভর করছে আপনার উপর, তারা আপনার হাতে।” আমি তাকে জাহান্নামে যাওয়ার অভিশাপ দিলাম। কিন্তু ভুট্টো হাল ছেড়ে না দিয়ে আমাকে খুঁজছিলেন। যেখানেই আমি গেছি সেখানেই একজন গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানী আমাকে অনুরােধ করেছে সাক্ষাতকারটা অস্বীকার করতে। বারবার তারা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে ষাট কোটি মানুষ আমার হাতে। হতাশ হয়ে আমি উত্তর দিয়েছি যে ষাট কোটি মানুষকে ধারণ করার পক্ষে আমার হাত দুটো খুবই ছােট। আমি চিৎকার করে বলেছি যে, তাদের দাবি অসম্ভব এবং অপমানজনক। এ দুঃস্বপ্নের অবসান তখনই ঘটলাে যখন ইন্দিরা গান্ধী মহানুভবতার সাথে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, ভুট্টোর এ ধরনের ভুল আর ঘটবে না এবং তারা উভয়ে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করলেন।
যখন তারা হাত মিলালেন ও হাসি বিনিময় করলেন, টেলিভিশনে তা দেখে আমার খুব মজা লাগছিল। ইন্দিরার হাসি ছিল বিজয়ের। ভুট্টোর হাসিতে অস্বস্তি।
জুলফিকার আলী ভুট্টো : আমার অবশ্যই বলা উচিত, কেন আমি আপনার সাথে সাক্ষাতের জন্য আকাক্ষিত ছিলাম। কারণ, আপনি একজন সাংবাদিক যিনি শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে সত্যটা লিখেছেন। আপনার লেখাটা আমি দারুণ উপভােগ। করেছি। তাছাড়া…….দেখুন, মার্চ মাসে ঢাকায় অত্যাচারের ব্যাপারে আমার কিছু করার ছিল, এটা খুব সুখপাঠ্য ছিল না।
ওরিয়ানা ফালাচি : কিছু করার ছিল মানে? মি. প্রেসিডেন্ট, ঢাকায় তারা সরাসরি বলছে যে, আপনিই ধ্বংসযজ্ঞটা চেয়েছিলেন। আপনি মুজিবের গ্রেফতার চেয়েছিলেন এবং সেজন্যেই আপনি ২৬শে মার্চ সকাল পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন।

পৃষ্ঠাঃ ৪৪
জু আ ভু: হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের উঁচু তলায় আমার স্যুটের জানালা পথে ধ্বংসের দৃশ্য দেখা, হুইস্কি পান এবং সম্ভবত নিরাের মতাে বাঁশী বাজাতে। কিন্তু তারা কোন সাহসে একটি বর্বরােচিত ঘটনার সাথে আমাকে জড়াতে চায়, পুরাে ঘটনাটা পরিচালিত হয়েছিল এক জঘন্য উপায়ে। তারা সকল নেতাকে নিরাপদে ভারতে পালিয়ে যেতে দিয়ে যাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে তারা কোন কিছুর জন্য দায়ী নয়। শুধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। একটু ভেবে দেখুন। আমি হলে আরাে একটু চাতুর্যের সাথে কাজটা সম্পন্ন করতাম, আরাে বৈজ্ঞানিকভাবে এবং কম নিষ্ঠুরতায়। টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ব্যবহার করতাম এবং সকল নেতাই গ্রেফতার হতাে। কেবল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মতাে একটি বিরক্তিকর মাতালের পক্ষে এত জঘন্যভাবে এবং রক্তপাত ঘটিয়ে এ ধরনের অপারেশন ঘটানাে সম্ভব।
সে যাই হােক, এ ধরনের উন্মত্ততা হােক, এটা চাওয়ার পিছনে আমার কি স্বার্থ থাকতে পারে? আপনি কি জানেন যে, ইয়াহিয়া খানের প্রথম শিকার শেখ মুজিব না হয়ে আমার হওয়ার কথা ছিল? আমার পার্টির বহু লােক জেলে ছিল এবং ১৯৭০ সালের শেষদিকে, হ্যা, ১৯৭০ এর ৫ই নভেম্বর তিনি শেখ মুজিবকে বলেছিলেন, “আমি ভুট্টোকে গ্রেফতার করবাে কি করবাে না?” একটি মাত্র কারণে তিনি তার সিদ্ধান্ত বদলেছেন তাহলাে, পূর্ব পাকিস্তানে যেভাবে তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানে তা পারতেন না। এছাড়া মুজিব কখনােই বুদ্ধিমান ছিলাে না। সে নিজেকে কোণঠাসা করে রেখেছিল। ২৫শে মার্চের দুঃখজনক ঘটনায় আমি হতভম্ব হয়েছিলাম। ইয়াহিয়া খান আমাকেও বােকা বানিয়ে ছেড়েছিল। পরের দিনের জন্য তিনি আমাকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিলেন এবং দিন শেষে জেনারেল মােহাম্মদ ওমর আমাকে জানালেন যে, ইয়াহিয়া খান চেয়েছিলেন আমি যাতে ঢাকায় অবস্থান। করে সেনাবাহিনীর দক্ষতা প্রত্যক্ষ করি। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, এর সব কথাই সত্যি।
ও ফা: অল রাইট মি. প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আমার অবাক লাগে যে, সেই ভয়াবহ রাতে এবং পরবর্তী মাসগুলােতে আসলে কি ঘটেছিল ইতিহাস কখনাে তার সঠিক ব্যাখ্যা দেবে কি না? শেখ মুজিবুর রহমান…….।
জু আ ভু: মুজিবকে তাে আপনি দেখেছেন, আজন্ম মিথুক। মিথ্যা ছাড়া কথাই বলতে পারে না….এই অভ্যাসটা তার নিজের থেকেও শক্তিশালী। মর্জি হলে মুজিব ঢালাওভাবে কথা বলে। যেমন, সে বলে ত্রিশ লাখ মানুষ মরেছে। সে পাগল, বদ্ধ পাগল। ওরা সবাই পাগল। সংবাদপত্রগুলাে আবার তার কথা পুনঃপ্রচার করে “ত্রিশ লাখ নিহত, ত্রিশ লাখ নিহত।” ভারতীয়রা সংখ্যাটা বলেছিল দশ লাখ। সে এটাকে দ্বিগুণ, এরপর তিনগুণ করলাে। এই হলাে লােকটির বৈশিষ্ট্য। জলােচ্ছ্বাসের সময় সে একই কাণ্ড করেছে। শুনুন, ভারতীয় সাংবাদিকদের মতে সে রাতে মারা পড়েছিল ৬০ থেকে ৭০ হাজার মানুষ। মিশনারিরা বলেছিল ত্রিশ হাজার। আমার পক্ষে যেভাবে সম্ভব হয়েছে সে বিচারে মৃতের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের মতাে। এটা অনেক বেশি,

পৃষ্ঠাঃ ৪৫
নৈতিকভাবে যদি কাজটা সমর্থনযােগ্যও হয়। আমি সংখ্যা কমাতে চাইনা, আমি তাদেরকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে চাই-পঞ্চাশ হাজার ও ত্রিশ লাখের মধ্যে বিরাট পার্থক্য।
শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে। মিসেস গান্ধী বলেন এক কোটি লােক। এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, তিনি তার প্রতিরােধের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অভিযান চালানাের জন্য তিনি এই সংখ্যা দিয়ে শুরু করেছিলেন। কিন্তু আমরা যখন বিষয়টা তদন্ত করার জন্য জাতিসংঘকে আমন্ত্রণ জানালাম, ভারতীয়রা। তার বিরােধিতা করলাে। কেন তারা বিরােধিতা করেছিল? সংখ্যাটা যদি সঠিকই হতাে, তাহলে তাে তদন্তের প্রশ্নে তাদের ভীত হওয়ার কথা নয়। ঘটনাটা হলাে, আসলে এক কোটি নয়, বিশ লাখ লােক গিয়েছিল। নিহতের সংখ্যা বলায় আমার ভুলও হতে পারে, কিন্তু শরণার্থীদের সংখ্যার ক্ষেত্রে নয়। আমরা জানি কে দেশ ত্যাগ করেছিল। বহু বাঙালী ছিল পশ্চিমবঙ্গের। ইন্দিরা গান্ধী তাদের পাঠিয়েছিলেন। বাঙালীরা যেহেতু দেখতে একই রকম, সুতরাং কে তাদের চিনবে?।
আরেকটা প্রসঙ্গ বলি, মহিলারা ধর্ষিতা ও নিহত হয়েছে। আমি এটা বিশ্বাস করি না। এটা তাে নিশ্চিত যে, বাড়াবাড়ির কোন কমতি ছিল না। কিন্তু জেনারেল টিক্কা খান বলেছেন যে, ঐ দিনগুলােতে তিনি জনগণকে আহ্বান করেছেন দুর্ব্যবহার সম্পর্কে সরাসরি তার কাছে রিপাের্ট করতে। তার এই আবেদন, লাউড স্পীকারে প্রচার করা হয়েছে এবং তার কাছে মাত্র চারটি ঘটনা রিপাের্ট করা হয়েছে। এটাকে কি আমরা দশ দিয়ে পূরণ করে চল্লিশ করতে পারি? মুজিব এবং গান্ধীর ছড়ানাে সংখ্যা থেকে আমরা এখনাে দূরে।
ও ফা: না মি. প্রেসিডেন্ট। ওটাকে হাজারের সাথে পূরণ করুন, এমন কি দশ হাজারের সাথেও পূরণ করতে পারেন, তাহলে আপনি সঠিক সংখ্যার কাছাকাছি আসবেন। মুজিবের ত্রিশ লক্ষ যদি ঢালাও বর্ণনা হয়, তাহলে টিক্কা খানের মাত্র চারটি ঘটনার বর্ণনা রীতিমতাে ফাজলামাে। চরম নারকীয়তা সংঘটিত হয়েছে। বলবেন কিভাবে? আমি এমন একজন আপনার সাথে কথা বলছি যে ঢাকায় বহু মৃতদেহ দেখেছে। আপনি কি একটা কথা বলেছেন, ‘নৈতিকভাবে সমর্থনযােগ্য, অথবা সমর্থিত? আমি কি ঠিক ধরতে পেরেছি? আপনি কি যথার্থই বুঝাতে চাচ্ছেন যে, এই ধ্বংসযজ্ঞটা নৈতিক দিক হতে সঠিক ছিল?
জু আ ভু: প্রত্যেক সরকারের, প্রত্যেক দেশের অধিকার রয়েছে প্রয়ােজন হলে বল প্রয়ােগ করার। যেমন, ঐক্যের নামে। ধ্বংস ছাড়া আপনি সৃষ্টি করতে পারেন না। দেশ গড়ার স্বার্থে স্টালিন শক্তি প্রয়ােগ ও হত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মাও সে তুংও বলপ্রয়ােগ ও হত্যা করেছেন বাধ্য হয়ে। বিশ্বের পুরাে ইতিহাস তুলে না ধরে সাম্প্রতিক কালের দুটো ঘটনাই উল্লেখ করলাম। হ্যা, এখন কোথায় রক্তপাত ঘটিয়ে দমন করা হবে এবং তা সমর্থনযােগ্য হবে কি হবে না সেটাই বিচার্য। মার্চ মাসে

পৃষ্ঠাঃ ৪৬
পাকিস্তানের ঐক্য নির্ভর করছিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নির্মূল করার উপর। কিন্তু যারা এর জন্য দায়ী তাদের বদলে জনগণের উপর এ ধরনের নিষ্ঠুরতা চালানাের কোন প্রয়ােজন। ছিল না। যে নিরীহ লােকদের বলা হয়েছিল যে, ছয় দফা আদায় হলেই আর কোন জলােচ্ছ্বাস হবে না, আর কোন বন্যা হবে না, খাদ্যাভাব হবে না-তাদেরকে বুঝানাের পন্থা এই নিষ্ঠুরতা নয়। আমি কঠোরভাবে এই পন্থা গ্রহণের বিরােধিতা করেছি-বিশেষ করে যখন কেউ মুখ খুলতে সাহস করেনি।
ও ফা: তবু আপনিই টিক্কা খানকে সেনাবাহিনীর প্রধান নিয়ােগ করেছেন-যে জেনারেল এই ধ্বংসযজ্ঞের নির্দেশ দিয়েছিল, তাই না?
জু আ ভু: টিক্কা খান একজন সৈনিক হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিলেন সুনির্দিষ্ট নির্দেশ নিয়ে এবং ফিরেও এসেছেন সেই নির্দিষ্ট আদেশে। তাকে যা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তিনি তাই করেছেন, যদিও সবকিছুতে তার সম্মতি ছিল না। আমি তাকে নিয়ােগ করেছি, কারণ আমি জানি যে তিনি একই ধরনের শৃঙ্খলার সাথে আমার নির্দেশও পালন করবেন এবং তিনি কখনাে রাজনীতিতে নাক গলাবার চেষ্টা করবেন না। আমি গােটা সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে পারি না। তাছাড়া ঢাকার ঘটনা নিয়ে তার বদনাম আসলে অতিরঞ্জিত। এ ঘটনার জন্য একজনই কেবল দায়ী-ইয়াহিয়া খান। তিনি এবং তার উপদেষ্টারা ক্ষমতা নিয়ে এতই মদমত্ত ছিলেন যে, সেনাবাহিনীর মর্যাদার কথাও বিস্মৃত হয়েছিলেন। তারা সুন্দর গাড়ি সংগ্রহ, বাড়ি তৈরি, ব্যাংকারদের সাথে বন্ধুত্ব করা, বিদেশে অর্থ পাচার করা ছাড়া আর কিছু ভাবার সুযােগ পাননি। ইয়াহিয়া খান দেশের সরকার সম্পর্কে উৎসাহী ছিলেন না। নিজের জন্য ক্ষমতা ছাড়া আর কিছুতে তার আগ্রহ ছিল না। ঘুম থেকে উঠেই যিনি মদপান শুরু করেন এবং ঘুমাতে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মদপান বন্ধ করেন না। এ ধরনের একজন নেতা সম্পর্কে কি আর বলা যেতে পারে। তার সাথে কিছু করা যে কি বেদনাদায়ক, সে ধারণাও করতে পারবেন না। তিনি হচ্ছেন জ্যাক দ্য রিপার।
ও ফা: ইয়াহিয়া খান এখন কোথায়? তার ব্যাপারে আপনার কি সিদ্ধান্ত?
জু আ ভু: রাওয়ালপিণ্ডির কাছে এক বাংলােতে তিনি গৃহবন্দী। হ্যা, বাংলােটা সরকারী। তাকে নিয়ে আমার বেশ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনাটার দায়দায়িত্ব অনুসন্ধান করার জন্য আমি একটা ওয়ার কমিশন গঠন করেছি। ফলাফল পাবার অপেক্ষা করছি এবং তাতে সিদ্ধান্ত নিতে আমার সুবিধা হবে। কমিশন যদি তাকে দোষী দেখে তাহলে তার বিচার হবে। আমরা যে পরাজিত হয়েছি, এ পরাজয় ইয়াহিয়া খানের-মিসেস গান্ধী যদি সত্যিই যুদ্ধ জয় করে থাকেন, তাহলে প্রথমেই তাকে ধন্যবাদ। দেয়া উচিত ইয়াহিয়া খান ও মূর্খ তােষামােদকারীদেরকে। এমনকি তাকে কিছু। বুঝানােও মুশকিল-শুধু আপনার মেজাজ খারাপ হবে।
ঢাকার ঘটনার পর এপ্রিল মাসে তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাকে সন্তুষ্ট মনে হচ্ছিল। নিজের উপর আস্থাশীল, পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে। তিনি আমাকে মদপান

পৃষ্ঠাঃ ৪৭
করতে দিলেন। বললেন, “আপনারা রাজনীতিবিদরা আসলেই শেষ হয়ে গেছেন।” এরপর বললেন যে, শুধু মুজিবই নয়, আমাকেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বিবেচনা করা হয়েছে। আমিও নাকি পাকিস্তানের ঐক্যের বিরুদ্ধে একজন প্রবক্তা ছিলাম। “আপনাকে গ্রেফতার করার জন্য সবসময় চাপের মধ্যে ছিলাম জনাব ভুট্টো।” আমি এতটা উত্তেজিত হয়েছিলাম যে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারিনি। উত্তর দিলাম যে, আমি কখনাে তার অনুসারী হবাে না। কারণ তার পথ দেশকে ধ্বংস করবে।
আমি হুইস্কির গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কক্ষ ত্যাগ করলাম। জেনারেল পীরজাদা আমাকে থামালেন, আমার হাত ধরলেন। “আসুন, শান্ত হােন, বসুন এবং আবার কথা বলুন।” আমি শান্ত হয়ে আবার ভিতরে গেলাম। তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে মুজিব ও আমার মধ্যে বিরাট একটা পার্থক্য রয়েছে। মুজিব একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী, আমি তা নই। নিষ্ফল প্রচেষ্টা। আমার কথা শােনার পরিবর্তে তিনি শুধু গ্লাসের পর গ্লাস মদপান করছিলেন।
ও ফা: প্রেসিডেন্ট আমরা কি একটু পিছনের দিকে ফিরে গিয়ে বুঝার চেষ্টা করতে পারি যে কিভাবে সেই ভয়াল মার্চের আগমন ঘটলাে-সেটা নৈতিকভাবে সমর্থন করা যায় কিনা?
জু আ ভু: ২৭শে জানুয়ারি মুজিবের সাথে আলােচনার জন্য ঢাকা যাই। আপনি যদি তার সাথে আলােচনা করতে চান, তাহলে আপনাকে ঢাকায় তীর্থযাত্রা করতে হবেকারণ তিনি কখনাে রাওয়ালপিণ্ডি আসতে সম্মত হননা। আমি গেলাম এমন এক পরিস্থিতিতে ঠিক যেদিন আমার বােনের স্বামী মারা গেছেন। লারকানায় আমাদের পারিবারিক গােরস্থানে তাকে দাফন করতে নেয়া হচ্ছিল। আমার বােন এতে খুবই মনক্ষুন্ন হয়েছেন। নির্বাচনে মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল এবং আমার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। কিন্তু তিনি দফার উপর খাড়া থাকতে চাচ্ছিলেন। ফলে আমাদেরকে একটা সমঝােতায় পৌছার চেষ্টা করতে হচ্ছিল। ইয়াহিয়া খানের দাবি ছিল চার মাসের মধ্যে আমাদেরকে সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। তা না হলে জাতীয় পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন নির্বাচন দেয়া হবে। মুজিবকে বুঝানাে, সে এক কঠিন কাজ। যার মাথায় ঘিলু নেই, তার কাছে তা আশাও করা যায়।
আমি যুক্তি দেখালাম, ব্যাখ্যা করলাম এবং তিনি একই সুরে বার বার বলছেন : “ছয় দফা, আপনি কি ছয় দফা মানেন?” প্রথম, দ্বিতীয় এমনকি তৃতীয় বারও আমি আলােচনা চালাতে প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু চতুর্থ বৈঠকে জোর করা হলাে যে, দুই প্রদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্যের বন্দোবস্ত তাদের স্ব স্ব পছন্দ অনুযায়ী স্থির করা হবে। তাহলে দেশের সার্বভৌমত্ব এবং ঐক্যের আর কি থাকে? তাছাড়া, এটা প্রায় জানাই ছিল যে, মুজিব পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করতে চায় এবং তিনি এজন্য ১৯৬৬ সাল থেকেই ভারতের সাথে সম্পর্ক রেখে আসছিলেন। ফলে জানুয়ারিতে আমাদের আলােচনা বাধাগ্রস্ত হলাে এবং মার্চে উপনীত হলাম।

পৃষ্ঠাঃ ৪৮
মার্চ মাসের মাঝামাঝি ইয়াহিয়া খান করাচীতে এলেন এবং আমাকে বললেন যে, তিনি ঢাকা যাচ্ছেন-আমি তার সাথে যেতে চাই কিনা? আমি তাকে জানালাম যে, মুজিব যদি আমার সাথে আলােচনায় সম্মত হয় তাহলে যেতে পারি। ইয়াহিয়া খান স্বয়ং একটি টেলিগ্রামে আমাকে ঢাকা থেকে জানালেন যে, মুজিব আমার সাথে কথা বলতে রাজি। ১৯শে মার্চ আমি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এবং ২১শে মার্চ মুজিবের সঙ্গে দেখা করলাম, ইয়াহিয়া খানও সাথে ছিলেন। অবাক হলাম, মুজিব অত্যন্ত শান্ত এবং খােশমেজাজে। তিনি বললেন, “মি. প্রেসিডেন্ট আমি আপনার সঙ্গে সমঝােতায় পৌছাতে এসেছি। ভুট্টোর সাথে আমার করার কিছু নেই। সাংবাদিকদের আমি বলবাে যে, প্রেসিডেন্টের সাথে আমি সাক্ষাত করেছি এবং ভুট্টো সাহেবও সেখানে ছিলেন,” তার কণ্ঠে আনুষ্ঠানিকতার সুর। ইয়াহিয়া খান বললেন “না, না, মুজিব সাহেব। আপনি আপনার নিজের কথাই বলবেন।” মুজিব শুরু করলেন, “জলােচ্ছ্বাসে অসংখ্য লোেক নিহত হয়েছে। অসংখ্য লােক।” এই হলাে লােকটির ধরন। হঠাৎ করে তার অসুস্থ মনে এমন একটি কথা বলে বসতেন, যার সাথে আসল কথার কোন সঙ্গতিই নেই। মতিভ্রষ্টের মতাে বলতেই থাকবেন। এক পর্যায়ে আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটলাে। আমি। কিভাবে জলােচ্ছ্বাসের জন্য দায়ী? আমি কি এমন একজন যে জলােচ্ছ্বাস পাঠিয়েছি? মুজিবের উত্তর ছিল-হঠাৎ উঠে দাঁড়ানাে এবং বলা যে, তাকে একজন মৃতের জানাযায় যেতে হবে।
ও ফা: বলুন মি: প্রেসিডেন্ট।
জু আ ভু: কথা হলাে, আপনি যখন মুজিবের প্রসঙ্গে বলবেন, সবকিছু অদ্ভুত মনে হবে। আমি বুঝি না কি করে বিশ্ব তাকে গুরুত্ব দিতে পারে। ভালাে কথা, আমি উঠে দাঁড়ালাম, বাইরের কক্ষ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে, যদিও তিনি তা চাচ্ছিলেন না। সে কক্ষে তিনজন ছিলেন, ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টা, মিলিটারি সেক্রেটারি এবং তার রাজনৈতিক কসাই; জেনারেল ওমর। মুজিব বলতে শুরু করলেন, “বাইরে যান, সবাই বাইরে যান। ভুট্টোর সাথে আমার কথা আছে। তারা তিনজন চলে গেলেন। তিনি বসে আমাকে বললেন, “ভাই, ভাই। আমাদেরকে একটা সমঝােতায় আসতে হবে। আল্লাহর দোহাই।” আমি রীতিমতাে বিস্মিত। তাকে বাইরে নিয়ে এলাম, যাতে কেউ তার কথা শুনতে না পায়। বাইরে এসে তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন যে, আমার অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তানটা নেয়া উচিত এবং তিনি পূর্ব পাকিস্তান নেবেন। আরাে বললেন যে, গােপন একটা বৈঠকের ব্যবস্থা তিনি করে ফেলেছেন। সন্ধ্যার পর তিনি আমাকে নিতে লোেক পাঠাবেন। আমি তাকে বললাম যে, তার এ ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই। আমি চোরের মতাে অন্ধকারে কলা গাছের নিচে সাক্ষাত করার জন্য ঢাকা আসিনি। আমি পাকিস্তানকে ভাঙ্গতে চাই না। তিনি যদি বিচ্ছিন্নতা চান তাহলে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর নির্ভর করে জাতীয় পরিষদে সে প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারেন। কিন্তু এ যেন প্রাচীরের কাছে কথা বলা। আমাদের মুখপাত্রদের মাধ্যমে আলােচনা পুনরায় শুরু করার ব্যাপারে আপােস হলাে। কিন্তু ফল কিছুই হলাে না।

