নকশি বিওপি আক্রমণ
মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম
বাংলাদেশ বাহিনীর প্রথম পদাতিক বিগ্রেড গঠনের পর ব্রিগেড কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমানের এক যৌথ নির্দেশ অনুযায়ী নকশি বিওপির ওপর আক্রমণের দায়িত্ব বর্তায় অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর । নকশি বিওপি জামালপুর মহকুমার ঝিনাইগাতি থানার অন্তর্গত । এলাকাটি শালবন আচ্ছাদিত এবং সমতলভূমি থেকে কিছুটা উঁচু টিলাসংবলিত । আশেপাশে টিলার মাঝখানে কিছুটা নিচু ভূমিতে ছিল নকশি বিওপির অবস্থান । পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাত তিনটা ৪৫মিনিটে আর্টিলারি ফায়ার শুরু করার সংকেত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আর্টিলারি গর্জে ওঠে । নিজেদের আর্টিলারির তিনটি গোলা ভুল করে আক্রমণের শুরুর স্থানে (এফডব্লিউপিতে) এসে পড়ায় আমাদের ছয়জন সেনা হতাহত হয় । ফলে ওই প্লাটুন কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং প্লাটুনের সদস্যরা আহত সেনাদের সেবার নামে এফইউপিতেই থেকে যাওয়ার চেষ্টা করে । প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে আমাদের আর্টিলারি গর্জে ওঠার মিনিট খানেকের ভেতর পাকিস্তানি আর্টিলারি গর্জে ওঠে । একবার মাটিতে শুয়ে পড়ে তারপর আবার দাঁড়িয়ে অগ্রসর হওয়া যথেষ্ট সাহসের কাজ বৈকি, বিশেষ করে আমার দুই কোম্পানির জন্য । কারণ, আমার দুই কোম্পানিতে (অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল) ৩০০ জনের মধ্যে শুধু ১০ জন সামরিক বাহিনীর লোক গোটা আটেক ইপিআর এবং দু-তিনজন পুলিশের লোক ছাড়া বাকি সবাই সাত দিনের ট্রেনিংপ্রাপ্ত গ্রাম বাংলার একান্ত সাধারণ মানুষ । এদিকে সুযোগে আক্রমণকারী দল ৫০০ গজ দূরে নালার কাছে পৌছালে আমি মর্টার গ্রুপকে নালার পাড়ের আড়ালে অবস্থান নিয়ে ৩০০গজ দূরবর্তী শত্রুশিবিরে গোলাবর্ষণ করার নির্দেশ দিই । এই নির্দেশের সুযোগে স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রায় সব সেনাই নালার আড়ালে অবস্থান নিয়ে মাথা নিচু করে অনুমানের ভিত্তিতে ফায়ার করতে থাকে । নালায় আমার সেনাদের এমন কাণ্ড দেখে শত্রুশিবিরের নিকটবর্তী এসেও আমি চিৎকার না করে পানিরি । এমনকি কলার চেপে ধরে এবং জোর করে আগে পাঠাতে শুরু করি । আমার বাঁ দিকে হাবিলদার নাছির
৪৩
তাঁর সেকশন নিয়ে অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে ক্ষিপ্রগতিতে এগোতে থাকেন এবং আমি নিজে নায়েক সিরাজকে সঙ্গে করে ডানে বাংকারের দিকে এগোতে থাকি । আমাদের এই মনোবল দেখে শত্রুরা তখন পলায়নরত । ইতোমধ্যে আমরা অ্যাসল্ট লাইন ফর্ম করে চার্জ বলে হুংকার দিতেই মুহূর্তে ‘ইয়া আলী’ বলে আমার সেনারা সঙ্গিন উঁচু করে বেয়নেট চার্জের জন্য রীতিমতো দৌড়াতে শুরু করে । তাদের উত্তেজনাকে বাড়ানোর জন্য নায়েব