অনারারী ক্যাপ্টেন মো. আবদুল জাব্বার খান, বীর প্রতীক
ফরিদপুরের নাড়িয়া থানার আটিপাড়া গ্রামে ২-৭-৩৭ তারিখে আমার জন্ম হয় । আমার পিতা ওয়াসিউদ্দিন খান । তিনি ১৯৬৭ সালে ইন্তেকাল করেন । মাতার নাম বিবি মিরেন নেছা । আমরা মোট ৩ভাই, কোনো বোন নাই । আমি মেঝ । আমি ২রা জুলাই ১৯৫৭ সালে একজন সাধারণ সৈনিক হিসাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করি । নন কমিশন পদ লাভ করি ১-৬-৬২ সালে । জুনিয়র কমিশন পদ লাভ করি ২৬-৩-৭১ সালে । অনারারী কমিশন পেয়ে লেফটেনেন্ট পদে উন্নিত হই ২৬শে মার্চ ১৯৮৫ সনে । ১৯৮৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অনারারী ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হই । ১৯৫৫ সালের ২রা জুলাই চাষাড়া রিক্রটিং অফিসে ভর্তি হয়ে বিকালে চট্টগ্রাম ইবিআরসিতে গমন করি এবং এ কোম্পানির ১নং প্লাটুনে ট্রেনিং গ্রহণ করি । তখন সেন্টার কমাণ্ডার ছিলেন লে.কর্নেল এলএমকে লোদী । আমার কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন ফিরোজ সালাউদ্দিন । ট্রেনিং সমাপ্তের পরে ১৯৫৬ সালের জুন মাসে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ময়নামতি সেনানিবাসে সি কোম্পানিতে একজন পূর্ণাঙ্গ সিপাহী রূপে চাকরি শুরু করি । জুন মাসে ময়মনসিংহে ফুড অপারেশনে যাই । আগস্ট মাসের ১৪তারিখে সেখান হতে কুমিল্লা ফিরে আসি । তৎকালীন জেনারেল আতিকুর রহমানের অধীনে তখন আমরা নানা প্রকার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছি । ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর সি কোম্পানি হতে বদলী হয়ে হেড কোয়ার্টার কোম্পানির মর্টার প্লাটুনে আসি । ১৯৫৭ সালের মে মাসে কুমিল্লা হতে পল্টনের সাথে রাত ৯টায় বন্দরে আসি । এবং ৯দিন জাহাজে অতিবাহিত করে পেশোয়ারে আমাদের কর্মকাণ্ড অনেক সুনাম অর্জন করে । ১৯৫৮ সালে ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খানের নির্দেশে মার্শাল ল ডিউটি করি । পরে বাঙালি জাতির মান সবার উচ্চাসনে প্রমাণিত করে সম্মানের সঙ্গে যশোর প্রত্যাবর্তন করি । ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেই । আয়ুব ও ফাতেমা জিন্নার
নির্বাচনে খুলনায় ডিউটি করি । ১৯৬৭ সালে পুনরায় লাহোর গমন করি । সেখানেও পাক-ভারত সীমান্তে ডিউটি করি । ১৯৬২ সালে আমার ইউনিটের খেলাধূলায় বহু সুনাম অর্জন করেছি । ১৯৬৮ সালে দ্বিতীয় বারের রিইউনিয়নে আমি ১লা রিইউনিয়নে যে গৌরব অর্জন করি তা ক্ষুন্ন করিনি । ১৯৬৯ সালে লাহোর হতে পুনরায় জুন মাসে ঢাকার জয়নেদবপুরে আসি । তখন আয়ুব নগরে শেখ মুজিবের বন্দী অবস্থার (আগরতলা মামলা-সম্পাদক) ডিউটি করি । দেশের পরিস্থিতি আয়ত্বে না আসায় আইউব খান ইয়াহিয়া খানকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে অবসর নেন । ১৯৭০ সালের মুজিব এবং ইয়াহিয়ার নির্বাচনী ডিউটি করি । আমার ছোট ভাই আবদুল হাশেম খান ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর আর্টিলারী কোরের একজন সৈনিক ছিল । যুদ্ধের সময় সে ছুটিতে বাংলাদেশে এসে অক্টোবরের দিকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে মুজিব ব্যাটারীতে যোগ দেয় । আমার আপন চাচাতে ভাই ফিরোজ খান মেলাঘরে ২ নম্বর সেক্টেরের সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধ করেন । আমার আপন শালা শহীদ আবদুল হামিদ সরদার মুক্তিযুদ্ধের আগে সিপাই পদে ২য় ইস্ট বেঙ্গলে কর্মরত ছিল । মার্চের প্রথম দিকে (যুদ্ধ শুরু হবার আগে)জয়দেবপুর থেকে সে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ইনফেন্ট্রী ওয়ার্কশপে ডিউটিতে আসে । মার্চ মাসে (২৫ শে মার্চের পর) ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি অফিসারদের সহায়তায় সে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আগরতলা হয়ে ইণ্ডিয়া আসে ও পরে ৩য় ইস্ট বেঙ্গলে যোগ দেয় । দেশ স্বাধীন হবার মাত্র ৭দিন আগে সুনামগঞ্জ এলাকায় সে শহীদ হয় । সেখানেই তার কবর আছে । আমরা একটা সংঘবদ্ধ সেনাবাহিনীতে ছিলাম । একাত্তর সালে কর্নেল ওসমানী এবং বাঙালি জাতি যখন আমাদেরকে যুদ্ধে যাবার আহবান জানাল তখন মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করলাম । দেশের পরিস্থিতিতে তখন আমাদের মনের অবস্থা ভাল ছিল না । সারা জীবন পাঞ্জাবীদের সাথে লড়াই করেছি । সেনাবাহিনীতে বাঙালি ও পাঞ্জাবীদের মধ্যে যে পার্থক্য দেখি । আমরা বাঙালিরা ব্যারাকে বাংলা বলতে পারতাম না । ওরা আমাদের ছোট নজরে দেখতো-বাঙালিরা ছোট জাত, মাক্ষী কা জাত, চাউল খানেওয়ালা । আমাদের প্রতিদিনের রেশন ছিল ২২ আউন্স । তার মধ্যে বাঙালিরা পেত ৬ আউন্স আটা ও ১৬ আউন্স চাল । পাঞ্জাবীরা পেত ১৬ আউন্স আটা ও ৬ আউন্স চাল । তাছাড়া আমাদের লোক ছিল মাত্র ৩% ওদের ৯৭% । শেখ সাহেবের বক্তৃতার পর তা বেড়ে ৬% হয় । তবে ট্রেনিংএর রেজাল্ট বাঙালিদের সবসময়ই ভাল হত । আমরা ওদের চেয়ে এগিয়ে থাকতাম । পাঞ্জাবীরা ছিল মোটা বুদ্ধিঅলা । আমরা যেহেতু একটা সুশৃঙখলা সেনাবাহিনীর অন্তর্গত ছিলাম এবং সবকিছুই একটা সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে চলতো তাই সরা সরি খারাপ ব্যবহার বা পক্ষপাতিত্বের কোনো সুযোগ ছিল না । ফলে উপর দিয়ে পাঞ্জাবী ও বাঙালি অফিসারদের ব্যবহারে কোনো তারতম্য ছিল না সবাই ভাল ব্যবহার করত । তবে তলে-তলে সুযোগ পেলে পাঞ্জাবীরা বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করত । অন্যদিকে বাঙালি অফিসাররা কিছুটা সহানুভূতিশীল ছিলেন ।
