পালাটানা ট্রেনিং ক্যাম্প এর স্মৃতি
গোলাম মুস্তফা
বিলোনিয়ার প্রথম যুদ্ধের পর একাত্তরের ২১শে জুন পাকিস্তানির প্রচন্ড গোলাগুলি, সন্ত্রাস, অবিশ্বাস্য রকমের ধ্বংসযজ্ঞ ও ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিলোনিয়ার ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত এসে আসন গেড়ে বসে । তার আগেই অবশ্য সমগ্র এলাকার জনগণ জীবন ও সম্রম বাঁচানোর স্বাভাবিক তাগিদে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত বর্তী এলাকাগুলোতে, বিশেষত বিলোনিয়া শহরে এসে আশ্রয় দেয় । পালাটানা ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগদানের উদ্দেশ্যে আমি আগেই বিলোনিয়ায় এসে পৌছেছিলাম । পথে আমার সাথে যোগ দেয় বন্ধু ওয়ালী । বিলোনিয়া পরিচয় হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাহাঙ্গীর ও আনসারের সাথে । জাহাঙ্গীর ও আনসার সহ সদ্য ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী যুবকদের মধ্য হতে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী তাদেরকে সংগঠিত করতে শুরু করলাম । সৌভাগ্যবশত বিলোনিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের তৎপরতা ও মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে আমাদের ব্যাকুলতা ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) এর মেজর প্রধান এর নজরে আসে । তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন এবনহ আমাদের সৎ উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে তার অধীনস্থ দুটি SHAKTIMAN ব্র্যান্ডের সামরিক ট্রাকের ব্যবস্থা করে দিলেন । হানাদার দস্যুদের মোকাবেলায় দু’ট্রাকে ভর্তি তরুণ ও যুবক নিয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা যাত্রা শুরু করলাম পালাটানার উদ্দেশ্যে । আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ । চারদিকে পাহাড় আর পাহাড় । পাহাড়গুলো গাড় সবুজ গাছ-গাছালি দ্বারা আবৃত । চারদিকে শুধূ সবুজ আর সবুজ । উপরে নীল আকাশ, মাঝে-মাঝে শ্লথ গতির সাদা মেঘের নীরব আনাগোনা । নির্মল ও ভীষন গতির বাতাস এলোমেলো করে দিচ্ছে চুল ও কাপড়-চোপড় । অজানার পথে আমরা । অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তার সাথে এক ধরণের রোমাঞ্চকর অনুভূতি । এগিয়ে চলেছে ভারি সামরিক ট্রাক । পাহাড়ের গা পেঁচিয়ে খাড়া রাস্তা বেয়ে উঠে যাচেছ ট্রাক একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় । নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায় । ব্রেক ফেল করলে অথবা অন্য কোনো কারণে বিপজ্জনক এ রাস্তায় দূর্ঘটনায় পতিত হলে সোজা গিয়ে পড়তে হবে হাজার ফুট নিচের পাহাড়ী খাদে । এ ধরণের দুর্ঘটনার কবলে পতিত, নিচের গভীর খাদে চির নিন্দার শয়নে শায়িত একটি উল্টে যাওয়া ট্রাক দেখা গেল । এতো উচু থেকে ট্রাকটিকে লাগছিল একটি ক্ষুদ্র খেলনা ট্রাকের মত । আমাদের ট্রাক এবার ট্রাক ঘুরে ঘুরে নীচের দিকে নামা শুরু করলো ঘঁ ঘঁ করে, ষাঁঢ়ের ন্যায়, গোঁয়ারের মতো । পাহাড়িয়া রাস্তায় এ ধরণের ভ্রমণে আমরা কেউই অভ্যস্ত ছিলাম না । ট্রাকে গাদাগাদি করে বসে থাকা ছেলেদের মধ্যে অনেকেই ভয়ানক রকম বমি শুরু করে দিল । এ ধরণের একটি বমির ধারা তীব্র গতিতে আমার বাম কাঁধের উপর দিয়ে গিয়ে পড়ল আরেক সাথী ভাইয়ের পিঠে । রক্ষা পেলাম অল্পের জন্য । কিন্তু আরতৃপ্তির অবকাশ ছিলনা । পরমুহুর্তেই দেখলাম কুলির চেয়ে শত গুণ বেশি তীব্র গতিতে ধেয়ে আসছে বমির আরেক ধারা । সড়াৎ করে মুহুর্তের মধ্যেই সরিয়ে ফেললাম মাথা । ধাঁ করে সেই ‘বমি-কুলি’ সরাসরি গিয়ে আছঁড়ে পড়ল আরেক সাথীভাইয়ের গলায় ও বুকের উপরের অংশে । সে এক কান্ড বটে ! যাক, এভাবে বমি । জগতে অবগাহন করতে করতে, হেলে-দুলে, জাম-বানানীর মত ঝাঁকানি খেতে খেতে এবং “দুর্গম গিরী কান্তার মরু দুস্তর পারাপার ওহে, লঙিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার” টাইপের কোরাশ গাইতে গাইতে শেষ পর্যন্ত আমরা এসে পৌছুলাম পালাটানা ট্রেনিং ক্যাম্পে । ক্যাম্প কমান্ড্যান্ট ক্যাপ্টেন সুজাত আলী এমএনএ আমাদেরকে স্বাগত জানালেন এবং ট্রেনিংয়ের জন্য আমাদেরকে নিবন্ধন প্রদান করলেন । আমরা সেদিনের জন্য ব্যারাকে চলে গেলাম খাওয়াদাওয়া ও বিশ্রামের জন্য । পালাটানা এলাকাটির অবস্থান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুর শহরের ৫কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে । পালাটানা প্রাইমারী স্কুল নামে এখানে ছিল একটি স্কুল । স্কুলের সামনে বেশ বড় একটি মাঠ । চারদিকে ছোট ছোট টিলা ও পাহাড় । শান্ত, সবুজ ও মনোরম একটি পরিবেশ । লোক বসতি হালকা । বেশিরভাগ অদিবাসীও বাঙালি হিন্দু । পাহাড়ী এবং মুসলমানের সংখ্যাও অবশ্য একেবারে কম নয় । স্বাচ্ছন্দে ও সহমর্মীতায় তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান । বৃটিশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন সুজাত আলী আওয়ামী লীগ হতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কুমিল্লার দেবীদ্বার এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য । পালাটানা ট্রেনিং