সুবেদার মুসলিম ‘নারায়ে তাকবির’ ধ্বনি করলে সেনারা ঘন ঘন ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি করে পুরো যুদ্ধের ময়দানকে প্রকম্পিত করে তোলে । আমরা যখন শত্রুশিবিরের মাত্র ১০০গজের মধ্যে পৌঁছে যাই, ঠিক তখনই শত্রুর নিক্ষিপ্ত একটি আর্টিলারি শেল এসে আমাদের ওপর বিস্ফোরিত হলে সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকজন ঢলে পড়ল, যার ভেতরে সম্ভবত হাবিলদার নাসিরও ছিল ।
৪৪
আমাদের সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, আমার ডান পায়ে এসে একটা শেল লাগল । আঘাতটার গুরুত্ব উপলব্ধি করার আগেই জোশের সঙ্গে আরও ৫০গজ এগিয়ে যাই এবং ছত্রভঙ্গ অবস্থায় আমাদের ছেলেরাও এগিয়ে গিয়ে পলায়নরত শত্রুসেনাদের আঘাত করতে থাকে । পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষেও তখন হতাহতের ঘটনা ঘটছিল । কেউ মাইন বিস্ফোরণে, কেউ বা গুলিতে হতাহত হচ্ছিল । আমি আরও অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করি এবং হঠাৎ বাঁ পায়ে বাঁশের কঞ্চি বিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যাই । একই সময়ে বাঁ দিক থেকে এক পাকিস্তানি সেনা সঙ্গিন উঁচু করে আমরা দিকে বন্দুক তাক করে আসতে থাকে । এমন সময় অল্প বয়স্ক ছেলে সালাম (অষ্টম শ্রেণির ছাত্র এবং এক সুবেদার মেজরের ছেলে) সেই পাকিস্তানি সেনাকে গুলি করে হত্যা করে । মাটিতে পড়ে গিয়ে আমি দুটি ধাবমান শত্রুকে গুলি করে ডান দিকের বাংকারে অবস্থানরত শত্রুসেনাকে গুলি করার জন্য বিহারি ছেলে হানিফকে ঘন ঘন নির্দেশ দিচ্ছিলাম । ওই একটি বাংকারে অবস্থিত শত্রুর নিখুঁত গুলিবর্ষণ আমাদের ভীষণভাবে ঘায়েল করছিল, অন্য বাংকারগুলো থেকে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল । হানিফ বারবার অনুরোধ করছিল, ‘স্যার, আব পিছে চলে যাইয়ে, ম্যায় কভারিং দে রাহাহু’। হানিফকে দ্বিতীয়বার নির্দেশ দেওয়ার আগেই হিসেং শব্দ হলো । আমি হানিফকে মৃদু আঘাত করে ডাকলাম ‘হানিফ’- কোনো উত্তর এল না । সঙ্গে সঙ্গেই শত্রুর গুলিতে আমার পাশের মাটি উড়ে গেল, শত্রু আমায় দেখে ফেলেছে বুঝতে পেরে সাইডরোল করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করি । এমন সময় বাঁ দিক থেকে একটা গুলি এসে আমার ডান হাতের কনুইয়ে লাগে, ফলে হাতের স্টেন ছিটকে পড়ে, বাঁ হাতে কুড়িয়ে নিলাম । ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে । ফিল্ড ড্রেসিংটা বের করব, এক ঝাঁক গুলি এসে পাশের জমির আইলটা উড়িয়ে দিল । বুঝতে পারলাম শত্রুর এত কাছে থাকা সম্ভব না । আমাদের যে আট-দশজন লোক শত্রু বাংকারে ঢুকে পড়েছিল এয়ার ব্রাস্ট আর্টিলারি ফায়ারে তারা ধরাশায়ী হলো । তার মধ্যে নায়েক সিরাজ এবং পুলিশের ল্যান্সনায়েক সুজা মিয়াও ছিল । ফিল্ড ড্রেসিং বের না করে সাইড রোল শুরু করার কিছুক্ষণ পর তাকিয়ে দেখি আসলে ডানে