বাংলার উৎপাদিত সামগ্রীর মূল্য পাঞ্জাবী শাসকের চক্রান্তে বৃদ্ধি পায় । চাকুরীতে বাঙালির পদমর্যাদা থাকে না । যদিও বাঙালির দেশে উৎপাদন বেশি তবুও বাংলায় হাহাকার সর্বত্র বিরাজমান । কোনো বাঙালি ন্যায়সঙ্গত কথা নিয়ে দাঁড়ালে রাষ্ট্রদ্রোহী ধারায় বন্দি করে শাস্তি প্রদান করে । শেখ মুজিবকে আগরতলা মামলায় আটক রাখে । এমনিভাবে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার পরিকল্পনায় লিপ্ত ছিল শাসক গোষ্ঠী । কৃত্রিম ভালোবাসার অভিনয়ে ইয়াহিয়া খান শেখ সাহেবকে মুক্তি দেন । ভোটের পর বাংলায় সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে । ১৯৭০ সালে ভোটে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করে । পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্রো সাহেব শতকরা ৭৫ ভাগ ভোট পায় । ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ভুট্রো সাহেবের উস্কানিতে ইয়াহিয়া খান শেখ সাহেবকে এসেম্বলীতে ডাকেনা এবং ক্ষমতা প্রদান না করে স্বাধীনতা রক্ষার অজুহাতে বাংলায় সৈন্য সমাবেশ করেন । তার ভাষায় শেখ সাহেবকে গদী দিলে সে ভারতীয় নীতি গ্রহণ করবে ফলে বাংলা ভারতে পরিণত হবে । বাঙালি যখন তাদের ন্যায্য দাবির শ্লোগান চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয় তখন উপায়ন্তর না দেখে ইয়াহিয়া খান ৮ জন জেনারেল এবং তার দলীয় কর্মীদের নিয়ে এসেম্বলীতে বসেন । কিন্তু ইয়াহিয়ার একরোখা সিদ্ধান্ত শেখ সাহেব মানলেন না । কারণ তিনি বাঙালির স্বার্থকে ছোট করে চুক্তির মাধ্যমে গদী নিতে রাজি হন নাই । ঐ সময় বাংলার সেনাসদরে ছিলেন লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব আলী খান, এবং গভর্নর ছিলেন ভাইস এডমিরাল এস. এম. আহসান । তারা দুইজন পাকিস্তানি থাকা সত্ত্বেও বাঙালিকে অত্যাচার করতে রাজি ছিলেন না । অতএব তাদের বদলী করে টিক্কা খানকে বাংলার গভর্নর ও সামরিক প্রধান করে পাঠায় । বৈঠকে কোনোমতেই যখন ইয়াহিয়া খানের স্বার্থসিদ্ধি হলনা তখন সে লাহোরে প্রত্যাবর্তন করে ও পরিকল্পনা করে ২ ডিভিশন সৈন্য আনে এবং লাহোরে যাবার সময় ২৫ শে মার্চের গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে যায় । ইয়াহিয়ার নির্দেশক্রমে জেনারেল টিক্কা খান পাঞ্জাবী সেনা ও অফিসারদের নির্দেশ দিলেন বাঙালি অফিসার ও সেনাদের উইথড্র করার এবং তাদের সমূলে ধ্বংস করার । ১৯শে মার্চ ব্রিগেডিয়ার আরবার এবং তার সাথে ৩২ পাঞ্জাবের ১ কোম্পানি ও আর্টিলারিসহ জয়দেবপুরে ২য় ইস্ট বেঙ্গলের হাতিয়ার উইথড্র করতে যায় । ঘটনা বুঝে জনসাধারণ রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে । ২য় বেঙ্গলকে কিছু না করতে পেরে নিরীহ কিছু লোক গুলি করে হত্যা করা হয় । এবং পরে লে. কর্নেল মাসুদুল হোসেন খানকে হেলিকপ্টার যোগে বন্দি করে ঢাকায় আনে । তিনি ছিলেন পাক আমলে ২য় বেঙ্গলের সর্বপ্রথম বাঙালি সিও । তারপর ৩২ পাঞ্জাবের সিও লে., কর্নেল রকিবকে আমাদের সিও হিসেবে পোস্টিং দেয় । কিন্তু তখনও জানতাম না আমাদের সিও বন্দি কিনা । টিক্কা খান যখন বুঝতে পারে যে বাঙালিকে জোরপূর্বক দাবাতে হবে তখন ২৬তারিখে চট্টগ্রাম ইবিআরসি, চিটাগাং পোর্ট, ইপিআর ছাউনি, পুলিশ ব্যারাক আক্রমণ করে এবং শেখ সাহেবকেবন্দি করে নিয়ে যায় । ফলত বাঙালিরা পাক সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করে । এবং টিক্কাখান তার সেনাদের আদেশ দেয় প্রয়োজন হলে ৭২ঘন্টার