ক্যাম্পের তিনিই প্রতিষ্ঠাতা কমান্ড্যান্ট । রাশভারি ধরণের মানুষ । স্বল্পভাষী ও রাগী । গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা । কিন্তু রেগে গেলে টকটকে লাল । নাকের নিচে কাঁচা-পাকা এক গুচ্ছ গোঁফ । মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের জন্য স্থানীয় তার খুবই পছন্দ । সানন্দে তাতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত (ইউনিয়ন পরিষদ) চেয়ারম্যান ও সদস্যগন । এগিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী ও গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ । জেলা প্রশাসন সহ সংশ্লিষ্ট সকলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন । স্কুলটি বন্ধ ঘোষিত হলো অনির্দিষ্ট কালের জন্য । প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপনের জন্য শুরু হলো প্রচেষ্টা । স্কুল ঘরটি ছিল মাঠের পূর্বে অংশে । ক্যাপ্টেন সুজাত আলীর থাকার ব্যবস্থা হল এর একটি রুমে । সাথে থাকত ৮ ও ১০ বছর বয়সী তার ফুটফুটে দুই ছেলে । পাশের রুমটি নির্ধারিত হলো তার কমান্ড্যাটি অফিস হিসেবে । অন্যান্য রুম ব্যবহৃত হতো চিকিৎসা কেন্দ্র, তথ্য কেন্দ্র, ইনষ্ট্রাক্টরদের থাকা ও গুদাম হিসেবে ।
মাঠের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিঞ দিকে উপরে ছন ও চারদিকে বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি হল ব্যারাক । উত্তর-পূর্ব কোনায় স্থাপিত হল লঙ্গরখানা, মানে রান্নাঘর । দক্ষিন-পূর্ব পাশে শাল ও গজারী কাঠ দিয়ে নির্মিত হল মেইন গেট । পশ্চিম দিকের ব্যারাকের মাঝামাঝি স্থানে বাঁশ দিয়ে নির্মিত হলো দ্বিতীয় গেটটি । সে গেট হতে ২০গজ দূরেই দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে তৈরি করা হয়েছে ৩০টি কাঁচা টয়লেট । মাটি থেকে ২ফুট উচুতে বাঁশ ও বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি হয়েছে টয়লেটগুলো । টয়লেটের কাছাকাছি স্থান রাখা আছে ৩০টি মাটির বদনা । পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির ক্ষীন একটি পাহাড়ি ধারা থেকে বদনায় পানি এনে প্রকৃতির ডাকে দেয়ার পর সৌচকার্য সম্পন্ন করা হত । মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আকুলতা নিয়ে পালাতানা ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রতিদিন পূর্ব বাংলা থেকে স্রোতের মত তরুন ও যবক ছেলেরা আসতে লাগল । এদের বেশিরভাগই ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, ফেরিওয়ালা ও ছোট ব্যবসায়ী ধরনের মানুষ । গড় বয়স ১৫ থেকে ২৮ বছর । ছাত্রদের মধ্যে নবম-দশম শ্রেনী থেকে শুরু করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও ছিল । ট্রেনিংরত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছাত্রদের সংখ্যাই ছিল অধিক । মেইন গেটের পাশে ছোট একটি রুমে আগ্রহী প্রশিক্ষণার্থীদের শারিরীক ও মনস্ত স্নাত্ত্বিক পরীক্ষা নিয়ে ট্রেনিংয়ের জন্য বাছাই করা হত । পাকিস্তানিদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য কেউ যাতে প্রশিক্ষণার্থীর ছদ্দবেশে ক্যাম্পে ঢুকতে না পারে অথচ যুদ্ধে যোগদানে ইচ্ছুক প্রকৃতি প্রশিক্ষণার্থীর যাতে বাদ না যায় সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ ছিলেন বিশেষ সজাগ । শারীরিক ও মানসিক সহ বয়সের কারনে যে সব প্রশিক্ষণার্থী ট্রেনিংয়ের জন্য তথা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য অনেক আকুলী-বিকুলী করেও নির্বাচিত হতে পারেনি তাদের মধ্যে অনেকেই অঝোর ধারায় কাদঁতে দেখেছি । প্রশিক্ষপণার্থীদেরকে সেকশন, প্ল্যাটুন ও কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত করে শৃংখলা সাথে বিন্যাস করা হল । কোম্পানিরগুলোর নাম দেয়া হল এভাবে আলফা, ব্রাভো, চার্লী, ডেল্টা, ইকো, ফাইটার, গামা, হীরা ইত্যাদি । প্রতিটি কোম্পানিকে তিনটি সেকশনে বিভক্ত করে তিনজন সেকশন কমান্ডার এবং একজন কোম্পানি কমান্ডার নিয়োগ দেয়া হয়েছিল । কমান্ডার নিয়োগের পূর্বে শারিরীক, মানসিক ও শিক্ষাগত যোগ্যতা সহ লিডারশীপ কোয়ালিটির বিষয়ে সাক্ষাতকার ছাড়াও ব্যাপকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিলো । আমক ফাইটার কোম্পানির কমান্ডার মনোনীত করা হলো । জাহাঙ্গীর ও ওয়ালী যথাক্রমে ইকো ও গামা কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত হলো । অন্য কোম্পানি কমান্ডারদের নাম আজ আর কিছুতেই মনে করতে পারছিনা । প্রত্যেক কোম্পানির জন্য আলাদা আলাদা ব্যারাক তৈরি করা হয়েছিল । ব্যারাকের মাঝখানটা হাটা-চলার জন্য রেখে দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল । প্রতিটি প্রশিক্ষণার্থীকেই দেয়া হলো দুটো করে চটের খালি বস্তা, দুটো করে ১০ইট, একটি এলুমিনিয়ামের থালা ও একটি এলুমিনিয়ামের বড় মগ । আমাদের বলা হলো একটি চটের বস্তা দিয়ে দুটো ইট মুড়িয়ে বালিশ বানাতে এবং বাকি চটের বসাটি বিছানা হিসেবে ব্যবহার করতে । আমরা তাই করলাম । তবে কোমর সহ শরীরের নীচের অংশ মাটিতেই থাকত । বিছানার পূর্ণতার জন্য অনেক চেষ্টা করেও তৃতীয় একটি বস্তার বরাদ্ধ পাওয়া গেল না ! অনেকেই আমরা পাশের বন থেকে গাছের পাতা সংগ্রহ করে বিছানাগুলোকে বিস্তৃত ও আরামদায়ক করার ব্যবস্থা নিলাম । ক্যাম্পের লংগরখানায় খাবার তৈরি হত । সকালের পিটি প্যারেড়ের পরে নাস্তা হিসেবে আমাদেরকে দেয়া হত একটি আঁটার রুটি ও এক মগ চা । দুপুরে বরাদ্ধ ছিল এক প্লেট ভাত ও এক চামচ ‘লাবড়া’ টাইপের তরকারী । রাতে দুটা আটার রুটি ও এক চামচ ডাল । অবশ্য সপ্তাহে এক বেলা এক টুকরা মাছ অথবা ঝোল সহ ২/৩ টুকরা ছাগলের মাংশ অথবা ঝোল সহ এক টুকরা মুরগীর মাংশ পরিবেশিত হত । সেদিন সকলের চোখে-মুখে আনন্দের ঢেউ বয়ে যেত । আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেনিং শুরু হওয়ার ৮/৯ দিন পরে প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্য হতে ওয়ালী সহ ১২ জন ছেলেকে আলাদা করা হল । বলা হল যে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এবং ভারতীয়/মুক্তিবাহিনীর পক্ষে গুপ্তচরবৃত্ত্বির ট্রেনিং প্রদানের জন্য তাদেরকে আসামের কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে । তারা সকলেই সম্মত । গেটে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি গাড়িও প্রস্তত।ক্যাম্পে আমার অন্যতম বাল্যবন্ধু ওয়ালী । অথচ সে চলে যাচ্ছে । মনটা বিষাদে ভরে গেল । অশ্রসজল নয়নে ওয়ালীকে বিদায় দিলাম । ওয়ালীদের গাড়ি ছেড়ে দেয়ার মুহুর্তেই ভোঁজবাজীর মত ভাড়া করা একটা জীপে এসে হাজির হল আমার দুই প্রিয় বাল্যবন্ধু শহীদ ও মোশাররফ (হারুন) । এক বন্ধু প্রস্থানের প্রক্কালে দুই বন্ধুর আগমন আমার মনের বিষন্নতা দূর করে দিল । আসার সাথে সাথেই আমাকে সামনে পেয়ে ওরা খুশি ও আনন্দে একেবারে দিশেহারা । যোদ্ধা হিসেবে বাছাই ও দাপ্তরিক অন্যান্য আনুসঙ্গীকতার পরে ওদেরকে ওদের জন্য নির্দিষ্ট ব্যারাকে পৌছে দিলাম । দু’জনকেই হীরো কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত করা হল । শহীদ পরবর্তীতে হীরো কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত হয়েছিল । শুরু হলো ট্রেনিং । ভোর বেলা বিউগলের আওয়াজের সাথে সাথে প্রশিক্ষণার্থীফের সকলেই হাজির হল মাঠে । ইংরেজী বর্ণমালার ক্রমানুসারে কোম্পানিগুলোকে সাজানো হয় । প্রতিটি কোম্পানির সামনে কোম্পানি কমান্ডারদেরকে দাঁড় করান হল । তার পেছনে তিনটি সেকশনকে তিন লাইনে (In 3’s) দাঁড় (Fall In) করান হল । প্রতিটি সেকশনের সামনে একেকজন সেকশন কমান্ডার দন্ডায়মান । প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে কেউ পরে আছে প্যান্ট । নির্দেশানুযায়ী লুঙ্গীওয়ালাকে ‘গোঁচ’ (মালাকোচা) দিয়ে দাঁড়াতে হল । পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন রেজিমেন্ট হতে ছুটিতে আসা, অবসরপ্রাপ্ত অথবা ইউনিট ছেড়ে বেরিয়ে আসা ১৫/১৬ জন হাবিলদার ও নায়েব সুবেদার টাইপের সৈনিক ছিলেন আমাদের প্রশিক্ষক । এদের মধ্যে একজনকে কিছুইতে ভোলা যায়না । তিনি হাবিলদার বারেক । বারেক ওস্তাদ ছিলেন সরল প্রকৃতির, কিন্তু গায়ে-গতরে এবং লম্বায়-চওড়ায় ছিলেন বিশাল । গলার আওয়াজ ছিল বজ্রের মত । ট্রেনিং প্রদানের সময় সে গলা গমগম করত, শোনা যেত বহুদূর পর্যন্ত । প্রথম দিন ৭ কোম্পানির প্রশিক্ষণার্থীকে প্রাথমিক (Phtsical Training) এবং (Parrade) করিয়ে (Attention) এর ভঙ্গীতে দাঁড় করানো হল । কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জন প্রশিক্ষক Escort করে ক্যাপ্টেন সুজাত আলীকে নিয়ে এলেন । তিনি আমাদের সকলকে স্বাগত জানিয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ভাষায় এবং তেজোদ্দীপ্ত একটি ভাষন দিলেন । দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ধর্মভিত্তিক অবাস্তব রাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা কত নির্মমভাবে পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালির শাসিত ও শোষিত হয়েছে ভাষনে তিনি তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দেন । ৫২এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৮ এর সামরিক শাষন, ৬৬এর ৬ দফা আন্দোলন, ৬৮ এর আগরতলা মামলা, ৬৯ এর ছাত্র-গন অভ্যূন্থান, ৭০এর উপকুলীয় প্রলয়ংকারী ঘূর্ণীঝড় ও নির্বাচন, বঙ্গবন্ধুএ নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে ছল-চাতুরী, বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষন এবং সবশেষে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ২৬শে মার্চের আক্রমন ও গণহত্যা সহ ছাব্বিশে মার্চের প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষনার নিখুত বর্ণনা তার ভাষনে উঠে আসে । মন-প্রান ঢেলে নিয়ে স্বল্পতম সময়ে নিখুতভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি উদাত্ত্ব আহ্বান জনালেন ।