টাইম ম্যাগাজিন, ২৯ নভেম্বর ১৯৭১
ভারত – যদি না, কিন্তু কখন?
প্রধানমন্ত্রী তার পশ্চিমের দেশে ৩ সপ্তাহের সফর শেষে প্রথম যে কাজটি করেছেন তা হল পার্লামেন্টে গিয়ে সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন। পরিস্থিতির আশু সমাধান আপেক্ষিক। নয়াদিল্লীর সরকারি মুখপাত্র বলেন ভারত পাকিস্তান সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয়েছিল যখন পশ্চিমবঙ্গে ১৮০০ জন পাকিস্তানি রেগুলার সেনা প্রবেশ করেছিল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজিবন রাম পার্লামেন্টে বললেন পাকিস্তানের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া উচিত। সাড়া দেশ জুড়ে বাজি লাগছিল কখন পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ শুরু হবে।
মিসেস গান্ধি আশাবাদী যে পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার গৃহযুদ্ধ দ্রুত শেষ হবে। তিনি বলেন একেবারে সমাধানযোগ্য নয় এমন সমস্যারও সমাধান আছে। তিনি বলেন যতক্ষণ পর্যন্ত পশ্চিমারা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত ভারত একা কোন ব্যাবস্থা নেবে না। তিনি আশা করেন যে তারা প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মাদ ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারকে চাপ দেবেন একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য যা পুর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
যদিও ইন্দিরার সফরে শরণার্থীদের জন্য উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক সাহায্য এসেছে তথাপি ভারত অনেক বড় অর্থণৈতিক চাপে আছে যার পরিমাণ এই অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ মার্চ পর্যন্ত ৮৩০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। ১৯৭০ সালে গ্রস ন্যাশনাল প্রোডাক্ট ছিল মাত্র ৫০ বিলিয়ন ডলার এবং ৫৬০ মিলিয়ন জনগণের দেশ হিসেবে ভারতের পক্ষে এই চাপ সহ্য করা মুশকিল।
জাতিগত উত্তেজনা
অর্থোণৈতিক ব্যয়ের পাশাপাশি ৯৭০০০০০ জন শরণার্থী সামাজিক টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি করছে এবং জাতিগত উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই আছে ৭০০০০০০ জন শরনার্থি এবং আরও আসছে। ভারত সরকার ভয়ে আছেন যে অনেক হিন্দু শরনার্থি যারা মূলত একা (অর্থাৎ যাদের পরিবারে কেউ নেই) তারা হয়ত পাকিস্তানে মুসলিম মিলিটারির ভয়ে আর নাও ফিরে যেতে পারে।
গত মার্চে যখন সমস্যা শুরু হল তখন সীমান্ত এলাকায় অনেকেই সাহায্যের জন্য এগিয়ে গিয়েছিল। এখন পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের চাপ এত বেশি যে অনেক উত্তেজনা বিরাজ করছে – তাই ক্যাম্পে সশস্ত্র পাহারা দেয়া হয়েছে – এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কর্মচারীরা কাঁটাতার দিয়ে রিলিফ ক্যাম্পের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছেন।
উত্তেজনা মূলত বেড়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস আগে পাওয়ার ব্যাপারে এবং অনেকে চাকরি নিয়ে চিন্তিত। ক্যাম্পের ভেতরে শরনার্থিদের বলা হচ্ছে কোন কাজ না খুঁজতে এবং পাশের গ্রামের ভেতরে না যেতে। স্থানীয়দের সাথে এটা নিয়ে দ্বন্দ্ব হচ্ছে যে শরণার্থীরা দিনে ১ রুপি (২৫ সেন্ট) তে কাজ করতে চায় আর স্থানীয়রা দিনে আড়াই রুপি নেয়। ক্ষেতমজুর, দোকানের কর্মচারি এরা এবং নদীয়ার অন্যান্য ওয়ার্কিং ডিস্ট্রিক্ট এর কর্মচারিরা স্থানীয় চাকরিদাতাদের অনুরোধ করছে যাতে তারা শরনার্থিদের চাকরি না দেয়। স্থানীয়রা আরও অভিযোগ করে যে কেরোসিন, সবজি আর অন্যান্য খাবারের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
অনেকগুলো ঘটনা নির্দেশ করে যে স্থানীয় জনগণ নূন্যতম কেয়ার পাচ্ছেনা যা কিনা শরনার্থিদের দেয়া হচ্ছে। কৃষক যোগেন মণ্ডল বলে যে – এই লোকগুলো হল খারাপ লোক। প্রত্যেকের তিনটি রেশন কার্ড আছে। রেশনের কিছুটা রেখে দিয়ে বাকিটা তারা বিক্রি করে দেয়। তারা ফ্রি মেডিকেল চিকিৎসা পাচ্ছে – অথচ তারা অনেকেই আমাদের থেকে ভালো আছে। বাহেন্দ্রনাথ রায় বলেন পূর্ব পাকিস্তানের মনিরামপুর কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল একজন শরনার্থি। আমরা জানি স্থানীয় লোকেরা আমাদের উপস্থিতি পছন্দ করছে না এবং প্রতিদিন ঝগড়া বিবাদ হচ্ছে। ক্যাম্প এর কর্মচারিরা আমাদের তেমন রেশন দিচ্ছেনা। এবং আপনি যদি অভিযোগ কেন্দ্রে যান তাহলে স্থানীয়রা আমাদের মারধর করে।
বড় সমস্যা
যানা মতে হিন্দু মুসলিম দের মাঝে উল্লেখযোগ্য দাঙ্গা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে তথাপি এখন পশ্চিমবঙ্গে অর্থণৈতিক ও জনসংখ্যার চাপ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যেই ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় যখন পূর্ব বাংলা মুলসিম দেশের সাথে থাকতে চাইল তখন সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসা ৪০০০০০০ হিন্দুর বিশাল জনসংখ্যার বোঝার কারণে পশ্চিমবঙ্গে বেকারত্ব রয়েছে এবং সেই অর্থনৈতিক অবনতি থেকে পশ্চিমবঙ্গ এখনো উত্তরণ ঘটাতে পারেনি। সেই থেকে এই এলাকা সন্ত্রাসীদের জন্য একটি স্বর্গ – ক্রিমিনালরা রাজনীতির ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে – অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা ছেলেরা চাকরির কোন সন্ধান পাচ্ছেনা। কিন্তু কর্মচারিরা তার উপর এত লক্ষ লক্ষ মানুষের চাপ সহ্য করছে – এতে করে অন্যান্য সমস্যা প্রায় চাপা পরে গেছে। মিসেস গান্ধির পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা সিদ্ধার্থ সংকর রায় বলেন, ‘আমার বড় সমস্যা হল শরনার্থিদের থাকতে দেয়া ২৫০০ স্কুল আমি কখন শুরু করতে পারব।’