বাংলার আগুন | ফ্রাঙ্কফুটার আলমেইন জাইটুং | দ্যা ডেইলি ফ্রাঙ্কফুটার, পশ্চিম জার্মানি | ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সম্পাদকীয়
রচনায়ঃ ক্লস নাটরপ
বাংলার চলমান দুর্দশার কোন সুরাহা এখনও পর্যন্ত হয়নি। সত্যিই কি এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়? বিষয়টি অনেক আগেই এমন এক পর্যায়ে পৌছে গেছে, যেখান থেকে এখন আর এটিকে নিছকই পাকিস্তানের “অভ্যন্তরীণ বিষয়” বলে গন্য করা যাচ্ছেনা। যে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিয়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালি দিন কাটাচ্ছে, তাতে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর এই বিষয়ে প্রশ্ন তোলাই স্বাভাবিক। তবে তারাই বা কি করতে পারেন?
এমুহূর্তে মানবিক সাহায্যই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী। ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের মত প্রচন্ড দুর্দশা ও অভাবের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাঙ্গালিরাও। তাদের সহায়তা করার কার্যক্রমকে আরো উন্নত করা যেতে পারে। কিন্তু, সেটাই শেষ কথা নয়। সমস্যার উপসর্গ নয়, বরং মুল সমস্যাকেই সমুলে উৎপাটন করতে হবে। এই সমাধানের ক্ষেত্রে দুইটি বিষয় খুবি জরুরী। প্রথমত, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে,যার মানে হল, ১৯৪৭ এ একত্রিত হওয়া এই দুই অঞ্চলের মধ্যে বর্তমানে যে বিচ্ছিন্ন অবস্থান চলমান, তা নিরসন করে পুনরায় তাদের একত্রিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পূর্ব বাংলার এই সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশীয় দুই প্রতিবেশি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে বিপদজনক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে তা হ্রাস করা। যতদুর মনে হয়, দ্বিতীয় উল্লেখিত সমস্যাটির ক্ষেত্রে এখন কিছুটা শিথিলতার লক্ষন দেখা যাচ্ছে। যুদ্ধের ঝুকি কিছুটা কমেছে বলেই মনে হচ্ছে। যদিও যুদ্ধের দামামা বাজছে দুই দেশেই, তবে বাংগালির স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করতে গিয়ে যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে এ মুহূর্তে একটি সামরিক যুদ্ধ যে দুই দেশের জন্যই দুর্ভোগ বয়ে আনবে তা মনে হয় নিউ দিল্লী ও ইসলামাবাদের নেতারা উপলব্ধি করতে পারছেন।
যুদ্ধের সম্ভাবনা কমিয়ে আনতে গত ৯ই অগাস্ট স্বাক্ষরিত ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তিরও একটি ভুমিকা আছে বলে মনে হচ্ছে। নিজের দক্ষিন সীমান্তের এত কাছে কোন বিশৃঙ্খল সংঘর্ষ হোক তা সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনই চাইবেনা; বিশেষ করে যদি সেখান থেকে চায়নার উপকৃত হবার কোন সম্ভাবনা থেকে থাকে, তারা প্রতিরোধ করবেই। প্রথম দিকে, মস্কো একপেশে ভাবে ভারত ও ভারতের তীব্র সমর্থনপুষ্ট বাঙ্গালী স্বাধীনতা আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হলেও, অচিরেই তা ভুল বলে প্রমানিত হল। ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি সমআচরনের যে নীতি ১৯৬৬ সালে তাশখন্দে প্রবর্তিত হয়েছিল, সোভিয়েত নেতারা তা অনুসরন করে যাচ্ছেন এখনও। তার উপর, পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা অব্যাহত রাখার বিষয়ে দেশটি আগ্রহী বলে সম্প্রতি একটি ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এমনকি ইতিমধ্যেই, পাকিস্তানকে উন্নয়ন সহায়তা দেয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের অবস্থান প্রমান করে