না গিয়ে আমি কোনাকোনি শত্রুশিবিরের দিকেই যাচ্ছি । মাথাটা ঠাণ্ডা রেখে লক্ষ্য ঠিক করে নিলাম । উদ্দেশ্য হাজার গজ দূরে শালবন এলাকায় পৌঁছাতে হবে । ক্রল শুরু করব, এমন সময় দেখি বাচ্চা ছেলে হঠাৎ করে দৌড়ে এসে পড়ে একটি এলএমজি নিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে হুংকার দিয়ে শত্রুবেষ্টনীর দিকে ধাবিত হলো । চিৎকার করে বলছিল, ‘তোরা আমার মা-বাপ, ভাই-বোন সবাইকে মেরেছিস, আমি ছেড়ে দেব?’ কিছুক্ষণ আগে যে আমার জীবন রক্ষা করেছিল, সেই সালামকে আর ফিরিয়ে আনতে পারিনি । অথচ বাচ্চা বলে এবং তার সংসারে একমাত্র জীবিত ব্যক্তি বলে
৪৫
আমি তাকে যুদ্ধ শামিল করিনি, কিন্তু সে পালিয়ে এসে অ্যাসেম্বলি এরিয়ার আমাদের সঙ্গে চুপি চুপি যোগ দেয় । শালবনে অবস্থানরত আমাদে মেশিনগান তখন ঘন ঘন গর্জে উঠছে সম্ভবত আমার পশ্চাদ অনুসরণ সেনাদের কাভারিং ফায়ার দিচ্ছিল । তাই আমি নিজেদের ফায়ার থেকে বাঁচার জন্য ডানে অপেক্ষাকৃত নিচু ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে এগোতে শুরু করি । নালার কাছে পৌঁছে সব শক্তি নিয়োগ করে খাড়া হয়ে টলতে টলতে কেমন করে জানি নালাটা পার হয়ে গেলাম । শরীরটা ক্রমেই ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল । তাই বুঝি সমস্ত জোর খাড়া হয়ে দৌড় দিতে চেষ্টা করলাম । দু-এক কদম যাওয়ার আগেই একঝাঁক গুলি আমার পায়ের কাছের মাটি উড়িয়ে দিল, সঙ্গে সঙ্গে মাটির ওপর পড়ে গেলাম । শত্রুর আর গুলি আসছে না দেখে স্বস্তি বোধ করলাম । কিন্তু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার আগেই টের পেলাম ১০-১২ জন শত্রুসেনা এগিয়ে আসছে আমার দিকে । বোধ হয় ঠেলে ঠেলে আসার ফলে কর্দমাক্ত মাটিতে রাস্তা হয়ে গিয়েছিল আমার পালানোর পথ । সঙ্গে হাতের ও পায়ের রক্ত বেশি করে চিহ্নিত করছিল সেই পথকে । পাশের ধানক্ষেত থেকে একজন আহত সৈনিক বলছিল, ‘আই বাঁচতে চাই, আঁরো লই যা’- অগ্রসরমান শত্রু তাকে খতম করে দিল । প্রায় ৩০০গজ আসার পর ধানক্ষেত শেষ হয়ে গেল । এর পরের ২০০গজ সম্পূর্ণ খোলা ময়দান । হাতে বাঁধা কর্দমাক্ত ঘড়ির দিকে তাকালাম সকাল আটটা ১০মিনিট । শত্রু তখন ৫০গজ দূরে আমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে । শেষবারের মতো টেনেহিঁচড়ে নিজের বিক্ষত দেহটাকে আর্টিলারি শেলে সৃষ্ট একটি গর্ত নিয়ে গেলাম । শত্রু যাতে সহজে দেখতে না পায় সে জন্য গলা পর্যন্ত ধীরে ধীরে লেপে দিলাম । স্টিল হেলমেট মাথার নিচে দিয়ে চরম মুহূর্তের অপেক্ষায় রইলাম । ঠিক এমন সময় আমার কমান্ডিং অফিসার মেজর আমীনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল শালবন থেকে-‘আমীন, আস্তে আস্তে আসার চেষ্টা করো’ আহত হওয়ার তিন ঘন্টা পর এই প্রথমবারের মতো সক্রিয় সাহায্য পেলাম । স্টেনগানটিকে আমার পায়ের সঙ্গে বেঁধে স্ট্রেচারের মতো করে একটু ওপরের দিকে তুলে ধীরে ধীরে টানতে শুরু করলেন । ডান পায়ের ব্যথায় ডুকরে উঠলেও দাঁত কামড়ে রইলাম । লেফটেন্যান্ট মোদাসসের তখন চিৎকার করছে শালবন থেকে, ‘তাড়াতাড়ি করেন স্যার’ । শত্রুরা তখন আমাদের ২০-২৫ গজ পেছনে একজন আহত জওয়ানকে হত্যা করে পায়ে পায়ে এগোচ্ছে । আমাদের দুই এলএমজিওয়ালা কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘আপনাদের ধরে ফেলবে স্যার’। দাঁত খিঁচিয়ে মেজর আমিন বললেন, ‘বেটা ফায়ার কর’ । আমাদের ওপর দিয়ে ফায়ার করতে হবে তাই আমাদের জওয়ানরা ইতস্তত করছিল । শত্রু তখন আমাদের ওপর চার্জ শুরু করে । সঙ্গে সঙ্গে এলএমজি গর্জে উঠল । ছয়-সাতটি খানসেনা তৎক্ষণাৎ লুটিয়ে পড়ল । মকবুল আর তার সাথি দালালকে আমরা হাতেনাতে ধরে
৪৬
ফেললাম । দুটি খানসেনা পালিয়ে বাঁচল । কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শত্রুর আর্টিলারি ফায়ার এসে পড়তে লাগল । আর্টিলারি ফায়ারের মধ্যে মেজর আমীন আমায় কাঁধে নিতে চেষ্টা করলেন কিন্তু পরিশ্রান্ত থাকায় তিনি নিজেই আমায় নিয়ে নালায় পড়ে গেলেন । শেষ পর্যন্ত আমি জোর করে তাহেরের দিকে হাত বাড়ালাম এবং সে আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে বলল, ‘স্যার চিন্তা করএন না, মরলে দুইজন একসঙ্গে মরব’ বলেই দিল ভোঁ এক দৌড় । দৌড়ে রেজিমেন্টাল এইড পোস্টে পৌঁছে যায় । আরওপি থেকে জিওসি গুর বক্স সিংহ গীল তা৬র হেলিকপ্টারে করে আমাকে গৌহাটি সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যান । যুদ্ধে আমাদের পক্ষে ৩৫জন হতাহত হয়, যার ভেতর যুদ্ধের ময়দানে ১২ জনের লাশ থেকে যায়, বাকি আহত সেনাদের গৌহাটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ।
মেজর জেনারেল আমীন আহম্মদ চৌধুরী, বীর বিক্রম কোম্পানি কমান্ডার (আগস্ট পর্যন্ত); সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সামরিক বিশেষজ্ঞ জন্ম ঃ ১ জানুয়ারী, ১৯৪৬, ফেনী । ৫জুন, ১৯৬৬ ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এ কমিশন লাভ করেন । সত্তরের মার্চে তিনি ক্যাপ্টেন পদবীতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কর্তব্যরত ছিলেন । ২৪মার্চ, ১৯৭১, ১৪ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা চট্টগ্রাম থেকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুর রহমান মজুমদারসহ (বাঙালি) ক্যাপ্টেন আমীনকে আগাম কোনো সংবাদ ছাড়া হেলিকপ্টারে ঢাকা নিয়ে আসেন । ক্যাপ্টেন আমীন পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন । তিনি ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যুদ্ধ করেন । ৩আগস্ট তিনি শেরপুরের নকশী বিওপিতে শত্রু অবস্থানের উপর দুই কোম্পানি গণযোদ্ধা নিয়ে আক্রমণকালে মারাত্মকভাবে আহত হন । সাহসিকতার জন্য তাকে ‘বীর বিক্রম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় ।