জবাবে গলা ফাটিয়ে “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর” এবং “জয় বাংলা” ও “জয় বঙ্গবন্ধু” স্লোগান দিয়ে এক হাজারেরও বেশি প্রশিক্ষণার্থী সেদিন তাদের আবেগ, অনুভূতি ও দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেছিল । এবার ট্রেনিংয়ের বিষয়ে কিছু স্মৃতিচারণ করা যাক । সূর্য উদিত হওয়ার প্রক্কালেই প্রতিদিন ভোর বেলা বুগল বেজে উঠত । বিউগল বাজার ৫মিনিটের মধ্যেই আমাদেরকে যার যার কোম্পানি নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় In Threes Fall In করতে হত । মিনিট দশেক Left Right করার পর সারিবদ্ধভাবে একটার পর একটা কম্পানীকে Double March করতে করতে মূল ফটক দিয়ে বেরিয়ে মেইন রোডে পৌছতে হত । এরপর রাস্তার ডান পাশ দিয়ে ৫কিলোমিটার দূরের উদয়পুর শহর হয়ে একই গতিতে আবার ফিরে আসতে হত ক্যাম্পে । ক্যাম্পে ফেয়ার পর আধা ঘন্টা পিটি-প্যারেড এবং তার পরে সকালের নাস্তার জন্য আধা ঘন্টার বিরতী । বিরতীর পর এক ঘন্টা বিভিন্ন রকমের শারিরীক কসরত ও কুচকাওয়াজ । পরের এক ঘন্টা বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধের কলা-কৌশল ও অস্ত্র-সস্ত্রের বিষয়ে প্রশিক্ষণ । এরপর এগারোটা নাগাদ ছুটি । ছুটির পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম । বিশ্রামের পর গোসল এবং দুপুরের খাবার । খাবারের পর বিছানায় শোয়ার আগেই গভীর ঘুম । বিকেল ৪টায় আবার বিউগল এবং হালকা শারিরীক কসরত । তারপর আবার যথারীতি যুদ্ধের কলা-কৌশল ও বিভিন্ন সমরাস্ত্রের উপর থিওরেটিক্যাল ও প্র্যাকটিকেল ক্লাশ । থ্রি-নট-থ্রি (303) রাইফেল, সেলফ লোডিং রাইফেল (এসএলআর), সাব মেশিন কার্বাইন (এসএমসি), লাইট মেশিনগান(এলএমজি), মেশিন গান, ২মর্টার, HE 36 Hand Granade সহ যাবতীয় ক্ষুদ্রাস্ত্রের বিভিন্ন অংশের নাম ও কার্যক্রম মুখস্ত করা, এসব অস্ত্রের বিভিন্ন অংশ খোলে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তা আবার যথাস্থানে লাগানো এসব অস্ত্র বহন ও শত্রুর বিরুদ্ধে কার্য্যকরভাবে ব্যবহার করা, বিভিন্ন অস্ত্রের কার্য্যকর ভিন্ন ভিন্ন Range, Minor repair এবং Maintenance সহ যাবতীয় বিষয়ে আমাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় । সূর্যাস্তের প্রক্কালে ছুটি । এক ঘন্টা বিশ্রাম । তারপর রাতের খাবার । রাত ন’টার পরপরই বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হত । মোটামুটি এই ছিল আমাদের প্রশিক্ষণকালীন রোজনামচা । এভাবে এক মাস ট্রেনিং চলার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ধর এর নেতৃত্বে একটি টিম আমাদের ক্যাম্পে আসেন । তারা বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর টিমই আমাদেরকে প্রশিক্ষণ দেন । বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সৈনিকগন আমাদেরকে মূলত ‘কনভেশনাল ওয়ার’ এর ট্রেনিং দিয়েছিলেন । ভারতীয় ইন্সট্রাক্টরগন প্রচলিত যুদ্ধ ছাড়াও আমাদেরকে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিংও দেন । গেরিলা যুদ্ধের জন্য ক্ষীপ্রতা ও বিদ্যুৎময় গতি সহ তারা আমাদেরকে Anti Tank মাইন, Anti personnel মাইন এবং Explosive এর সাহায্যে Demolition এর ট্রেনিংও প্রদান করেন । যুদ্ধের মৌলিক কলা-কৌশল সহ দেশের সব আর্মির জন্যই মোটামুটি একই রকম । অবশ্য ভৌগোলিক অবস্থান ও আবহাওয়াগত কারনে Operational plan অনেক সময় প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন হতেই পারে । কিন্তু আমাদের ধারণা, পাকিস্তানি আর্মি এবং ভারতীয় আর্মির মধ্যে মানসিকতার কিছু পার্থক্য আছে । উভয় সেনাবাহিনীই বৃটিশ সেনাবাহিনীর স্টাইলে পেশাগতভাবে চমৎকারভাবে প্রশিক্ষীত । তবে পাকিস্তান বাহিনীকে আমাদের যখন মনে হয়েছে উগ্র, অস্থীর, চঞ্চল এবং ইমোশনাল তখন ভারতীয় বাহিনীকে আমাদের মনে হয়েছে অপেক্ষাকৃত শান্ত, অচঞ্চল ও ধৈর্য্যশীল । হয়তো খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে না, তবুও ভিন্ন ধরণের একটি উদাহরণ দেই । পাকিস্তানিদের স্টাইলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর ইন্সট্রাক্টরগন পিটি-প্যারেড এর সময় কমান্ড দিতেন এভাবে লেফট-রাইট-লেফট, রাইট র্টান, লেফট র্টান, এবাউট টার্ন, কইক মার্চ, ডবল আপ, হলট ইত্যাদি । পক্ষান্তরে ভারতীয় ইন্সট্রাক্টরগন কম্যান্ড দিতেন এভাবে সাবধান, ডানে মোড়, বাঁয়ে মোড়, পিছন ফির, এগিয়ে চল/আগে বাড়, জোর কদম, থাম ইত্যাদি । প্রশিক্ষণের ৪৩তম দিনে আমদেরকে বলা হল যে আমাদের সংক্ষিপ্ত সামরিক ট্রেনিং শেষ হয়েছে । পরদিন হবে প্র্যাকটিকাল ফায়ারিং ট্রেনিং ও টেষ্ট । পরদিন সকালে Fall In এর পর আমাদেরকে মার্চ করে নিয়ে যাওয়া হল ৬/৭ কিলোমিটার দূরে পর্বতময় গভীর এক জংগলে । সেখানে এমন এক স্থানে তাঁবু দিয়ে আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করা ছিল যার এক দিকে ছিল গভীর অরণ্য এবং অন্য দিকে ছিল খাড়া পাহাড় । মাঝখানের স্থানটি সবুজ ঘাসময় একটি সমভূমি । পাহাড়ের গায়ে ২৫/৩০ জন টি স্যুটিং স্পট । সাদা রং এর গোলাকার স্পটগুলোর মাঝখানটা আবার গোলাকার লাল রং দিয়ে তৈরি । স্পটগুলো হতে নির্দিষ্ট দূরত্ত্বে সমতল ভূমির উপর দিয়ে বালির বস্তার উপর রাখা আছে একেকটি ৩০৩ রাইফেল । প্রতি ব্যাচে ২৫/৩০ জন করে প্রশিক্ষণার্থীকে ১০টি করে গুলি দিয়ে হুইসেল দেয়া হত । সাথে সাথে দৌড়ে গিয়ে ম্যাগজিনে গুলি করে বালির বস্তার এপাশে পজিশনে গিয়ে নির্দিষ্ট স্পট লক্ষ করে “ফায়ার” (!) বলার সাথে সাথে পরপর ১০টি গুলি ফায়ার করা চলল । আমরা খুবই উত্তেজিত ছিলাম । কারন দেড় মাসের কঠোর-কঠিন ট্রেনিং এর পর এই প্রথম বাস্তব অনুশীলন এবং তাজা গুলি ফায়ার করার