১৯৪৭ সালের ৩ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন ঘােষণা করলেন, ব্রিটিশ সরকার দেশ বিভাগের নীতি মেনে নিয়েছে এবং ১৪ আগস্ট তারা ভারতের শাসনভার ছেড়ে দেবে। বাংলার আইনসভার সদস্যরা অধিবেশনে বসে আলােচনা করলেন—তারা ভারতে যােগ দেবেন, না পাকিস্তানে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। মুসলমান। তারা পাকিস্তানে যােগ দেওয়ার পক্ষে মত দেন। ২০ জুন (১৯৪৭) স্পিকার নুরুল আমিনের সভাপতিত্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলাের আইনসভার সদস্যরা আলাদা বৈঠক করে ১০৬-৩৫ ভােটে বাংলা অখণ্ড রাখার পক্ষে মত দেন। বর্ধমানের মহারাজা স্যার উদয়চাদ মাহতাবের সভাপতিত্বে অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলাের আইনসভার সদস্যরা অপর একটি সভায় ৫৮-২১ ভােটে বাংলা ভাগ করার পক্ষে মত দেন।৩৩ অর্থাৎ আইনসভায় সব মুসলমান সদস্য বাংলা অখণ্ড রাখা এবং একজন ছাড়া সব হিন্দু সদস্য বাংলা ভাগ করার পক্ষে দাঁড়ালেন। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ভােট দেন। তারা সবাই ছিলেন হিন্দু’।৩৪ ব্যতিক্রম ছিলেন বঙ্গীয় কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেতা কিরণশংকর রায়। তিনি একমাত্র হিন্দু সদস্য, যিনি বাংলা ভাগ করার বিরুদ্ধে মত দিয়েছিলেন।৩৫ ৬-৭ জুলাই (১৯৪৭) আসাম প্রদেশের সিলেট জেলায় একটি গণভােট অনুষ্ঠিত হয়। ভােটের রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিলেটবাসী পাকিস্তানের অংশ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।৬। সােহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিনের মধ্যে কে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের পার্লামেন্টারি দলের নেতা হবেন, এ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় । নাজিমুদ্দিন ৭৫-৩১ ভােটে জিতে যান।৭ সােহরাওয়ার্দী ভােটে হেরে যাওয়ার পরমুহূর্তে বসিরহাটের আবদুর রহমানকে সঙ্গে করে পাশের কামরায় যেখানে পশ্চিমবঙ্গ মুসলিম লীগের সংসদীয় দলের সদস্যরা তাদের নেতা নির্বাচন করার জন্য বসেছিলেন, সেখানে ছুটে যান। আবদুর রহমান সােহরাওয়ার্দীর নাম প্রস্তাব করেন এবং তিনি পশ্চিমবঙ্গ মুসলিম লীগের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। এটা ছিল দেবতাদের উপভােগ করার মতাে এক দৃশ্য। যে ব্যক্তি এক মুহূর্ত আগেও পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পােষণ করেছিলেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা হিসেবে নিজের নাম প্রস্তাব করলেন।”৩৮ অমুসলিম অংশের (পশ্চিমবঙ্গ) পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন ডা, প্রফুল্ল চন্দ্র ঘােষ। সােহরাওয়ার্দী ১৩ আগস্ট (১৯৪৭) পর্যন্ত অখণ্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৩ আগস্ট তিনি পূর্ববঙ্গের শাসনভার নাজিমুদ্দিনের হাতে এবং পশ্চিমবঙ্গের শাসনভার প্রফুল্ল চন্দ্র ঘােষের হাতে তুলে দেন।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাংলা ভাগকে অনিবার্য করে তুলেছিল। পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে যে মানুষের প্রতিষ্ঠা এবং রাজত্ব কায়েমের চেষ্টা হয়েছিল—সে মানুষ মুসলমান মধ্যবিত্ত। এ আন্দোলন তাই এক মানুষের (হিন্দু মধ্যবিত্ত) হাত থেকে অন্য মানুষের (মুসলমান মধ্যবিত্ত) পরিত্রাণ পাওয়ার আন্দোলন। এ জন্যই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হিন্দু মধ্যবিত্তরা দেশ ত্যাগ করল এবং মুসলমান মধ্যবিত্ত অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণি হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণির আওতাবহির্ভূত হয়ে কায়েম করল নিজের রাজত্ব। কিন্তু ইসলামের আওয়াজ তােলা সত্ত্বেও তার মধ্যে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণিনির্বিশেষে মানুষ কোনাে স্বীকৃতি পেল না।”৪০
বাংলা যখন ভাঙছিল, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছিল তখনাে। হিন্দুদের দ্বারা মুসলমান হত্যার প্রতিবাদে গান্ধী কলকাতার দাঙ্গা-উপদ্রুত বেলেঘাটা এলাকায় এক দরিদ্র মুসলমানের বাড়িতে আশ্রয় নেন এবং দাঙ্গা না থামা পর্যন্ত আমরণ অনশনের ঘােষণা দেন। তার পাশে রইলেন সােহরাওয়ার্দী। অগুনতি মানুষ সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও দাঙ্গার শিকার হয়েছিলেন। হঠাৎ করেই তারা হয়ে গেলেন ‘নিজগৃহে পরবাসী’। প্রায় দেড় কোটি লােক জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। এভাবেই শুরু হয়েছিল স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দেশত্যাগের প্রক্রিয়া। দ্য স্টেটসম্যান-এর সম্পাদক আয়ান স্মিথ পাকিস্তান গ্রন্থে লিখেছেন, ১৬ মাসের গৃহযুদ্ধে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিলেন। এর সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কমনওয়েলথভুক্ত সব দেশের মােট ৫ লাখ ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যুর তুলনা করা যায়।৪২ বাঙালি মুসলমান পরিচিত প্রতিবেশী হিন্দুর সঙ্গে এক রাষ্ট্রে বসবাস করবে , এই লক্ষ্য নিয়ে অপরিচিত দূরবর্তী অঞ্চলের মুসলমানদের সঙ্গে যােগ দিয়ে পাকিস্তান বানাল তবে মােহভঙ্গ হতে দেরি হলাে না।
Ref: আওয়ামী-লীগ-উত্থান-পর্ব-১৯৪৮-১৯৭০-মহিউদ্দিন-আহমদ, pp 22-24