পৃষ্ঠাঃ ৪৯
সেই দিনগুলােতে তিনি ক্ষ্যাপার মতাে ছিলেন, যে কোন ব্যাপারে তার মাথা গরম হতাে। এভাবে আমরা ২৫ শে মার্চে পৌছলাম।
ও ফা: ২৫ শে মার্চ আপনি কি সন্দেহ হওয়ার মতাে কিছু লক্ষ্য করেন নি?
জু আ ভুঃ আমি একটু অস্বস্তির ভাব অনুভব করেছি, অদ্ভুত একটা অনুভূতি। প্রত্যেক সন্ধ্যায় আমি ইয়াহিয়া খানের কাছে গিয়ে রিপাের্ট করতাম যে, আমার ও মুজিবের মধ্যে আলােচনায় কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। ইয়াহিয়া খান কোন আগ্রহ দেখাতেন না। বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, অথবা টেলিভিশন সম্পর্কে অভিযােগ করতেন অথবা ক্ষোভ প্রকাশ করতেন যে তার প্রিয় গানগুলাে শুনতে পাচ্ছেন নারাওয়ালপিণ্ডি থেকে রেকর্ডগুলাে এসে পৌঁছায়নি। ২৫শে মার্চ সকালে তিনি আমাকে। এমন কথা বললেন, যাতে আমি উদ্বিগ্ন হলাম: “আজ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাতের কোন প্রয়ােজন নেই। আগামীকাল আমরা তার সাথে দেখা করবাে। আপনি এবং আমি। তবু বললাম, “ঠিক আছে” এবং রাত আটটায় আমি মুজিবের দূতের কাছে সবকিছু বললাম এবং তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন, “ঐ কুত্তার বাচ্চাটা ইতিমধ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছে।” আমার বিশ্বাস হলাে না। প্রেসিডেন্টের বাসভবনে টেলিফোন করে বললাম যে, ইয়াহিয়ার সাথে কথা বলবাে। তারা আমাকে বললাে যে, তাকে ডিসটার্ব করা যাবে না। জেনারেল টিক্কা খানের সাথে তিনি নৈশভােজে বসেছেন। আমি টিক্কা খানকে ফোন করলাম। তারাও জানালাে যে তাকে ডিসটার্ব করা যাবে না। কারণ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তিনি নৈশাহারে বসেছেন। তখনই আমার উৎকণ্ঠা শুরু হলাে এবং নিশ্চয়ই কোন কৌশল বলে সন্দেহ হলাে। আমি রাতের খাবার খেতে গেলাম। এরপর ঘুমােতে। গুলির শব্দে এবং অন্যান্য কক্ষ হতে দৌড়ে আসা বন্ধুদের গােলযােগে আমার ঘুম ভাঙ্গলাে। দৌড়ে জানালার কাছে গেলাম, আল্লাহ আমার সাক্ষী, আমি কাঁদলাম। কেঁদে বললাম, “আমার দেশটা শেষ হয়ে গেল।”
ও ফা: কেন? আপনি জানালা দিয়ে কি দেখলেন?।
জু আ ভুঃ আমি কোন নির্বিচার হত্যাকাণ্ড দেখিনি। কিন্তু দেখলাম সৈন্যরা ‘পিপল’ অফিসটি ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করছে। বিরােধী দলীয় এই সংবাদপত্রটির অফিস ইন্টারকন্টিনেন্টালের ঠিক সামনেই ছিল। লাউড স্পীকারে সৈন্যরা লােকদের নির্দেশ দিচ্ছিল চলে যাওয়ার জন্য। যারা বাইরে বেরিয়ে এলাে, তাদের একপাশে দাঁড় করানাে হলাে মেশিন গানের মুখে। আরাে কিছু লােককে ফুটপাথের উপর দাঁড় করানাে হলাে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেল ঘিরে রেখেছে বেশ কিছু ট্যাংক। যে কেউ আশ্রয় লাভের জন্য ছুটাছুটি করছে তারা সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ছে। সকাল আটটায় জানতে পারলাম, মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমি খুশি হয়েছিলাম যে তিনি জীবিত আছেন এবং এটুকু ভাবনা হয়েছিল যে সৈন্যরা তার সাথে একটু দুর্ব্যবহারও করতে পারে। এরপর আমি ভাবলাম, তার গ্রেফতার আপসের একটা পথ বেরুতে পারে। তারা নিশ্চয়ই মুজিবকে একমাস বা দু’মাসের বেশি কারাগারে রাখবে না এবং এরই মধ্যে আমরা আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবাে।

পৃষ্ঠাঃ ৫০
ও ফা: মি: প্রেসিডেন্ট, শেখ মুজিব আপনাকে বলেছিলেন, “আপনি পশ্চিম পাকিস্তান নিন আর আমি পূর্ব পাকিস্তান নেই।” ফলটা শেষ পর্যন্ত তাই দাঁড়ালাে। এজন্যে কি আপনি তাকে ঘৃণা করেন?
জু আ ভু: মােটেও না। আমি ভারতীয় ধরনে অর্থাৎ ভণ্ডামি করে বলছিনা। আমি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথেই বলছি। ঘৃণার বদলে আমি তার জন্যে দারুণ আবেগ অনুভব করি। তিনি অযােগ্য, বিভ্রান্ত, অশিষ্ট, বােধহীন। কোন সমস্যা। নিস্পত্তির অবস্থায় তিনি ছিলেন না-তা রাজনৈতিক, সামাজিক অর্থনৈতিক বা আন্তর্জাতিক যে সমস্যাই হােক না কেন। তিনি শুধু জানেন, কি করে গলাবাজি করা যায়, কথার তুবড়ি ছুটানাে যায়। আমি তাকে চিনি সেই ১৯৫৪ সাল থেকে এবং আমি তাকে কখনাে গুরুত্ব দেইনি। শুরু থেকেই বুঝেছিলাম যে তার মধ্যে কোন গভীরতা নেই, প্রস্তুতি নেই, শুধু অগ্নিবর্ষণ করতে জানেন। কোন ধ্যানধারণা নেই তার। তার মাথায় একটি ধারণাই ছিল-বিচ্ছিন্নতা। এ ধরনের একজন লােককে দেখে শুধু করুণাই হয়।
১৯৬১ সালে ঢাকায় এক সফরে গিয়ে আবার তার সাথে সাক্ষাত হলাে। আমার হােটেলের লবিতে দেখেছিলাম। তার কাছে গিয়ে বললাম, “হ্যালাে মুজিব। চলুন এক কাপ চা খাওয়া যাক।” তখন সবেমাত্র জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন তিনি। তিক্ততায় পরিপূর্ণ এবং সেদিনই কেবল তার সাথে শান্তভাবে আলােচনা করা সম্ভব হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান কিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা শােষিত হচ্ছে, উপনিবেশের মতাে দেখা হচ্ছে, এখানকার রক্ত শুষে নেয়া হচ্ছে-কথাগুলাে সত্য। আমার একটা বইএ আমি এ কথাগুলােই লিখেছি। তিনি কোন উপসংহারে পৌছতে পারলেন না। তিনি ব্যাখ্যা করতে পারলেন না যে, ত্রুটিটা আসলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও শাসকগােষ্ঠীর মধ্যে। তিনি সমাজতন্ত্র ও সংগ্রামের কথা বলেননি। অপরদিকে তিনি বললেন, জনগণ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত নয় এবং কেউই সশস্ত্রবাহিনীর বিরােধিতা করে না। সশস্ত্রবাহিনীর পক্ষেই দেশে বিরাজমান অন্যায় অবিচার দূর করা সম্ভব। তার সাহস ছিল না-কোনদিনই ছিল না। তিনি কি আসলে সাংবাদিকদের মুখােমুখি হন-এই বাংলার বাঘটি?
ও ফা: তিনি একথাও বলেছেন যে, তার বিচারের সময় তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এবং গ্রেফতারের পর তার আচরণ ছিল বীরােচিত। তিনি এমন একটা সেলে ছিলেন, যেখানে ঘুমানাের জন্য একটা মাদুর পর্যন্ত ছিল না।
জু আ ভু: আসল কথা শুনুন। তিনি কোন সেলে ছিলেন না। তাকে রাখা হয়েছিল একটা অ্যাপার্টমেন্টে যেটা গুরুত্বপূর্ণ রাজবন্দীদের জন্যই ছিল। মিয়ানওয়ালীর কাছে লায়ালপুরের পাঞ্জাব জেলে। একথা সত্য, তাকে সংবাদপত্র পড়তে ও রেডিও শুনতে দেয়া হতাে না। কিন্তু পাঞ্জাবের গভর্নরের পুরাে লাইব্রেরিটাই তাকে দেওয়া হয়েছিল
এবং বাস্তবিকপক্ষে তিনি খুব ভালােভাবে ছিলেন। এক পর্যায়ে তারা তাকে একজন – বাঙালী বাবুর্চিও দিয়েছিল, কারণ তিনি বাঙালী খাবার খেতে চাইতেন। বিচারে তিনি