দিয়েছে। সম্ভবত এই অবস্থান ভারতকে সংযত হতে প্রভাবিত করেছে। স্বভাবতই ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তির ফলে পাকিস্তানও কিছুটা শান্ত আচরন করছে। ভারতের সাথে ঝামেলায় জড়ালে ইসলামাবাদের সরকারকে সর্বক্ষণ আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে থাকতে হবে। তবে যাইহোক, যে কারনে মুলত এ উত্তেজনার সৃষ্টি, সেটিরই সমাধান যেহেতু এখনও হয়নি, সেহেতু উপমহাদেশের এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ হবার সম্ভাবনাও একেবারে শেষ হয়ে যায়নি।
পূর্ব বাঙ্গলার স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীরাও এখন পাকিস্তানের জন্য একটি বড় সমস্যার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে আন্দোলন মুলত পরিচালিত হয় ভারত থেকে। সম্মুখ যুদ্ধে সীমান্ত লঙ্ঘন হতেই পারে, কিন্তু হয়ত এটিই যুদ্ধের আগুনকে আরেকটু উস্কে দিবে। বর্ষা শেষ হতে হতে সাধারন মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকখানি ভাল অবস্থানে চলে আসার সম্ভাবনাই বেশি। সেক্ষেত্রে সংঘাতের সংখ্যাও আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। সুতরাং খুবি জরুরী ভিত্তিতে একজন নিরপেক্ষ মধ্যস্ততাকারীর প্রয়োজন যিনি অবস্থা আরো খারাপ হবার আগেই ভারত ও পাকিস্তানকে আলোচনার জন্য এক টেবিলে নিয়ে আসতে পারবেন। এসময়ে পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের কিভাবে দ্রুত ভিত্তিতে ফেরত পাঠানো যায় সে বিষয়েও আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। স্থায়ীভাবে তাদের দায়িত্ব নেয়া ভারতের জন্য একটি অসহনীয় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। স্বাভাবিকভাবেই, সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি আলোচনায় উঠে আসবে, যার ফলে শরণার্থী পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পরছে। কেননা, নিজদেশে নিরাপত্তা ও সেনাদের ব্যারাকে ফেরত যাওয়ার নিশ্চয়তা না পেলে কোন শরণার্থী ফেরত যেতে সম্মত হবে না।
কিন্তু, পাকিস্তানি পূর্ব বাংলার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে কারো সাথেই, এমনকি কোন নিরপেক্ষ পক্ষের সাথে আলোচনা করতেও ইচ্ছুক নয়। কেননা তা করতে গেলে ইসলামাবাদ সরকারকে স্বীকার করে নিতে হবে যে এ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমে যেটি প্রয়োজন, সেই দুই প্রদেশের পুনর্মিলিত হবার সম্ভাবনা যদি থেকেও থাকে তাও খুবি কম। দেশের জনসাধারণের বেশিরভাগই পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের দখলদার বাহিনী বলে ভাবে। তারা বেসামরিক প্রশাসন চায়। তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত বেসামরিক সরকার নির্বাচিতও করেছিল, কিন্তু তার ফলে আজ তাদের বিদ্রোহী বলে চিনহিত করা হচ্ছে। ভারতের সাহায্য ছাড়াই তারা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ করে যাচ্ছে। গ্রেফতার হওয়া নেতা শেখ মুজিবর রহমানকেই তারা আজো তাদের আদর্শ ভাবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যদি তার সাধারন ক্ষমার আওতার মধ্যে শেখ মুজিবর রহমান এবং আওয়ামীলীগের অন্যান্য নেতাদের অন্তর্ভুক্ত না করে, তবে অভ্যন্তরীণ কোন সমঝোতায় আসার সম্ভাবনা খুবি কম।
সবকিছু নতুনভাবে শুরু করা ছাড়া এই সেনাদের নিপীড়ন, প্রতিরোধ, প্রতিশোধ, ষড়যন্ত্র, সঙ্ঘাত, ক্ষুধা, রোগ বালাই এবং আরো যত সম্ভাব্য বিপর্যয় হতে পারে, তার দুষ্টচক্র ভাঙ্গা সম্ভব হবে না। তবে এখনও পর্যন্ত, পাকিস্তান নতুনভাবে সবকিছু শুরু করার অনুপ্রেরনা খুব কমই পেয়েছে।