ঢাকার মিরপুরে প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকার : মোহাম্মদ আ: সোবহান
(মোহাম্মদ আব্দুস সোবহান ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আর্মড সাব ইন্সপেক্টর অব পুলিশ হিসেবে কর্মরত থাকাকালে মিরপুর দশ নম্বর সেকশনে জরুরী টহলে গিয়েছিলেন)
ইন্সপেক্টর অফ রিজার্ভ পুলিশ
বি-আর-পি, রাজশাহী
২৯-১-১৯৭৪
আমার ওয়ারলেস সেটটি কিছুক্ষন নীরব থাকার পর রাজারবাগ ওয়ারলেস কন্ট্রোল রুম থেকে আর এক বাঙালি পুলিশের কণ্ঠ ঘোষণা করলো, “অল অফিসার্স অফ এণ্ড অ্যাভব র্যাঙ্ক অফ ইন্সপেক্টরস উইল প্রোসিড টু দেয়ার কোয়ার্টার্স।” হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের পশ্চিমের গেটে প্রহরারত বাঙালি পুলিশের ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠ আমার ওয়ারলেস সেটে বেজে ওঠার পর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কন্ট্রোল রুমের ওয়ারলেস থেকে সতর্কবাণী পাওয়ার পর আমারা সন্ত্রস্ত হয়ে পরেছিলাম। এরপর বিএসপি, ইন্সপেক্টর সহ সকল পদস্থ বাঙালি পুলিশ অফিসার যারা মিরপুর ও অন্যান্য স্থানে বিভিন্ন সেকশন ও সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন, ওয়ারলেস মারফৎ রাজারবাগ কন্ট্রোল রুম থেকে উপরোক্ত নির্দেশ পাওয়ার পর সবাই হেড কোয়ার্টারে চলে গেলে আমি আমার এক প্লাটুন (৩৭ জন পুলিশ) নিয়ে মিরপুর থানায় উঠি। সেখানে আমি মিরপুরের বিভিন্ন সেকশনে কর্তব্যরত সকল ফোর্সকেই জমায়েত দেখতে পাই। সারা মিরপুরে এ সময় থমথমে ভাব বিরাজ করছিলো। হঠাৎ পুলিশ (কমিশনার বিল্ডিং) কন্ট্রোল রুম থেকে আবার ওয়্যারলেস সেটে বাঙালি পুলিশের কম্পিত কণ্ঠ বেজে উঠলো। সেই কণ্ঠ বলছিলো- “পাক আর্মি ভারী কামান, ট্যাংক ও মেশিনগান নিয়ে আমাদের কন্ট্রোনল রুম ঘেরাও করে ফেলেছে। ওরা গোলাবর্ষণ করতে করতে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে আমাদিগকে নিশ্চিহ্ণ করে দেবার জন্য- ওরা ভীষণভাবে ধেয়ে আসছে – তোমরা যে যেখানে থাকো এগিয়ে আসো, আমাদের রক্ষা করো, বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও।” সেই কণ্ঠ বলে যাচ্ছিলো– “রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকপশুদের হামলা হয়েছে, সেখানেই গোলাগুলি চলছে, আমাদের বীর পুলিশরা লড়ছে, সেখানকার ওয়্যারলেস বেইস থেকে আমরা কোন শব্দ পাচ্ছি না, সব নীরব নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।” পরক্ষনেই আমারা ঢাকার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশে বৃষ্টির মতো লাইট বোম উড়ছে। কামান, ট্যাঙ্ক আর গোলাবর্ষণের ভীষণ গর্জন শুনছিলাম, অসংখ্য মানুষের বুকফাটা অসহায় কান্নার রোল ভেসে আসছিলো। অস্থির অধীর ছাত্র জনতা যেন ঝাপিয়ে পড়ছে সেই অসংখ্য কামান, ট্যাঙ্ক ও গোলাবর্ষণের আগুনের মধ্যে। চোখের সামনে দেখলাম আগুন আর আগুন, জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলছে, রাজধানী ঢাকা জ্বলছে। চোখ ফিরিয়ে মোহাম্মদপুরের আসাদ গেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানেও ভীষণ গুলি আরম্ভ হয়ে গেছে, বাড়ি ঘর জ্বলছে । সেই ভয়াল ও ভয়ংকর গোলাবর্ষন ও আগুনের লেলিহান শিখা আস্তে আস্তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিলো, আমাদের ফোর্স সবই মিরপুর