পৃষ্ঠাঃ ৫১
আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন এবং কিভাবে? তিনি তার পক্ষে দু’জন সেরা আইনবিদ চাইলেন; কামাল হােসেন ও এ কে ব্রোহী-তার আইন বিষয়ক উপদেষ্টা ও বন্ধু। কামাল হােসেন জেলে ছিলেন। ব্রোহী বাইরে। ব্রোহীকে পাওয়ার অর্থ সর্বোত্তমকে পাওয়া। আপনাকে আরাে কিছু কথা বলছি। প্রথমে ব্রোহী ব্যাপারটা হাতে নিতে চাননি। কিন্তু ইয়াহিয়া খান তাকে বাধ্য করলেন। তিনি চারজন আইনবিদ সহকারীকে নিয়ে বিচারে হাজির হলেন। রাষ্ট্র তাদের ফি দিয়েছে। এটাই স্বাভাবিক ছিল। ব্রোহীর একমাত্র। দোষ, বেশি কথা বলা, বাচালতা। সুতরাং লায়ালপুর থেকে করাচীতে ফিরে তিনি মুজিবের সাথে তার আলাপ আলােচনাগুলাে ব্যক্ত করে বলতেন যে, তাকে দোষী সাব্যস্ত করা কঠিন-মুজিব পাকিস্তানের ঐক্য এবং ইয়াহিয়া খানের প্রতি তার শ্রদ্ধার কথা অত্যন্ত নমনীয়ভাবে বলেন। মুজিব বারবার ইয়াহিয়া খানের উল্লেখ করেন, চমৎকার মানুষ, দেশপ্রেমিক এবং আমিই নাকি তার এ অবস্থার জন্য দায়ী। জেনারেল পীরজাদাও আমার সম্পর্কে মুজিবের একই বক্তব্যের কথা বলেছেন। পীরজাদাকে আমি বলেছি, “তাকে আমার কাছে দিয়ে দেখুন, তিনি আমাকে চমৎকার মানুষ ও দেশপ্রেমিক বলবেন এবং আপনাকে অপমান করবেন।”
ও ফা: কিন্তু বিচারে তিনি অভিযুক্ত হয়েছিলেন এবং তার সাজা হয়েছিল।
জু আ ভু: না। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তাকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং তখন থেকে সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে সম্পূর্ণ ইয়াহিয়া খানের এখতিয়ারে ছিল তার সাজার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টি। এই শাস্তি পাঁচ বছর বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা মৃত্যুদণ্ডও হতে পারতাে। কিন্তু ইয়াহিয়া কোন সিদ্ধান্তই নিলেন না। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল এবং তার মনে আরাে অনেক কিছু ছিল।
ও ফা: মুজিব আমাকে বলেছিলেন যে, তারা তার কবর খুঁড়েছিল।
জু আ ভু: আপনি জানেন সেই কবরটা কি ছিল? এয়ার রেইড শেলটার। তারা কারাগারের চারপাশের প্রাচীর ঘেঁষে খুড়েছিল। বেচারী মুজিব। ভীত হয়ে সবকিছুর মধ্যে মৃত্যুর নিশানা দেখেছে। কিন্তু আমি মনে করি না যে ইয়াহিয়া তাকে হত্যা করার কথা ভাবছিলেন। ২৭শে ডিসেম্বর আমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করে ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাত করলাম। তিনি উন্মত্ত, মাতাল। তাকে দেখতে মনে হচ্ছিল ডােরিয়ান গ্রে’র পােট্রেট। আমাকে বললেন, “আমার জীবনের সবচেয়ে মারাত্মক ভুল ছিল মুজিবুর রহমানকে মৃত্যুদণ্ড না দেয়া। আপনি মনে করলে তা করতে পারেন।”
ও ফা: আপনি কি বললেন?
জু আ ভুঃ আমি বললাম যে, আমি তা করবাে না এবং অনেক ভেবেচিন্তে, আমি মুজিবকে মুক্তি দিতেই প্রস্তুত হলাম। সেনাবাহিনীর কথিত বর্বরতার কারণে সকলের দ্বারা নিন্দিত পাকিস্তানের জন্য কিছু সহানুভূতির প্রয়ােজন হয়ে পড়েছিল। ভাবলাম

পৃষ্ঠাঃ ৫২
ক্ষমাশীলতায় অনেক সহানুভূতি পাওয়া যাবে। এছাড়া আমি ভাবলাম যে এই উদারতায় যুদ্ধবন্দীদের ফিরিয়ে আনার কাজ ত্বরান্বিত হবে। অতএব বিলম্ব না করে লায়ালপুরে নির্দেশ পাঠালাম মুজিবকে রাওয়ালপিণ্ডিতে আমার কাছে নিয়ে আসতে। নির্দেশটা সেখানে পৌছলে মুজিব আতঙ্কিত হয়ে পড়লাে। জড়ানাে কথায় তিনি বলতে চাচ্ছিলেন যে তারা তাকে এখান থেকে বের করে মেরে ফেলবে। সফরের সময়টাতেও তিনি সুস্থির ছিলেন না, এমনকি তার জন্য নির্দিষ্ট বাংলােতে এলেও একই অবস্থা। গুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের জন্য চমৎকার বাংলাে। আমি যখন একটি রেডিও, একটি টেলিভিশন এবং বেশ কিছু কাপড় চোপড় নিয়ে সেখানে গেলাম তিনি অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে বললেন, “আপনি এখানে কি করছেন?” আমি তাকে বিস্তারিত বললাম যে, আমি প্রেসিডেন্ট হয়েছি। তার সুর পাল্টে গেল সাথে সাথে। দু’হাত আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললেন যে তার জীবনে এর চেয়ে আনন্দের কোন খবর নেই। আল্লাহ সবসময় আমাকে পাঠাচ্ছেন তাকে রক্ষা করার জন্য….। এরপরই আমি যা ভেবেছিলাম, তিনি ইয়াহিয়া খানকে আক্রমণ করে আমাকে বললেন যে, আমি তার মুক্তির বিষয় বিবেচনা করতে পারি কিনা। লণ্ডন হয়ে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার পূর্বে আমি আরাে দু’বার তার সাথে সাক্ষাত করেছি। দু’বারই তিনি কোরান শরীফ বের করে কোরান স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করেছেন যে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করবেন। ভাের তিনটায় আমি যখন তাকে বিদায় জানাই তখনাে বিমানে তিনি এই প্রতিজ্ঞা করেছেন। প্রতিজ্ঞার সাথে আমার বুকে বুক মিলালেন, আমাকে ধন্যবাদ জানালেন এবং বললেন, “চিন্তা করবেন না মি. প্রেসিডেন্ট, আমি শীঘ্রই ফিরে আসবাে। আপনার সুন্দর দেশকে আমি আরাে ভালােভাবে জানতে চাই। আপনার সাথে শীঘ্র আমার দেখা হবে, খুব শীঘ্র।”
ও ফা: তাকে মুক্তি দিয়ে আপনি কি কখনাে অনুতাপ করেছেন?
জু আ ভু: না, কখনাে না। তিনি যাই বলুন না কেন, আমার মতাে তিনিও একজন পাকিস্তানী। একাধিকবার আমরা একই অভিযােগে অভিযুক্ত হয়েছি, একই শাস্তি লাভ করেছি-কিন্তু সবকিছুর উর্ধ্বে আমাদের একটা বন্ধন রয়েছে। জানুয়ারির একটি দিনে আমি তাকে যেমন দেখেছি সেভাবে তাকে সব সময় স্মরণ করি, তিনি আমার হাত ধরে অনুনয় করেছেন, “আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান।” তার জন্যে আমি আসলেই করুণা অনুভব করি। বেচারি মুজিব-বেশিদিন পারবে না। আট মাস, বড়জোর এক বছর-এরপরই তাকে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি হজম করতে হবে, যা তার নিজেরই সৃষ্টি। আপনিই দেখুন, বাংলাদেশ এখন ভারতের একটি স্যাটেলাইট। শীঘ্রই এটা সােভিয়েত ইউনিয়নের স্যাটেলাইট হবে। কিন্তু শেখ মুজিব কমিউনিস্ট নন। তিনি যদি গুছিয়ে উঠতে পারেন তাহলে তাে কথা নেই, কিন্তু পারবেন বলে মনে হয় না। সে অবস্থায় তার পিঠের উপরে দেখবেন মাওবাদীদের, যারা যুদ্ধের আসল বিজয়ী। এখনই তারা তার বােঝা হয়ে আছে।

পৃষ্ঠাঃ ৫৩
রাজনৈতিকভাবে মুক্তিবাহিনী হিসেবের বাইরে। তাদের না আছে কোন আদর্শিক প্রস্তুতি, না আদর্শনিষ্ঠা অথবা শৃঙ্খলা। সামাজিকভাবে তারা গােলযােগের উৎস-তারা কেবল জানে কিভাবে শূন্যে গুলি করতে হয়। মানুষকে আতঙ্কিত করে, চুরি করে, ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তােলে। জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে কারাে পক্ষে একটি দেশ চালানাে সম্ভব নয়। অপরদিকে বাঙালী মাওবাদীরা…. যদিও তারা খুব প্রশিক্ষিত নয়-তবু মাও এর লাল বই এর অর্ধেক পাঠ করেছে। কিন্তু তারা সুস্পষ্ট একটি শক্তি এবং ভারতীয়রা তাদের ব্যবহার করতে পারবে না। তাছাড়া আমি এটাও মনে করি না যে, তারা পাকিস্তানের ঐক্যের বিরােধী ছিল। আল্লাহ ভালাে জানেন, কিভাবে এই জটিল ও বিপজ্জনক সমস্যা মােকাবেলা করা সম্ভব-শুধু কল্পনা করুন, মুজিবকে এগুলাে মােকাবেলা করতে হচ্ছে। তাছাড়া দেশটি বড়ই দুর্ভাগা। জলােচ্ছ্বাস, বন্যা ঝড় লেগেই আছে। বলা যায় একটি দুর্ভাগা তারকার নিচে দেশটির জন্ম। আমাদের ভুললে চলবে না যে দেশটা সবসময়ই বিশ্বের মন্দ অবস্থানে ছিল। আপনি ১৯৪৭ সাল অথবা ১৯৫৪ সালের ঢাকা দেখে থাকবেন। একটি নােংরা গ্রাম, সেখানে একটা রাস্তাও ছিল না। আর এখন সবকিছু ধ্বংস করা হয়েছে। সেজন্যে মুক্তিবাহিনীর ডিনামাইটকেও ধন্যবাদ, বাংলাদেশ…..।
ও ফা: আমি অবাক হচ্ছি, আপনি বাংলাদেশ বলছেন।
জু আ ভু: অবশ্যই আমি বলছি রাগে এবং ঘৃণায়। যদিও এখনাে এটি আমার কাছে পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু সঠিকভাবে অথবা ভুলেই হােক, কিংবা ভারতীয়দের দ্বারা সামরিক কার্যকলাপের ফলেই হােক পঞ্চাশটি রাষ্ট্র এটাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাকে মানতে হবে। আমিও স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত, যদি ভারত আমাদের যুদ্ধবন্দীদের ফেরত দেয়, যদি বিহারীদের উপর নির্যাতন বন্ধ হয়, যদি পাকিস্তানের ঐক্যের পক্ষের লােকদের উপর নিপীড়ন না করা হয়। আমরা যদি নিজেদেরকে আবার একটি ফেডারেশনে যুক্ত করি, তাহলে প্রথমেই আমাদেরকে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। এবং আমার মনে হয় দশ অথবা পনের বছরের মধ্যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ একটি ফেডারেশনে যুক্ত হতে পারে। হতে পারে এবং হওয়া উচিত। তা না হলে এ শূন্যতা কে পূরণ করবে। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়। পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে অভিন্ন কিছুই নেই। পূর্ববঙ্গের বাঙালী ও আমাদের মধ্যে ধর্ম অভিন্ন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের ধারণাটা ছিল চমৎকার।
ও ফা: আপনি চমৎকার বলছেন? দুই হাজার কিলােমিটার দূরে দু’টি জায়গা নিয়ে একটি দেশের জন্ম এবং তার মাঝখান ভারত?
জু আ ভু: এই দু’টি ভূখণ্ডই পঁচিশ বছর একত্রে ছিল, সকল ভুলভ্রান্তির পরও। একটি রাষ্ট্র শুধু ভৌগােলিক বা ভূখণ্ডের ধারণা হয়। যখন পতাকা এক, জাতীয় সঙ্গীত এক, ধর্ম এক-দূরত্ব সেখানে কোন সমস্যাই নয়। মােঙ্গলরা যখন ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল তখন এই অংশের মুসলমানরা একশ’ দিনে দেশের অপর প্রান্তে যেতাে। এখন বিমানের মাত্র দু’ঘণ্টার পথ। আমার কথা কি আপনি বুঝতে পারছেন।

