You dont have javascript enabled! Please enable it! স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা - সংগ্রামের নোটবুক

স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা

১৯৬৮ সালে প্রকাশিত পুস্তকটিতে ষষ্ঠ অধ্যায় ছিল সর্বশেষ অধ্যায়। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত এই ভাষান্তরে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের পূর্ববর্তী কয়েক বৎসরের ঘটনাবলী ও পরিপ্রেক্ষিত অতিসংক্ষেপে সংযােজিত হওয়া যুক্তিযুক্ত (তাই এই পরিশিষ্ট)।
শেখ মুজিবর রহমান গ্রেফতার হন ১৯৬৬ সালের মে মাসে। তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযােগ আনা হয়। এই অভিযােগ সত্ত্বেও তিনি জামিনে মুক্তিলাভ করেন। তখন তাকে জননিরাপত্তা আইনে আটক করা হয়। কারাগারের অভ্যন্তরে মুজিবরের বিচার অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্র সাংবাদিকদের বিচারকক্ষে উপস্থিতির অনুমােদন দেয়। বিচারসভার কার্যাবলী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ায় মুজিবরের জনপ্রিয়তা অসামান্য হারে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সরকারের দমন নীতির আংশিক সাফল্যের কারণে ১৯৬৭ সালের ৭ জুন বিগত বৎসরের ৭ জুন – এর ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি ঘটেনি। আওয়ামী লীগের দৃঢ়চেতা নেতারা ছিলেন কারাগারে। ছাত্ররা – বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ এবং মস্কোপন্থী পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন-এর সদস্যবৃন্দ – ১৯৬৭ সালের ৭ জুন প্রতিবাদ সভা, শােভাযাত্রা, ইত্যাদির প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু শীর্ষস্থানীয় ছাত্রনেতারা কারাগারে বা পলাতক থাকতে বাধ্য হয়। সশস্ত্র আধাসামরিক বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমগ্র প্রাঙ্গন ঘিরে রাখে। অতএব ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়। (১)
আপাতদৃষ্টিতে, পূর্ব পাকিস্তান আয়ুবশাহীর নিয়ন্ত্রনে ছিল। বাস্তবে, সরকারবিরােধী গণআন্দোলন পৃথক পৃথক খাতে বিভিন্ন গতিতে প্রবাহিত হােচ্ছিলাে। ছাত্র আন্দোলন অব্যাহত ছিলাে। তাছাড়া, সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে ষাটের দশকের শুরুতে প্রতিষ্ঠিত মাও গবেষণা কেন্দ্র ১৯৬৮ সালের জানুয়ারীতে পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ঐ কেন্দ্র ও আন্দোলন গ্রামাঞ্চলে গেরিলা সংগঠন গড়ে তােলে। সরকারী বিধিনিষেধের কারণে সংগঠনটি গােপনে কার্য পরিচালনা করলেও পূর্ব পাকিস্তানের কিছু কিছু দূরবর্তী গ্রামেও এর শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। (২)
অন্যদিকে, আয়ুবচক্র (এবং পূর্ব পাকিস্তানে তার তল্পিবাহক মােনেম চক্র) দমন নীতি আরও কঠোর ভাবে প্রয়ােগের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উপায় উদ্ভাবন করে। পূর্ব পাকিস্তানের যেসব স্থানে অবাঙ্গালীদের সংখ্যাধিক্য — যেমন, ঢাকার মিরপুর ও মােহম্মদপুরে, ঈশ্বরদি, খুলনা, চট্টগ্রাম, লালমনিরহাট, সৈয়দপুর, ও শান্তাহারের কিয়দংশে – সরকার অবাঙ্গালীদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র বিতরণ করে। ঐ সব অঞ্চলে কর্মরত অবাঙ্গালী প্রশাসকবৃন্দ এ কাজে উদ্যোগ নেয়। মনে হয়, তারা যেন ছয়দফা আন্দোলনের প্রবক্তাদের বিরুদ্ধে আয়ুব যে গৃহযুদ্ধ এবং সশস্ত্র হস্তক্ষেপের হুমকি দেন, সেটিকেই কাজে পরিণত করতে তৎপর। উপরন্তু, পূর্ব পাকিস্তানের রাজ্যপাল মােনেম-এর সহযােগিতায় আয়ুব সরকার ছয় দফা আন্দোলনের সমর্থকদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ষড়যন্ত্রকারী চিহ্নিত করার প্রয়াস নেয়। শেখ মুজিবর রহমান ও তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের জনপ্রিয়তা বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে আয়ুবশাহী এই অভিযােগ আনে যে তারা এবং কিছু সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ভারতের সহায়তায় পাকিস্তানের অখণ্ডতা ধ্বংসের চক্রান্তে লিপ্ত। প্রথমে, ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারী, দুইজন প্রবীণ সি এস পি (সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান) কর্মকতাসহ ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। সরকারী বার্তায় বলা হয় যে তারা পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জাতিবিরােধী পরিকল্পনায় সংশ্লিষ্ট। এর পর ১৯৬৮ সালের ১৮ মার্চ আর একটি সরকারী ঘােষণায় বলা হয়, ইতিপূর্বে পাকিস্তান। প্রতি রক্ষা বিধি অনুযায়ী ধৃত উপরােক্ত ২৮ জনকে ঐ সময়ে স্থল-নৌ-বায়ু সেনাবাহিনীদের প্রতি প্রযােজ্য আইন অনুযায়ী আটক রাখা হলাে। এদের বিরুদ্ধে যে মামলা রুজু করা হলাে, সরকার তার আখ্যা দিলাে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’, এবং শেখ মুজিবর রহমানকে ঐ ষড়যন্ত্রের নায়ক বলে অভিহিত করা হলাে। যে মুজিবর ইতিমধ্যে এক বৎসরেরও বেশি সময় কারাগারের অভ্যন্তরে দিন যাপন করেছেন, তাকে ঐ মামলায় জড়ানাে নিঃসন্দেহে কৌতূহলােদ্দীপক। মুজিবর এবং অন্যান্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রস্তুতির নিমিত্ত তাদের আত্মীয়-বন্ধু-সহকর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়, বিপুল সংখ্যায় গুপ্তচর নিয়ােগ করা হয়, এবং এই ষড়যন্ত্র মামলার নথিপত্র তৈরীতে সরকারের দশ লক্ষেরও বেশি টাকা খরচ করতে হয়। মুজিবর জড়িত হওয়ায় ঐ মামলা বিশাল গুরুত্ব অর্জন করলাে। উল্লেখযােগ্য, আওয়ামী লীগের যেসব নেতা কারাগারের বাইরে ছিলেন, তারা – এবং ঐ দলের সঙ্গে দীর্ঘদিন সংশ্লিষ্ট প্রবীণ ব্যবহারজীবীরাও – এত ভীতিবিহ্বল হয়ে পড়ে যে তিনজন নবীন ব্যবহারজীবীকে মুজিবের সমর্থনে মামলা পরিচালনার জন্য এগিয়ে আসতে দেখা যায়। পরে লণ্ডনে বসবাসকারী কিছু পূর্ব পাকিস্তানীদের আনুকূল্যে বৃটেনের একজন খ্যাতনামা ব্যবহারজীবী মুজিবকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেন। (৩)
পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসংগঠনগুলির মধ্যে তাত্ত্বিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক নানা বিভেদ ছিলাে। কিন্তু মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হওয়ার অব্যবহিত পরে ঐ বিভেদ অনেকটাই দূরীভুত হয়। ১৯৬৮ সালের ২৬ জানুয়ারী ছাত্র সংগঠনগুলি তাদের বিবাদ বিস্মৃত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি দিবস পালন করে। এই উপলক্ষে অনুষ্ঠিত একটি সভায় ছাত্ররা দাবি করে যে মুজিবের বিচার হােক প্রকাশ্যে। বিভিন্ন ছাত্রসং গঠনগুলি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে, এবং ১৯৬৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবস পালনের উদ্দেশ্যে পল্টন ময়দানে একটি যুগ্ম সভা আহ্বান করে। এক ধরণের সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থানও ঘটে যায়। শিক্ষা সম্পর্কে হামুদুর রহমান কমিশনের রিপাের্ট-এর বিরুদ্ধে শিক্ষা সংকোচন ও শিক্ষাক্ষেত্রে দমন নীতির অভিযােগ তুলে ১৯৬৮ সালের ২৪ জুলাই ছাত্র ধর্মঘট ডাকা হয়। একই কারণে ১৯৬৮ সালের ১০ আগষ্ট ছাত্ররা। হরতাল দেয়। সরকার-সমর্থক সাংবাদিক, রাজনীতিক ও শিক্ষকগণ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের ওপর নিষেধাজ্ঞার দাবি জানায়, কারণ ঐ সাহিত্য ইসলামবিরােধী। প্রবেশিকা পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ তথ্য মন্ত্রী, খাজা সাহাবুদ্দিন, একটি বিবৃতিতে বলেন যে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রচনাবলীর ওপর নিষেধজ্ঞা জারী হবে। কিন্তু এই বিবৃতি ও তদনুসারী। সরকারী নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে অধিকতর আড়ম্বর ও উদ্দীপনার মধ্যে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয়। (৪)।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে সরকারী ঘােষণার একমাসের মধ্যেই আয়ুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঐ অসুস্থতাজনিত রাজনৈতিক অস্থিরতা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, কারণ পশ্চিম পাকিস্তানে আয়ুবের প্রাক্তন অনুচর জুলফিকার আলী ভুট্টোই তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে অতীব সংঘর্ষমুখী হয়ে ওঠেন। ১৯৬৮- র নভেম্বর মাসে পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্রদের সঙ্গে সরকারের বিবাদ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে অভূতপূর্ব মাত্রা প্রদান করে। উক্ত মাসে রাওয়ালপিণ্ডির ৭০ জন ছাত্রকে পুলিশ চোরাচালানিকৃত দ্রব্য সংগ্রহের অপরাধে গ্রেফতার করে। এই ব্যাপারটিকে রাওয়ালপিণ্ডি পলিটেকনিকের ছাত্ররা আয়ুবের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে উদ্যোগী হয়। এজন্য তারা ভুট্টোর সহায়তা কামনা করে। ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেয়, ৭ নভেম্বর ভুট্টো তাদের সমাবেশে বক্তৃতা দেবেন। পুলিশ ভুট্টোকে সমাবেশে উপস্থিত হতে দেয় নি। অসন্তুষ্ট ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে একজন পলিটেকনিক ছাত্র নিহত হয়। বিক্ষোভের আশংকায় সরকার রাওয়ালপিণ্ডির সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। এতদসত্ত্বেও ৮ নভেম্বর বিশাল আয়ুববিরােধী ছাত্র মিছিল দেখা যায়। জনসাধারণও ছাত্র বিক্ষোভে যােগ দেয়। আয়ুবের অসংখ্য প্রতিকৃতিতে অগ্নিসংযােগ করা হয়। সান্ধ্য আইন জারী হয়। সেনাবাহিনী আইনশৃংখলার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ৯ নভেম্বর বিনা অপরাধে পুলিশের গুলীতে দুইজন পথচারী প্রাণ হারায়। পশ্চিম পাকিস্তানের নানা শহরে — করাচী, লাহাের, মুলতান, পেশােয়ার ও হায়দ্রাবাদে – ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। বহুসংখ্যক ছাত্রকে আটক করা হয়। ১০ নভেম্বর পেশােয়ারে জনসভায় বক্তৃতারত আয়ুবকে লক্ষ্য করে জনৈক ছাত্র গুলী চালায়, ও ধরা পড়ে। পুলিশের কাছে তার সখেদ স্বীকারােক্তি ছিল, সে অত্যাচারী শাসককে হত্যা করায় ব্যর্থ হলাে। দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার জন্য ভুট্টোসহ বেশ কিছু আয়ুব বিরােধী রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তান সরকার বুঝতে পারে। যে শুধুমাত্র নির্যাতন – গ্রেফতার দ্বারা ছাত্র অসন্তোষ স্তব্ধ করা যাবে না। তাই আপােষ আলােচনার পথও খােলা হয়। ছাত্ররাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক কাজ শুরু করার পক্ষপাতী ছিল। অতএব, নভেম্বর ১৯৬৮-র প্রথম সপ্তাহে পশ্চিম পাকিস্তানে যে বিক্ষোভকে সর্বগ্রাসী মনে হয়েছিল, তা অল্প দিনের মধ্যে খানিকটা স্তিমিত হলাে। কিন্তু, আবার তা জ্বলে ওঠার সম্ভাবনাও রয়ে গেল। (৫)
পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্রবিক্ষোভ পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনে নতুন গতিবেগ সঞ্চার করে। ১৯ নভেম্বর ১৯৬৮ ঢাকায় বায়তুল মােকাররম চত্বরে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে জেল-জুলুমের প্রতিবাদে বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সকল ধৃত ছাত্র ও রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি ছাড়াও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকার, প্রত্যক্ষ নির্বাচন, ইত্যাদি দাবি তােলা হয়। ২২ নভেম্বর ঢাকায় এক যুক্ত বিবৃতিতে কবি জসীমুদ্দিন, কবি সুফিয়া কামাল, সাংবাদিক মানিক মিয়াসহ ১২ জন সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট নাগরিক পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্রজনতার ওপর দমন-পীড়নে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ২৬ নভেম্বর রাওয়ালপিণ্ডির বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি খুলে দেয়া হয়। সেদিনই শিক্ষা সংক্রান্ত দাবি নিয়ে ছাত্ররা যে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ জানায় তাতেও পুলিশের গুলিতে একজন পথচারীর মৃত্যু ঘটে। এর প্রতিবাদে ২৯ নভেম্বর আহূত ছাত্র ধর্মঘটে পশ্চিম পাকিস্তানে রীতিমতাে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ বেধে যায়। রাওয়ালপিণ্ডিতে ছাত্রদের আহ্বানে শ্রমিকরা হরতাল পালন করে। শ্রমিক ও ছাত্ররা দুটি থানায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পেশােয়ারে ছাত্ররা মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের পাঠাগারে হামলা চালায়। পশ্চিম পাকিস্তানে ১৯৬৮ -র ২৯ নভেম্বর আয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার যে রােষ স্ফুরিত হয় তা ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আয়ুববিরােধী গণঅভ্যুত্থানের সূচনায় নিশ্চিত সহায়ক হয়। (৬)
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কার্যবিবরণী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হােতে থাকায় জনমানস ক্রমাগত আন্দোলিত হচ্ছিল। ১৯৬৮-র ১ ডিসেম্বর ছাত্ররা প্রতিবাদ দিবস পালন করে। সেদিন এবং তার পরের দিন ছাত্ররা যেসব জনসভা ও বিক্ষোভের আয়ােজন করে তাতে জনসাধারণের সরকার বিরােধী মনােভাব প্রকট হয়। যে মৌলানা ভাসানী এতদিন পরােক্ষে আয়ুবকে সমর্থন দিচ্ছিলেন, তিনিও ৬ ডিসেম্বর দমনবিরােধী দিবস পালনের ডাক দেন, এবং ৭ ডিসেম্বর সাধারণ ধর্মঘটের নির্দেশ দেন। ৭ ডিসেম্বর আয়ুব ঢাকা সফরে এসে বিক্ষোভের সম্মুখীন হন। পুলিশ গুলী চালাতে বাধ্য হলে দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এই দিন আয়ুব আসলে সর্বপ্রথম ঢাকায় সেনাবাহিনী তলব করেন। ১৩ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ যে হরতালের ডাক দেয় তাকে ভাসানীর নেতৃত্বাধীন পিকিংপন্থী ন্যাপ ব্যতীত সব প্রগতিবাদী ছাত্রসংস্থা সমর্থন দেয়। ঐ হরতাল এতটা সফল হয় যে ঐ দিন ঢাকা থেকে করাচী ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আয়ুবকে বাতিল করতে হয়। ডিসেম্বরের
১৩০
শেষ সপ্তাহে পবিত্র ইদ দিবসে ছাত্ররা কালাে চিহ্ন পরিধান করে আয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে ধিক্কার জানায়। ২৯ ডিসেম্বর গ্রামাঞ্চলের হাটবাজারে ধর্মঘট আয়ােজন করতে গিয়ে ৩ জন কৃষক প্রাণ হারায়। তবে, যে অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতারা কারাগারে, আর অন্যান্য বিরােধী দলগুলি হয় আয়ুবের সমর্থক, অথবা সাংগঠনিক ক্ষেত্রে দুর্বল ও নিস্ক্রিয়, সেই অবস্থায় ছাত্রদেরই আয়ুব-বিরােধী আন্দোলনের পুরােভাগে থাকতে হয়েছিল। (৭)।
অনেকের মতেই – এমন কি কোন কোন পাকিস্তানী লেখক, যেমন তারিক আলীর, মতেও – পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজের রাজনৈতিক চেতনা ও সংবেদনশীলতা সমপর্যায়ের পশ্চিম পাকিস্তানীদের তুলনায় অধিকতর অগ্রগামী ছিল। ১৯৬৯-র ৫ জানুয়ারী সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ (যার নামের বহুল প্রচলিত ইংরেজী আদ্যাক্ষরসমষ্টি হলাে অ্যাপস্যাক) একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল প্রকাশ করে ? এগারদফা কর্মসূচী। আওয়ামী লীগের অধিভুক্ত পূর্বপাকিস্তান ছাত্র লীগ ছিল অ্যাপস্যাক- এর অভ্যন্তরস্থ সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন ছাত্র লীগ প্রস্তাব দেয়, মুজিবের ছয়দফা এগারদফার অন্তর্ভুক্ত হােক। কিন্তু ভাসানীর ন্যাপ – এর অধিভুক্ত মেননপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করে। তখন মতিয়াপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন যে আপােষ আলােচনার উদ্যোগ নেয় তার ফলশ্রুতি এগারদফা। এতে ছয়দফার অতিরিক্ত আরও কিছু কার্যক্রম ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর রাজনৈতিক নির্যাতন ও অর্থনৈতিক শােষণের প্রতিবাদ করা ছাড়াও এগারদফায় সিন্ধু, বালুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা হয়েছিল। উপরন্তু, এগারদফায় ব্যাংক, ইনসিওরেন্স কোম্পানি, পাট ও ভারী শিল্পের জাতীয়করণ দাবি করা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা সমস্যার সমাধান, কৃষক – শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, গােষ্ঠী নিরপেক্ষ বিদেশ নীতি অবলম্বন, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃ ভাষার ব্যবহার, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন, ইত্যাদি নানা দাবির সমন্বয় এগারদফাকে একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। (৮)
বিশদ কর্মসূচী থেকে প্রকৃত কর্মে উত্তীর্ণ হওয়ার নিমিত্ত অ্যাপস্যাক ১৯৬৯-র ৭ জানুয়ারী হরতালের ডাক দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। ইতােমধ্যে অনেকগুলি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ একটি যৌথ কার্যক্রম অনুসরণের উদ্যোগ নেন। এই দলগুলি – পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি), জামাত -ই- ইসলামি, নেজাম -ইইসলামি, জামিয়াত -উল- উলেমা -ই- ইসলাম, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), ন্যাশানাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ), এবং পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন (পি ডি এম) – সম্মিলিতভাবে ডেমােক্রেটিক অ্যাকশান কমিটি (ইংরাজী আদ্যাক্ষর অনুযায়ী ডি এ সি) গঠন করে। কিন্তু এসব পেশাদার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তহীনতা ছিল মজ্জাগত। ফলে, যখন অ্যাপস্যাক ৭ জানুয়ারী থেকে কয়েকদিন রাজনৈতিক দলগুলির আহ্বানের ব্যর্থ প্রতীক্ষার পর ১৭ জানুয়ারী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়, তখন ডি এ সি যেন উপায়ান্তর না দেখে – এবং সম্ভবত আত্মবিশ্বাসের অভাবে – ১৭ জানুয়ারীই হরতালের ডাক দেয়। ঐ দিন সরকার ছাত্রদের ওপর চরম নির্যাতন প্রয়ােগ করে। ১৮ জানুয়ারী আধাসামরিক বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রবেশ করে ছাত্রদের আবাসিক ভবনের ওপর হামলা চালায়। ফলে, ছাত্র-বিক্ষোভ প্রায় একটি অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। যে ছাত্রসংস্থা (এন এস এফ) সরকারী পুতুল হিসেবে চিহ্নিত ছিল, তার সদস্যরাও আইনরক্ষকদের অত্যাচারী ভূমিকার নিন্দা করে। ২০ জানুয়ারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উদ্দেশ্যে আয়ােজিত মিছিলের ওপর পুলিশ গুলীবর্ষণ করলে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান নিহত হন। আসাদ গণঅভ্যুত্থানের পথিকৃৎ ছিলেন কিনা, তার মৃত্যু আত্মাহুতি না অঘটন, এ সব নিয়ে বিতর্ক (অতি বামপন্থীদের কাছে প্রিয়, কিন্তু) নিষ্ফল ও নিষ্প্রাণ। যে সত্য অকাট্য তা হলাে, জনগণের স্বার্থরক্ষায় যারা শহীদ হন, আসাদ তাদেরই একজন। তাছাড়া, ১৯৬৯ সালের পরিপ্রেক্ষিতে, আসাদের মৃত্যুতে গণআন্দোলন অধিকতর আপােষবিরােধী ও সং ঘর্ষমুখী হয়ে উঠলাে। সাধারণ মানুষ আসাদের মৃত্যুতে ছাত্রদের নেতৃত্বে গণআন্দোলনে যােগ দেয়ায় অনুপ্রাণিত হলাে। তিনদিনব্যাপী শােকপালনের যে কর্মসূচী অ্যাপস্যাক গ্রহণ করে তার দ্বিতীয় দিনে ঢাকায় একটি মশাল মিছিল পরিচালিত হয়। এর একটি অভিনব বৈশিষ্ট্য ছিল শােভাযাত্রাকারীদের স্বাগত জানাবার জন্য পথের দুই পাশে যে বিরাট জনতা অপেক্ষমান ছিল, তারাও যেন একটি সমান্তরাল (যদিও নিশ্চল) শােভাযাত্রার আয়ােজন করেছিল। (৯)
ছাত্রনেতা আসাদের মৃত্যুতে পালিত তৃতীয় শােকদিবসে – ২৪ জানুয়ারী ১৯৬৯ – শােভাযাত্রাকারীরা হিংসাত্মক পদক্ষেপ নেয়। সচিবালয়ের ওপর আক্রমণে একাংশ পুড়িয়ে দেয়া হয়। ছাত্রদের সঙ্গে জনতা – বিশেষত দিনমজুর, রিকশাচালক – হাত মেলায়। ফলে, গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য মধ্যবিত্তের সংগ্রাম প্রায় রূপান্তরিত হয় জনগণের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানে। সরকারী সংবাদপত্র দৈনিক মর্নিং নিউজ এবং দৈনিক পাকিস্তান- এর দফতরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এভাবে ২৪ জানুয়ারী ছাত্ররা যে গণ অভ্যুত্থান দিবস’ পালনের ডাক দেয়, তা সার্থকনামা হয়। মাহফুজউল্লাহ লিখেছেন ঃ ২৪ জানুয়ারী সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বাধ্য হয়ে সরকারকে তলব করতে হয় সেনাবাহিনী। … সান্ধ্য আইন জারীর পর থেকে এক থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করতে থাকে। … কিন্তু ২৫ জানুয়ারী সেনাবাহিনী ও ই পি আর এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে ঢাকা শহরে। বেপরােয়াভাবে গুলী চলে নিরীহ জনসাধারণের উপর।” দিনের পর দিন হরতাল, মিছিল, সান্ধ্য আইন আয়ুবশাহীর ভিত্তি নড়িয়ে দেয়। এই পরিস্থিতিতে মত্তলানা ভাসানী তার আয়ুব-প্রীতি সত্ত্বেও গ্রামাঞ্চলে ঘেরাও আন্দোলন শুরু করেন। মেসবাহ কামাল লিখেছেনঃ “গ্রামাঞ্চলে জোতদার, মহাজন টাউট, ফড়িয়া, বাটপার, গরুচোর ও তাদের সহযােগী পুলিশদের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ কোথাও কোথাও বিক্ষোভে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। বিভিন্ন এলাকায় গণ আদালত গঠিত হয়। এবং সেই আদালতে বিচারের মাধ্যমে অনেকের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা পর্যন্ত নেয়া হয়।” (১০)