মধ্যে বাঙালিদের ধুলায় পরিণত করার । তাই পাকসেনা নারকীয় কর্ম শুরু করে । উপায়ন্তর না দেখে বাঙালি জনতা গোপনে সংঘবদ্ধ হয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে থাকে । তখন ২য় ইস্ট বেঙ্গল ছিল জয়দেবপুরে । কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় কোম্পানি ছিল । যেমন এ কোম্পানি ছিল টাঙ্গাইল, তার কোম্পানি কমাণ্ডার ছিল মেজর কাজেম কামাল (অবাঙালি) । বি কোম্পানি ছিল অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে, তার কমাণ্ডার ছিলেন মেজর এ. লতিফ(অবাঙালি) ।‘সি কোম্পানি’ ছিল ময়মনসিংহ, কোম্পানি কমাণ্ডার ছিল মেজর নুরুল ইসলাম । ‘ডি কোম্পানি’ ছিল জয়দেবপুর, কোম্পানি কমাণ্ডার ছিলেন মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী । এডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান, আইও ক্যাপ্টেন নাসিম, কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপ্টেন এজাজ এবং টুআইসি মেজর কাজী মোহাম্মদ সফিউল্লাহ । লে.কর্নেল রকিব সাহেব মেজর সফিউল্লাহকে বলেন যে ময়মনসিংহে ভারতীয়দের সাথে কিছু গোলমাল হচ্ছে । তাই অটোমেটিক হাতিয়ারগুলো নিয়ে যেন তথায় যাই । পরে পল্টনের যত বাঙালি জোয়ানরা একত্র হয়ে ২৮তারিখ রাত ৯টায় তাদের হত্যা করে টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে রওনা হই । চলন্ত অবস্থায় যেখানে অবাঙালি পাই তাদের হত্যা করা হয় । ২৮ তারিখ রাত ২ঃ৩০ মিনিটে এ কোম্পানির সাথে মিলিত হই । টাঙ্গাইলের অবাঙালিদের ঐ রাতে খতম করে মুক্তাগাছা রাজবাড়িতে থাকি । সেখানে জনগণ আমাদের অনেক উপকার করেছিল । ৩০শে মার্চ সেখানে হতে ময়মনসিংহ যাই ও সার্কিট হাউসে থাকি । সেখানে অবাঙালি খতম করি ও সমস্ত বাঙালি ট্রুপস একত্র হয়ে দল গঠন করি । ১লা এপ্রিল অধিনায়ক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করে মেজর শফিউল্লাহ ভাষণ দেন এবং কেন আমরা পাক সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করেছি তা বুঝিয়ে দেন । ২রা এপ্রিল ট্রেনযোগে কিশোরগঞ্জ পৌছি । ৩রা এপ্রিল আমাদের উপর বিমান হামলা হয় । ঐ দিন এ কোম্পানি কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন নাসিম সাহেব ভৈররে ডিফেন্স নেয় । কিশোরগঞ্জ হতে বাকি লোক ট্রেনযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাই । সেখান হতে বাস ও ট্রাক যোগে সিলেট অভিমুখে যাত্রা করি । ঐ সময় ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে মিলিত হই এবং সবাই সিলেটের সাতঘর চা বাগানে থাকি এবং ৪র্থ বেঙ্গলের সঙ্গে তেলিয়াপাড়া যাই । তখন কর্নেল ওসমানী সাহেব আমাদের সাথে দেখা করেন । পরে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল তেলিয়াপাড়া লোকেশন আমাদের দিয়ে ভারতে চলে যায় । তখন বিভিন্ন স্থান হতে লোক জড়ো হয়ে আমাদের শক্তি বাড়ায় এবং সি কোম্পানি কমাণ্ডার মেজর আজিজ সাহেব সিলেট গমন করেন । আর এক কোম্পানি মেজর ক্যাপ্টেন এজাজ সাহেব । ডি কোম্পানি কমাণ্ডার ছিলেন মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী । হেড কোয়ার্টার ও ডি কোম্পানি একত্রে থেকে ছোট বড় সব অপারেশন করে এবং প্রশিক্ষণ কযাম্প চালায় । আমি তৎকালীন পাকিস্তানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি । তারপর কাকুল ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি । প্রশিক্ষণদাতা অফিসারবৃন্দের কেউ কেউ ক্যাপ্টেন ছিলেন । তাদের নাম এখন স্মরণ নাই । তাছাড়া সাবেক রাষ্ট্রপতি হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ প্রশিক্ষণ অফিসার ছিলেন এবং অন্যান্য অফিসারবৃন্দও ছিলেন ।
২৬শে মার্চ পাক বাহিনী ১০ঘন্টা হামলা চালায় এ কোম্পানি সেখান থেকে তেলিয়াপারায় ফিরে আসে । ২৪শে এপ্রিল শফিউল্লাহ সাহেব পুনরায় তেলিয়াপাড়ায় সভা ডাকেন এবং ৩০শে এপ্রিল সেখান থেকে হেডকোয়ার্টার সিমনাতে নেওয়া হয় । ডি কোম্পানি ঐ দিনই কলকলিয়া যায় ও সেখানে সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া লোকেশন নির্ণয় করে । ডি কোম্পানি কমাণ্ডার মেজর মইনুল চৌধুরী আমাকে হুকুম দিলেন যে, লক্ষীপুর গ্রামে ডিফেন্স করেন । ১৯৬২ সালের পাক-ভারত বর্ডার সংঘর্ষের জন্য গ্রামটা বিখ্যাত । এখানে মেজর তোফায়েল শহীদ হন । তার নামে একটা স্মৃতিসৌধ ঐ গ্রামে আছে । পাক সেনাদের উপর আদেশ ছিল যে ঐ গ্রামে এসে মেজর তোফায়েলের স্মৃতি দখল করতে পারে নাই । দুইটা হেভী মেশিনগান এবং দুইটা টু ইঞ্চ মর্টার আমাদেরকে সহায়তা করে আমি ঐ সময় বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে ফাঁদ পেতে আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের অনেক ক্ষতি করি । ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেটগামী রেললাইন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেটের পাকা রাস্তা আমার দায়িত্বে ছিল । সিলেট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসা পাক সেনার ট্রেন এবং যোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেটে আসা পাকসেনাদের উপর ফাঁদ পেতে আক্রমণ চালিয়ে অনেক ক্ষতি করি । ফলে তারা পিছনে ভেগে যায় । এছাড়া সিলেট এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া ত্রেন লাইনের ইসলাম ব্রীজ, পাঁচগাও ব্রীজ, হরষপুর ব্রীজ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট গামী সড়কের মাদমপুর ব্রীজ, চান্দ্রা ব্রীজ, এবং বুজুন্দী গ্রামের ব্রীজ ধ্বংস করি । পাওয়ার হাউস, বিজলী সাপ্লাই পয়েন্ট, কোয়ার্টার সাপ্লাই পয়েন্ট ধ্বংস করি । এইসব ধ্বংস করার কারণ ছিল পাক সেনাবাহিনী সরাসরি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং আমাদের উপর সরাসরি আক্রমণ না করতে পারে । তাদের চলার পথে, রাস্তায় ফাঁদ পেতে কেচকা মাইর দেওয়া ছিল আমাদের কাজ । আমার অপারেশনের এরিয়া ছিল চান্দ্রা গ্রাম, কালিশিমা গ্রাম, মাধুপুর গ্রাম, হরষপুর গ্রাম, বুল্লা কোম্পানি হেডকোয়ার্টার ঐ লক্ষ্মীপুর গ্রামে বহাল ছিল । আমি ঐ গ্রামে মে মাস থেকে ৩০শে অক্টোবর পর্যন্ত ঐ দায়ত্বে বহাল থাকি । তারপর আমাদের হেডকোয়ার্টা থেকে হুকুম পেলাম যে আমাদের বিলোনিয়া যেতে হবে । আমি সেক্টর ফোর্সকে আমার এরিয়ার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলে ১লা নভেম্বর আমার ফোর্স নিয়ে ইণ্ডিয়ান ফোর্সের গাড়িতে চড়ে ডি কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদের অধিনায়কত্বে বিলোনিয়ায় রাত ৮টায় পৌছি । ঐ এলাকাটা ছিল আমাদের জন্য অজানা বা অচেনা । ওখানে অধিনায়ক ছিলেন মেজর জাফর ইমাম । তার কাছে আমরা রিপোর্ট করি । ২নভেম্বর আমার উপর নির্দেশ হয়, আপনি বিলোনিয়া-চিতলিয়া গ্রামে একলা রেকি করতে যান । ৪-১১-৭১ তারিখে ঐ সেক্টরে একজন ইণ্ডিয়ান জেনারেল, একজন ব্রিগেডিয়ার এবং ঐ সেক্টরে আমাদের সকল কমাণ্ডার, অর্ডার গ্রুপ এবং রেকি গ্রুপ
আমরা ঐ চিতলিয়া এরিয়া রেকি করতে যাই । কারণ ৫-১১-৭১ তারিখে আমাদের অনুপ্রবেশ করার তারিখ নির্ধারিত করা হয়েছিল । ৪-১১-৭১ তারিখে বেলা ৪ ঘটিকার সময় নিজ নিজ এরিয়াতে পৌছে । পৌছানোর পর ক্যাপ্টেন হেলাল মোরশেদ আমাকে হুকুম দিলেন যে, লেফট ফরোয়ার্ড প্লাটুনের এরিয়া আপনি নিজে যেয়ে রেকি করে আসেন । আমার সাথে আমার অর্ডার গ্রুপ মেশিনগান কমাণ্ডার এবং তিন সেকশেন কমাণ্ডার এবং অন্যান্য অটোমেটিক হাতিয়ার কমাণ্ডারগণ ছিল । ঐ এরিয়ায় গাইড করে নিয়ে যাবে বলে একজন সৈনিক আমার সাথে দেন । রওনা হয়ে যাওয়ার ২০০ গজ পরে শত্রুর পোঁতা মাইন আমার বাঁ পায়ের নীচে পরে এবং বাঁ পায়ে আঘাত পাই । তখন ৪-১১-৭১ তারিখের বেলা চারটা, ১৪ই রমজান ইফতারের কিছু আগে । বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনে আমাদের অধিনায়ক সাহেব এবং অন্যান্য অফিসার, জেসিও এনসিওগণ ছুটে এসে দেখে আমি আহত হয়ে পড়ে আছি । ঐ সময় অনেক রক্ত পড়ছিল । তখন আমার কাছে একটা লুঙ্গি এবং একজন হাবিলদারের কাছে একটা লুঙ্গি ছিল । দুটি লুঙ্গি দিয়ে ধরে রাখায় রক্ত পড়া থেমে গেছে । পরে ব্যাণ্ডিজ করে নায়েব সুবেদার আবদুল মোমিন ও ৪ জন মুক্তিযোদ্ধার সাথে দিয়ে আমাকে রিয়ার হেডকোয়ার্টারে পাঠানো হয় । তারা পাশের বাড়ি হতে ঘরের বেড়া ঝাঁপ এনে তাতে আমাকে শুইয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ইণ্ডিয়া নিয়ে আসে । হেডকোয়ার্টার থেকে আমার একসিডেন্ট স্থলের দূরত্ব ছিল ৫-৭ মাইল । আমি যেখানে এক্সিডেন্ট হই পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে থেকে ২০০ গজ দূরে ছিল । তারা ইচ্ছা করলে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারত । কিন্তু যখন আমি নদী পার হচ্ছিলাম তখন তারা আমার উপর ফায়ার করেছিল কিন্তু আমাদের কোন ক্ষতি হয় নাই । ৫-১-৭১ তারিখে ভারতীয় ফিল্ড মেডিকেল ব্যাটালিয়নে (শালবন-আগরতলা) অপারেশন করে আমার বাঁ পা হাটুর নীচে পর্যন্ত কেটে ফেলে । তার ৫/৭ দিন পর জ্ঞান ফিরলে আমাকে মুক্তিযোদ্ধা হসপিটাল, ধর্মনগরে (ছনের ঘর) পাঠানো হয় । এখানে ২/৩ দিন ছিলাম । তারপর হেলিকপ্টার যোগে শিলচর মেডিকেল হাসপাতালে পাঠানো হয় । ৪/৫ দিন পর শিলচর থেকে ট্রেনযোগে গোহাটি মিলিটারি হসপিটালে পাঠানো হয় । এখানে ১ মাসের মত ছিলাম । ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আরও ৩জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আমাকে পুনার খিড়কি সামরিক পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয় । খিড়কিতে ১০ই আগস্ট (২৭) পর্যন্ত থাকতে হয়েছে । এখানে আমার দুই বার অপারেশন হয় । ফেব্রুয়ারি ১৫ তারিখে skin grafting করা হয় । খিকড়িতে আর পুনাতে মে মাসে অপারেশন করা হয় । পুনাতে কৃত্রিম পা সংযোজন করা হয় । খিকড়ি থেকে পুনাতে কয়েকবার যেতে হয়েছে । এখানে চিকিৎসা, ব্যবহার খুব ভাল ছিল । ভারতীয় কর্নেল আবদুল মজিদ খিড়কি হাসপাতালের ইনচার্জে ছিলেন । উনার সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা (যারা খিকড়িতে ছিল) বোম্বাই ইত্যাদি জায়গায় ট্যুরে গিয়েছিল । উনার জন্য আমরা একটা ঈদের নামাজ পড়েছি । তার বদৌলতে আমরা ঐ হাসপাতালে হালাল মাংশ পেয়েছি ।
পুনাতে (খিড়কি) তখন অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন । যেমন দুই জন অফিসার (তাদের একজন মরহুম কর্নেল তাহের), চার জন জেসিও (যাদের মধ্যে দুই জন বিডিআর ২ জন সেনাবাহিনীর)ও অন্যান্য পদবীর সৈনিক অনেক ছিল । ৯ মাস ভারতে চিকিৎসা শেষে, কৃত্রিম পা সংযোজন করে ১০-৮-৭২ তারিখে হাসপাতাল হতে কোলকাতা-বেনাপোল, খুলনা এবং বরিশাল হয়ে রকেটে করে ১৫-৮-৭২ তারিখে ঢাকা আসি । ঢাকায় সেনা সদরে আমার রপোর্ট করার কথা ছিল কিন্তু আমার ইউনিট (২য় ইস্ট বেঙ্গল) তখন ঢাকার কুর্মিটোলায় ছিল । তাই সেখানেই যোগ দেই । তারপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিয়মিত কর্তব্যেরত ছিলাম । এর ভিতর বাংলাদেশের নানা দর্যোগ এবং ১৯৭৭ সন থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত পার্বত্য চট্রগ্রামে অপারেশন ডিউটি করি । ১৯৭৯ সালের মে/জুন মাসে কুমিল্লা সেনানিবাসে বদলী হয়ে আসি । আমার ব্যক্তিগত পদোন্নতি উপলক্ষে ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে ৩২ বেঙ্গলে বদলী করা হয় । সেখান থেকে ১৪-৯-৮৬ সালে আমি চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করি । দীর্ঘ ৩২ বছর সামরিক বাহিনীতে চাকরি করে বর্তমানে অবসর অবস্থায় আছি । চাকুরি জীবনে বহু ডিউটি করি তার মধ্যে ২৬শে মার্চ ১৯৭১ সালে আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘোষনা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই । এর আগে আমি তৎকালীন পাকিস্তানে নানা দুর্যোগের সময় ডিউটি করি । যেমন- ১. ১৯৫৬সালে ফুড অপারেশন ডিউটি করি । ২. ১৯৫৫ সালে গোমতী নদীর ভাঙ্গন থেকে কুমিল্লা শহর রক্ষার জন্য ঐ বাঁধের জন্য ডিউটি