পৃষ্ঠাঃ ৫৪
ও ফা: না, মি. প্রেসিডেন্ট। আমি বরং ইন্দিরা গান্ধীকে ভালাে বুঝি যখন তিনি বলেন যে, ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ ছিল ভুল এবং ১৯৭০ এর দশকে ধর্মের নামে যুদ্ধ হাস্যকর।
জু আ ভু: মিসেস গান্ধীর স্বপ্ন একটাই-গােটা উপমহাদেশ দখল করা, আমাদেরকে শাসন করা। তিনি একটা কনফেডারেশন পছন্দ করেন, যাতে বিশ্ব থেকে পাকিস্তান মিশে যায় এবং সেকারণেই তিনি বলেন, আমরা ভাই-ইত্যাদি। আমরা ভাই নই। কখনাে ভাই ছিলাম না। আমাদের ধর্ম আমার আত্মার গভীর পর্যন্ত, আমাদের জীবন ব্যবস্থার মধ্যে। আমাদের সংস্কৃতি ভিন্ন, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। জন্ম থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত একজন হিন্দু ও একজন মুসলিম আইন ও রীতির অধীন, যার মধ্যে কোন আপােস নেই। দু’টিই শক্তিশালী ও আপােসহীন বিশ্বাস। ইতিহাসে দেখা গেছে দুটোর কোনটিই একে অপরের সঙ্গে আপােসে পৌঁছতে পারেনি। শুধু রাজতন্ত্রের একচ্ছত্র শাসনে-বিদেশী আধিপত্যের সময় অর্থাৎ মােঙ্গল থেকে বৃটিশ পর্যন্ত কোন রকম জোড়াতালি দিয়ে আমাদেরকে এক রাখা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু একটি ঐক্যবদ্ধ প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেনি।
ইন্দিরা গান্ধী আপনাকে যেভাবে বলেছেন, আসলে হিন্দুরা সেরকম শান্ত বা নম্র সৃষ্টি নয়। তাদের পবিত্র গরু সম্পর্কে তারা শ্রদ্ধাশীল কিন্তু মুসলমানদের প্রতি নয়। তারা সবসময় আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার ও অত্যাচার করেছে। ১৯৪৪ সালে আমার সাথে একটি ঘটনা আমি কোনদিন ভুলবাে না। আমার আব্বা আম্মার সাথে কাশ্মীরে ছুটি কাটাতে গেছি। অন্য বালকরা যা করে আমিও তেমনি দৌড়ে পাহাড়ে উঠছিলাম নামছিলাম এবং এক পর্যায়ে আমি খুব পিপাসার্ত হলাম। অতএব আমি নিকটেই এক লােকের কাছে গেলাম। যে পানি বিক্রি করছিল। পানি চাইলাম। লােকটি পানির মগ ভরলাে। আমার হাতে দিতে গিয়ে থেমে জিজ্ঞাসা করলাে, “তুমি কি হিন্দু, না মুসলমান?” উত্তর দিতে আমার দ্বিধা হচ্ছিল-ক্ষিপ্ত হয়ে পানিটা চাইলাম। শেষে বললাম, “আমি মুসলমান।” লােকটি মাটিতে ফেলে দিল পানির মগ উপুড় করে। ঘটনাটা ইন্দিরা গান্ধীকে বলবেন।
ও ফা: আপনারা দু’জন পাশাপাশি দাঁড়াতে পারেন না, পারেন কি?
জু আ ভু: আমি তাকে শ্রদ্ধাও করি না। আমার কাছে তিনি একজন সাধারণ নারী, সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্না। তার মধ্যে বড় কিছু নেই। শুধু যে দেশটা তিনি শাসন করেন সেটা বড়। আমি বলতে চাই, সিংহাসনটার কারণে তাকে বড় মনে হচ্ছে, যদিও তিনি খুব ছােট এবং তার নামটাও। বিশ্বাস করুন, তিনি যদি শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী হতেন, তাহলে আরেকজন মিসেস বন্দরনায়েক ছাড়া কিছুই হতেন না। যদি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হতেন….। অবশ্য আমি তাকে গােল্ড মেয়ার এর সাথে তুলনা করতে চাই না। গােল্ডা মেয়ার তার থেকে অনেক উপরে। তার একটি সুন্দর মন আছে, সুস্থ বিচারশক্তি আছে এবং তাঁকে ইন্দিরা গান্ধীর চেয়ে আরাে অনেক কঠিন সমস্যার মধ্য

পৃষ্ঠাঃ ৫৫
দিয়ে অতিক্রম করতে হয়। তাছাড়া গোেল্ডা মেয়ার ক্ষমতায় এসেছেন তার নিজের মেধার বলে। অপরদিকে মিসেস বন্দরনায়েক ক্ষমতায় এসেছেন মি. বন্দরনায়েকের বিধবা স্ত্রী হওয়ার কারণে। ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় এসেছেন নেহেরুর মেয়ে হওয়ার কারণে। নেহেরুর মেয়ে না হলে, তার সকল শাড়িতে, কপালের লাল টিপে, সুন্দর। হাসি দিয়েও তিনি কখনাে আমাকে আকৃষ্ট করতে সফল হতেন না। লণ্ডনে তার সাথে যখন প্রথম সাক্ষাত তখন থেকেই তিনি আমাকে আকৃষ্ট করতে পারেননি। আমরা। দু’জনই একটা ক্লাসে যেতাম এবং ইন্দিরা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিস্তারিত নােট নিতেন। তাকে বলতাম “আপনি কি নোেট নিচ্ছেন, না থিসিস লিখছেন?” থিসিস সম্পর্কে বলতে হয়, আমি বিশ্বাস করি না যে, অক্সফোর্ড হতে ইতিহাসে ডিগ্রী নয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। আমি অক্সফোর্ডে তিন বছরের কোর্স শেষ করেছি দুই বছরে। তিন বছরেও তার পক্ষে কোর্স শেষ করা সম্ভব হয়নি।
ও ফা: আপনি কি একটু বাড়াবাড়ি করছেন না, একটু অন্যায়? আপনি কি সত্যিই মনে করেন যে, তার মাঝে কিছু নেই অথবা দীর্ঘ সময় ধরে টিকে আছেন কি করে? অথবা বলতে চান, তার মাঝে কোন যােগ্যতা নেই, কারণ তিনি নারী?
জু আ ভু: না, না। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মহিলাদের বিরুদ্ধে আমার কোন বক্তব্য নেই, যদিও আমি মনে করি না যে, পুরুষের চেয়ে মহিলারা ভালাে রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারে। ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে আমার অভিমত নৈর্ব্যক্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ। জেনেভা কনভেনশনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করে এবং আমাদের যুদ্ধবন্দীদের ফিরিয়ে না দিয়ে যে কঠোর আচরণ তিনি করছেন সে ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত না হয়েই আমি তার সম্পর্কে বলছি। আমি তাকে সবসময় কিভাবে দেখি : একজন স্কুল বালিকার মতাে সতর্ক ও পরিশ্রমী, কিন্তু উদ্যোগ ও কল্পনাশক্তিশূন্য একজন নারী। বলা যায় অক্সফোর্ডে পড়াশােনার সময় ও লণ্ডনে নােট নেয়ার সময় তিনি যেমন ছিলেন, এখন বরং তার চেয়ে ভালাে। ক্ষমতা তাকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু তার সাফল্যের মাঝে সফলতা নেই। সাফল্যের প্রশ্নটির সাথে কতটা মেধা যােগ হয়েছে তার অনুপাত দেখতে হবে। পাকিস্তান ও ভারত যদি কনফেডারেশনভুক্ত দেশ হতাে তাহলে মিসেস গান্ধীর পদটা লাভ করা আমার পক্ষে কঠিন হতাে না। তার সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক দ্বন্দ্বে আমার কোন ভয় নেই। আমি বলতে চাই, তিনি যখন যেখানে চান সেখানেই তার সাথে সাক্ষাত করতে আমি প্রস্তুত। এমনকি দিল্লীতেও, হ্যা, আমি দিল্লীতেও যেতে প্রস্তুত। ঠিক ভিয়েনার কংগ্রেসের পর ট্যালিব্যাণ্ডের মতাে। যে বিষয়টি আমাকে পীড়া দেয় তা হলাে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিকট হতে গার্ড অব অনার এবং সেই ভদ্রমহিলার সাথে দৈনিক সংস্পর্শ। এ ভাবনা আমাকে পীড়িত করে। হায় আল্লাহ। এটা যেন আমাকে ভাবতেও হয়। বরং আমাকে বলুন, মিসেস গান্ধী আমার সম্পর্কে কি বলেছেন?
ও ফা: তিনি বলেছেন, আপনি ভারসাম্যহীন একজন লােক। আজ এক কথা বলেন, আগামীকাল আরেকটা। কেউ বুঝতে পারে না আপনার মনে কি আছে?

পৃষ্ঠাঃ৫৬
জু আ ভু: হ্যাঁ। আমি সরাসরি এর জবাব দিচ্ছি। দার্শনিক জন লকের একটি বক্তব্যই আমি উল্লেখ করছি : “ছােট মনের গুণই হলাে সামঞ্জস্যবিধান।” অন্যভাবে বলা যায়, আমি মনে করি একটি মৌলিক ধারণায় অত্যন্ত দৃঢ় থাকা উচিত। মূল ধারণার মধ্যে একজন অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করতে সক্ষম হয়। একবার এই প্রান্তে, আরেকবার অপর প্রান্তে। একজন বুদ্ধিজীবী কখনাে একটিমাত্র ও সংক্ষিপ্ত ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন না-তার ভাবনার নমনীয়তা থাকা উচিত। তা না হলে একটি গণ্ডির মধ্যে গোঁড়ামির মধ্যে তিনি নিমজ্জিত হন। একজন রাজনীতিবিদও তাই। রাজনীতি একটি আন্দোলন-এবং রাজনীতিবিদকেও হতে হবে সচল। একবার তাকে ডানে, আরেকবার বামে যেতে হবে। তাকে আসতে হবে দ্বন্দ্ব ও সন্দেহ নিয়ে। অব্যাহতভাবে তার পরিবর্তন হবে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন, সবদিক থেকে আক্রমণ করবেন। ফলে বিরােধীর দুর্বল দিকগুলাে চিহ্নিত করে আঘাত হানতে পারবেন। মূল ধারণার দিকে যিনি দ্রুত মনােযােগী হন, তার কাছেই শিখা যায়। তার কাছে শিখুন যিনি সত্য প্রকাশ করেন।
দৃশ্যত : সামঞ্জস্যতা বুদ্ধিমান মানুষের প্রধান গুণ। মিসেস গান্ধী যদি তা না বুঝেন তাহলে তিনি তার পেশার সৌন্দর্য বুঝেন না। তার পিতা এ বিষয় খুব ভালােভাবে বুঝেছিলেন।
ও ফা: ইন্দিরা গান্ধী বলেন, তার পিতা রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সন্ন্যাসী।
জু আ ভু: মিসেস গান্ধী তার পিতা সম্পর্কে ভুল বলছেন। বরং নেহেরু একজন। রাজনীতিবিদ ছিলেন। পিতার অর্ধেক মেধা তার থাকা উচিত। দেখুন, যদিও তিনি পাকিস্তানের নীতির বিরােধী ছিলেন, তবু আমি সবসময় এই লােকটির প্রশংসা করি। আমি যখন তরুণ তার দ্বারা প্রভাবিত ছিলাম। পরে অবশ্য বুঝতে পারি তিনি অনেক ভুল, হতাশা, কঠোরতা ইত্যাদি দোষে দুষ্ট এবং তার মধ্যে স্ট্যালিন, চার্চিল বা মাও সে তুং এর মতাে যােগ্যতা ছিল না। মিসেস গান্ধী আর কি বলেছেন?
ও ফা: তিনি বলেছেন, আপনারা পাকিস্তানীরাই যুদ্ধ শুরু করেছেন।
জু আ ভু: হাস্যকর। প্রত্যেকে জানে তারা আমাদেরকে আক্রমণ করেছিল। ২৬শে নভেম্বর পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্টে তারা আঘাত হানে। পূর্ব পাকিস্তান সম্ভবতঃ পাকিস্তান ছিল না। ভালাে করে একটু ভেবে দেখুন। কেউ যদি পালেরমাে আক্রমণ করে, তাহলে আপনি কি এ সিদ্ধান্তই নেবেন না যে ইতালি আক্রান্ত হয়েছে? কেউ যদি মার্সেলিস আক্রমণ করে তাহলে কি আপনি ভাববেন না যে ফ্রান্স আক্রান্ত হয়েছে? মিসেস গান্ধী বিতর্কিত ভূখণ্ড কাশ্মীরে আমাদের পাল্টা আক্রমণের কথা ভুলে যেতে চাইছেন। ৩রা ডিসেম্বর কাশ্মীরের উপর হামলা হয়। আমার মনে পড়ছে ২৯শে নভেম্বর ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাত করে আমি পাল্টা হামলা করতে ব্যর্থতার ব্যাপারে তাকে বলি, “আপনি এমন ভাব দেখেছেন যে পূর্ব পাকিস্তানে কিছুই ঘটেনি। কোন পদক্ষেপ না

