মুহূর্তেই ধ্বংস হলো রেলগাড়ি
এ কে এম জয়নুল আবেদিন খান, বীর প্রতীক
ঢাকার ছেলেদের নিয়ে একটা আলফা কোম্পানি করা হয়। আলফা কোম্পানিকে কয়েকটি প্লাটুনে ভাগ করা হলো। জামান ভাইকে কোম্পানি কমান্ডার, কোম্পানির সেকেন্ড ইন কমান্ড (টু আই সি) করা হলো শাহাজান ভাইকে। আর ঢাকার ছেলেদের নিয়ে করা হলো ১ নম্বর প্লাটুন। তার সেই প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওম্পী ক্যাম্পে থাকাকালীন আমার ডায়রিয়া দেখা দেয়। তখন খুব দুর্বল হয়ে পড়ি। আশপাশে কোনো ডাক্তার ছিল না। আমার প্রাটনের ছেলেরা খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে রাতটা কাটায়। হারুন নামে একজন সারা রাত আমারে সেবাযত্ন করে। পরের দিন সকালে ক্যাপ্টেন সাক্সেনা গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে যান। সাত-আট দিন হাসপাতালে থেকে আবার ওম্পী ক্যাম্পে ফিরে আসি। আমার অবর্তমানে কমান্ডার ছিলেন কাশেম। ১৯৬৯ সালের ১১ দফার আন্দোলনের সময় রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের কঠিন নিয়মশৃঙ্খলার জন্য সভা, মিছিল ইত্যাদিতে যোগ দিতে পারিনি কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে লুকিয়ে হোস্টেলে কালো পতাকা উত্তোলনের জন্য স্কুল থেকে বহিষ্কার হই। ৬ জুন, ১৯৭১ সালে বিদায় হলাম ওম্পী ক্যাম্প থেকে, মেলাঘর ক্যাম্পে আমরা অবস্থান করি। সেখানে ছোট ছোট দু-একটা দলকে গেরিলা যুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে পাঠাননা হয়। একদিন আমি ঢাকায় যুদ্ধ অপারেশনের জন্য দল গঠন করার জন্য জহিরুল ইসলামকে প্রস্তাব দিই। তিনি রাজি হওয়ার পর ক্যাপ্টেন হায়দারকে রাজি করাই। বললাম, আমাদের দলটা হবে ছোট। ১০ জনের বেশি হবে না। কাউকে জানানোর দরকার নেই। আমাদের দলে ১০ জন হলো জহির, সালাম, আহম্মদ (আদি), ফারুক, আসাদ, ইসহাক, মোবারক, মবিন ও সামসুল। দল চূড়ান্ত হওয়ার পর আমার কাছে একটা খবর এল। খবরটা হলো একসময় আমি কর্নেল আবদুর রব আর্মি কমিশন্ড র্যাংকে নিয়োগের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তার রেজাল্ট আসে যে আমি চান্স পেয়েছি। এত দিন কঠিন পরিশ্রমের পর দল গঠন করে যুদ্ধে যাব এমন সময় এই খবরটা সবাইকে ভারাক্রান্ত করে ফেলে। আমি আর্মি কমিশনার র্যাংকে চলে যাই—এটা কেউ মেনে
৩১
নিতে পারছিল না। আমি অনেক ভেবে ঠিক করি দেশকে স্বাধীন করতে যুদ্ধ করার জন্য এসেছি। ট্রেনিং শেষ। এখন যুদ্ধ করার পালা। দেশ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি অফিসার হব, এটা শুনে অনেক খুশি হয়েছিলাম কিন্তু দেশের দিকে তাকিয়ে আর অগ্রসর হলাম না। এ কথা শুনে সবার মুখে আনন্দের আলো জ্বলে ওঠে। তারপর ঢাকার পথে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বের হয়ে পড়ি। ১৯৭১ সালের শেষ দিক। রাতে গোপন শিবির থেকে বেরিয়ে পড়ি একদল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে। বেশিরভাগ স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। জলপথে নৌকায় করে পৌঁছাই লক্ষ্যস্থলে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের পুবাইল-আড়িখোলা রেলস্টেশনের মাঝামাঝি এক স্থানে। সেখানে আছে ছোট একটি রেলসেতু। রেলপথের দুই পাশের বেশিরভাগ স্থান জলমগ্ন। সেতুর দক্ষিণে একটি বটগাছ ও বিরাট পাটক্ষেত। বেশ দূরে একটি গ্রাম। রেলপথের আশপাশ জনমানবহীন। দু-তিন ঘণ্টা পরপর ট্রেন চলাচলের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের জন্য উপযুক্ত স্থান। একটু আগে গেছে একটি রেলগাড়ি। দু-তিন ঘণ্টার মধ্যে আর রেলগাড়ি আসার সম্ভাবনা নেই। পরিকল্পনা অনুসারে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত শুরু করলেন তাদের কাজ। আমিসহ কয়েকজন থাকলাম