করি । ৩. ১৯৫৮ সালে আয়ুবের মার্শাল লর সময় পাকিস্তানের পেশোয়ার জেলায় ডিউটি করি । ৪. ১৯৬৪ সালে আয়ুব ও ফাতেমা জিন্নার নির্বাচনে ডিউটি করি । ৫. ১৯৬৫-র পাক ভারত যুদ্ধে যশোর ছিলাম । ৬. ১৯৭০ সালে শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইয়াহিয়া খানের নির্বাচনী ডিউটি করি ময়মনসিংহে । ৭. একাত্তরের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ করে আহত হই । ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধসমূহঃ ময়মনসিংহ -২৭-২৮ মার্চ জয়দেবপুর -২৮-২৯ মার্চ টাঙ্গাইল -২৮-২৯ মার্চ নরসিংদি-ডেমরা -১-২০ এপ্রিল আশুগঞ্জ-ভৈরব -১-১৪ এপ্রিল সিলেট -৯-১৭ এপ্রিল ব্রাক্ষণিবাড়িয়া, লালপুর, গেকর্নঘাট -২০-২৮ এপ্রিল
শাহবাজপুর, সরাইল, মাধবপুর, -২৫ এপ্রিল -১৫ মে তেলিয়াপাড়া -১৯ এপ্রিল -১৯ মে শেরপুর, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল -৫-২৫ এপ্রিল হাটহাজারী, নাজিরহাট -১০ এপ্রিল -২৫ মে নাজিরহাট রামগড় -১০ এপ্রিল -২৫ মে হরষপুর, মুকুন্দপুর -১৫ এপ্রিল -১৬ জুন নলুয়া চা বাগান -১-৩ জুন ধর্মগড় -২-৪ সেপ্টেম্বর মুকুন্দপুর -১২ সেপ্টেম্বর কালেঙ্গা ফরেস্ট -২৩-২৫ সেপ্টেম্বর কৃঞ্চপুর-মণ্ডলা -মে-নভেম্বর বিলোনিয়া -২-২৮ নভেম্বর রাজাপুর, আজমপুর, আখাউড়া -১-৫ ডিসেম্বর ডেমরা -১০-১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযূদ্ধে আমার স্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে নভেম্বরে আহত হওয়া আর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হচ্ছে ধর্মনগর এ্যাটাক । তখন বর্ষাকাল (তারিখ মনে নেই । মে, জুন বা আগস্ট মাসে হবে) ছিল । আমাদের কোম্পানির কমাণ্ডার ছিলেন মেজর মইন । আমি ছিলাম ডেলটা কোম্পানি এবং কাট আপ পার্টিতে । রাইট ফরোয়ার্ড কাতলামারা এরিয়াতে ছিল প্রটেকশন পার্টি, ফোর্স ছিল বি কোম্পানি । ঐ কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান । তার সাথে ছিলেন ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া । এই অপারেশনে আমাদের এ্যাটাকিং ফোর্স ফেল করেছিল কারণ প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল আর পাকিস্তানিরা প্রচণ্ড ফায়ারিং করছিল-বলার মও না । পাকিস্তানিরা আমাদের ‘ডি কোম্পানি ঘেরাও করে ফেলে । ডি কোম্পানির একটা প্লাটুন যার কমাণ্ডার ছিলেন সুবেদার মমিন, সুবেদার আবদুর কাদের, হাবিলদার ওয়াজদ আলী বর্কী ওদেরকেও ঘেরাও করে ফেলেছিল । আল্লাহর রহমতে আমার মর্টারের ফায়ারের সাহায্যে তারা বেঁচে আসেন । এদের মধ্যে লে. সাঈদ আহমদও ছিলেন । সেদিন আমি প্রায় ৫০০-র মতো তিন ইঞ্চি মর্টারের গোলা ফেলি । আমাদের ৪জন লোক আহত হয় । এদের মধ্যে লে. জহিরুল হক আমার পোস্টে এসে আমাকে ধন্যবাদ, মোবারকবাদ জানান । মোট কথা কোনো পক্ষেরই তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি । ইণ্ডীয়ান ১৮ রাজপুত আমাদের সঙ্গে ছিল । তাদের ২/৩ জন লোক মারা যায় ও আহত হয় ।