থানায় জামায়েত হয়েছিল। অর্ধেকের হাতে ছিলো লাঠি আর অর্ধেকের হাতে ছিলো সাধারণ রাইফেল আর বিশ রাউণ্ড গুলি। মিরপুর থানায় এভাবে বসে থাকলে সব এক সাথে ওদের ঘেরাও এর মধ্যে পড়ে কুকুর-বিড়ালের মতো মরতে হবে ভেবে আমরা আমাদের ফোর্সকে বিভিন্ন জায়াগায় ছড়িয়ে পজিশন নিতে বলি আর আমার সিপাহীদের যাদের হাতে শুধু লাঠি ছিল তাদের চলে যেতে বলি আত্মরক্ষার জন্য। আমি আমার ফোর্স নিয়ে মিরপুর ইটখোলার ভিতরে পজিশন নিয়ে পাক পশুদের অপেক্ষা করতে থাকি। আমারা পালাই নাই। কারণ পালাবার ইচ্ছা আমাদের ছিলো না। আমারা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দৃঢ় শপথ নিয়েছিলাম। সামান্য রাইফেল নিয়েই আমারা পশুদের প্রতিরোধ করবো। প্রতিহত করবো, লড়বো তবু পিছু হটবো না। সারারাত আমি আমার সশস্ত্র ফোর্স নিয়ে সেই ইটখোলার বিভিন্ন জায়াগায় ছড়িয়ে পড়ে পজিশন নিয়ে বসেছিলাম। আর ঢাকার আকাশে দেখেছিলাম আগুনের লেলিহান শিখা, সকল নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার সহিত পাক পশুদের কামান ও ট্যাঙ্ক যুদ্ধের তাণ্ডবলীলা। রাত তিনটার সময় আমরা দেখছিলাম আমাদের চোখের সম্মুখে চারটি সশস্ত্র পাকসেনাদের ট্রাক চলে গেলো। ট্রাকের পিছনে পিছনে যাচ্ছিলো কামান বসানো ‘ডজ’। মিরপুরের ইপিআর বাহিনীর সাথে আমারা পাক আর্মিদের এক ঘন্টা তুমুল সংঘর্ষ দেখলাম। কামান ও ট্যাঙ্কের কানফাটা গর্জনে আমারা সবাই বিমূঢ় হয়ে পড়ছিলাম। কিছুক্ষন পর দেখলাম পাক আর্মি সেই সশস্ত্র ট্রাকগুলো নিয়ে ফিরছে আর তার পিছনে আরও তিনটি ট্রাক আসছিল। ঐ অতিরিক্ত ট্রাকে ছিলো পর্যুদস্ত বাঙালি ইপিআর বন্দীরা। আমাদের সম্মুখ দিয়েই পাক পশুদের সশস্ত্র ট্রাকগুলো ইপিআর বন্দীদের নিয়ে সদর্পে এগোচ্ছিলো। আমি আমার সিপাহীদের ওদের উপর গুলিবর্ষণ করতে নিষেধ করছিলাম। ওদের গাড়িগুলো এগোচ্ছিলো– সবই চলে গেলো । পিছনে দুটি গাড়ি থাকতেই আমার এক সিপাহী হঠাৎ ওদের প্রতি গুলিবর্ষণ করতেই ওরা ট্রাক থামিয়ে নেমে পড়ে কুকুরের মতো। ভীষণ ব্রাশ ফায়ার শুরু হয় আমার সিপাহীদের উপর। আমাদের উপর পড়ছিলো অসংখ্য গ্রেনেড, আরোও পড়েছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান থেকে বৃষ্টির মত অসংখ্য গুলি। আমরা আমাদের সামান্য রাইফেল নিয়েই পশুদের প্রাণপণ প্রতিরোধ করতে থাকি । কিছুক্ষণ পর আমাদের গুলি শেষ হয়ে গেলে আমরা গুলিবর্ষণ করতে করতে আস্তে আস্তে পিছু হটতে থাকি– আমাদের হাতে সামান্য রাইফেল থাকলেও ওরা রাতের কালো অন্ধকারে সেই ভারী কামান, ট্যাঙ্ক বহর ও অসংখ্য মেশিনগান, গ্রেনেড ও সশস্ত্র সৈন্য নিয়েও আমাদের সামনে সদম্ভে এগিয়ে আসতে সাহস পায় নাই। আমাদের দূর্জয় মানসিক শক্তির সামনে ওরা প্রথমত আসতে সাহস পায় নাই। সামান্য রাইফেল দিয়েই ওদেরকে প্রায় এক ঘন্টা প্রতিরোধের পর আমি আমার ফোর্স নিয়ে পিছু হটছিলাম। আমার ফোর্স সব পিছনে চলে গিয়েছিলো। আমি আমার দূর্জয় সিপাহী নিয়ে একাই ওদের বিরুদ্ধে ফাইট দিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম ওরা নীরব- ওদের নীরবতা দেখে আমি ওদের ঘেরাওয়ের মাঝে পড়ে যাওয়ার ভয়ে পিছু হটে চলে আসি। পিছনে এসে দেখমাল এক প্রাসাদের ছাদের উপর এক বিদেশী দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তার গেটের সামনে যাওয়ার সাথে সাথে সেই বিদেশী ভদ্রলোক এসে আমাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বিল্ডিংয়ের পিছনে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় দিলেন। কিন্তু সে জায়গা নিরাপদ মনে না করায় আমরা সেই ভদ্রলোকের পরামর্শ অনুযায়ী তার বিল্ডিংয়ের পিছনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার এক সিপাহীর কথামত আমরা সবাই নিকটবর্তী অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মান্নান সাহেবের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেই। তিনি আমাদিগকে যথেষ্ট যত্ন করেন। আমারা তার বাড়িতে চা নাস্তা খেয়ে ছাদের উপরে গিয়ে দেখলাম পাক আর্মিরা ইটখোলার ভিতরে ঢুকে আমাদিগকে সার্চ করছে, তখন ভোর হয়ে গিয়েছিলো। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার তার বাসা থেকেই ধেয়ে আসতে থাকা পাক আর্মিদের বিরুদ্ধে ফাইট দিতে বললেন কিন্তু আমার সিপাহীদের গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় এবং রাতের ফাইটে আমরা সাঙ্ঘাতিক ভাবে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় কল্যানপুরের বাঙালি এলাকায় চলে গিয়ে পুলিশের পোশাক ফেলে দিয়ে কলোনীর বাঙালি ভাইদের দেয়া ছেঁড়া লুঙ্গী গেঞ্জী পরে কল্যানপুর কলোনীর ছাত্র-জনতার সাথে মিশে গিয়ে সেখাঙ্কার বাঙালি জনতাকে সর্বতোভাবে সাহস দিতে থাকি। সকাল তখন দশটা বেজে গিয়েছিলো। আমি আমার হাতে রাখা অচল ওয়্যারলেস সেটটা মেরামত করে সচল করে দিয়ে ঢাকার সব পুলিশ সেক্টর ডেড দেখলাম। মিরপুর থানার সহিত লাইন দিলাম, সেখান থেকে এক বাঙালি কণ্ঠ ভেসে আসছিল– জোর করে স্বাভাবিক করা সেই কণ্ঠ বলছিলো, “মিরপুর থানা,” পরক্ষনেই এক অবাঙালি পাকসেনা ওয়্যারলেস সেটে বলে ওঠে– “কোন শালা কাহা তোম বোলতা হায়।” আমি বেশ বুঝতে পারি ওয়্যারলেসে বাঙালি কণ্ঠ সোনা গেলেও সেখানে পাকসেনাদের প্রভুত্ব বহাল রয়েছে। এরপর আমি আমার ওয়্যারলেস সেটটি অচল করে কল্যানপুর কলোনীর এক বাঙালির বাসায় রেখে পার্শ্ববর্তী মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। মসজিদে জনতার ব্যাকুল চাহনী কিছুতেই এড়াতে পারলাম না। নামাজ শেষে বের হয়ে এসে পাশের এক ছোট ঘরে বসে আছি এমন সময় দেখলাম অসংখ্য দাঙ্গাবাজ বিহারী লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে, পিছনে পাকসেনাদের গাড়ী। বিহারীরা সেখানে এসেই বাঙালি কনোনীতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে লুটপাট শুরু করে দিলো। ইতিমধ্যে পাকসেনাদের গাড়ী দুটো বিহারীদের বাঙালি কলোনীতে লুণ্ঠনে লাগিয়ে দিতে চলে গেলো। আমরা বিহারীদের তাণ্ডবলীলা আর সইতে পারলাম না– আমি আমার সিপাহীদের পজিশন নিয়ে বিহারীদের উপর ফায়ার করার নির্দেশ দিলে দুজন বিহারী গুলি খেয়ে পড়ে যায়– আর বাকীসব বিহারী দৌড়ে পালিয়ে যায়। তখনকার মত কল্যানপুর বাঙালি কলোনী বেঁচে যায় বিহারী লুণ্ঠন থেকে। আমাদের গুলিবর্ষনে বাঙালি কলোনীতে আসন্ন পাক ও বিহারীদের হামলা ও লুণ্ঠনের আশংকায় সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পাগলের মতো পালাতে থেকে চারদিকে। এরপর আমি মিরপুরের রাস্তার সামনে নদী পার হয়ে গ্রামের দীর্ঘ রাস্তা ধরে আমাদের সিপাহীদের নিয়ে অজানার পথে অদৃশ্য হয়ে যাই।
Source: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড