১৯৬২-১৯৭১ পর্যন্ত বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তি ও গণতন্ত্রের আদর্শ সমর্থনের জন্য ভারতকে উচ্চ মূল্য দিতে হয় – শশাঙ্ক ব্যানার্জী
৪০ বছর পার করে ২০১৩ সালে এসেও ভারতের সাথে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অক্লান্ত শত্রুতা শেষ হয়নি। যুদ্ধ চলছে পাকিস্তানের পূর্ব সীমান্তের লাইন অফ কন্ট্রোল জুড়ে, আফগান পাকিস্তান সংঘর্ষ চলছে ডুরান্ড লাইন জুড়ে, যার স্বয়ংক্রিয় যােগাযােগ ১৯৭১ সালে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সমর্থন দানের সাথে জড়িত।
ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের প্রেক্ষিতে মােহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর অহিংস আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কোনাে উপনিবেশ-বিরােধী সংগ্রামে সাহায্য করার বিষয়ে নয়াদিল্লী সবসময়ই রক্ষণশীল ও অতিসাবধানী ছিল । ভারত এর আগে স্বাধীনতার জন্য কোন সশস্ত্র সংগ্রামে বস্তুগত সাহায্য করেনি বললেই চলে। যদিও তার পরােক্ষ ভাবভঙ্গীতে তৃতীয় বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রামে নৈতিক সমর্থন দিয়ে এসেছে যেমন- আলজেরিয়ায় বেন বেলার নেতৃত্বে ফ্রন্ট ফর দি ন্যাশনাল লিবারেশন অফ আলজেরিয়াকে মুক্তি সংগ্রামে চিকিৎসা সহায়তা দেয়া, যদিও তা পুরােপুরি অহিংস আন্দোলন ছিলনা। আরেকটি উদাহরণ হল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এর সংগ্রামে নয়াদিল্লী চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছিল। ভারতের স্বভাবই ছিল এই সব বিষয়ের প্রচারে স্পর্শকাতরতা।
২১০
ভারত যেভাবে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মত একটি আন্দোলনে সমর্থন দেয় সেভাবে এর আগে সে কাউকে সমর্থন দেয়নি। যখন শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬২ সালের ২৫ ডিসেম্বর প্রথম বারের মত ভারতের সমর্থন প্রত্যাশা করেন। নয়াদিল্লী সম্পূর্ণ ভাবে এগিয়ে আসতে দ্বিধাবােধ করছিল। সেই দ্বিধার যথেষ্ট কারণও ছিল কিন্তু ভারতের শুভ ইচ্ছে বিস্তারিতভাবে শেখ মুজিবের কাছে ব্যাখ্যা করা হয়। এর আগের একটি অধ্যায়ে আমি গল্পের এই। অংশটি বলেছি। যাইহােক অংশগ্রহণের নিয়মাবলী ও আদর্শগত বিষয়গুলি নিষ্পত্তি হবার পরে কেবলমাত্র নয়াদিল্লী এগিয়ে আসে বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে। সীমাহীন সমর্থন দেয় কেবলমাত্র তখন যখন এই প্রদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের বলতে পেলে প্রায় শেষ মানুষটাও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দমন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালাে। ইসলামাবাদের নিজেকে দোষ দেয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। পাকিস্তানের নৈতিকতার হিসাব এবং সৎ জাতি হিসেবে দাবী অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল।
বাঙলাদেশের মানুষ যখন সীমাহীন দুর্ভোগ এবং গভীর সংকটের ভেতর পড়ে গেল ভারত তখন উদ্ধার করতে এগিয়ে গিয়েছিল। আর পাকিস্তান সেই কাজটিই করলাে যা তারা ভালাে পারে, ভারতকে সবকিছুর জন্য দোষারােপ করা, এমন কী তাদের ক্ষমার অযােগ্য কর্মকান্ডের জন্যেও।
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ভারত সফল হতােনা যেখানে পাকিস্তান সবগুলাে ব্রীজ ধ্বংস করে দিয়েছিল, এগিয়ে যাবার কোনাে উপায় ছিল না। বাঙলাদেশের মানুষ তার ভেতর দিয়েই তাদের অনেক দিনের লালিত স্বাধীনতার পথ খুঁজে নিয়েছিল।
একটি স্বাধীন দেশ ও রাষ্ট্র হিসেবে বাঙলাদেশের অস্তিত্ব নিশ্চিত হবার সাথে সাথেই ভারত পাকিস্তান সম্পর্কের এক নতুন পর্যায় শুরু হয়। ভারতের। কৌশলগত গুরু কে. সুব্রামানিয়ামের কথায় ইতিহাসের পথ বেয়ে পাকিস্তান। একটি কঠিন সমস্যায় জর্জরিত ও যুক্তিহীন রাষ্ট্র হয়ে ওঠে। তিনি আরাে বলেন তাদের (অর্থাৎ জেনারেলদের) জন্য ভারতবিদ্বেষ সীমাহীন হয়ে ওঠেছিল।
পূর্ব পাকিস্তান হারানাের পরে পাকিস্তানের ভারতনীতি অসম্ভব প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে এবং সে ভারতীয় জাতিসত্ত্বার মূল বিষয়গুলি ধ্বংস করার সব ধরনের সুযােগ খুঁজতে থাকে। আর এর ফলেই পাকিস্তানে ছদ্মবেশী যুদ্ধ জন্ম নেয় । এটি যুদ্ধের একটি ধারার প্রবর্তন করে। পূর্ব ফ্রন্ট থেকে কাশ্মীরের
২১১
নিয়ন্ত্রন রেখা পেরিয়ে ওপারেও ছিল যার বিস্তার। পাকিস্তানের সাবেক চিফ অফ আর্মি স্টাফ (COAS) জেনারেল আসলাম বেগ এই ধারা সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন- ‘শত্রু অঞ্চলের গভীরে যুদ্ধ নিয়ে যাওয়া। এর মানে হল পাকিস্তানের ছদ্ম (Proxy) যুদ্ধ ভারতের অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া। পাকিস্তানের সাবেক জোটভুক্ত ক্যাবিনেটের মন্ত্রী জাভেদ জব্বার কে. সুব্রামানিয়ামকে যা বলেছিলেন আমি তা উদ্ধৃত করছি, ‘ভারত ভেঙ্গে টুকরাে না হওয়া পর্যন্ত। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি আসবে না।’
চীনের সহায়তায় তৈরী পারমানবিক প্রতিরক্ষা ছত্রটি চলমান ছদ্ম যুদ্ধটাকে সীমা ছাড়িয়ে পারমানবিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার সম্ভাবনাকে ঠেকিয়ে রাখে। শ্রীনগরে পার্বত্য উপত্যকায় প্রতিদিনের হত্যা ও রাহাজানি এই ছদ্ম যুদ্ধের উদাহরণ। ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্ট ভবনের উপর হামলা ও ২০০৮ এর ২৬/১১’র মুম্বাই হামলাও আইএসআই-এর পরিকল্পনায় লস্কর ই তায়েবার মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছিল (এই বিষয়গুলির যথাযথ প্রমান আছে)।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সমর্থন এবং পাকিস্তান পরিচালিত।
আফগান পাক সংঘর্ষের মধ্যে সম্পর্ক
পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অন্যান্য নিরাপত্তা তত্ত্বের কথা ভুলে গেলে চলবে না যা পশ্চিম সীমান্ত পেরিয়ে ডুরান্ড লাইনে ব্যবহারের জন্য তৈরী করা হয়েছিল। এটি ‘আফগানিস্তানে কৌশলগত গভীরতা’ তত্ত্ব। পাকিস্তানের জেনারেলদের দৃঢ় বিশ্বাস যে ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধ অপেক্ষা করছে যা একই রকম হবে।
এই কৌশলগত গভীরতা অর্জন সম্ভব হবে শত্রু অঞ্চলের গভীরে একটি সামরিক ফিল্ড তৈরী করার মাধ্যমে। ধরা যাক একটা গুদামঘর তৈরী যেখানে সামরিক সরঞ্জাম মজুদ করা যাবে- যা বলতে গেলে পাকিস্তানের বাড়ির পেছনের উঠোনে, যেখান থেকে যুদ্ধকালীন সময়ে যুদ্ধ বিমান এবং বােমারু বিমানগুলাে ভারতীয় আকাশ সীমায় সহজেই প্রবেশ করে যুদ্ধ করতে পারবে। এটি পাকিস্তানের স্বপ্ন ছিল যে আফগানিস্তানের এই জায়গাগুলি পাকিস্তানকে ধীরে ধীরে আয়তনে বৃদ্ধি করবে। পূর্ব পাকিস্তান হারানাের বিষয়টি তাতে কাটিয়ে
২১২
ওঠা সম্ভব হবে। এই ধরণের কৌশলগত পরিচালনা থেকে এই বিষয়টিই প্রমাণ হয় যে ভারত বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে পূর্ব পাকিস্তান হারিয়ে ফেলার ঘটনার সাথে আফগান-পাকিস্তান সংঘর্ষের একটি যােগাযােগ আছে।
যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরব ও অন্যান্য ইসলামী দেশের সংগঠণ গুলির সাথে পাকিস্তানের মিত্রতার উদ্দেশ্য একটিই, সেটা হলাে ভারতকে টুকরাে করে ফেলার তার অঘােষিত গােপন মিশন। জেনারেলদের লক্ষ্য একটি বিষয়ের ওপরেই স্থির ছিল যে তারা চায় ভারত পাকিস্তান টুকরাে করে বাংলাদেশ তৈরীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চল পাকিস্তানকে দিয়ে দেবে। আর এই বার্তাটিই জেনারেল পারভেজ মােশারফ এর বক্তব্যে উঠে আসে যে LOC এমন একটি সমস্যা যার কোনাে সমাধান নেই।
ভারত বার বার ওয়াশিংটনকে সাবধান করে আসছে যে ২০১১ থেকে পরবর্তী এক দশকে জনগণের কর থেকে সংগৃহিত কোটি কোটি ডলার, যার পরিমাণ প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বলে মনে করা হয়, পাকিস্তানকে দেয়া হচ্ছে তা শুধুমাত্র আফগানিস্তানে ভারত বিরােধী ছদ্ম যুদ্ধে ব্যবহার করছে পাকিস্তান। দুই সীমান্তে পাকিস্তানের এই যুদ্ধ একসাথে চলছে। ৯/১১’র ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র এই সব সংঘর্ষের এক চরম অবস্থার শিকার। ২০০১ পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র বহু মানুষ ও সরঞ্জাম হারিয়েছে।
পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে ভালাে না বেসে তার টাকার কোন জবাবদিহিতা ছাড়াই উন্নতির বিদ্যা খুব ভালমতাে আয়ত্ব করেছে বলে মনে হয়। ওসামা বিন লাদেন যখন বেঁচে ছিল তখন কোথায় লুকিয়ে ছিল? আইমান আল জাওয়াহিরি অথবা মােল্লা মােহাম্মদ ওমরের লুকোনাের জায়গা কোথায়? এসব প্রশ্নের কোনাে উত্তর নেই । ১৯৭১ সালে বাঙলাদেশে যুদ্ধের পর থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তান তার সম্পর্ক বিচার করে শুধুমাত্র ডলারের অংকে। অন্যদিকে যতদিন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ডলার প্রবাহ অক্ষুন্ন আছে ততদিন ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সম্পর্ক অর্জন সম্ভব নয়।
ভুলে গেলে চলবে না যে ভারতের প্রতি পাকিস্তানের অসীম হিংসা নিহীত আছে মধ্য অঞ্চলে চলমান আফগান-পাকিস্তান দ্বন্দের ওপর। এখানে দুইটি বিষয় সংশ্লিষ্ট। একদিকে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার মধ্যে আদর্শগত দ্বন্দ, ক্রমবিকাশমান শক্তিগুলির মধ্যে ভারত যার ধারক ও বাহক এবং অন্যদিকে
২১৩
বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ভারতের উচ্চ মূল্য প্রদান পাকিস্তানের ধর্মীয় সামরিকতন্ত্র যা পাকিস্তানে সামরিক শাসকদের শক্তভাবে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখে। প্রধানত কোন দোষ না থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান এই নােংরা যুদ্ধে আফগানিস্তানকে টেনে এনেছে।
ভারতের রক্তের জন্য পাকিস্তানের পিপাসা
আরেকটি কারণে মেটেনি
বাঙলাদেশের জন্ম পাকিস্তানের অভ্যন্তরে চলমান জাতি ভিত্তিক সংঘর্ষের একটি অংশ যা একটি ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের পাপের বাক্স খুলে দিয়েছে। এটি পাকিস্তানের সংখ্যালঘু প্রদেশগুলির জাতিয়তাবাদী গােষ্ঠিগুলাের সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায় যা পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ ভাগ্যকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এই সমস্যার বিস্তারিত নিয়ে আমি অন্য কোন একটি অধ্যায়ে আলােচনা করেছি। এই সব অস্তিত্ববিনাশী হুমকির মুখে পাকিস্তান তার নিজের টিকে থাকার তত্ত্ব হাতে নেয় যেটা মূলতঃ দেশের সকল মানুষকে মুসলমান বানাবার তত্ত্ব। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল ঐতিহাসিক আদী জনগােষ্ঠির শক্তির বিরুদ্ধে দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখা যা সবসময় দেশটিকে বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সামরিক শাসকেরা বিশ্বাস করে এই ব্যাপক ইসলামীকরণ এক ধর্মীয় আঠা তৈরী করবে যা দিয়ে আদী জনগােষ্ঠীর বিভাজন টিকিয়ে পাকিস্তান এক রাখা যাবে।
নয়াদিল্লীর জন্য এই বিষয়টির একটি বিস্তৃত নিরাপত্তা সংক্রান্ত যােগাযােগ আছে। পাকিস্তানের এই পদ্ধতি ভারতের মুসলমানদেরও একত্রিভূত করবে যার ফলে ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে আইএসআই এর সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত দল গঠন করতে সুবিধা হবে। আইএসআই কার্যকরী ভাবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ৯/১১’র সন্ত্রাসী হামলা যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান অঞ্চলে এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতে টেনে নিয়ে গেছে। এখন যেহেতু এই সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট, তাই ধরে নেয়া যায় যে, আফগান-পাকিস্তান সংঘর্ষ সমাধানের সব উপায় পাকিস্তানের কাছে আছে। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র এই সমাধান ত্বরান্বিত করতে পারে। সেখানে আর কোনাে পথ নেই।।
২১৪
বাঙলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের সংশ্লিষ্টতায় পাকিস্তানের ক্রোধের একটি মূল্যায়ন। দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামাবাদের আধা সনাতন যুদ্ধের গল্প।
মিজো বিদ্রোহ ১৯৬৩-১৯৮৫
পাকিস্তানের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরাে (আইবি) ১৯৬৩ সালের শুরুতে তাদের এক তথ্যসূত্র মারফত আওয়ামী লীগের অভ্যন্তর থেকে খবর পায় যে শেখ মুজিবুর রহমান সম্ভবত গােপনে তাঁর পার্টির জন্য ভারতের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা খুঁজছেন। বলা হয়েছিল পার্টির ফান্ডে কিছু সংযুক্তি এসেছে। কোনরকম সতর্কতা ছাড়াই আইবি শেখ মুজিবের উপর ২৪ ঘণ্টা। নজর রাখার ব্যবস্থা গ্রহন করে। বাসায়, অফিসে, চলতি অবস্থায়, তাঁর সব । ধরনের কাজকর্ম তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে থাকে।
আইবি’র সন্দেহ আরাে শক্তিশালী হয় যখন মুজিব গােপনে ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশে যান। এবং এর রাজধানী আগরতলা থেকে তিনি যখন ফিরে আসছিলেন সে সময় পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। আই বি নিম্ন আদালতে মুজিবের বিরুদ্ধে কোন টেকসই প্রমাণ প্রদর্শন করতে পারেনি যদিও এজেন্সি যথেষ্ট নিশ্চিত ছিল যে সীমান্তের ওপারে তিনি পারিবারিক কিংবা ব্যবসায়িক কারণে যাননি।
পুলিশ কয়েক বছর পর তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযােগে মামলা সাজায়। নাম দেয়া হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। পূর্ব পাকিস্তানের মিডিয়া এই গল্পটি ব্যাপক ভাবে প্রচারিত করে। তাঁকে গ্রেফতার করেছিল যে পুলিশ অফিসারটি, তার ইংরেজী ছিল উপনিবেশ আমলের গদ্যের মত। মামলাটির উপসংহারে সে লেখে Final report true, no clue’। মামলার বিচার চলে ৫ বছর ধরে, যার শেষে কোন শাস্তি ছাড়াই ২২ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ মুজিবকে। মুক্তি দেয়া হয়।
এর ছয় মাস পরে ২১ অক্টোবর ১৯৬৯ মুজিব লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তিনি সেখানে সিলেট থেকে আগত রেস্টুরেন্ট মালিক মিনহাজউদ্দিন আহম্মেদ এবং তার আইরিশ স্ত্রী’র আতিথ্য গ্রহন করেন । মিনহাজউদ্দিন
২১৫
লন্ডনে আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন এবং পার্টির তহবিল সংগ্রহের কাজও করতেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার একজন অটল সমর্থক ছিলেন। লন্ডনে শেখ মুজিবের আরেকজন বন্ধু ছিলেন তাসাদুক আহমেদ। তিনিও আরেকজন রেস্টুরেন্ট মালিক ও দলের তহবিল সংগ্রাহক ছিলেন। গাউস খান, মিনহাজউদ্দীন আহমেদ, তাসাদুক আহমেদ, এরা সবাই এখন মারা গেছেন, এদের এবং আরাে অনেকের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করার বিষয়ে আলাপ করেন এবং সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রয়ােজনীয় অস্ত্র কিনতে আর্থিক সহায়তায় তাদের সবার সহযােগিতা কামনা করেন তিনি।
পাকিস্তানের গােয়েন্দা সংস্থা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলাফল এবং পুলিশের প্রতিবেদন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না।
কিন্তু আইবি’র রাগ শুধু মুজিবের ওপর ছিলনা। মুজিবকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সাথে ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থার ইদুর বিড়াল খেলা নিয়েও তারা মনক্ষুন্ন ছিল।
পাকিস্তান আইবি’র সৌভাগ্য যে সেইসময় এক দারুন সুযােগ তাদের সামনে আসে। তখন ঢাকায় মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কোর্ট এবং মিডিয়ায় পুরােদমে চলছে।
লাল ডেঙ্গা ও লাল জুলিয়ানা নামে দুইজন ব্যক্তি পূর্ব পাকিস্তানে চট্টগ্রাম পাবর্ত্য অঞ্চলের এক পুলিশ স্টেশনের সামনে এসে উপস্থিত হয়।
লাল ডেঙ্গা ও লাল জুলিয়ানা ভারতের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী দল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট এর সবচেয়ে সিনিয়র দুজন নেতা। তারা সার্বভৌম স্বাধীন মিজোরাম প্রদেশের জন্য ভারতের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল। তাদের সীমান্ত পেরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসার কারণ ছিল পাকিস্তানের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ এবং সরঞ্জাম সংগ্রহ করা। মিজো যােদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয় পাবার বিষয়টাও এর মধ্যে আছে।
সেখানে পৌঁছানাের পরে তারা পুলিশ স্টেশনের ওসি’র কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে। এই দুজনকে নিয়ে কি করবে বুঝতে না পেরে ওসি তাদের পুলিশ হেফাজতে বন্দী করে রাখে। ওয়ারলেস-এ মেসেজ আদান। প্রদান শেষ হয় এবং দ্রুত ইসলামাবাদের গােয়েন্দা সংস্থা এতে জড়িয়ে পড়ে। আইবি’র পরিচালক এবি আওয়ান স্বয়ং ঢাকায় এসে এই দুজনকে।
২১৬
ইসলামাবাদ নিয়ে যান। এর পর এই দুই মিজো নেতাকে এবি আওয়ান জিজ্ঞাসাবাদ করেন জানতে যে তারা পাকিস্তানের কাছে আসলে কি চায়?
তাদের সাহায্য আবেদনে সাড়া দিয়ে ইসলামাবাদ, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টকে ভারতের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে সীমাহীন সরঞ্জাম সহায়তা দেয়। প্রায় ২০ বছর ধরে এই বিদ্রোহ চলতে থাকে। হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। ১৯৮৫ সালে রাজিব গান্ধী যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন মধ্যস্ততার মাধ্যমে ভারত এবং লাল ডেঙ্গা ও লাল জুলিয়ানার মধ্যে প্রকাশ্য জনসভায় একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং তারা তাদের অস্ত্র জমা দেয়। ভারতের মিজোরাম প্রদেশে শান্তি ফিরে আনে। লাল ডেঙ্গাকে চিফ মিনিস্টার ও লাল জুলিয়ানাকে ডেপুটি চিফ নিয়ােগ দেয়া হয়। এর ফলে এই বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটে।
খালিস্তানী সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ১৯৭১-১৯৯১
১৯৭১ সালে যখন বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম গতি পাচ্ছিল তখন ইসলামাবাদ ধীরে ধীরে আরাে বেশি নিশ্চিত হয়ে ওঠে যে এই আন্দোলন ভারতের সহানুভূতি পাচ্ছে এবং আওয়ামী লীগ নয়াদিল্লীকে তার দলে টানতে সক্ষম হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে ভুগতে পাকিস্তান গােয়েন্দা সংস্থা জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অনুমােদনের জন্য একটি পরিকল্পনা পেশ করে । বাঙলাদেশ প্রসঙ্গে তার প্রতিবেশীর সংশ্লিষ্টতার জবাবে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে অস্থিরতা তৈরীর পরিকল্পনা ছিল তাতে। এই কর্মসূচীতে পরিকল্পনা ছিল শিখ গােষ্ঠির বেকার তরুনদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে নিয়ােগ করা। অপরদিকে কিছু প্রভাবশালী প্রবাসী শিখ ব্যক্তিত্ব যারা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং কানাডায় বসবাস করছে, তাদের কাছে স্বাধীন খালিস্তান প্রদেশের প্রস্তাব দেয়া যা তৈরীতে পাকিস্তান সাহায্য করবে।
এই পরিকল্পনা ১৯৪৭ সালে লর্ড লুইস মাউন্ট ব্যাটনের ধর্মের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত বিভাগের পরিকল্পনার সাথে মিলে যায়। সে সময় ভারতের শেষ ভাইসরয় শিখদের জন্য আলাদা দেশ তৈরী করার প্রস্তাব দেন। মাষ্টার তারা সিংহ, সর্দার বলদেব সিংহ সহ আরাে শিখ নেতারা তখন সে পরিকল্পনা অগ্রাহ্য করে ভারতের সাথে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।
২১৭
স্বাধীন সার্বভৌম খালিস্তানের প্রস্তাব সেই পুরানাে প্রস্তাবকে আবার জাগিয়ে দেয় এবং ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি হিংস্র সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে পরিণত হয়।
পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ অর্থ সংগ্রহ করা হত কর্মীদের মাদক ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট করে। এছাড়া অন্যান্য পদ্ধতি ছিল ব্যাংক ডাকাতি ও রাহাজানি।
কর্ম পরিকল্পনার মধ্যে ছিল অল্পবয়সী সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ােগের পর সীমান্তবর্তী পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে তাদের প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করা। তাদের শেখানাে হত কী করে বিস্ফোরক বানাতে হয়। তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও যােগাযােগের যন্ত্র সরবরাহ করা হতাে। তাদের গােপনে ভারত থেকে। নিয়ে যাওয়া হত প্রশিক্ষণের জন্য তারপর ভারতে ফেরত পাঠানাে হত সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিকল্পনার উদ্দেশ্যে। উদ্দেশ্য ছিল হত্যা রাহাজানী ও বৃহৎ পরিসরে বিশৃঙ্খলা তৈরী করা, যাতে পাঞ্জাব প্রদেশটি শাসনের অযােগ্য হয়ে পড়ে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাথে সাথেই পরিকল্পনাটি অনুমােদন করেন। জগজিৎ সিং চৌহান, লন্ডনে পাকিস্তান হাই কমিশনে যার যাতায়াত ছিল এবং একটি দুর্ঘটনায় যে একটি হাত হারিয়েছিল, তাকে ১৯৭১ সালে বেছে নেয়া হয় খালিস্তানের মুখপাত্র হিসাবে।
খুব তাড়াতাড়ি বিপুল সংখ্যক শিখ এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে অংশ নেয়। অনেক টাকা ছড়ানাে হয়। নেতৃত্বের সবাইকে খুশি করার জন্য ছােট ছােট দলে ভাগ করা হয়। ভারতীয় নিরাপত্তা গােষ্ঠিতে এই দলগুলি আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। যখন এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড মারাত্মক আকার ধারণ করে, ভারতের ক্ষয়ক্ষতির প্রেক্ষিতে পাকিস্তানী গােয়েন্দা সংস্থা তখন এর আসল ক্ষমতা বুঝতে পারে। জেনারেল জিয়াউল হক সামরিক একনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে খালিস্তানী অপারেশন চালানাের দায়িত্ব বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ থেকে ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)’র হাতে তুলে দেন। আইএসআই’র নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তানের রাষ্ট্র নীতিতে এই খালিস্তানী আতঙ্ক একটি অ-ইসলামিক উপাদান হিসেবে পরিচিতি পায়।
দুই দশক ধরে পাঞ্জাব ও ভারতের অন্যান্য স্থানে বিপুল সংখ্যক হত্যার মাধ্যমে পরিচালিত খালিস্তানী সন্ত্রাস বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে ছিল বাব্বার খালসা ইন্টারন্যাশনাল-এর প্রধান ওয়াধ্যা সিং বাব্বার, ইন্টারন্যাশনাল শিখ ইওথ ফেডারেশনের প্রধান লাখবীর সিংহ রােদে, খালসা
২১৮
এর প্রধান পরমজিৎ সিংহ পাঞ্জওয়ায়, ১৯৮১ সালে ভারতীয় বিমান ছিনতাই করে লাহােরে নিয়ে যাওয়ার নায়ক গাজিন্দার সিং, যে পরবর্তীতে পাকিস্তান পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করে, এবং খালিস্তান জিন্দাবাদ ফোর্সের প্রধান রনজিৎ সিং নীতা, ২০০৫ সালে ইউরােপীয় ইউনিয়ন যাকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করে। এছাড়াও ছিল ওয়াসান সিং জাফরওয়াল, সুখবিন্দর সিং সুখি এবং দয়া সিং লাহােরিয়া। এরা সব ছােট ছােট খুনে দল যারা দক্ষ ঘাতক হিসেবে পরিচিত ছিল। বেশিরভাগ সন্ত্রাসী নেতারা এখন বুড়াে হয়ে গেছে এবং পাকিস্তানে বসবাস করছে। অনেকে ইওরােপীয় দেশগুলােতে চলে গেছে এবং কানাডায়, যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক শরনার্থী হিসাবে বাস করছে।
গণহত্যার ভয়াবহতা বাড়তে থাকায় ১৯৮৪ সালে ভারত সরকার বাধ্য হয় প্রতিহামলামূলক সামরিক অভিযান অপারেশন ব্লু স্টার চালাতে। শিখ ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে পবিত্র তীর্থ অমৃতসরের গােল্ডেন টেম্পল চত্বরে এই সংঘর্ষ হয় যাতে বহু লােক প্রাণ হারায়। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শিখ সন্ত্রাসী নেতা সন্ত জার্ণাইল সিংহ ভিন্দ্রনওয়ালে। মহান পবিত্র আকাল তক্ত’র মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন তিনি। আর গােল্ডেন টেম্পলে হামলার কয়েকমাসের মধ্যেই ভারতের জন্য সেই দুঃসংবাদটিও অপেক্ষা করছিলাে। মিসেস গান্ধী তার বাসভবনে শিখ দেহরক্ষীর হাতে মৃত্যুবরণ করলেন। ঘটনাটি গােটা জাতিকে শােকে স্তব্ধ করে দেয়। ভারত তার স্বাধীনতা পরবর্তী সবচেয়ে মহান প্রধান মন্ত্রীকে হারায়। বাঙলাদেশের অন্যতম পরিকল্পক সেদিন মৃত্যুবরণ করেন।
আইএসআই’র জন্য এটি ছিল দারুন একটি সময়। ভারতের এই শােকবিহ্বল পরিস্থিতি আইএসআই-এর খালিস্তান অপারেশনের সাফল্য ছিল। খালিস্তানের প্রাদেশিক আন্দোলনে আইএসআই-এর ব্যর্থতা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর হত্যায়, যাকে বহু বছর ধরে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন করার দায়ে ঘৃণা করা হত। পূর্ব পাকিস্তান হারানাের প্রতিশােধ হিসেবে এই মৃত্যু রাওয়ালপিন্ডির আইএসআই পরিচালকেরা বেশ ঘটা করে পালন করে।
রেফারেন্স – ভারত, মুজিবুর রহমান, বাঙলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তান – শশাঙ্ক ব্যানার্জী