পৃষ্ঠাঃ ৫৭
নিয়ে আপনি ভারতের খেলায়ই অংশ নিচ্ছেন। মানুষকে আপনি এ বিশ্বাসই করতে দিচ্ছেন যে, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান এক রাষ্ট্র নয়।” কিন্তু তিনি আমার কথা শুনলেন না। পাল্টা আক্রমণের নির্দেশ তিনি চারবার পরিবর্তন করেন। চতুর্থবারের সময় আমাদের জওয়ান ও অফিসাররা অধৈর্য হয়ে ট্যাংকে মুষ্ঠাঘাত করছিল। ঢাকা সম্পর্কে আমি বলেছিলাম, আমাদের সকল ছাউনি ঢাকায় কেন্দ্রীভূত করা হােক এবং একটি শক্তিশালী অবস্থান নেয়া হােক দশ মাসের জন্য, এক বছরের জন্য-গােটা বিশ্ব আমাদের পক্ষে এসে যাবে। তার শুধু বক্তব্য ছিল ভারতীয়রা ক্ষুদ্র একটি ভূখণ্ড দখল ও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করবেনা। কিন্তু যখন তিনি নিয়াজীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলেন…..হে খােদা। আমি হাজার বার মৃত্যুবরণ করলেও এর চেয়ে ভালাে বােধ করতাম। মনে পড়ে, আমি নিউইয়র্কে ছিলাম। তিনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন একজন পর্যটক হিসেবে এবং আমি নিজেকে দেখলাম জাতিসংঘের এক অদ্ভুত অধিবেশনে।
ও ফা: এবং আপনি সেখানে সেই দৃশ্যের অবতারণা করেন।
জু আ ভু: আমি স্বীকার করি। একটি বাস্তব দৃশ্য। আমি ক্রোধে, বিরক্তিতে পূর্ণ হয়েছিলাম। ভারতীয়দের আক্রমণাত্মক ভাব, বৃহৎ শক্তি কর্তৃক ভীতি প্রদর্শন, যারা শুধু ভারতের অনুকরণ করতে চাচ্ছিল। আমি আমার ভাবাবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। আমার বক্তৃতায় সকলকে আমি জাহান্নামে যেতে বলেছি। আমি কেঁদেছি। হ্যা, আমি মাঝে মাঝে কাঁদি। যখন কোন কিছু অন্যায়, অসম্মানজনক আবিষ্কার করি, আমি তখন কাঁদি। আমি খুবই আবেগপ্রবণ।
ও ফা: আবেগপ্রবণ, দুর্বোধ্য, জটিল এবং……..আরাে অনেক কিছু বলা হয়। আমার মনে হয়, এখন আপনার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করার সময় হয়েছে। মি. প্রেসিডেন্ট, এই লােকটি সম্পর্কে একটু বলুন, যিনি অত্যন্ত ধনবান, অথচ একজন সমাজতন্ত্রী, পাশ্চাত্যের লােকের মতাে বাস করেন অথচ তার দু’জন স্ত্রী রয়েছে।
জু আ ভু: আমার মধ্যে অনেক বৈপরীত্য হয়েছে-আমি সে সম্পর্কে সচেতন। আমি এসবের মধ্যে আপােসের চেষ্টা করি, সমস্যা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করি। কিন্তু আমি সফল হতে পারি না। ফলে আমি এশিয়া ও ইউরােপের অদ্ভুত মিশ্রণ হিসেবেই রয়েছি। আমার শিক্ষা খুব কম কিন্তু ইসলামী পরিবেশে বড় হয়েছি। আমার মনটা পাশ্চাত্যের কিন্তু আত্মা প্রাচ্যের। আমার দুই স্ত্রী সম্পর্কে আমি কি করতে পারি? অভিভাবকরা আমার মামাত বােনের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন তের বছর বয়সে। আমার বয়স ছিল মাত্র তের, আর আমার স্ত্রীর তেইশ বছর। এমন কি আমি জানতামও না যে একজন স্ত্রী থাকার অর্থ কি। যখন তারা আমাকে এটা বুঝানাের চেষ্টা করলাে, আমি রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি কোন স্ত্রী চাইনি। আমি ক্রিকেট খেলতে চেয়েছিলাম। আমি ক্রিকেটের দারুণ ভক্ত। আমাকে শান্ত করতে আমাকে দুটি নতুন ক্রিকেট ব্যাট দিতে হয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষ হওয়া মাত্র আমি ক্রিকেট খেলতে যাওয়ার জন্য দৌড় দিয়েছিলাম। আমার দেশে এমন অনেক কিছু আছে, যা আমাকে অবশ্যই

পৃষ্ঠাঃ ৫৮
ইন্টারভিউ উইথ হিস্টরি পরিবর্তন করতে হবে। আমাকে ভাগ্যবান বলতে হবে। তারা আমার এগার বছর বয়সী খেলার সাথীকে বিয়ে দিয়েছিল বত্রিশ বছর বয়সী এক রমণীর সঙ্গে। সে সবসময় আমাকে বলতাে, “তুমি ভাগ্যবান।”
আমি যখন আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রেমে পড়লাম, তখন আমার বয়স তেইশ বছর। সেও ইংল্যাণ্ডে পড়াশােনা করছিল। যদিও সে একজন ইরানী অর্থাৎ তার দেশে বহু বিবাহ একটি রীতি, আমাকে বিয়ে করার জন্য তাকে রাজি করাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। মাত্র দুটি কথা ছাড়া তাকে বুঝানাের মতাে যুক্তি আমার ছিল না, “তাতে কি, ওসব বাদ দাও।” আমার প্রথম স্ত্রীকে তালাক দেয়ার ধারণা কখনাে আমার মাথায় আসেনি। সে যে আমার মামাত বােন, সে কারণে নয়, কারণ তার প্রতি আমার একটি দায়িত্ব আছে। একটি বালকের সাথে এই অবাস্তব বিয়ের কারণে, এই অবাস্তব রীতি যেখানে আমরা বড় হয়েছি-সে কারণে তার গােটা জীবনটা বরবাদ হয়ে গিয়েছিল। সে আমার লারকানার বাড়িতে বাস করে। মাঝে মাঝে আমাদের সাক্ষাত হয়। প্রায় সবসময় সে একা কাটায়। এমনকি তার কোন সন্তানও নেই-আমার চারটি সন্তান দ্বিতীয় স্ত্রীর। আমি খুব অল্পসময় তার সাথে কাটিয়েছি। বড় হওয়ার পরই পড়াশােনা করতে আমি পাশ্চাত্যে চলে যাই। এটা আসলে অবিচারের একটি কাহিনী। বহুবিবাহ নিরুৎসাহিত করতে আমার পক্ষে যা সম্ভব সবকিছু করবাে। বহুবিবাহ অর্থনৈতিক সমস্যাও সৃষ্টি করে। কখনাে স্ত্রীরা বিভিন্ন শহরে বা ভিন্ন বাড়িতে বিচ্ছিন্নভাবে বাস করে-যেমনটি আমার বেলায় হয়েছে। তাছাড়া আমার যা সাধ্য তা সবার নেই। যদিও যেমনটি আপনি বলেছেন, আমি তেমন বিত্তবান নই।
ও ফা: না?
জু আ ভু: না। আপনার কাছে বিত্তবান অর্থ ডুপন্ট বা একজন রকফেলার হওয়া। আমাদের কাছে আরাে অনেক কম। এদেশে যারা ধনী তারা বিস্তর জমির মালিক, কিন্তু আসলে সে ইউরােপীয় ব্যারনদের চেয়ে ধনী নয়। ব্যারনদের জাঁকজমকপূর্ণ ভিলা থাকে এবং বেঁচে থাকার জন্য গিগােলা খেলে। আমার ভূমি শুষ্ক এবং এতে উৎপাদন হয় কম। অতএব ধনী বলার চেয়ে বলুন, আমি তুলনামূলকভাবে ধনী। আমি ভালােভাবে বাস করি। আমার বােনেরা ভালােভাবে থাকে, আমার ভাইদের অবস্থাও ভালাে। অবস্থা ভালাে হলেও আমরা অর্থ অপচয় করি না। আমি কখনাে প্লেবয় ছিলাম না। যখন আমি আমেরিকায় এবং অক্সফোর্ডে ছাত্র ছিলাম, আমি কখনাে গাড়ি কিনিনি। আমি বুদ্ধিমানের মতই অর্থ ব্যয় করেছি, যেমন; গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাত করতে ও বই কেনার মতাে কাজে। আপনি যদি আমার লাইব্রেরিটা দেখেন, তাহলেই দেখবেন আমার অর্থের একটা ভালাে অংশ আমি কোথায় ব্যয় করেছি : বই কিনতে। আমার হাজার হাজার বই আছে। অনেক বই পুরােনাে এবং সুন্দর। আমি সবসময় পড়তে দারুণ ভালােবাসি। খেলাধুলার মতাে। ভালাে পােশাক পরার জন্য। অনেকে আমার দোষারােপ করে। কথাটা সত্য। কিন্তু তাদের অভিযােগ পােশাকে, আমার অর্থব্যয়ের কারণে নয়, আমি পরিচ্ছন্ন থাকি সেজন্যে। আমি গােসল করতে