বাস্তব সুযোগ আমরা পেলাম । যাদেরই গুলি করা শেষ তাদেরকেই আবার মার্চ করে নিয়ে যাওয়া হল এমন এক স্থানে যার সামনে একটি বালির বাঁধ এবং বাঁধের অপর দিকটা ৫/৬ ফিট নিচু । এখানে আমাদের সকলের হাতেই দেয়া হলো এজটি করে তাজা HE 36 হ্যান্ড গ্রেনেড । “রেডী” বলার সাথে সাথে ডান হাত দিয়ে লিভার সহ গ্রেনেডটি শক্ত করে ধরে দাঁত দিয়ে সেফটি পিন খুলেই আমরা পজিশনে চলে যেতাম । “চার্জ” বলার সাথে সাথে পেছন হতে হাত ঘুরিয়ে সামনের অদৃশ্য শত্রুকে লক্ষ করে সজোরে আমরা গ্রেনেড ছুড়ে মারতে থাকলাম । ২৫/৩০টি গ্রেনেড একসাথে বিস্ফোরিত হবার যে Impact, কান ফাটানো আওয়াজ এবং বিপুল পরিমান মাটি আকাশে উত্থিত হতে থাকলে সে অপূর্ব দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন । রাইফেল দিয়ে জীবনের প্রথন গুলি ছোড়া ও স্বহস্তে হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করার দারুন অভিজ্ঞতা সহ তৃপ্ত মন নিয়ে সন্ধ্যার কিছু পূর্বে মার্চ করে শৃংখলার সাথে আমরা আবার আমাদের ক্যাম্পে ফিরে এলাম । পরদিন সকালে শুরু হলো সমাপনী কুচকাওয়াজ ।আমাদের ক্যাম্প কমান্ড্যাট কযাপ্তেন সুজাত আলী কুচকাওয়াজ উপভোগ করলেন । আমরা তাকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করলাম । উদ্দীপক ভাষায় তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষন দিলেন । নির্ভেজাল দেশপ্রেম এবং জনগনের জান মালের নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনায় রেখে আমরা যেন প্রদত্ত ট্রেনিং সদ্ব্যবহার করে যুদ্ধে অর্থবহ অবদান রাখতে পারি সে ব্যাপারে তৎপর থাকার জন্য তিনি আমাদেরকে উপদেশ দিলেন । দেশমাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে নির্মূল করে স্বল্পতম সময়ে দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে তিনি আমাদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানালেন । আমাদের সকলের জীবদ্দশায় স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হবে এবং স্বাধীন বাংলায় ফের দেখা হবে এ আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি তার বক্তব্য শেষ করলেন । তার বক্তব্যে পরপরই আমাদেরকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষনটি টেপ রেকর্ডারের মাধ্যমে শুনান হল । সে ভাষন শোনার পর আমরা যেন লাখো শুনে উজ্জীবিত হলাম, অস্থীর হয়ে গেলাম যুদ্ধের ময়দানে পাকিস্তানি বর্বরদের মোকাবেলা করার জন্য । ক্যাপ্টেন সুজাত আলী এরপর আমাদেরকে শপথ বাক্য পাঠ করালেন । বেলা সাড়ে বারোটায় আমাদেরকে সেদিন উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করা হল । বেলা ১২টার মধ্যেই গেটের বাইরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্রাক এর একটি বহর এসে পৌছল । খাওয়া-দাওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এলাকাভিত্তিক ভাগ করা হলো । ততদিনে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার পূরো বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ দান করেছে । প্রধান সেনাপতি হিসেবে আগেই নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী । সদ্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনস্থ ২নং সেক্টরের বিভিন্ন সাব-সেক্টর কমান্ডারদের নিকট পাঠিয়ে দেয়া হল । মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়ে ট্রাকবহর বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল । সাব-সেক্টর কমান্ডারগন নবাগত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অস্ত্র-সজ্জিত করে এবং ব্রিফিং দিয়ে গেরিলা যুদ্ধের জন্য পাঠিয়ে দিবেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, নির্ধারিত অঞ্চলে । সব শেষে ফেনী আঞ্চলের এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আমার কমান্ডে ন্যস্ত করে পাঠিয়ে দেয়া হলো বিলোনিয়া সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জাফর ইমামের নিকট । পালাটাঞ্জা ট্রেনিং ক্যাম্প এর সুখ-দুঃখেরারো কিছু স্মৃতি ঃ ক. পিটি ও ড্রিল এর প্রাথমিক ধকল ঃ ভোর বেলা প্রতিদিন প্রায় ১০ কিলোমিটার দৌড়ানো আমাদের সকলের জন্যই অত্যন্ত কষ্টদায়ক ছিলো । নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস এত ঘন ও গভীর হতো যে, প্রথম প্রথম মনে হতো, নাকের ভেতর থেকে বাতাস বেরুনোর সময় যেন ছুরির আঁচড়ে আঁচড়ে তা ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে । প্রথম দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে, বিশেষ করে ফেরত পথে, অনেককে রাস্তার পাশে লুটিয়ে পড়তে দেখেছি । কিন্তু আমাদেরকে এগিয়ে যেতেই হয়েছে । অবশ্য ১০/১২ দিন পরে এ দৌড় আমাদের প্রায় সকলের কাছেই অনেকটা সহনীয় হয়ে এসেছিল । খ. টয়লেট অভিমুখে শেষ রাতের লাইন ঃ প্রায় ১০০০ প্রশিক্ষণার্থীর জন্য টয়লেট ছিল মাত্র ৩০টি । ভোর বেলা বিউগল বাজার সাথে সাথে ট্রেনিংয়ের জন্য সকলকেই মাঠে সমবেত হতে হত । সুতরাং শেষ রাতের দিকেই, ভোর হওয়ার বেশ আগেই, ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে-হিঁচড়ে আমাদেরকে উঠতেই হত । উঠেই টয়লেট সহ হাত-মুখ ধোয়ার জন্য দাঁড়িয়ে পড়তে