গণআন্দোলনে অভূতপূর্ব গতিবেগ সঞ্চারিত হওয়ায় সশঙ্কিত রাষ্ট্রপতি আয়ুব ১ ফেব্রুয়ারীর এক ভাষণে আপােষ আলােচনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সঙ্গতভাবে বলে যে রাজনৈতিক নেতাদের কারাগারে রেখে কোন আলােচনা সম্ভব নয়। ৬ ফেব্রুয়ারী আয়ুব ঢাকায় আসেন। পরদিন তিনি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির প্রয়ােগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। ৮ ফেব্রুয়ারী ইত্তেফাক সংবাদপত্র গােষ্ঠীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়। ৯ ফেব্রুয়ারী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। আলাপ মীমাংসার পথ প্রশস্ত করার উদ্দেশ্যে সরকার ১১ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধি অনুযায়ী ধৃত সব রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিদানের সিদ্ধান্ত নেয়। এটা অবশ্যই ছাত্রদের এগারদফা আন্দোলনের বিজয় সূচিত করে। আওয়ামী লীগ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহম্মদ মুক্ত হন ১২ ফেব্রুয়ারী। ইতােমধ্যে আয়ুব সরকারের সঙ্গে আলােচনায় যােগদান করা – এবং তার ফলে গণআন্দোলনের গতি রুদ্ধ করার বিষয়ে – ছাত্রসংগ্রাম পরিষদে তীব্র মতভেদ দেখা দেয়। কিন্তু গণআন্দোলনের শক্তি তখন এতই প্রবল ছিল যে ঐ মতপার্থক্য পরিষদে ভাঙ্গন ধরাতে পারে নি। আয়ুব কর্তৃক আহূত কোন বৈঠকে যােগদানের পূর্বশর্ত হিসেবে আওয়ামী লীগ দাবি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা খারিজ করতে হবে। ছাত্র আন্দোলনের অপ্রতিরােধ্য সাফল্যে বিচলিত হয়ে ডি এ সি নেতৃবৃন্দ ১৪ ফেব্রুয়ারী সাধারণ ধর্মঘট ও জনসভার আয়ােজন করে। কিন্তু যেসব নেতা – যেমন নুরুল আমিন – দীর্ঘকাল পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য বাঙ্গালীদের কাছে বেইমান হিসেবে চিহ্নিত — তাদের ১৪ ফেব্রুয়ারী পল্টন ময়দানে সভামঞ্চে উঠতেই দেয়া হয় নি। বিশাল জনসমষ্টির দাবিতে ছাত্রনেতৃবৃন্দ মঞ্চ অধিকার করে। সমবেত জনগণ হাত তুলে এগারদফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়। এভাবে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জাতীয়তাবাদী রূপ পরিগ্রহ করে স্বাধীনতার লক্ষ্যে ধাবিত হবার শক্তি সংগ্রহ করে। মহিলারাও এই আন্দোলনে সামিল হয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারী সরকারী দমননীতি বিরােধী সমাবেশ-শােভায়াত্রার আয়ােজন করে। (১১)
ঢাকার সেনানিবাসে ১৫ ফেব্রুয়ারী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হয়। সরকারী বক্তব্য, বন্দী জহুরুল পালাবার চেষ্টা করায় এই দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। জনসাধারণ সরকারী ভাষ্য বিশ্বাস করেনি। লক্ষাধিক লােকের সমাবেশে ঢাকায় জহুরুলের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ১৬ ফেব্রুয়ারী। জনতার একাংশের মনে এই আশংকা দানা বাঁধে যে মুজিবরকেও সেনানিবাসের অভ্যন্তরে হত্যা করা হতে পারে। ১৬ ফেব্রুয়ারী উপরােক্ত জনসভায় প্রধান বক্তা ছিলেন ভাসানী। জনসভা শেষ হবার আগেই বিক্ষুব্ধ জনগণ সভা ছেড়ে দুই প্রাদেশিক মন্ত্রী ও এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর গৃহে অগ্নিসংযােগ করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান বিচারপতি এস এ রহমানের বাসভবনেও আগুন লাগানাে হয়। ঐ মামলার সরকারী অভিশংসক মনজুর কাদির সত্বর লাহােরে পলায়ন করেন। জনগণ বেপরােয়া হয়ে কিছু পুলিশের হাত থেকেও বন্দুক ছিনিয়ে নেয়। এক ধরণের অরাজকতার সৃষ্টি হয়। সান্ধ্য আইন এবং সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও গণবিক্ষোভ প্রশমিত হয় নি। উপরন্তু, ১৮ ফ্রেব্রুয়ারী ১৯৬৯ ঐ বিক্ষোভ আরও ঘনীভূত হয়, কারণ ঐদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রােক্টর। অধ্যাপক শামসুজ্জোহা ও অধ্যাপক নুরুল ইসলাম নিরাপত্তা বাহিনীর গুলীতে নিহত হন। এই হত্যার প্রতিবাদে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ প্রতিবাদ মিছিল করে। আয়ুব যদিও ১৭ ফেব্রুয়ারী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকে বসতে রাজী ছিলেন, ডি এ সি নেতারা সিদ্ধান্ত নেন যে মুজিবের অনুপস্থিতিতে আলােচনা নিষ্ফল। ১৯৬৯ সালে সরকার প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারী ছুটির দিন বলে ঘােষণা করে। পরদিন, অথাৎ ২২ ফেব্রুয়ারী, সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করায়। জননিরাপত্তা আইনে আটক মুজিবসহ আরও ৩৪ জন বন্দী মুক্তি লাভ করেন। জামিনে বা শতাধীন মুক্তি নিয়ে মুজিব আয়ুবের সঙ্গে আলােচনায় বসবেন কিনা এ নিয়ে ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলিতে যে বিতর্ক ও মতান্তরের সৃষ্টি হয়েছিল, তার অবসান ঘটলাে। (১২)
প্রসঙ্গত, একটি বক্তব্য বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পুনরায় উপস্থাপিত হবার দাবি রাখে। স্বৈরাচারী আয়ুব খান যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনায় বসতে এবং সেজন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতেও রাজী হন, তার মৌলিক কারণ ছিল, ১৯৬৯-র জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারীতে অ্যাপস্যাক বা সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১দফার জন্য আন্দোলন ঢাকা ছাড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নানা জেলা, উপজেলা, থানা, গ্রাম, পাড়া, কারখানা ও বিদ্যালয়ে পরিব্যাপ্ত হয়। এমন কি পশ্চিম পাকিস্তানে আয়ুবের ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতেও এর প্রভাব পড়ে, যেমন, আসাদের মৃত্যুজনিত বিক্ষোভে ঢাকায় পুলিশের গুলিচালনার প্রতিবাদে ২৭ জানুয়ারী করাচী, লাহােরে ও পেশােয়ারে তুমুল বিক্ষোভ দেখা দেয়, সেনাবাহিনীও তলব করতে হয়। অবশ্য, পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন অন্য পর্যায়ে উঠে যায়। মেসবাহ কামালের ভাষায়, “গণতন্ত্রের দাবিতে স্বৈরশাসনবিরােধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে এসে গ্রাম-গঞ্জে ও শহরের খেটে খাওয়া মানুষ কেবল সরকার বিরােধী পদক্ষেপ গ্রহণ করেই থেমে থাকেন না, তাদের একটা অংশ স্ব স্ব এলাকার ক্ষমতা-বলয়ে অধিষ্ঠিত শােষণকারী শ্রেণী সমূহের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেও জনমতকে সংগঠিত করতে শুরু করেন। সাধারণ মানুষ হয়তাে এ ব্যাপারে যুক্তির চেয়ে ভাবাবেগকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিল। অথবা, বলা যেতে পারে, সাধারণ মানুষের চিন্তাধারা ছাত্রদের তুলনায় অধিকতর অগ্রগামী ছিল। অন্যদিকে, আয়ুবের ভাবনাচিন্তা ছিল পুরােপুরি অনগ্রসর; তাই তার ১ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯-র আলােচনাপ্রার্থী বক্তৃতায় তিনি এগারদফার আন্দোলনকে শুধু মাত্র আইনবর্জিত আখ্যা দিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন। (১৩)
কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পরই মুজিব ১১ দফার প্রতি তার অকুণ্ঠ সমর্থন ঘােষণা করেন, কারণ ৬ দফা ১১ দফার অন্তর্নিহিত। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ২৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ মুজিবকে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিপুল সম্বর্ধনা জানায়। মুজিব বলেন, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা জনতার মুক্তির উপায়। তিনি আশ্বাস দেন, আয়ুবের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত আলােচনায় যদি স্বায়ত্তশাসনের দাবি গৃহীত না হয়, তাহলে তিনি বৈঠকের পর পূর্ব পাকিস্তানে ঐ দাবি আদায়ের নিমিত্ত তুমুল আন্দোলন শুরু করবেন। মুজিব প্রতিশ্রুতি দেন যে প্রস্তাবিত গােল টেবিল বৈঠকে তিনি কেন্দ্রীয় আইনসভায় লােকসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব দাবি করবেন — অথাৎ পূর্ব পাকিস্তানীরা কেন্দ্রীয় আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। ২৩ ফেব্রুয়ারী জনসভায় মুজিবকে ‘বঙ্গ বন্ধু’ খেতাব প্রদান করা হয়। মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে ইসলামাবাদ যড়যন্ত্র মামলা’ বলে আখ্যা দেন। ২৩ ফেব্রুয়ারী বিকেলেও পুলিশের গুলী বর্ষণে তিনজন আহত হলে জনতা প্রতিশােধপরায়ণ হয়ে ওঠে। অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে মুজিব শান্তি স্থাপনের আহ্বান জানান। ঢাকা রেডিও থেকে মুজিবের আহ্বান পুনঃ পুনঃ প্রচারিত হয় – মনে হয় যেন রাজ্যপালের বানী জনগণকে বারবার শােনানাে হচ্ছে। এতে অবশ্যই পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের চিত্ত জাতীয়তাবাদী আবেগে মথিত হয়। (১৪)
২৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ রাওয়ালপিণ্ডিতে গােলটেবিল বৈঠক শুরু হয়। কিন্তু এটি ছিল আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত। এর পরদিনই ইদ উৎসব উপলক্ষ্যে সভার অধিবেশন মুলতবি রাখা হয়। সভা পুনরায় শুরু হয় ১০ মার্চ। ইতােমধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ নানা দফায় আলােচনা করেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ বা ডি এ সি-র নেতৃবৃন্দের মধ্যে – বিশেষত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের মধ্যে – কোন ঐকমত্য গড়ে উঠে নি। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামােয় সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে পরিষদীয় গণতন্ত্র স্থাপনের ব্যাপারে সাধারণভাবে মতৈক্য ছিল। কিন্তু ১৯৫৬ সালে যে সংবিধান পূর্ব পাকিস্তানীরা গ্রহণ করেছিল, জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার উন্মেষের ফলে ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা সেই সংবিধান বা তদনুরূপ সংবিধান গ্রহণে সম্পূর্ণ গররাজী ছিল। রাওয়ালপিণ্ডিতে মুজিবের সঙ্গে কামাল হােসেন, আমীরুল ইসলাম ও মত্তদুদ আহমেদ আইনজ্ঞ-উপদেষ্টা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। আয়ুবের আইনমন্ত্রী এস এম জাফর

১৩৫
ও বেসরকারী আইন-উপদেষ্টা মনজুর কাদির মুজিবের উপরােক্ত উপদেষ্টা এয়ীর সঙ্গে আলােচনায় যে ধ্যানধারণা ব্যক্ত করেন, তাতে বােঝা যায় যে পূর্ব পাকিস্তানীদের জাতীয়তাবাদকে সম্মান জানিয়ে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য যে পরিমাণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন মানা প্রয়ােজন, সেটা আয়ুব সরকার মানতে রাজী নয়, আয়ুবশাহী ১৯৬২-র সংবিধানে ছােট খাটো পরিবর্তন করতেই উৎসুক। মুজিবের উপরােক্ত উপদেষ্টাত্রয়ীর সঙ্গে স্থল সেনাবাহিনী প্রধান আগা মহম্মদ ইয়াহিয়া খানের একটি গােপন বৈঠক হয়। ইয়াহিয়া তাে প্রায় হুমকিই দিলেন যে, রাজনৈতিক নেতারা যদি একমত হতে পারেন – যেমন, আয়ুবকে রাষ্ট্রপতি, মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী ও দৌলতানাকে অর্থমন্ত্রী করে একটি জোড়াতালি দেওয়া সরকার গঠনেও প্রস্তুত না থাকেন – তাহলে দেশের স্বার্থরক্ষায় সামরিক বাহিনী এগিয়ে এসে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে বাধ্য হবে। পূর্ব পাকিস্তানে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জনমানসে কি স্থান অধিকার করেছে। তৎসম্পর্কে ইয়াহিয়ার বিন্দুমাত্র বােধােদয়ও ছিলাে না। আয়ুবও এ ব্যাপারে খুব একটা প্রাগ্রসর ছিলেন না। তাই গােল টেবিল বৈঠকের শেষ দিনে অথাৎ ১৩ মার্চ – তিনি ইসলামের দোহাই দিলেন, ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতির সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিলেন, কিন্তু ১৯৫৬ সালের সংবিধানের মূল নীতিগুলিকেই মােটামুটি আঁকড়ে ধরে রইলেন। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন তাে দূরের কথা, কেন্দ্রীয় আইনসভায় জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানকে প্রতিনিধিত্বদানের স্বীকৃতিও তিনি দিলেন না। বলাই বাহুল্য, মুজিব দ্বিমত জানিয়ে বৈঠক ত্যাগ করলেন, এবং ১৩ মার্চ আওয়ামী লীগও ডিএ সি-র সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলাে। মুজিব ঢাকায় ফিরে এলেন। বঙ্গ বন্ধু নামের মর্যাদা বজায় রইলাে। গণআন্দোলনের শীর্ষে তার নেতৃত্ব বহাল থাকলাে। কোন কোন বামপন্থী মহলের অসূয়ামিশ্রিত রটনা ছিল যে মুজিব বাঙ্গালীদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে আয়ুবের সঙ্গে আপােষ করবেন। এ রটনা মিথ্যা প্রমাণিত হলাে। (১৫)
উপরােক্ত সময়ে গণআন্দোলনের নেতৃত্ব চুড়ান্তভাবে মুজিবের ওপর ন্যস্ত হবার একটি প্রধান কারণ ছিল, গ্রামাঞ্চলে গনআন্দোলনের শ্রেণী উপাদান ও রণােন্মত্ততা অত্যন্ত প্রকট হয়ে ছাত্র নেতাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছিল। উদাহরণস্বরূপ, মৌলিক গণতন্ত্রীদের প্রতি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশ ছিল, তারা যেন পদত্যাগ করে। কিন্তু অত্যুৎসাহী জনতা অনেক ক্ষেত্রেই স্বেচ্ছামূলক পদত্যাগের জন্য অপেক্ষা না করে বাধ্যতামূলক পদত্যাগের অবস্থা সৃষ্টি করে। বলাবাহুল্য, আয়ুবশাহী মৌলিক গণতন্ত্র মারফত গ্রামাঞ্চলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে তাদের পূর্বাহ্নত অর্থনৈতিক সামাজিক শােষণের ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে দেয় ও দীর্ঘস্থায়ী করে। অতএব, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে শােষিত গ্রামবাসী যদি তার প্রতিশােধ স্পৃহা চরিতার্থ করার প্রয়াস নেয়, সেটা নিতান্তই স্বাভাবিক। নৌকা থেকে ধান লুট করা, ঘুষখাের তহশিলদারের গলায় জুতাের মালা পরানাে, ধনী গ্রামবাসীর গৃহে অগ্নিসংযােগ, ইত্যাদি ঘটনা অনেক জায়গায় ঘটেছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের। পক্ষে এটা স্বীকার করার বিকল্প ছিল না যে এই জঙ্গী গ্রামীন’আন্দোলনের রাশ টেনে রাখা তাদের পক্ষে অসম্ভব। ১৯ মার্চ ১৯৬৯ শেখ মুজিব রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, সবাইকে জনগণের অধিকার অর্জনের জন্য শক্তি সংরক্ষণ করার, এবং এই উদ্দেশ্যে শান্তি বজায় রাখারও আবেদন জানান। একই দিন ছাত্ররা ১১ দফা আদায় ও মােনেমকে রাজ্যপালের পদ থেকে বিদায়ের লক্ষ্যে ২৫ মার্চ হরতালের ডাক দেয়। কিন্তু ঐ হরতালের কয়েকদিন পূর্বেই, সবারই অজ্ঞাতসারে, মােনেম ঢাকা থেকে পলায়ন করেন। ২১ মার্চ তার স্থলভিষিক্ত হন অধ্যাপক এম এন হুদা। হরতালের আগের দিন – ২৪ মার্চ – ভাসানী ১৫ দিনের পশ্চিম পাকিস্তান সফর শেষ করে ঢাকায় পৌঁছান। তিনি ইঙ্গিত দেন যে পর দিন – ২৫ মার্চ – সামরিক আইন জারী হবে। ভাসানীর ইঙ্গিত সত্য প্রমাণিত হলাে। মাহফুজউল্লাহর ভাষায়, “পুর্নবার, বিপথগামী ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন”।(১৬)
মৌদুদ আহমেদ সঠিক ভাবেই মন্তব্য করেছেন যে সামরিক আইন আয়ুবের কাছেও অভিপ্রেত ছিল, আর সেনাবাহিনীর কাছেও। কারণ পাকিস্তানের শাসকচক্রের নেতা প্রতিভূ কারও কাছেই পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান লাভজনক ছিল না। স্বায়ত্তশাসনভােগী। পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করা যাবে না, এই শােষণের সুযােগ না থাকলে শাসকচক্রের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত লাভ শূন্যের কোঠায় পৌঁছাতে পারে। ১৩ মার্চ গােলটেবিল বৈঠক পরিত্যক্ত হবার পর আয়ুব একটি গােপন বৈঠকে মুজিবকে জিজ্ঞাসা করেন, পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রেখে ছয় দফার রূপায়ন সম্ভব কিনা। এর পর মুজিব ঢাকায়। ফিরে এলে তার আইনজ্ঞ-উপদেষ্টাবৃন্দ (যেমন, কামাল হােসেন, মৌদুদ আহমেদ) ছয়দিনের মধ্যে ১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানের একটি সংশােধনী প্রস্তুত করেন, যাতে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও ছয়দফার সার্থক সমাহার পরিলক্ষিত হয়। মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী এবং সারা পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মহাসচিব এ এইচ এস কামারুজ্জামান ২০ মার্চ ঐ খসড়া সংশােধনী আইন নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যান। কিন্তু ঐ খসড়াপ্রাপ্তির চারদিনের মধ্যে – অর্থাৎ ২৪ মার্চ ১৯৬৯ – আয়ুব ইয়াহিয়া খানকে যে চিঠি দেন তাতে সংবিধানের উপরােক্ত সংশােধনীকে সামরিক আইন বহালের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়, বলা হয় যে ঐ সংশােধনী পাকিস্তানকে বিখণ্ডায়নের দিকে ঠেলে দেবে। আয়ুবের চিঠিতে তাই পাকিস্তানকে ধ্বংসের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রন জানানাে হয়। স্পষ্টত, জীবনের সায়াহ্নে গণঅভ্যুত্থান থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার আত্মবিশ্বাস আয়ুবের ছিল না। অপর দিকে, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যারা ছিলেন – যেমন ইয়াহিয়া খান — তাদের তাে গণআন্দোলনের গতিপ্রকৃতি অনুধাবনের ন্যূনতম ক্ষমতাও ছিল না। গণজাগরণের তাৎপর্য উপলব্ধি তাে দূরের কথা, পাকিস্তানের বিদ্যমান সংবিধানও তারা কতােটা বুঝতেন বলা মুস্কিল। কারণ আয়ুব যেভাবে স্থল সেনা প্রধানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন, তা ছিল পাকিস্তান সংবিধানের সম্পূর্ণ বিরােধী। ১৯৬২ সালের পাকিস্তানী গঠনতন্ত্রে এই হস্তান্তরের কোন বিধানই ছিল না। তবে, অন্যান্য অনেক দেশের রাজনৈতিক প্রভুত্বকামী সেনাপতিদের মতাে পাকিস্তানের সেনাপতিরাও একটি কৌশল জানতেন ? কিভাবে অন্ততঃ কিছুদিনের জন্য গণপ্রতিরােধ এড়ানাে যায়। তাই তারা আশ্বাস দিলেন যে তারা শাসন করতে চান না, তারা চান নিবাচিত জননেতাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে। তাদের কোন রাজনৈতিক উচ্চাশা নেই, তাদের লক্ষ্য সংবিধানসম্মত সরকার প্রতিষ্ঠার উপযােগী অবস্থার সৃষ্টি করা। ২৬ মার্চ ১৯৬৯ জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে ইয়াহিয়া খান এসব সুললিত বাণীই প্রচার করেন। কারও কারও মতে অবশ্য, ইয়াহিয়া খান ও তার সহকর্মীরা (যেমন, চীফ অব জেনারেল স্টাফ গুল হাসান) আয়ুবকে না জানিয়েই সামরিক আইন জারীর গােপন সিদ্ধান্ত নেন। আয়ুব চেয়েছিলেন, তিনিই থাকবেন সামরিক সরকারের নেতা। কিন্তু তার মনস্কামনা পূর্ণ হলাে, তাকে পদত্যাগ করতে হলাে। সামরিক আইন জারীর পরই চট্টগ্রামে শ্রমিক ধর্মঘট হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র নেতা তারিক আলীর মন্তব্য অনুবাদ করে মাহফুজ উল্লাহ লেখেন, “পূর্ব পাকিস্তানীরা এক বছরের বেশী আরেকজন পশ্চিম পাকিস্তানী একনায়ক মেনে নেবেন বলে মনে হয় না। সামান্যতম ঘটনাও আরেকটি অভ্যুত্থানের জন্ম দিতে পারে, যার পরিণতি হবে স্বাধীন এবং সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান।” (১৭)
২৬ মার্চ ১৯৬৯ ইয়াহিয়া খান তার বক্তৃতায় গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন ও সাধারণ নিবাচনের ওপর জোর দেওয়ায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণ এটা ভেবে উল্লসিত হলাে যে পাকিস্তানের জন্মের পর এই প্রথম সারা দেশে সাধারণ নিবাচন অনুষ্ঠিত হােতে চলেছে। কিন্তু অন্যান্য অনেক দেশের সমরনায়কদের মতাে একবার রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে ইয়াহিয়া খানও নিজেকে মুখ্য সামরিক প্রশাসকের সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চাইলেন না। ৩১ মার্চ ইয়াহিয়া রাষ্ট্রপতির পদ দখল করলেন। একটি অস্পষ্ট কিন্তু অশুভ রাজনৈতিক সংকেত তিনি দিলেন ২ জুলাই, যখন তিনি বললেন যে ১৯৭০ সালে বা তার পূর্বে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারটি জনগণের আকাংখার ওপরই নির্ভর করবে। আর ৭ আগষ্ট তাে ইয়াহিয়ার রাজনৈতিক অভিলাষ গভীরতর প্রতীয়মান হলাে, তিনি ৭ জন মন্ত্রী নিযুক্ত করে মন্ত্রীপরিষদ গঠন করলেন। ২৮ নভেম্বর ১৯৬৯ একটি বক্তৃতায় ইয়াহিয়া শাসনতন্ত্রের আইনগত কাঠামাের আদেশ (লীগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার, সংক্ষেপে এল এফ ও) ৩১ মার্চ এর মধ্যে জারী করার প্রতিশ্রুতি দেন, এবং সাধারণ নির্বাচনের দিন ধার্য করেন ৫ অক্টোবর ১৯৭০। উপরােক্ত ভাষণে ইয়াহিয়া তিনটি বিতর্কিত শাসনতান্ত্রিক বিষয়ের উল্লেখ করেন, এবং প্রতিটি বিষয়ে স্বীয় সিদ্ধান্তও জ্ঞাপন করেন। প্রথমত, তিনি এক ইউনিট রদ করে পুনরায় পশ্চিম পাকিস্তানে ৪ টি প্রদেশের অস্তিত্ব ঘােষণা করেন। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় আইনসভায় দুই অঞ্চলের – অথাৎ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের – ‘সমতার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা নাকচ করে এক ব্যক্তি এক ভােট নীতি – বা জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিত্বের নীতি – গ্রহণের পক্ষে মত দেন। তৃতীয়ত, কেন্দ্র ও প্রদেশের সম্পর্কের ব্যাপারে ইয়াহিয়া খান প্রদেশগুলিকে সর্বোচ্চ সম্ভব মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, “ পশ্চিমা রাষ্ট্র নায়কদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াই সর্বপ্রথম এই কথাটা প্রকাশ্যে স্বীকার করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন ঃ পূর্ব পাকিস্তানীরা রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশীদারি অনুভব করিতে পারিতেছে না। তাই সেন্স অব পার্টিসিপেশন হইতে তারা বঞ্চিত। কথাটা সত্য। কিন্তু অংশতঃ সত্য। তাই জনসংখ্যা – ভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব দিয়া তিনি অংশতঃ তার প্রতিকারের চেষ্টা করিয়াছেন। অংশতঃ এই জন্য যে, শুধু পালামেন্টে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় ও চাকুরিতে পূর্ব পাকিস্তানীদের মেজরিটি দিয়াও আসল বৈষম্যের প্রতিকার করা যাইবে না। কারণ, তাতে পূর্ব পাকিস্তানীদের সেন্স অব পার্টিসিপেশন দেওয়া হইবে বটে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ফায়দা দেওয়া হইবেনা।” (১৮)।
যেমন ২৮ নভেম্বর ১৯৬৯ ভাষণে, তেমনি ৩০ মার্চ ১৯৭০ আইনকাঠামাে আদেশে, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মাত্রা কতােটা তা ইচ্ছাকৃতভাবেই অস্পষ্ট রাখা হলাে, প্রলােভন জাগ্রত করা হলাে, কিন্তু আকাংখা পূরণের নিশ্চয়তা দেওয়া হলাে না। তবে, আইনকাঠামাের আদেশে ইয়াহিয়া খান ও সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ক্ষমতা জবরদখল করে রাখার প্রয়াস কিন্তু বেশ স্পষ্টই ছিল। ঐ আদেশের অন্ততঃ দুটি ধারায় ঐ প্রয়াস প্রকট। একটি ধারায় বলা ছিল, কেন্দ্রীয় আইনসভা সংবিধানের খসড়া সত্যয়নের নিমিত্ত রাষ্ট্রপতির কাছে। পাঠাবে, সত্যয়ন প্রত্যাখ্যাত হােলে আইনসভাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অপর একটি ধারায় আইনকাঠামাে আদেশের শতাবলী ব্যাখ্যায় রাষ্ট্রপতিকে চূড়ান্ত ক্ষমতা দেয়া হয়, এবং বলা হয় যে তার কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তােলা যাবেনা। উপরন্তু ঐ আদেশ সংশােধনের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় আইনসভাকে না দিয়ে রাষ্ট্রপতিকেই দেয়া হয়। আইনকাঠামাে আদেশ পর্যালােচনায় এই সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে নির্বাচন যতই অবাধ-নিদোষ হােক, কেন্দ্রীয় আইনসভা রচিত সংবিধানের খসড়া যতই গণতন্ত্রসম্মত হােক, তার নাকচ হােয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল অত্যন্ত প্রবল। এই সন্দেহের বশবর্তী হয়ে সাধারণ নির্বাচন বর্জন করলে বােধহয় সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ক্ষমতাভােগ দীর্ঘায়িত হােতাে। অন্ততঃ মুজিব হয়তাে সেরকমই ভেবেছিলেন, তাই তিনি কোনও কোনও উগ্রবামপন্থী মহলের নির্বাচন। বর্জনের প্ররােচনা অগ্রাহ্য করেছিলেন। ঐসব বামবন্থী মহল আবার স্বৈরাচারী আয়ুবের অনুরক্তও ছিল। তাছাড়া নির্বাচনে ঐ বামপন্থী মহলের বিপুল সংখ্যক আসনে জয়লাভেরও বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না। অতএব, কেউ যদি মনে করেন যে মুজিবের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার প্রতি অসূয়া এবং সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরাট সাফল্যের সম্ভাবনাকে অংকুরেই বিনষ্ট করার জন্য নির্বাচন বর্জনের ধূয়া তােলা হয়েছিল, তিনি বােধহয় ভুল করবেন না। কিছু বামপন্থী দল যখন ভাসানীর নেতৃত্বে হঠাৎ ‘ভােটের বদলে ভাত চাই’ আওয়াজ তুললেন, তখন উপরােক্ত অনুমানই সত্য বলে প্রমাণিত হলাে। অপরদিকে জামাত-ই-ইসলামী আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা খর্ব করার জন্য এই অপপ্রচার চালালাে যে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্যের অভিযােগ তােলা হচ্ছে। ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতা। (১৯)।
উগ্র বামপন্থী-ডানপন্থী নেতাদের উপরােক্ত প্রচারে মুজিব বিভ্রান্ত বা বিচলিত হন নি, এটা তার আত্মবিশ্বাস ও রাজমতিক দূরদর্শিতার প্রমাণ। তিনি নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন, ছয়দফা রূপায়নের জন্য প্রয়ােজন রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন, এবং তার জন্য জরুরী আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সাফল্য। পক্ষান্তরে, পূর্ব পাকিস্তানে মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধপন্থীরা সম্ভবতঃ ছয়দফা কার্যে পরিণত করার চাইতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে বেশি উৎসাহী ছিলেন। অতএব, দেখা গেল, ১৯৭০ সালে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আওয়ামী লীগ যতাে এগিয়ে গেল, এবং গণসম্মােহনী ভাষনের দ্বারা মুজিব যখন প্রায় প্রবাদ পুরুষে পরিণত, তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব কয়টি সংবাদপত্র এবং প্রায় সকল বাম-ডানপন্থী রাজনৈতিক দল মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচারে লিপ্ত হলাে। এই দলগুলির নেতিবাচক কার্যক্রম অত্যন্ত ন্যক্কারজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেল সেপ্টেম্বর ১৯৭০ -এ, যখন পূর্ব পাকিস্তান বন্যার শিকার হলাে। প্রায় প্রতি বৎসরই পূর্ব পাকিস্তানে বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। কিন্তু সেপ্টেম্বর ১৯৭০-র বন্যা পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধভাবাপন্ন দলগুলিকে ৫ অক্টোবর ১৯৭০ এর নিবচিন বানচাল করার একটা অজুহাত এনে দিলাে। মহা উৎসাহে তারা জনহিতার্থে নিবাচন পেছানাের দাবি তুললাে, তারা ভাবলাে, এভাবে নির্বাচনী দৌড়ে আওয়ামী লীগের সাফল্যের গতি রােধ করা যাবে। কিন্তু ঐ গতি যে অপ্রতিরােধ্য (কারণ যুগােপযােগী) সেটা অচিরেই উপলব্ধ হলাে। আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচনের দিন পিছিয়ে স্থির করলেন ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০া মুজিবের প্রচারাভিযানকে অবশ্য স্তব্ধ করা যায় নি, যথারীতি তা এগিয়ে চললাে। নির্বাচন পেছানাের ফলে শেষ পর্যন্ত বােধহয় মুজিব আরও সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে গেলেন। কারণ ১২ নভেম্বর ১৯৭০ স্মরণকালে সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘূর্ণীঝড় ও জলােচ্ছাসে পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত হলাে। এ সময় পাকিস্তান সরকারের কার্যকলাপে পূর্ব পাকিস্তানের জনমানসে মুজিবের ছয়দফার অপরিসীম গুরুত্ব অনুভূত হলাে। পূর্ব পাকিস্তানে যখন অন্ততঃ দশলক্ষ ব্যক্তি মৃত, এবং পশুসম্পদ ও স্থাবর সম্পত্তি নাশের পরিমাণ অজ্ঞত, তখন দশ দিন ইয়াহিয়া খান ব্যস্ত থাকলেন তার অধস্তন সেনানায়কদের পদোন্নতির দাবি মেটানাের
১৪০
উদ্বিগ্ন আলােচনায়। সংঘর্ষমুখী সমরনায়কদের দাবিপূরণ তখন ইয়াহিয়ার কাছে পূর্ব পাকিস্তানে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রানকার্যের চাইতে অনেক বেশি জরুরী — কারণ নিছক আত্মরক্ষা, ইয়াহিয়ার নিজের পদচ্যুতি নিবারণ ও রাজনৈতিক মর্যাদা সংরক্ষণ। অতএব, পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ সামগ্রী এলাে সুদূরবর্তী বৃটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ থেকে, কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে কোন সাহায্য আসেনি। পূর্ব পাকিস্তানের দুর্গত জনসাধারণের কাছে ছুটে যাবার সময় বা মানসিক ঔদার্য পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ছিল না। কিন্তু তারা যে শােকার্ত, এটা প্রচারের এক অভিনব উপায় তারা আবিষ্কার করে তারা দাবি তােলে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নির্বাচন পুনরায় পিছিয়ে দেয়া হােক। একই দাবি তােলে সেনা বাহিনীর দ্বারা সঙ্গোপনে পুরস্কৃত কিছু রাজনৈতিক দল, যেমন, পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ, কৃষক শ্রমিক দল, জামাত-ই-উলেমা -ইইসলাম। অথচ, যাতে এটা বােঝা না যায় যে তারা সেনাবাহিনীর সেবাদাস, এবং যাতে মুজিবের জনপ্রিয়তাকে হুমকির মুখােমুখি করা যায়, ঐ দলগুলি হঠাৎ পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তােলে, যদিও অতীতে তারা মুজিবের ছয়দফারও বিরােধিতা করেছে। (২০)।
মুজিব অবশ্য নিবাচন পেছােনাের অপকৌশলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ তােলেন, ও হুমকি দেন, দশলক্ষ লােক যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণ হারিয়ে থাকে, আরও দশ লক্ষ প্রস্তুত আছে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আশাপূরণে আত্মাহুতি দিতে। শেষ পর্যন্ত দুর্গত এলাকা বাদে সর্বত্র ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলাে। নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলে দেখা যায়, জাতীয় পরিষদের ৩১৩ টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭ টিতে জয়ী হয়েছে। প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয় ১৭ ডিসেম্বর, আওয়ামী লীগ ৩১০ টি আসনের মধ্যে ২৯৮ টিতে জয়ী হয়। অপরদিকে ভূট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপলস পার্টি জাতীয় পরিষদে মাত্র ৮৮ টি আসন পায়। আবদুল ওয়াহেদ তালুকদার লিখেছেন : “বঙ্গবন্ধুর নিরংকুশ বিজয় মাশাল ল’ কর্তৃপক্ষের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। গােয়েন্দা বিভাগের রিপাের্ট অনুসারে তারা ভেবেছিল আওয়ামী লীগ ১০২ টা আসনের বেশী পাবে। কিন্তু বাস্তবে তা মিথ্যা প্রতিপন্ন হলাে। মেজর জেনারেল ওমর ও গােয়েন্দা বিভাগের ডাইরেক্টর জেনারেল এন এ রিজভী বিভিন্ন শিল্পপতিদের ওপর চাপ প্রয়ােগ করে ২০-২২ লাখ টাকা যােগাড় করে আওয়ামী লীগ বিরােধী ৫-৬ টি দলের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও আওয়ামী লীগকে ঠেকানাে যায়নি।” (২১)।।