পৃষ্ঠাঃ ৫৯
এবং পােশাক পাল্টাতে পছন্দ করি। আমার পক্ষে কখনাে ভারতীয় ও পাকিস্তানী রাজপুত্রদের পাশে দাঁড়ানাে সম্ভব হয়নি-কারণ তারা নােংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত। আমার বাড়িগুলাে সুন্দর ও আরামদায়ক-এটাও সত্য। কিন্তু দীর্ঘদিন আমার বাড়িতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল না। আমি আপ্যায়ন করতে ভালােবাসি-কিন্তু কখনাে বাজে লােককে নয়। আমি নাচতে জানি, কারণ আমি সঙ্গীত পছন্দ করি এবং অন্যেরা যখন নাচে তখন দেয়ালে টানানাে ফুলের মতাে থাকতে ঘৃণা করি বলে। এবং…….।
ও ফা: এবং একজন লেডি কিলার হিসেবে আপনার সুনাম আছে বলে-একজন ডন জুয়ান। এটা কি সত্য মি. প্রেসিডেন্ট?
জু আ ভু: এ কথাটাও একটু অতিরঞ্জিত। আমি একজন রােমান্টিক-আমি মনে করি না যে, রােমান্টিক হওয়া ছাড়া আপনার পক্ষে রাজনীতিবিদ হওয়া সম্ভব। একজন রােমান্টিক হিসেবে আমি মনে করি প্রেম ছাড়া অনুপ্রেরণামূলক আর কিছু হতে পারে না। প্রেমে পড়া এবং একজন রমণীর হৃদয় জয় করার মধ্যে দোষ কোথায়-তার জন্যে আমার দারুণ দুঃখ হয়, যে প্রেমে পড়ে না। আপনি শতবার প্রেমে পড়তে পারেন। আমিও প্রেমে পড়ি। কিন্তু আমি অত্যন্ত নৈতিক মানুষ এবং নারীদের শ্রদ্ধা করি। মানুষ ভাবে যে মুসলমানরা নারীদের শ্রদ্ধা করে না। এটা মারাত্মক ভুল। নারীকে শ্রদ্ধা করা ও তাদের রক্ষা করা নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর শিক্ষার অন্যতম। একবার আমি এক লােককে বেত্রাঘাত করেছিলাম, যদিও আমি নিজেকে দৈহিক নির্যাতনের পক্ষে মনে করি না কিন্তু খুব নির্দয়ভাবে বেত মেরেছিলাম, রক্তপাত না হওয়া পর্যন্ত। আপনি বলতে পারেন, কেন? কারণ সে একটি ছােট্ট বালিকাকে ধর্ষণ করেছিল। আজ সকালেও যখন আমি পড়লাম যে কয়েকশ’ ছাত্র করাচীর সমুদ্র সৈকতে কিছু সংখ্যক ছাত্রীর উপর হামলা ও তাদের কাপড় খুলে ফেলেছে, আমি রাগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ক্রাউন্ডেল। আমি ওদেরকে সামরিক আইন বিধির আওতায় ফেলবাে। আপনাকে কথাটা বলতে চাই। আমি যদি নিশ্চিত হই যে, আমাদের সৈন্যরা সত্যি সত্যিই বাংলাদেশের নারীদের উপর অত্যাচার করেছে তাহলে আমি অবশ্য তাদের বিচার করবাে ও শাস্তি দেব।
ও ফা: অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক মি. প্রেসিডেন্ট। আপনার মার্ক্সবাদের কথাই বলি। আপনার যে সুযােগ সুবিধা এবং মুসলিম হিসেবে আপনার যে বিশ্বাস তার সাথে কি করে এর সাথে আপােস করেন?
জু আ ভু: আমি অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে আমাকে মার্ক্সবাদী বলি। তাহলাে, আমি মার্ক্সবাদের ততটুকুই গ্রহণ করেছি, যতটুকু অর্থনীতির সাথে জড়িত। মার্ক্সের ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক ব্যাখ্যা, জীবন সম্পর্কিত তত্ত্ব, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন-এসবকে আমি মানি না। মুসলিম হিসেবে আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি। সঠিক হােক আর ভ্রান্তই হােক-আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ আছেন। বিশ্বাস এমন একটি জিনিস তার অস্তিত্ব থাকুক আর নাই থাকুক তার বিশ্বাসে দুর্বলতা নেই। যদি তিনি থাকেন, তাহলে

পৃষ্ঠাঃ ৬০
এনিয়ে তর্ক করা বৃথা। তিনি আমার মধ্যে। মার্ক্সবাদের দার্শনিক অথবা কাল্পনিক ব্যাখ্যায় আমি আল্লাহর নিন্দা করতে পারি না। একই সাথে আমি এটাও বিশ্বাস করি যে, একজন মার্ক্সবাদী এবং একজন মুসলিম পাশাপাশিই চলতে পারে বিশেষ করে পাকিস্তানের মতাে একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ছাড়া আমি কোন সমাধান দেখি না।
আমি পাকিস্তান বলছি এজন্যে যে, আন্তর্জাতিক ক্রুসেড শুরু করার মতাে কোন প্রসঙ্গ উত্থাপন করছিনা। আমি অন্যের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছি না। আমি শুধু আমার দেশের বাস্তবতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাই। না, আমি এও স্বীকার করছি যে, বিপ্লবের কোন প্রক্রিয়ায় নয়। আমি শপথ করে বলতে পারি আমি একজন বিপ্লবী। কিন্তু আমি হঠাৎ ও রক্তাক্ত একটি বিপ্লবের ভার বহন করতে পারি না। পাকিস্তান সে ধরনের বিপ্লবের ভার সইতে পারবে না, সেটা হবে বিপর্যয়। অতএব আমাকে অগ্রসর হতে হবে ধৈর্যের সাথে। সংস্কারের মাধ্যমে পরিমাপ করে ক্রমশ দেশকে নিতে হবে সমাজতন্ত্রের পথে। যখন সম্ভব হবে জাতীয়করণ করতে হবে এবং যখন, প্রয়ােজন হবে জাতীয়করণ বাদ দিতে হবে। বিদেশী পুঁজি যা আমাদের প্রয়ােজন তাকে শ্রদ্ধা করতে হবে। আমার সময়ের প্রয়ােজন। একজন সার্জনের মতাে সয়ে সয়ে ছুরি চালাতে হবে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আমাদের সমাজটা অসুস্থ। যদি অস্ত্রোপচারে মরে না যায় তাহলে সতর্কতার সাথে তাই করতে হবে। একটি আঘাত সেরে উঠার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সংস্কারকে সংহত করতে হবে। বহু শতাব্দী আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম। একটি ভূমিকম্পের আচমকা ধাক্কায় নিজেদের জাগাতে পারি না। লেনিনকেও শুরুতে আপােস করতে হয়েছিল।
ও ফা: মি. প্রেসিডেন্ট, বহু মানুষ আপনাকে বিশ্বাস করে না। তারা বলেন, আপনি শুধু ক্ষমতাই চান, আর কিছু নয় এবং ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যে আপনি সবই করতে পারেন।
জু আ ভু: না, এটা সত্যি নয়। গত তিন মাসে আমি যে কৃষি সংস্কার করেছি তাতে আমার পরিবার পঁয়তাল্লিশ হাজার একর জমি হারিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে। হারিয়েছি ছয় থেকে সাত হাজার একর। আমাকে আরাে জমি হারাতে হবে। আমার সন্তানরাও হারাবে। আল্লাহ সাক্ষী যে, আমি সমাজতন্ত্রের নামে খেলছি না এবং কোন সংকীর্ণ স্বার্থ সামনে রেখে আমি ধীরে ধীরে অগ্রসর হই না। যেদিন থেকে আমি মার্ক্স পড়েছি সেদিন থেকে আমার মালিকানায় কোনকিছুই দান করতে আমি ভয় পাই না। এখনাে তার স্থান ও সময় বলতে পারি : বােম্বে ১৯৪৫ সাল। আমি শুধু ক্ষমতার অভিলাষী এই অভিযােগ প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই যে আসলে আমরা ক্ষমতা’ শব্দটির দ্বারা কি বুঝি। ইয়াহিয়া খানের যে ক্ষমতা ছিল ক্ষমতা দ্বারা আমি তা বুঝি না। ক্ষমতা দ্বারা আমি বুঝি যা ব্যবহার করে পর্বতকে সমতল করা যায়, মরুভূমিকে পুস্পিত করে তােলা যায়, এমন একটি সমাজ গড়ে তােলা যায় যেখানে জনগণ ক্ষুধা ও অত্যাচারে

পৃষ্ঠাঃ ৬১
মারা যাবে না। আমার কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই। আমি একনায়ক হতে চাই না। কিন্তু যতটুকু আমি বলতে পারি, তাহলাে আমাকে অত্যন্ত শক্ত হতে হবে, এমনকি কর্তৃত্ববাদী হতে হবে। ভাঙ্গা জানালা আমি মেরামত করছি। জানালার ভাঙ্গা টুকরাে আমি দূরে নিক্ষেপ করছি। অসতর্কভাবে যদি এগুলাে নিক্ষেপ করি তাহলে আমি একটি দেশ পাবাে না, আমি পাবাে একটি বাজার।
সে যা হােক, শুধু হাসিঠাট্টা করার জন্য কেউ রাজনীতি করে না। রাজনীতি করার উদ্দেশ্যই হলাে ক্ষমতা হাতে নেয়া এবং তা রক্ষা করা। এর উল্টো যদি কেউ বলে তাহলে সে মিথুক। রাজনীতিবিদরা সবসময় আপনাকে এ বিশ্বাস দিতেই সচেষ্ট যে তারা ভালাে, নৈতিক এবং ভারসাম্যপূর্ণ। কিন্তু কোনদিন তাদের ফাঁদে পা দেবেন না। ভালাে, নৈতিক ও ভারসাম্যপূর্ণ বলে কিছু নেই। রাজনীতি হলাে দেয়া নেয়ার বিষয়। আমার পিতা বলতেন, “কারাে দ্বারা দু’বার আঘাতপ্রাপ্ত হবার প্রস্তুতি না নিয়ে কখনাে কাউকে আঘাত করবে না।” এরপর কিছু শিখেছি বয়স্কাউট থাকাকালে কিন্তু আমি অনেক কিছু ভুলে গেছি।
ও ফা: তারা বলে, আপনি মুসােলিনী, হিটলার ও নেপােলিয়ন সম্পর্কিত বইপত্রের একনিষ্ঠ পাঠক।
জু আ ভু: অবশ্যই। তাছাড়া দ্য’গল চার্চিল, স্ট্যালিন এর উপর লিখিত বইও পড়ি। আপনি কি আমাকে এ কথা স্বীকার করাতে চান যে আমি একজন ফ্যাসিস্ট।
না, আমি ফ্যাসিস্ট নই। একজন ফ্যাসিস্ট প্রথমত সংস্কৃতির শত্রু। কিন্তু আমি সংস্কৃতি দ্বারা পরিশীলিত একজন বুদ্ধিজীবী। একজন ফ্যাসিস্ট ডানপন্থী, কিন্তু আমি বামপন্থী। একজন ফ্যাসিস্টের চরিত্র পেটি বুর্জোয়ার। কিন্তু আমি এসেছি আভিজাত্য থেকে। কোন লােক সম্পর্কে পাঠ করার অর্থ তাকে আপনার নায়ক হিসেবে সৃষ্টি নয়। আমি যখন ছাত্র ছিলাম তখন আমার কিছু নায়ক ছিল। কারাে মাঝে নায়কের অস্তিত্ব চুইংগামের মতাে-চিবিয়ে ফেলে দেয়া বা বিভিন্ন আকার দেয়ার মতাে-বিশেষ করে আপনি যখন তরুণ। আপনি যদি জানতে চান কাদেরকে আমি দীর্ঘদিন চিবিয়েছি, জেনে নিন-চেঙ্গিস খান, আলেকজাণ্ডার, হ্যানিবল, নেপােলিয়ান। হ্যা, নেপােলিনকেই সবচেয়ে বেশি ভালাে লাগতাে। কিন্তু আমার মনে মাজিনি, ক্যাভর, গ্যারিবন্ডিরও কিছু কিছু স্থান ছিল। রুশাের প্রভাব ছিল যথেষ্ট। আপনি নিজেই আমার মধ্যে বিস্তর স্ববিরােধিতা দেখতে পাচ্ছেন।
ও ফা: তাই বলুন। আপনাকে আর একটু ভালােভাবে বুঝার জন্যে প্রশ্ন করতে চাই, আমাদের সময়ের কোন নেতাকে আপনি খুব ঘনিষ্ঠ বলে অনুভব করেন-যাদেরকে আপনি পছন্দ করেন অথবা যারা আপনাকে বেশি পছন্দ করে।
জু আ ভু: একজন সুকর্ণ। তিনি আমার ভক্ত এবং আমি তার ভক্ত। তার সকল দুর্বলতা সত্ত্বেও তিনি একজন ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ। যেমন নারীর সাথে তার সম্পর্কটা অমার্জিত। এটা প্রয়ােজনীয়ও নয়, কিংবা পৌরুষােচিত-ও নয়। কিন্তু তিনি সেটা