হত লাইনে । পরিস্থিতির কারনে, অন্য বন্ধুদের যেন অসুবিধা না হয় বিবেকের সে তাড়নায়, দ্রুততম গতিতে টয়লেট সারার একটা অভ্যাস আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল । তবে ট্রেনিং এর মাঝামাঝি সময়ে অনেকের মধ্যেই আমাশয়ের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল এবং টয়লেট-স্বল্পতার কারনে ভোর রাতে যে লম্বা লাইন হত তাতে তাদের বড় কষ্ট হত । গ. আহলাদী ছেলেটি মারাই গেলো! দূঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আজ মনে পড়ছে ফুটফুটে একটি ছেলের কথা । ছেলেটির বাড়ি ছিল নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জে । সে নবম শ্রেনীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে পালাটানা ট্রেনিং ক্যাম্প এ যোগ দেয় । তার মায়াবী চোখ, সহজ-সরল হাসি এবং অমায়িক ব্যবহার আমাদের সকলকেই মুগ্ধ করত । তার নাম এতোদিন পরে কিছুতেই আর মনে করতে পারছিলা । তবে দু’টো ছোট বোন ছিল । ‘মা’-বাবা, বিশেষত ছোট বোনগুলোর কথা মনে পড়লে প্রায়ই সে বিষন্নতায় আক্রান্ত হতো এবং আকুল কান্নায় ভেঙ পড়ত । আমরাও, নিজের অজান্তেই, সে কান্নায় শরীক হয়ে যেতাম । প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে সেই ছিল সর্ব কনিষ্ঠ এবং একটু আহলাদী ধরণের । ইনষ্ট্রাক্টরা সহ আমরা সকলেই তাকে খুবই স্নেহ করতেম । আমরা তাকে আশ্বস্ত করতে চাইলাম এই বলে যে, ত্রেনিং শেষে যুদ্ধ করে, জালিমদেরকে বাংলার মাটি থেকে তাড়িয়ে, আল্লাহর রহমতে নিশ্চয়ই একদিন আমরা বাংলাদেশকে শত্রু-মুক্ত করব, ছিনিয়ে আনব প্রিয় স্বাধীনতা । সে তখন বীড় বেশে মা’র কোলে ফিরে যেতে পারবে । আমাদের কথায় সে আস্বস্ত হত । বলত, আপনারাও যাবেন আমার সাথে, আমাদের বাড়িতে । আমার মা’র হাতে বানান মজাদার পিঠা, বিশেষ করে নারকেল পিঠা খেলে আপনারা একেবারে পাগল হয়ে যাবেন । নাম ভূলে যাওয়া সে ছেলেটির হঠাৎ আমাশয় হল । ক্যাম্প কোনো ডাক্তার ছিল না । স্থানীয় একজন কম্পাউন্ডার মাঝে-মধ্যে ডাক দিলে আসতো এবং অসুস্থ্যদেরকে ঔষধ দিত । বেশিরভাগ সময়েই ওইসব অষুধে কাজ হতনা । আমাশয় শেষ পর্যন্ত রক্ত আমাশয়ে রূপ নিল এবং মাত্র কয়েকদিনের অসুখেই এক বিষন্ন সন্ধ্যায় ছেলেটি হঠাৎ মারা গেল । সারারাত আমরা তার মৃতদেহ নিয়ে বসে রইলাম । বোবা কান্নায় এবং হাজারো বন্ধুর চোখের জলে সে রাত যে কত কষ্টের, কত বেদনার, কত অসহনীয় এবং দীর্ঘ হয়ে উঠেছিল তা আজ আর কিছুতেই কাগজ-কলম দিয়ে বিমূর্ত করে তোলা যাবেনা । শেষ রাতে আমরা তাকে শেষ গোসল করালাম এবং ফজরের নামাজের পরে জানাজা শেষে এলাকার মুসলমানদের পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহীত করা হল । শোকাহত মন এবং একটি বিশাল শুন্যতা নিয়ে সেদিন আমরা ট্রেনিং ক্যাম্পে ফিরে এসেছিলাম । ছেলেদের মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ সেদিনকার সকালের ট্রেনিং বাতিল ঘোষনা করলেন । সারাটা ক্যাম্প জুড়ে কবরের নিস্তব্দতা । প্রিয়জন হারানোর বেদনা ও শোকে সকলেই যেন নির্বাক ও মুহ্যমান । …। ঘ. চলে গেল জাহাংগীর ও আনসারঃ ট্রেনিংয়ের মাঝামাঝি সময়ে একদিন হঠাৎ আমাদের ক্যাম্পে এসে হাজির হলেন ছাত্রলীগ এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা জনাব আসম আবদুর রব । রব ভাই ক্যাম্প কমান্ড্যান্ট ক্যাপ্টেন সুজাত আলীর সাথে কিছুক্ষন একান্তে কথা বললেন এবং প্রশিক্ষণ একান্তে কথা বললেন এবং প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে দেশকে দ্রুততম সময়ে হানাদার-মুক্ত করে স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এবং বঙ্গবন্ধু’র আজন্ম লালিত স্বপ্ন “সোনার বাংলা” গড়ার জন্য আমাদের উদ্দেশ্য এক জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন । ফিরে যাওয়ার সময় তিনি সাথে করে জাহাঙ্গীর ভাই ও আনসার ভাইকে নিয়ে গেলেন । এরা দু’জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ছাত্র লীগের মধ্যম স্তরের নেতা হওয়ার রব ভাইয়ের সাথে আগে থেকেই ঘনিষ্ঠতা ছিল । পরে শুনেছি অন্যান্য অনেকের সাথে এদের দু’জনকেও Bangladesh Liberation Front তথা BLF এর সদস্য হিসেবে আলাদা ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল । জাহাংগীর ও আনসারের সাথে সেই বিলোনিয়াতে প্রশিক্ষণার্থী সংগ্রহের সময় থেকেই আমার সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে । বাল্যবন্ধু ওয়ালীর পর এদেরও হঠাৎ চলে যাওয়া এবং সর্বকনিষ্ঠ প্রশিক্ষণার্থী ভাইটির অকাল মৃত্যু তাই আমার মনকে বিষাদে আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল । ঙ. গোমতীতে জলকেলি । আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্প এর কাছেই কয়েকটি স্বচ্ছল মুসলমান পরিবারের বাড়ি ছিল । বলা যায়, এলাকায় তারাই ছিল সবচেয়ে ধনী । প্রচুর জমির মালিক তারা । হালের বলদ ছাড়াও তাদের ছিল বিপুল সংখ্যক গরু ও মহিষ । তাছাড়া ছিল অনেক কামলা ও কৃষি-শ্রমিক । তাদের বাড়ির সামনের পুকুরটি ছিল বেশ বড় এবং গভীর । প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল একটি দিঘি । পানি ছিল স্বচ্ছ, স্ফটিকের মতো পরিস্কার । কিন্তু সে পুকুরে গোসল করতে গেলে আমাদেরকে বাধা দেয়া হল । খুবই খারাপ লাগল । তবে সামান্য কিছু দূর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছিল গোমতি নদী, যা ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে কুমিল্লা হয়ে মেঘনা নদীতে গিয়ে মিসেছে । অগত্যা শিক্ষাণবিস মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়ে ‘গোমতী’ নদীতেই চলে গেলাম । আমাদের ট্রেনিং সেন্টার থেকে গোমতী বেশ খরস্রোতা । বহতা নদীতে সাঁতার কাটা আমার অনেক দিনের শখ । গোমতীর পানির স্রোত তীব্র হলেও বেশ পরিষ্কার । ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত সকলে মিলে খুব করে সাঁতার কাটলাম । প্রবাহমান জলে স্নান করে দেহ-মন প্রশান্তিতে ভরে গেল । এভাবে দু’একদিন পরপরই আমরা গোমতীতে জলকেলীতে মত্ত হয়ে যেতাম । সবুজের অবারিত বিস্তৃতি ও নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশে কুলকুলু রবে প্রবাহিত পাহাড়ী নদীর স্বচ্ছ ও শীতল পানিতে প্রাণ ভরে অবগাহন করার মধ্যে যে কী অপার আনন্দ ছিল তা আজ শুধু কল্পনাতেই মানায় । কেন সেই মুসলমান পরিবারগুলো তাদের বাধানো ঘাটের দিঘিতে আমাদেরকে গোসল করতে বারণ করল? কারণ জেনেছি অনেক পরে । ভারতের ওই অঞ্চলের ধন্নাঢ্য পরিবার ছিল তারা । যাকে বলে গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান ও পুকুর ভরা মাছ । বাড়ির পূর্ব অংশে পুকুরের উত্তরাংশে তাদের পারিবারিক কবরস্থান আর দক্ষিনাংশে সমজিদ । বাড়ী-ঘর, মসজিদ, টয়লেট সবই পাকা । পরিপূর্ণ সামজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা ভোগ করেছে তারা । এক কথায় সুখী ও সমৃদ্ধশালী বেশ বড় কয়েকটি পরিবার । তবে এতসব সত্বেও ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়াতে তারা এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে । সম্ভবত সব দেশের সব সংখ্যালঘুদের মধ্যেই এধরণের নিরাপত্তাহীনতা ও হীনমন্যতাবধ কাজ করে । এসব কারনেই পাকিস্তানের অখন্ডতা ও অস্তিত্বের ব্যাপারে তারা একটু হলেও উদ্বিগ্ন ছিল । ভারতের সহায়তায় ত্রেনিং নিয়ে, যুদ্ধ করে, পাকিস্তান ভেঙে আমরা বাংলাদেশ গড়র- এ কারনে তারা আমাদের প্রতি অসন্তষ্ট ছিল । মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বেশিরভাগই নিয়মিত নামাজ-কালেমা পড়ত । শুক্রবারে প্রায় সকলেই দল বেধে আমরা সেই মুসলমান বাড়ির মসজিদে জু’মার নামাজ পড়তে যেতাম । প্রথম দিন তারা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল । যেন পূর্ব বাংলার মুসলমানরা শুধুই বাঙালি, মুসলমান নয় ! বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার স্থান সংকুলানের জন্য তারা মসজিদের সামনে বাঁশ-ছন দিয়ে আচ্ছাদন তৈরি করল । পরবর্তী জু’মার দিনগুলতে তারা আমাদেরকে হাসি মুখে এবং প্রসন্ন চিত্তে বরণ করত । এমনকি তাদের পুকুরে গোসল করার জন্যও আমন্ত্রন জানাল এবং আগের রুঢ় আচরনের জন্য দুঃখ পেকাশ করল। ক্রমে তাদের সাথে আমাদের আন্তরিক একটা সম্পর্ক গড়ে উঠল । মসজিদে দেয়া শিন্নি (ফিরনি) খেতে খেতে আমি যখন আমাদের ভাষার ব্যাপারে পাকিস্তানিদের নগ্ন হামলা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য, হত্যা, ধর্ষন, অগ্নিসংযোগ এবং ভিবিন্ন প্রকারের নির্যতনের কথা বললাম, তখন তারা সত্যিই ব্যথিত হল ।পাকিস্তানি মুসলিম সেনাবাহিনী কর্তৃক হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালি বালিকা, কিশোরী, যুবতী ও বৃদ্ধাদেরকে নির্বিচারে ধর্ষনের কথা যখন বললাম, তারা ‘আসতাগফিরুল্লা’, ‘নাউযুবিল্লাহ’ বলে হাহাকার করে উঠল । মুসলমান হয়ে ইসলামের নামে এবং পাকিস্তানের অখন্ডতার নামে নারী ধর্ষন ? ! পাকিস্তানের ‘বরবাদি’ আর বেশি দিন বাঁকি নেই- মন্তব্য মসজিদের বয়োজৈষ্ঠ ইমাম সাহেবের । পাকিস্তানিদের প্রতি তারা শুধু ধিক্কারই জানালোনা, আমাদের প্রতিও হয়ে উঠল সহানুভূতিশীল । পরবর্তীতে জু’মার নামাজ শেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দোয়াও করা হত । ডাইলে যখন পানি দিতে শিখেছি । ‘গোমতী’তে গোসল শেষে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প যখন আমরা ফিরতাম তখন ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করত । গোগ্রাসে চলত খাওয়ার পালা । কি খেতাম আমরা? একটু বর্ণনা দেই । সকালে পিটি- প্যারেডের পর এক মগ চা ও একটি আতার রুটি অথবা এক স্লাইস ভারি পাউরুটি । সারা দিনের ট্রেনিং এর পর দুপুরে বড় চামুচের এক চামুচ ভাত ও ছোট এক চামুচ লাবড়া টাইপের তরকারি । বিকেলের ট্রেনিং এর পর সন্ধ্যায় এক চামুচ ডাল এবং একটি বড় সাইজের আটার রুটি । ভাত ছিল রাবারের মতো মোটা চাউলের । ভাত এবং রুটিতে প্রায়ই বিভিন্ন রং এবং বিভিন্ন সাইজের প্রচুর পোকা পাওয়া যেতো । আপত্তি সত্বেও ক্ষুধার তাড়নায় চোখ বন্ধ করে সেই খাবারই আমাদেরকে খেতে হত । তাছাড়া বিবেকেও খরচ করতাম আমরা । আমরা বুঝার চেষ্টা করতাম যে, আমাদের দেশ বেদখল হয়ে গেছে । সেখানে চলছে অমানবিক কর্মকান্ড, হত্যা, ধর্ষন, লুটতরাজ সহ ধ্বংশযজ্ঞ । ভারতে আমরা অন্তত আশ্রয় পেয়েছি, ট্রেনিং পাচ্ছি এবং গুনগতমান সহ মূল্যবান অস্ত্রশস্ত্র ও গোলা বারুদ ।