এর পর শুরু হলাে গভীর এবং ব্যাপক ষড়যন্ত্র কি ভাবে অবাধ-নিরপেক্ষ সাধারণ নিবাচনে অর্জিত নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে – এবং মুজিবকে— ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। এ ব্যাপারে অগ্রনী হলেন ভুট্টো এবং কট্টরপন্থী পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাপতিবৃন্দ, যেমন, ওমর, হামিদ, গুল হাসান, টিক্কা খান, ইত্যাদি। এই সব সেনানায়কগণ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানেই উৎসুক ছিলেন না – ইয়াহিয়া নির্বাচনে রাজী হওয়ায় এরা অতীব অসন্তুষ্ট হন। নির্বাচনের ফলাফল যখন আওয়ামী লীগ ও ছয়দফার পক্ষে গেল, তখন এরা প্রমাদ গণলেন। কারণ ছয়দফা রূপায়িত হােলে, এবং পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীভূত করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে উন্নয়ন ব্যয় বিপুলভাবে বাড়ানাে হােলে, সেনাবাহিনীর জন্য নির্দিষ্ট বার্ষিক ব্যয় অনেকটাই হ্রাস পাবে। ফলে সমরনায়কদের ক্ষুদ্রস্বার্থ আহত হবে। একই কারণে আহত হবে পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের স্বার্থ, যারা দুই দশকেরও অধিক সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে শােষণ করতে অভ্যস্ত। আওয়ামী লীগ শাসনে, ছয়দফার দ্বারা প্রভাবিত রাষ্ট্রনীতি, ঐ শােষণ বিলােপেই নিয়ােজিত হবে। পশ্চিম পাকিস্তানে যেসব গােষ্ঠী সর্বাধিক ক্ষমতাশালী – যেমন, সামরিক আমলাবর্গ (এবং তাদের সুহৃদ ও লেজুড় বেসরকারী আমলাবর্গ), এবং বৃহৎ ব্যবসায়ী (যাদের সঙ্গে জড়িত সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামীবৃন্দ) — তাদের স্বার্থের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিক ভুট্টোর স্বার্থ বেশ মিলে গেল। উভয়েরই উভয়কে বিশেষ প্রয়ােজন। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল যাই হােক, ভুট্টো যে কোন উপায়ে মুজিবকে এড়িয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। তার এই অন্যায় অভিলাষকে প্রশ্রয় দিলাে আমলা-ব্যবসায়ী-ভূস্বামীচক্র। স্বয়ং একজন বৃহৎ জমিদার, ভুট্টো, ঐ চক্রের প্রতিভূ হয়ে ১৯৭০ এর নির্বাচনী ফলাফল নস্যাৎ করার জন্য সর্বাত্মক ষড়যন্ত্রে সামিল হােলেন। (২২)।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলাফল নাকচ করার ষড়যন্ত্রে ভুট্টো নানাবিধ কলাকৌশল প্রয়ােগ করলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান সফরে এলেন, মুজিবের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করলেন। ছয়দফার ওপরে সমাজবাদের হেঁয়ালিকে অগ্রাধিকার দিলেন, কিন্তু, বলা বাহুল্য, মতৈক্য হলাে না। কট্টরপন্থী সেনাপতিদের উসকানিতে বলীয়ান হয়ে ভুট্টো ইয়াহিয়াকেও হুমকি দিলেন। ফলে, ঢাকায় মুজিবের সঙ্গে আলােচনায় ইয়াহিয়া তাকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্বােধন করলেও, এবং জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মুজিবের বারবার অনুরােধ সত্বেও, ইয়াহিয়া সত্বর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসাতে ব্যর্থ হলেন। অযথা বিলম্বের পর ৩ মার্চ ১৯৭১ অধিবেশনের দিন ধার্য হয়। কিন্তু ছয়দফা মানতে গররাজী ভুট্টো অধিবেশন বর্জনের ডাক দিলেন। তার দল এবং কায়ুমপন্থী মুসলিম লীগ ব্যতীত পশ্চিম পাকিস্তানের আর সব দলই জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দিতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কোন সাংসদ যাতে ঢাকায় ঐ অধিবেশনে যােগ দিতে না যায়, সেজন্য ভুট্টো হত্যার হুমকি দিতেও ইতস্তত করেন নি। ভুট্টোর আওয়ামী লীগ বিরােধিতার সঙ্গে যুক্ত হলাে তার দুর্নিবার ভারত বিরােধিতা, তার এক হাজার বছরব্যাপী যুদ্ধের আওয়াজ। এভাবে প্রচেষ্টা হলাে আওয়ামী লীগের ছয়দফা তথা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইকে ভারতের সঙ্গে লড়াই -এর জিগিরের
আড়ালে ঠেলে দেয়া। ছয়দফা অনুসারে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থসাধক রাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযােগিতা বৃদ্ধির সম্ভবনা ভুট্টো ও পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থগােষ্ঠীকে চূড়ান্ত ভাবে বিরূপ করেছিল। জানুয়ারী মাসে যখন একটি ভারতীয় যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে লাহােরে আনা হলাে, এবং পরে পাকিস্তানী নিরাপত্তা বাহিনীর সামনে বিনা বাধায় সেটিকে ধ্বংস করা হলাে, তখন পাকিস্তানের পূর্ব-পশ্চিম বিরােধকে ভারত-বিরােধিতার দ্বারা আচ্ছন্ন করার চেষ্টা হলাে। ভুট্টোর উদ্যোগে পাকিস্তানের নানা শহরে উপরােক্ত আতঙ্কবাদী ও নাশকতাকারীদের সম্মানে জনসভা আহ্বান করা হলাে। (২৩)।
পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উপরােক্ত ষড়যন্ত্রের মুখােমুখি হয়ে পূর্বাঞ্চলের জনগণ ও আওয়ামী লীগ একের পর এক সময়ােপযােগী ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পাকিস্তানের অতীত ইতিহাস থেকে জানা যায়, অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণে সামরিক-বেসামরিক আমলাবর্গের উপর্যুপরি সাফল্যের অন্যতম মৌলিক কারণ ছিল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনৈক্য। ১৯৭০ নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিরা যাতে ঐক্য বজায় রাখতে অনুপ্রাণিত হন, এবং অনৈক্য ও বিশ্বাসঘাতকতার কি চরম মূল্য দিতে হবে সেটা অবহিত থাকেন, সেজন্য ৩ জানুয়ারী ১৯৭১ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে একটি শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান * আয়ােজিত হয়। সেখানে মুজিব বলেন, যদি ছয়দফার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হয়, তাহলে জনতা যেন আওয়ামী লীগকে ক্ষমা না করে, এবং মুজিবকেও জীবন্ত কবর দিতে দ্বিধা না করে। ১ মার্চ মধ্যাহ্নে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতবী রাখার সিদ্ধান্ত প্রচার করা হয়। আবুল মনসুর আহমদের মূল্যায়নে, “নিতান্ত সদিচ্ছা সত্ত্বেও মানুষ বড় অন্যায় কাজ করিয়া ফেলিতে পারে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বেলাও ঠিক তাই ঘটিয়াছে। বিভিন্ন দলের মধ্যে আপােস ঘটাই বার চেষ্টা করিতে গিয়া নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই তিনি নিরপেক্ষতা হারাইয়াছেন। এক দলের পক্ষে ও অপরাপর দলের বিপক্ষে গিয়াছেন। শুধু মনের দিক হইতে নয়, কাজের দিক হইতেও। ১ মার্চ যখন কেন্দ্রীয় আইনসভার অধিবেশন অনির্দিষ্টকাল পেছানাের ঘােষণা দেয়া হলাে, তখন ঢাকার পূর্বানী হােটেলে মুজিব ও আওয়ামী লীগের সংবিধান প্রণেতারা ছয়দফা অনুসারে অখণ্ড পাকিস্তানের নতুন সংবিধান রচনার কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছিলেন। তারা জানতেনও না, রেডিওতে কি ঘােষণা প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু জনসাধারণ জানতাে। তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়লাে। শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মিছিল এসে পূর্বানী হােটেলের সামনে সমবেত হলাে। আওয়ামী লীগের সহচর সংগঠন ছাত্র লীগের নেতৃবৃন্দ প্রচণ্ড ভাবে ক্ষিপ্ত হলেন। ছাত্রনেতারা আর স্বায়ত্তশাসনের সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকতে রাজী ছিলেন না, পল্টন ময়দানে সভা করে তারা স্বাধীনতার দাবি তুললেন। মনে রাখা প্রয়ােজন, ঐ সময় সারা দেশে ছাত্র লীগের প্রভাব তুঙ্গে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭০ এর এপ্রিলের অবস্থা অনুযায়ী, ১৩৪ টি কলেজের মধ্যে ১২৪ টিতেই ছাত্র ইউনিয়নগুলি ছিল ছাত্র লীগের অধিকারে। অতএব ছাত্র লীগ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করলে তার অভিঘাত সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। ১ মার্চ হরতাল পালিত হলাে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, এবং পরদিন মুজিবের আহ্বানে হরতাল অব্যাহত রইলাে। ১ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ও জিন্নাহর প্রতিকৃতি দাহ করা হয়। জনতা আওয়াজ ওঠায়, “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনের সম্মুখে একটি বিরাট ছাত্রসভায় বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তানের নয়) স্বাধীনতা ঘােষণা করা হয়, এবং সদ্যপ্রস্তুত নতুন জাতীয় পতাকা উত্তোলিত করা হয়। প্রসঙ্গত মনে করা যায়, ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯ সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে মুজিব ঘােষণা করেন যে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের প্রদেশকে বাংলাদেশ নামে অভিহিত করা উচিত। (২৪)।
১ মার্চ নিরাপত্তা বাহিনীর গুলীতে একজন বিক্ষোভকারী নিহত এবং সাতজন আহত হয়। ৩ মার্চ ছাত্র লীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভা হয়। সভার সংগঠকগণ আওয়াজ দেন ঃ “কৃষক শ্রমিক অস্ত্র ধরাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করাে”। ঐ দিনই কট্টরপন্থী লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণের উদ্যোগ নেন। যেমন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠান বা মুলতবীর ব্যাপারে, তেমনি টিক্কা খানকে নিয়ােগের ব্যাপারেও আইনসভায় নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী – এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের একমাত্র ন্যায়সঙ্গত দাবিদার – মুজিবের সঙ্গে কোন পরামর্শই করা হয় নি। এসব সত্ত্বেও মুজিব ৩ মার্চ বক্তৃতায় ছিলেন। সহনশীলতা, মধ্যপন্থা ও গণতন্ত্রমনস্কতার মূর্ত প্রতীক। নিদারুণ প্ররােচনা সত্ত্বেও তিনি পাকিস্তান বিভাজনের আহ্বান দেননি। তিনি হুঁশিয়ারি দিলেন, গুলীবর্ষণ ও নিরস্ত্র মানুষের হত্যা নিছক কাপুরুষতা, এবং, সাড়ে সাত কোটি মানুষের নিধন অসম্ভব। মুজিব নির্দেশ দিলেন, যতদিন না পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতার পরিপূর্ণ হস্তান্তর ঘটছে ততদিন অহিংস অসহযােগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। সরকারকে কোনও খাজনা দেয়া বন্ধ। কিন্তু হিংসা প্রতিরােধ করতে হবে। শান্তি বজায় রাখতে হবে। মুজিব ডাক দিলেন, সব সরকারী সংস্থার কর্মীবৃন্দ দায়িত্বপালনে বিরত থাকবে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি আবার ভাষণ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রম পর্যালােচনা করে পুনরায় প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দেবেন বলে ৩ মার্চ ঘােষণা করলেন। ঐ দিন ৩০০ বিক্ষোভকারী নিরাপত্তা বাহিনীর গুলীতে নিহত হয়। পাকিস্তানী সৈন্যরা অত্যাচারী দখলদার বাহিনীর ভূমিকা অবলম্বন করেছিলাে। এই পরিস্থিতিতে ৬ মার্চ রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া যখন পুনরায় – এবং এবারও মুজিবের সঙ্গে পরামর্শ করার ন্যূনতম সৌজন্য প্রদর্শন না করে – ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধন দিবস ধার্য করলেন, তখন বােধহয় পূর্ব পাকিস্তানের কোন ব্যক্তিই রাষ্ট্রপতির বাতার ওপর আস্থা স্থাপন করতে পারেন নি। ৪, ৫, ও ৬ মার্চ অর্ধ দিবস সাধারণ ধর্মঘট চলে। ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে মুজিব বলেন, জনসাধারণ তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করেছিলাে। জনতার সহিত তিনি রক্তের ঋণে আবদ্ধ। নিজের রক্ত দিয়ে তিনি ঐ ঋণ শােধে প্রস্তুত। নির্বিচারে হানাদার বাহিনী জনসাধারণের ওপর গুলী চালিয়েছে। অতএব, মুজিব ঘােষণা দিলেন, শহীদের রক্তের ওপর হেঁটে তিনি ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদে প্রবেশ করবেন না। চারটি দাবি পূরণ হলেই তিনি আইনসভায় যাবেন। ঐ দাবিগুলি ছিলাে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীর ছাউনিতে প্রত্যাবর্তন, গণহত্যার তদন্ত এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা অর্পণ। ঐদিন মুজিবের মর্মস্পর্শী আহ্বান হলাে ঃ “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সং গ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। টিক্কা খান হুকুম দিলেন, মুজিবের ৭ মার্চ এর বক্তৃতা বেতারে প্রচার করা যাবে না। এর প্রতিবাদে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সব কর্মী ধর্মঘট করে। কর্তৃপক্ষ। পরদিন ঐ বক্তৃতা প্রচারে মত দেয়ায় ধর্মঘটের অবসান হয়। বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য, ঐ সময়ে ঢাকা বেতার ও দূরদর্শন কেন্দ্রের প্রায় সব কর্মীই কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে স্ব স্ব পেশাগত দক্ষতার প্রয়ােগে চমকপ্রদ প্রতিবাদ প্রতিরােধ গড়ে তুললেন। সঙ্গীত ও অন্যান্য কার্যক্রম মারফত তারা পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের বিদ্রোহী সত্ত্বাকে সদা জাগ্রত ও উদ্বুদ্ধ রাখলেন। (২৫)।
টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের রাজ্যপালের পদ অলংকৃত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেন নি, কারণ মুজিবের অসহযােগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টিক্কা খানকে শপথ গ্রহণ করাতে অস্বীকার করেন। অতএব টিক্কা পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্য সামরিক প্রশাসক হিসেবেই কার্যভার গ্রহণ করেন। ১৯৭১ এর মধ্য মার্চের মধ্যে দেখা গেলাে,” লিখেছেন মুনতাসীর মামুন এবং জয়ন্ত কুমার রায়, “সরকারী কর্তৃত্ব সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে সেনানিবাস ও বিমানবন্দরের মধ্যে। তা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা কতারা ভাবতাে, যথাযথ কর্তৃত্ব পেলে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের তারা দমন করতে পারবে। সেনানিবাসে খাদ্যসরবরাহকারী ঠিকাদাররাও সরবরাহ বন্ধ করে দিলাে। একই ভাবে, সেনানিবাসে প্রকৌশলী শাখার বেসামরিক কর্মচারীরাও কাজে যাওয়া থেকে বিরত থাকলেন। পাকিস্তানের দুই অংশে বানিজ্য বন্ধ রইলাে। কিন্তু চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে জাহাজ ভর্তি সেনা এসে নামলাে। বার্মা, চীন ও শ্রীলংকার ওপর দিয়ে বিমানে করে বেসামরিক পােশাকে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা এসে নামতে লাগলাে ঢাকা বিমানবন্দরে।” (২৬)। | ইয়াহিয়া খান অবশ্য কূটকৌশল প্রয়ােগ অব্যাহত রাখলেন। তিনি পুনরায় ঢাকা। এলেন। ঘােষিত উদ্দেশ্য মুজিবের সঙ্গে আলাপ আলােচনা, কিন্তু অঘােষিত ও প্রকট লক্ষ্য হানাদারবাহিনী কতােটা শক্তিশালী হয়েছে, এবং নির্বাচনী ফলফল সামরিক অভিযানে নিশ্চিহ্ন করা যাবে কিনা, এসব পর্যবেক্ষণ ও পর্যালােচনা করা। ১৯৭১ মার্চ মাসে মুজিব
১৪৫
ইয়াহিয়া আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে, লিখেছেন এম আর আখতার মুকুল, “ পরবর্তীকালে গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলেও সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, মুজিব-ইয়াহিয়া আলােচনা কিন্তু সেদিন অসমাপ্ত ছিলাে। ১৬ ই মার্চ থেকে শুরু করে ২৩ শে মার্চ পর্যন্ত এই আট দিনব্যাপী আলােচনার প্রতিটি বৈঠকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তার পরামর্শদাতারাসহ অন্যান্য বাঙালি নেতৃবৃন্দ যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকার কথা। কেননা আলােচনার বাহানা করে কালক্ষেপণের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অতিরিক্ত সৈন্য আমদানী করে বাংলাদেশে গণহত্যার পূর্ব সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষে আলােচনা ব্যর্থ হয়েছে এই কথা বলা সম্ভব হয় নি। … প্রকৃতপক্ষে কোন রকম ঘােষণা ছাড়াই ২৩ শে মার্চ ছিলাে শেষ বৈঠক।”(২৭)।
পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে দ্রুত বিলীয়মান বন্ধনের শেষ সূত্র বােধহয় ছিলেন মুজিব স্বয়ং। কিন্তু ৬ মার্চ এর ভাষণে ইয়াহিয়া খান যখন আইনসভার বৈঠক বাতিলের জন্য মুজিবকে দায়ী করেন, তখন তিনি ঘােরতর অন্যায় করেছিলেন। এই অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি ঘটলাে ২৩ মার্চ যখন মুজিবকে কোন কিছু না জানিয়ে ইয়াহিয়া মুজিবের সঙ্গে আলােচনায় সমাপ্তি ঘটালেন। অথচ মার্চ মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে মুজিব কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের শাসনকর্তা হিসেবে কাজ করে পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি পূর্ণ সমর্থন বজায় রেখেছেন। “ ছয়দফা যে পাকিস্তানের অখণ্ডতা-বিরােধী নয়, শেখ মুজিব .. তিনটি সপ্তাহ সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ডি ফ্যাক্টো সরকার চালাইয়া তা প্রমাণ করিয়াছেন। এই একুশ দিনে বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় সরকার বলিতে কিছু নাই। তবু শেখ মুজিব ছয়দফার বাইরে এক ইঞ্চি জমিতেও পদক্ষেপ করেন নাই। পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা ব্যাপারে তিনি কোনও হস্তক্ষেপ করেন নাই,” লিখেছেন আবুল মনসুর আহমদ।(২৮) | ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে কোনও সরকারী বা বেসরকারী ভবনে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ে নি। কিন্তু বাংলাদেশের নতুন পতাকা ছিল সর্বত্রই উড্ডীন। ঐ দিন শত শত মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে মুজিবের আবাসভবনে এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আওয়াজ তােলে। বৃহত্তম মিছিল ছিল ছাত্রদের, নেতৃত্বে ছিলেন এ এস এম আবদুর রব। এরপর শুরু হলাে গগনভেদী জাতীয়তাবাদী গণধ্বনি। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলাে যে তার নিজের বাড়ীতেও মুজিবকে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করতে হলাে। ২৪ মার্চ অপরাহ্নে মুজিব ও ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে শেষ আলােচনা অনুষ্ঠিত হলাে, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রকৃতি পরিমাণের ব্যাপারে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলাে না। সরকারীভাবে অবশ্য আলােচনা সমাপ্ত হয় নি। কিন্তু ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় ও ২৫ মার্চ সকালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত রাজনীতিকবৃন্দ এবং ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাগণের প্রায় সকলেই ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫ মার্চ সকাল ৯ টায় ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আওয়ামী লীগের শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাবের প্রতি তার চূড়ান্ত অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। শাসকচক্রের শীর্ষস্থানীয় চরমপন্থী সেনাপতিবৃন্দ – হামিদ, ওমর, মিঠা, পীরজাদা, টিক্কা — সকাল দশটায় রাষ্ট্রপতি ভবনে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলােচনায় বসেন। অপরাহ্নে সেনানিবাস সূত্র থেকে মুজিব জানতে পারেন, রাজনৈতিক মীমাংসার কোনও সম্ভাবনা নেই, ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেছেন, এবং সামরিক বাহিনী হিংসাত্মক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ২৫ মার্চ বেলা এগারােটায়ই টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত সেনানায়ক মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজাকে ঐ দিন রাতে অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন। এই অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিলাে অপারেশন সার্চলাইট। অভিযান শুরুর সময় ২৫-২৬ মার্চ রাত্রি একটা। অসমসাহসী মুজিব অভিযানের খবর পেয়ে তার সহকর্মীদের অজ্ঞাতবাসে যাবার নির্দেশ দিলেন, কিন্তু নিজে তার আবাসভবনেই থাকলেন। অভিযান শুরুর অল্প সময় পরই মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়, সাধারণ সৈনিকেরাও তার প্রতি ভয়ানক অভদ্র আচরণ করে। ইংরেজী তারিখ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর বেতারযন্ত্র মারফত চট্টগ্রাম ও নানা স্থানে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রেরণ করেন। পরে ২৬ মার্চ অপরাহ্নে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের জেলা সম্পাদক এম এ হান্নান স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচার করেন। আরও পরে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের কালুরঘাটে সদ্যস্থাপিত বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান (ভবিষ্যতে রাষ্ট্রপতি) স্বাধীনতার বাণী ঘােষণা করেন। মুজিব তার স্বাধীনতা ঘােষণায় বলেনঃ “সম্ভবতঃ এটাই আমার শেষ বাণী। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে আমি এ মর্মে আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যেখানেই থাকুন না কেন এবং আপনাদের হাতে যা কিছু রয়েছে, তাই-ই দিয়ে দখলদার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়াই করুন। বাংলাদেশের মাটি থেকে দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যকে বহিষ্কার করে বিজয়লাভ না করা পর্যন্ত আপনাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে।” (২৯)।