অপারেশনস্থলে। বাকিরা বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিলেন কাট অব পার্টি হিসেবে। বিস্ফোরণের প্রশিক্ষণ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা রেল স্লিপারের নিচের পাথর সরিয়ে বসাই নিয়ন্ত্রিত মাইন। এক ঘণ্টার মধ্যেই সম্পন্ন হলো কাজ। মাইনের সঙ্গে তার লাগিয়ে তা টেনে নিলাম কাছাকাছি নিরাপদ স্থান পর্যন্ত। আমরা অবস্থান নিলাম সেখানে। এবার রেলগাড়ির জন্য অপেক্ষার পালা। তারপর সময় গড়াতে থাকে আমরা তার টেনে অবস্থান নিয়েছিলাম একটা পুকুরের পাড়ে। চারদিকে পানি। শুধু পাড়টাই শুকনো। সেখানে পোকামাকড়ের দংশনে সবাই অতিষ্ঠ। আমি আবার অসুস্থ হয়ে গেলাম। এদিকে রাত শেষে ভোর হয়। কিন্তু ট্রেনের আর দেখা নেই। আমরা চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কারণ, যত বেলা হবে, আমাদের অবস্থান সেখানে | বিপজ্জনক হয়ে পড়বে। এমন সময় ট্রেনের হুইসেলের শব্দ। তখন আনুমানিক সকাল ছয়টা। কিছুক্ষণের মধ্যেই রেলগাড়ি দৃষ্টিগোচর হলো। মুক্তিযযাদ্ধাদের বিস্ফোরক দল প্রস্তুতই ছিল। সবাই অধীর উত্তেজনায়। অপেক্ষা করছেন রেলগাড়ি নির্দিষ্ট স্থানে আসার জন্য। ইঞ্জিনের সামনে বালুভর্তি ওয়াগন। বালুভর্তি ওয়াগন চিহ্নিত স্থান অতিক্রম করামাত্র বিস্ফোরক দল মাইনের বিস্ফোরণ ঘটালেন। বিকট শব্দে গোটা এলাকা প্রকম্পিত। কালো ধোঁয়া ও জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড উপরের দিকে উঠতে লাগল। ইঞ্জিন ও পেছনের কয়েকটি বগি মাইনের বিস্ফোরণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত। ইঞ্জিন ও দুটি বগি সম্পূর্ণ ধ্বংস। সেগুলো রেলপথ থেকে ছিটকে নিচে পড়ে। ইঞ্জিনের পরের বগিতে ছিল পাকিস্তানি সেনা। তারা বেশিরভাগ হতাহত। অপারেশন শেষে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে চলে গেলেন নিরাপদ স্থানে।
৩২
এই রকমে কয়েকটা অপারেশন আমরা করি । তবে এটার প্রভাব অনেক পড়ে-ছিল । এক সময় আমার প্লাটুন দিনে দিনে সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন খাবার সমস্যা দেখা দেয় । ৬০ জনের দুই বেলা খাবার ও নাশতা সংগ্রহ করতে নাভিশ্বাস ওঠার মতো অবস্থা । অর্থ ও খাবার সংগ্রহের দায়িত্ব নিলাম আমি । বাতুলিয়ার নুরুল ইসলাম বাটায় চাকরি করতেন । তাই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল সু কোম্পানির ম্যানেজার ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ডের (খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বিদেশি নাগরিক)। আমার সঙ্গে নুরুল ইসলামের যোগাযোগের কারণে ওডারল্যান্ডের সাথে দেখা হয় । তিনি একবার ও তাঁর কোম্পানির কর্মচারীরা আমাদের সাহায্য দিয়েছিলেন । আমাদের অনেক উৎসাহ দিতেন । একদিন আমাকে বললেন, তুমি কী চাও? আমি বললাম আমি তেমন কিছু চাই না । অপারেশন করার সময় যদি ধরা পড়ে যাই তখন তো আমাকে নানা প্রশ্ন করবে । এ থেকে রেহাই পেতে আমি পটাশিয়াম সালফেট খেয়ে আত্মবিসর্জন দেব । তাই আপনি আমাকে পটাশিয়াম সালফেট দেন । অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকলেন । ওডারল্যান্ড আমাদের তাঁর নিজের পিস্তলটি দেন । সেটা আমি সেই সময়ে ব্যবহার করি । ১৯৭১ সালে ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র । পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত অবস্থায় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ । ২১ এপ্রিল সেখান থেকে কৌশলে দেশে আসি । কয়েকদিন পর ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিই । প্রশিক্ষণ শেষে ২ নম্বর সেক্টরে বৃহত্তর ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গেরিলা যুদ্ধ করি । ছিলাম প্লাটুন কমান্ডার । এ কে এম জয়নুল আবেদিন খান, বীর প্রতীক