পৃষ্ঠাঃ ৬২
উপলব্ধি করেন না। তাছাড়া তিনি অর্থনীতি বুঝেন না। দ্বিতীয়জন নাসের। তিনি অত্যন্ত উঁচু দরের ব্যক্তিত্ব। তার সাথে আমার ভালাে সম্পর্ক ছিল। তিনি আমাকে ভালােবেসেছেন, আমিও তাকে ভালােবাসতাম। ১৯৬৬ সালে আমাকে যখন সরকার ত্যাগে বাধ্য করা হয়, তখন নাসের আমাকে মিসরে আমন্ত্রণ করেন এবং রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদায় আমাকে স্বাগত জানান। তিনি বলেছেন, যতদিন আমার প্রয়ােজন আমি সেখানে থাকতে পারি।
এরপর ধরুন স্ট্যালিনের কথা। হ্যা স্ট্যালিন। তার প্রতি বরাবর আমার গভীর শ্রদ্ধা। অন্তর থেকে অনুভব করি সে শ্রদ্ধা, ঠিক ক্রুশ্চেভের প্রতি যতটা বিদ্বেষ অনুভব করি সেরকম। ক্রুশ্চেভকে আমি কখনাে পছন্দ করিনি। একথাটা বললেই বােধকরি আপনি ভালােভাবে বুঝতে পারবেন। আমি সবসময় তাকে ভেবেছি একজন দাম্ভিক হিসেবে। সবসময় তার সদম্ভ আচরণ, চিৎকার, রাষ্ট্রদূতদের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ, মদ্য পান…….এবং সবসময় আমেরিকানদের গালিগালাজকে আমি পছন্দ করিনি। ক্রুশ্চেভ এশিয়ার অনেক ক্ষতি করেছেন। সবশেষে বলতে চাই…….আমি জানি আপনি আমার থেকে মাও সে তুং সম্পর্কে কিছু শােনার প্রতীক্ষা করছেন। কিন্তু মাও সে তুং এর মতাে মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমার কাছে কি শুনতে চান? বরং চৌ এন লাই সম্পর্কে আমার পক্ষে বলা সহজ। এমন একজন যাকে আমি ভালােভাবে জানি। তার সাথে দীর্ঘসময় ধরে আমি কথা বলেছি, আলােচনা করেছি। অফুরন্ত আলােচনা, ভাের থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দিনের পর দিন। কমপক্ষে বছরে একবার আমাদের সাক্ষাত হতাে। ১৯৬২ সাল থেকে আমি চীনে যাচ্ছি এবং চৌ এন লাই এর সঙ্গে সাক্ষাত করছি। আমি তার প্রশংসা করি।
ও ফা: মি. প্রেসিডেন্ট, যাদের কথা বললেন তাদের সকলকেই ক্ষমতা লাভের জন্য অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। কিন্তু আপনি তাে তা করেননি।
জু আ ভু: আপনি ভুল বলছেন। এখানে পৌছাটা আমার জন্যে খুব সহজ ছিল। আমি কারারুদ্ধ ছিলাম। অনেকবার আমার জীবনের উপর ঝুঁকি এসেছে। আইয়ুব খানের সময়ে, ইয়াহিয়া খানের সময়। তারা আমার খাবারে বিষ প্রয়ােগ করে হত্যার চেষ্টা করেছে, গুলিবর্ষণ করেছে। ১৯৬৮ সালে দু’বার আমার প্রাণনাশের চেষ্টা হয়, ১৯৭০ সালে একবার। দু’বছর আগে সংঘর্ষে ইয়াহিয়া খানের প্রেরিত হত্যাকারীদের সাথে পাল্টা গােলাগুলির মধ্যে আমি ঘণ্টাখানেক আটকা পড়ে ছিলাম। আমাকে ঘিরে রাখা এক ব্যক্তি নিহত হয়। অন্যেরা গুরুতর আহত হয়। এছাড়া মানসিক পীড়নের কথাই ভাবুন-আপনার জন্ম হয়েছে ধনবান পরিবারে এবং রূপান্তরিত হয়েছেন একজন সমাজতন্ত্রীতে-কেউ আপনাকে বিশ্বাস করবে না। আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও এনিয়ে হাসিঠাট্টা করবে। এমনকি দরিদ্র লােকজন আপনার নিষ্ঠার প্রতি আস্থাশীল হবে না। বুলেটের হাত বা বিষ থেকে রক্ষা পাওয়া আমার জন্যে কঠিন কাজ নয়। আমাকে যে কিছুলােক বিশ্বাস করছে না, সেটাই আমার কাছে গুরুতর। যে প্রাচুর্যের মধ্যে আমি

পৃষ্ঠাঃ ৬৩
জন্মগ্রহণ করেছি তা আমাকে আলাদিনের উড়ন্ত গালিচায় বসায়নি। রাজনীতিকে যদি আমার পেশা হিসেবে না নিতাম….।
ও ফা: এ পেশার সূচনা হলাে কিভাবে?
জু আ ভূ: আমি যখন একজন বালক, তখন থেকেই এটা ছিল। কিন্তু আমরা যদি মনােবিশ্লেষক হিসেবে কাজ করতে চাই, তাহলে বলতে হয়, আমি এর উত্তরাধিকার পেয়েছি আমার পিতার নিকট থেকে। আমার পিতা একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ ছিলেন। কিন্তু বেশ আগেই তিনি রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন—একটি নির্বাচনে পরাজিত হবার পর রাজনীতি সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল টনটনে-আভিজাত্যের রাজনীতি জ্ঞান। আমাকে এমনভাবে বলতেন, তাতে আমার মধ্যে অনুপ্রেরণা জাগত। তিনি আমাকে লারকানায় ঘুরিয়ে আনতেন। প্রাচীন মন্দির, জাঁকজমকপূর্ণ বাড়ি, আমাদের সভ্যতার কীর্তি দেখাতেন এবং বলতেন, “রাজনীতি হচ্ছে একটি মন্দির বা ভবন নির্মাণের মতাে তিনি আরাে বলতেন যে, রাজনীতি সঙ্গীত রচনার মতাে অথবা কবিতা লেখার মতাে। তিনি ব্রাহমা, মাইকোল্যাঞ্জেলাের কথা বলতেন। আমার মা ভিন্ন প্রকৃতির ছিলেন। তিনি এসেছিলেন দরিদ্র পরিবার হতে এবং অন্যান্য লােকের দারিদ্র্য তাকে পীড়িত করতাে। তিনি বার বার শুধু শুধু বলতেন, “আমাদেরকে দরিদ্রের প্রতি যত্নবান হতে হবে, দরিদ্রকে সাহায্য করতে হবে; দরিদ্রকে পৃথিবীতে বাঁচতে দিতে হবে ইত্যাদি।
আমি যখন আমেরিকা গেলাম, তার এসব কথা আমার কানে বাজতাে। আমি একজন সংস্কারবাদী হলাম। আমি আমেরিকায় ইউনিভার্সিটি অব ক্যালফোর্নিয়ায় পড়াশােনা করতে গিয়েছিলাম, যেখানে আন্তর্জাতিক আইনের একজন বিখ্যাত জুরিস্ট পড়াতেন। আমি আন্তর্জাতিক আইনে আমার ডিগ্রী নিতে চেয়েছিলাম। তখন যুগটা ছিল ম্যাকার্থিজমের। কমিউনিস্ট অনুসন্ধানের সময় আমার ইচ্ছা উবে গেল। সানসেট বুলভার্ড থেকে, লাল নেইল পলিশ করা মেয়েদের থেকে দূরে থাকার জন্যে আমি ম্যাক্সওয়েল স্ট্রীটে নিগ্রোদের সাথে বসবাস শুরু করলাম। এক সপ্তাহ, এক মাস। ওদের সাথে আমার ভালাে লাগলাে-তাদের মাঝে কৃত্রিমতা নেই। তারা জানতাে কি করে হাসতে হয়। আমি যখন স্যান ডিয়েগােতে গেলাম, একটা হােটেলে থাকার জায়গা পেলাম না, কারণ তামাটে চামড়ার রং এ আমাকে একজন মেক্সিকানের মতােই দেখতে। এরপর আমি ইংল্যাণ্ড গেলাম। তখন আলজিরিয়ার বিপ্লবের সময়। আলজিরীয়দের পক্ষ নিলাম আমি। কিন্তু ১০নং ডাউনিং স্ট্রীটের সামনে আমি স্লোগান দিতে যেতাম না। হয়তাে আমি কিছুটা লাজুক ছিলাম। জনতার মধ্যে মিশে যেতে আমি কখনাে পছন্দ করতাম না, বিক্ষোভে অংশ নিতাম না। আমি সবসময় লেখার মাধ্যমে আলােচনাকে প্রাধান্য দিয়েছি, রাজনীতির খেলায় সংগ্রাম করতে পছন্দ করেছি। এটা অনেক বুদ্ধিদীপ্ত এবং পরিশীলিত।

পৃষ্ঠাঃ ৬৪
ও ফা: আমার শেষ প্রশ্ন মি. প্রেসিডেন্ট। এই নির্দয় প্রশ্নের জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনি কি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন বলে মনে করেন?
জু আ ভুঃ জবাবটা এভাবে দেই। আমি আগামীকালই শেষ হয়ে যেতে পারি। কিন্তু এযাবত যারা পাকিস্তান শাসন করেছে আমি তাদের যে কারাে চেয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকবাে বলেই মনে করি। প্রথমত আমি স্বাস্থ্যবান ও শক্তিতে পরিপূর্ণ। আমি কাজ করতে পারি, এমনকি দৈনিক আঠার ঘণ্টা কাজ করি। দ্বিতীয়ত আমি এখনাে তরুণ-আমার বয়স বড়জোড় চুয়াল্লিশ, মিসেস গান্ধীর চেয়ে দশ বছরের ছােট। তৃতীয়ত আমি জানি, আমি কি চাই। আমিই তৃতীয় বিশ্বের একমাত্র নেতা যে দু’টি বৃহৎ শক্তির বিরােধিতা সত্ত্বেও রাজনীতিতে ফিরে এসেছি। ১৯৬৬ সালে আমাকে বিপদগ্রস্ত দেখে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই খুশি হয়েছিল। আমি যে বিপদ অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছি, তার কারণ আমি এই পেশার মৌলিক নীতি জানি। সে নীতিটি কি? রাজনীতিতে আপনাকে কখনাে কখনাে এমন ভাব করতে হয়, যাতে অন্যেরা বিশ্বাস করে যে, একমাত্র তারাই বুদ্ধিমান। কিন্তু এটা করতে একটু হালকা এবং শিথিল অঙ্গুলি থাকতে হবে এবং…..। আপনি কি কখনাে পাখিকে তার বাসায় ডিসের উপর তা দিতে দেখেছেন? একজন রাজনীতিবিদের সেই হালকা আঙ্গুল পাখির নিচের ডিমগুলাে সরিয়ে আনার যােগ্যতা থাকতে হবে। একটি একটি করে। যাতে পাখিটি কিছুতেই টের না পায়।
করাচী, এপ্রিল ১৯৭২
রেফারেন্স – ইনটারভিউ উইথ হিস্টরি – ওরিয়ানা ফালাচি – অনুবাদ আনোয়ার হোসেন মঞ্জু