You dont have javascript enabled! Please enable it! কাদের সিদ্দিকের গল্প-মুক্তিযুদ্ধের দুর্ধষ্য এক গেরিলা যােদ্ধার বিদ্রোহী স্বাধীন চেতনার করুণ পতন। শশাঙ্ক ব্যানার্জী - সংগ্রামের নোটবুক

কাদের সিদ্দিকের গল্প-মুক্তিযুদ্ধের দুর্ধষ্য এক গেরিলা যােদ্ধার বিদ্রোহী স্বাধীন চেতনার করুণ পতন। শশাঙ্ক ব্যানার্জী

কাদের সিদ্দিকী, যিনি বাঘা সিদ্দিকী নামেও পরিচিত, একজন বেপরােয়া যােদ্ধা ও সংগঠক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন লম্বা হালকা-পাতলা আকর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব। তিনি একাই প্রায় ৫০০০ থেকে ৭০০০জনের শক্তিশালী গেরিলা যােদ্ধার দল তৈরী করেছিলেন। অনেকে বলেন সংখ্যাটি প্রায় ১০,০০০। তারা পূর্ব পাকিস্তানের টাঙ্গাইলে কাদেরী বাহিনী নামে ঘাঁটি তৈরী করেছিলেন। যুদ্ধ শুরু হবার পর তিনি ভারতীয় বাহিনীর কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন প্রথমত কাজ করার প্রস্তাব পাঠিয়ে

১২৬

এবং পরবর্তীতে এক সাথে কাজ করতে সম্মত হয়ে। তখন তারা আসামের ডিব্ৰুগড় ঘাটি থেকে পূর্বপাকিস্তানের ভেতরে সুকৌশলে আক্রমন চালান। সে সময় ঢাকায় আসবার পথে গুরুত্ব পূর্ণ গােয়েন্দা-তথ্যের অভাবে ভারতীয় সেনা বাহিনীর কমান্ডার ভয়ঙ্কর ভুল করে প্রায় আত্মঘাতি একটা পথ বেছে নিয়ে সরাসরি পাকিস্তানীদের পাতা ফাঁদের ভেতরে পড়তে যাচ্ছিলেন। সে পথে শত্রুরা এন্টি-পার্সোনেল এবং এ্যান্টি ট্যাঙ্ক ল্যান্ডমাইন বিছিয়ে রেখেছিল। লাইনের পেছন থেকে বাঘা সিদ্দিকী এই আসন্ন বিপদের খবর জানতে পেরে দুর্দান্ত গতিতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং কাদেরী বাহিনী এবং ভারতীয় সেনাদের যৌথ পদযাত্রা নিরাপদ রাস্তায় সরিয়ে নেন। তার সময়মত হস্তক্ষেপের ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হিসাব মতে যৌথ বাহিনীর প্রায় ১০,০০০ মানুষের জীবন রক্ষা পায়। সঠিক সময়ে কাদের সিদ্দিকীর সঠিক সিদ্ধান্ত ও সাহসিকতার জন্য ভারত তাকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে।

বাঘা সিদ্দিকী আরাে দুটি বৈশিষ্টের জন্য পরিচিত ছিলেন। একটি তার আত্মবিশ্বাস, অপরটি তার নির্বোধ নিষ্ঠুরতা। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারী ১৯৭২, ঢাকায় তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কয়েকদিনের মধ্যেই পল্টন ময়দানে মুক্তি বাহিনীর সব গেরিলা যােদ্ধাদের অস্ত্র জমা দিতে বলেন। তাঁর আহ্বানে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। মুক্তি বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের যােদ্ধারা হাজার হাজার টন আগ্নেয়াস্ত্র ও গ্রেনেড তাঁর পায়ের কাছে এনে রাখেন। চেগুয়েভারার মত লম্বা চুল বাতাসে উড়িয়ে একটা সাদা ঘােড়ায় সওয়ার হয়ে নাটকীয়ভাবে কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর সামনে আসেন। ঘােড়া থেকে নেমে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে সামরিক কায়দায় অভিবাদন করেন তারপর পা ছুঁয়ে অস্ত্র সমর্পণ করেন। সেটি খুবই অনুগত আচরণ ছিল। কিন্তু সেদিন থেকেই তার পরিবর্তনেরও সূচনা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন নেতার গৌরবময় অবস্থান থেকে মানুষ হিসেবে তার পতন শুরু হয়।

এই নাটকীয় অস্ত্র সমর্পনের আগে কাদের সিদ্দিকী একটি নিষ্ঠুর কাজ করেন। পল্টন ময়দানে জনতার চোখের সামনে দুজন ‘রাজাকার’, উর্দু এই শব্দটির অর্থ সহযােগী, অর্থাৎ যারা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনা বাহিনীকে সহযােগিতা করেছিল, তাদের শিরােচ্ছেদ করেন। এই নিষ্ঠুর কাজটি এক মুহূর্তে গনতন্ত্রের জন্য মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে বাঘা সিদ্দিকীর সুখ্যাতি ধ্বংস করে। পরবর্তীতে এই হত্যার

১২৭

পক্ষে সাফাই দিতে তিনি বলেছিলেন যে শুধুমাত্র যুদ্ধের সময় বিশ্বাসঘাতকতা করায় তিনি রাজাকারদের শাস্তি দিয়েছেন। তৎক্ষনাৎ ভারতীয় বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধ চলকালীণ সময়ে কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুকন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বােনের মত সম্মান প্রদর্শন করতেন। কিন্তু তার ক্রমবর্ধমান অতি উচ্চাকাঙ্খ খুব তাড়াতাড়ি তাকে গ্রাস করে। সময়ের সাথে সাথে তার আচরণ আরাে দুর্বোধ্য এবং ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে নিজে দল গঠণ করেন। বাংলাদেশের সংসদে তার দল থেকে একমাত্র তিনি নিজে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি সত্যিই একজন বৈচিত্রময় চরিত্র। সময়ের সাথে যিনি রাজনৈতিক বিস্মৃতিতে হারিয়ে গেছেন। তিনি এখন এক রকম নির্বাসনেই থাকেন।

রেফারেন্স – ভারত, মুজিবুর রহমান, বাঙলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তান – শশাঙ্ক ব্যানার্জী