এর পর একদিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নৃশংস গনসংহার, গণধর্ষন, পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যা, ইত্যাদি, অপরদিকে জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধে যােগদান, মার্চ ১৯৭১ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭১ মুক্তিবাহিনীর উত্তরােত্তর সাফল্যলাভ, মুক্তিবাহিনীর প্রতি প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতের ক্রমবর্ধমান সমর্থন, শেষ পর্যন্ত ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ যৌথভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর কাছে ঢাকায় পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পন, এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ। এসব বিষয়ে আছে বহু বিতর্ক, প্রকাশিত হয়েছে অনেকের গ্রন্থ-প্রবন্ধ (বর্তমান লেখকেরও), কিন্তু ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত একটি পুস্তকের ভাষান্তরের পরিশিষ্ট হিসেবে রচিত এই সপ্তম অধ্যায়ে এসব বিষয়ের অবতারণা নিষ্প্রয়ােজন। যেটার উল্লেখ-এবং পুনরুল্লেখ – অবশ্য প্রয়ােজনীয়, সেটা হলাে, গণতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদের অগ্নিপরীক্ষায় পাকিস্তানী শাসকচক্রের চরম ব্যর্থতা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত। এই ব্যর্থতার কারণেই স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন রূপান্তরিত হয় অসহযােগ আন্দোলনে, আর অসহযােগ আন্দোলন পরিণত হয় সফল স্বাধীনতা সং গ্রামে। অসহযােগ আন্দোলন পরিচালনায় শেখ মুজিবর রহমান অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন — মুজিব প্রদত্ত বিশদ ৩৫ টি নির্দেশ ছিল অতীব সুচিন্তিত। বােরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর-এর ভাষায়, “৩৫ টি নির্দেশের লক্ষ্য ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিরােধ এবং অস্বীকার করা এবং একই সঙ্গে এই ভূখণ্ডের জনজীবনের স্বাভাবিকতা এবং শৃঙ্খলা রক্ষা করা। কর্তৃত্ব প্রতিরােধ এবং অস্বীকার করার মাধ্যম পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে সর্বাত্মক অসহযােগিতা এবং জনমুখী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যম বাঙালী জনসাধারণের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের সর্বাত্মক সহযােগিতা। এই সহযােগিতার ভিত্তি বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং এই জাতীয়তাবাদ দায়িত্বশীল।” বর্তমান পুস্তকের উপসংহারে জাহাঙ্গীর-এর আর একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করা সমীচীন ঃ “ অসহযােগ আন্দোলন রাষ্ট্রের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংজ্ঞার ভিত্তিতে কাজ করেছে। জনপ্রতিনিধিত্বহীনতা, সামরিকতা এবং জবরদস্তি। বিপরীতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি মূলে কাজ করেছে সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্র পরিচালনায় জনপ্রতিনিধিত্বতা প্রবর্তন, সামরিকতা উচ্ছেদ এবং সম্মতিবােধ শক্তিশালী করে তােলা।” (৩০)।
১৪৮
স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা।
1. KAMRUDDIN AHMAD, A Socio Political History of Bengal (Inside Library, Dhaka, 1975), pp. 206-7.
2. JAGLUL ALAM, Bangladeshe Bamponthi Rajnitir Garidhara (Pratik, Dhaka, 1990), p. 46.
3. MOUDUD AHMED, Bangladesh : Constitutional Quest for Autonomy (University Press Limited, Dhaka, 1979). pp. 99-104 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1. pp. 207-8.
4. The Pakistan Observer, 27 January, 23 February 1968 ; Sangbad, 20 February 1968 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, p. 209.
5. Dawn, 8 November 1968 ; The Pakistan Observer, 11, 14 November 1968 ; MAHFUZULLAH, Obhyuthyaner Unosottor (Dana, Dhaka, 1983), pp. 9-13.
6. Dainik Pakistan, 20, 23 November 1968 ; MAHFUZULLAH, n. 5, pp. 13-8.
7. MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 135-6; KAMRUDDIN AHMAD, n.
১৮০
1, pp. 212-3; MESBAH KAMAL, Srenidristite Bangladesher Muktijuddho (Kapotakshi, Dhaka, 1984), p.22.
8. The Pakistan Observer, Sangbad, 6 January 1969 ; Bichitra (Weekly, Dhaka), 9 September 1977, p. 68 ; TARIQ ALI, Pakistan : Military Rule or People’s Power (Jonathan Cape, London, 1970), p. 172; MOUDUD AHMED, n. 3, p. 138 ; JAGLUL ALAM, n. 2, p. 49.
9. KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 213-4 ; The Pakistan Observer, 18, 19, 24 January 1969 ; BADRUDDIN UMAR, Society and Politics in East Pakistan (Calcutta, 1980), pp. 55-7, 104 ; Shyamali Ghosh. The Awami League 1949-1971 (Dhaka, 1990). p. 151 ; MOHAMMAD HANNAN, Bangladesher Chhatra Andoloner Itihas (Warsee Prokashanee, Dhaka, 1987), p. 167.
10. MAHFUZULLAH, n. 5, p. 67 ; MESBAH KAMAL, n. 7. pp. 245; MOUDUD AHMED, n. 3, p. 140; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, p. 214.
11. MAHFUZULLAH, n. 5, pp. 71-3; ABDUR ROUF, Agartala Sharajantra Mamla O Amar Nabik Jiban (Papyrus, Dhaka, 1992), pp. 857; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 140-1 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 214.-5.
12. MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 141-5; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 215-8; MAHFUZULLAH, n. 5, pp. 72-5.
13. The Pakistan Observer, 26 January, 2 February 1969 ; MESBAH KAMAL, n. 7, p. 24 ; MAHFUZULLAH, n. 5, pp. 72-5.
14. The Pakistan Observer, 23 February 1969 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 217-8 ; MAHFUZULLAH, n. 5, pp. 75-7 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 148-9.
15. MAHFUZULLAH, n. 5, pp. 78-81 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 148-60; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 218-20.
16. Dainik Pakistan, 7, 8, 11, 12 March 1969 ; The Pakistan Observer, 15, 20 March 1969 ; MOHAMMAD FORHAD, Unosttorer Gonoabhyuthyan (Dhaka, 1989), pp. 82-4 ; MESBAH KAMAL, n. 7, p. 27 ; MAHFUZULLAH, n. 5, pp. 81-2; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, p. 220.
17. MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 163-86, 188-91 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 221-2; ABDUL WAHED TALUKDAR, 70 Theke 90: Bangladesher Rajnaitik Prekshapat (Pandulipi, Dhaka, 1991). pp. 11-2; MAHFUZULLAH, n. 5, pp. 85-6.
18. MOUDUD AHMED. n. 3, pp. 191-2 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 231-2 ; ABDUL WAHED TALUKDAR, n. 17, p. 12 ; ABUL MANSUR AHMAD, Amar Dekha Rajnitir Panchash Bachhar (Nowroze Kitabistan, Dhaka, 1975). p. 155.

19. MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 192-6 ; ABDUL WAHED TALUKDAR, n. 17, p. 12; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 232-4.
20. ABDUL WAHED TALUKDAR, n. 17, p. 12 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 236-7 ; MOUDUD AHMED, n. 3. pp. 220-1 ; MUNTASSIR MAMOON and JAYANTA KUMAR RAY, Bangladeshe Civil Samaj Pratisthar Sangram (Abosar, Dhaka, 1995), p. 44.
21. ABDUL WAHED TALUKDAR, n. 17, p. 13; MAMOON and RAY, n. 20, p. 45 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 201-4 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, p. 238; ZILLUR R. KHAN, Leadership Crisis in Bangladesh (University Press Limited, Dhaka, 1984), pp. 15-6.
22. ABUL MANSUR AHMAD, n. 18, pp. 380, 391-2 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 206-10; ZILLUR R. KHAN, n. 21, pp. 17-8.
23. ABUL MANSUR AHMAD, n. 18, pp. 393-5 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 209-15, 218-9 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 238-40; ABDUL WAHED TALUKDAR, n. 17, pp. 13-4.
24 ABUL MANSUR AHMAD, n. 18, p. 394 ; ABDUL WAHED TALUKDAR, n. 17, p. 12 ; Ittefaq, 28 April 1970 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 240-2 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 221-2 ; MAMOON and RAY, n. 20, pp. 45-6.
25. KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 252-5; MAMOON and RAY, n. 20, p. 47; ABDUL WAHED TALUKDAR, n. 17, pp. 15-6 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 223-31. 26. MAMOON and RAY, n. 20, p. 48.
27. M. R. AKHTAR MUKUL, Chollish Theke Ekattor (Sagar Publishers, Dhaka, 1990). p. 80 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 237-44. 28. ABUL MANSUR AHMAD, n. 18, p. 396; also see p. 388. 29. M. R. AKHTAR MUKUL, n. 27, pp. 80–2 ; ABDUL WAHED TALUKDAR, n. 17, pp. 17-22 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 245-9; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 265-7.
30. BORHANUDDIN KHAN JAHANGIR, Rashtrer Dayabaddhata (Agamee, Dhaka, 1995), pp. 7-9; for an eleaborate account of monstrous atrocities committed by the Pakistan army on the eve of surrender, see Major Rafiqul Islam PSC, Buddhijibi Hatyakander Nepatthey (Agamee, Dhaka, 1992).

Ref: গনতন্ত্র এবং জাতীয়তার অগ্নিপরীক্ষা – জয়ন্তকুমার-রায়, pp 127-141