আমাদের কমান্ড্যাট কযাপ্টেন সুজাত আলীও এই পরিস্থিতিতে এর চাইতে বেশি আর কি-ইবা করতে পারেন! আমরা এতাও বুঝার চেষ্টা করতাম যে, ভারত সরকার ও ভারতীয় জনগন বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, ফ্রি রেশন দিচ্ছে, স্বাধীন বাংলা সরকারকে তাদের কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে সর্বপ্রকার সহায়তা দিচ্ছে না । না দিলে কোথায় যেতাম আমরা? সূতরাং লা-জওয়াব ! কিন্তু একদিন সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল । গোমতি-ফেরত ছেলেরা খেতে বসে হৈ চৈ শুরু করে দিল । উল্টে ফেলে দিল এক হাঁড়ি ভাত । চিল্লাচিল্লির এক পর্যায়ে শুরু হল মিছিল ও শ্লোগান । ছুটে গেলাম । দেখি, ভারতের মধ্যে অসংখ্য ছোট ছোট কালো শক্ত পোকা । সংখ্যায় কম হলেও গা শিউরে উঠার মতো নরম এবং সাদা এক ধরনের লম্বা পোকাও ভাতের মধ্যে বিদ্যমান । যে ডাল আমরা খেতাম, সব সময়ই তা ছিল অতীব পাতলা । কিন্তু আজকের ডাল দেখে মনে হচ্ছে হালকা হলুদাভ গোমতি নদীর টলটলে পানি ‘। ছেলেরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা । কিছুতেই এ ধরনের খাবার তারা আর খাবেনা । ক্যাম্প কমান্ড্যাট আমাকে সহ সব কোম্পানি কমান্ডারদেরকে ডেকে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার দায়িত্ব দিলেন । আমরা সবাই ব্যর্থ হলাম । ক্যাম্প কমান্ড্যান্টের এক ভাই আমাদের ক্যাম্পে থাকতেন । তিনি ছিলেন একজন হেডমাষ্টার । মাষ্টার সাহেব হঠাৎ রেগে গেলেন এবং সবাইকে তীব্র ভাষায় তাদের আচরনের জন্য বকা-ঝকা শুরু করলেন । ফল হল বিপরীত । ছেলেরা আরো বিক্ষুদ্ধ হয়ে গেল এবং লংগরখানায় ভাংচুর শুরু করে দিল । ছেলেদেরকে শান্ত করার সব চেষ্টা যখন ব্যর্থ হল তখন কেন জানিনা সকলে মিলে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার একক দায়িত্ব আমার উপর আমার উপর চাপাল । ভয়ানক এ পরিস্থিতিতে ছেলেদের শান্ত করতে যাওয়াটাও ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ । কিন্তু কিছুতো একটা করতেই হবে । এটা একদমই ঠিক যে, অল্প সময়েই মিলিটারী ট্রেনিং শেষ করতে হবে বলে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বিরতিহীন ভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল । অথচ খাবারের পরিমান ও গুনগত মান ছিল খুবই অপ্রতুল ও নিম্ন । পরিশ্রান্ত শরীরের চাহিদার তুলনায় এ খাবার একেবারেই অপর্যাপ্ত । শুধুমাত্র দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতার জন্য দৃঢ় সংকল্প সহ প্রাণের আকুলতার কারনেই মাটি কামড়ে আমরা এখানে পড়ে আছি, নিচ্ছি কঠিন অনুশীলন ও কষ্টকর সামরিক প্রশিক্ষণ । আহা, দেশপ্রেমের এ প্রণোদনা আর স্বদেশের তরে জীবন উৎসর্গ করার প্রত্যয়দীপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের এ আত্মত্যাগ বুঝবেতো পরবর্তী প্রজন্ম, যাদের হাতে ঘাম, রক্ত আর অবর্ননীয় কষ্ট মাখা প্রিয় স্বাধীনতা আমরা তুলে দিয়ে যাবো? বেশি চিন্তার অবকাশ ছিলনা । ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম বিক্ষদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের জটলার দিকে । একা । হাতে হাতল ভাঙা একটা কাঠের চেয়ার । কাছে গিয়ে চেয়ারটা রাখলাম মাটিতে এবং উঠে দাঁড়ালাম তার উপর । এরপর বঙ্গবন্ধু কণ্ঠ নকল করে শুএউ করলাম এক অগ্নিধরা জ্বালাময়ী বক্তৃতা । কিছুক্ষণ পর চেঁচামেচি ও শ্লোগান বন্ধ হয়ে গেলো । পাকিস্তানি হারামী ও জালিমরা কীভাবে আমাদের ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি উপর আঘাত হেনেছে, কতো নির্মমভাবে অর্থনৈতিকভাবে শোষন করেছে, রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত করেছে এবং জাতি ও মানুষ হিসেবে পদে পদে বাঙ্গালিদেরকে অপমান, অপদস্থ করেছে গোল হয়ে দাঁড়াল । পৌরুষদীপ্ত শৌর্য-বির্য আর আকাশ সমান নিয়ে বাঙালি মাটি থেকে তারানোর বজ্র কঠীন শপথ নেয়ার উদাত্ত আহবান জানালাম । এরপর বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষনের আদলে দরাজ গলায় বললাম ঃ “ডাইলে যখন পানি দিতে শিখেছি, আরো পানি মিশাব, প্রয়োজনে আমৃত্যু না খেয়েই বাংলার মাটিকে শত্রু-মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ” । পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল ।
তুমুল করতালি হলো। শ্লোগানে শ্লোগানে মুক্তিযোদ্ধারা গলা ফাটাল “জয় বাংলা,” বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো, তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা, জয় বাংলা ইত্যাদি। সংকট কেটে গেল। টলটলে পানির মত ডাল দিয়ে পোকা ভর্তি মোটা চালের রাবারের মত ঠান্ডা দূগন্ধযুক্ত ভাত খেয়ে মালকোঁচা এঁটে মুক্তিসেনারা সুশৃংখলভাবে মাঠে গিয়ে দাঁড়াল প্রশিক্ষনের জন্য। আজ আর ভাগ্যে বিশ্রান নেই। কারন ভাতের পোকা মাকড় আর ডালের পানির জটিলতা নিয়ে অনেকে মূল্যবান সময় হারিয়ে গেছ। সময় হয়ে গেছে বৈকালিক প্রশিক্ষনের! ছ. স্বাধিন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানঃ প্রতি সন্ধ্যায় মাঠের মাঝখানে একটি ছোট্র গোল টেবিলে এনে রাখা হত একটি রেডিও।ক্যাপ্টেন সুজাত আলী আমাদের জন্য এটি কিনেছিলেন। সন্ধ্যার পর সুজাত আলী সাহেব, ইন্সট্রাক্টরগন এবং আমরা সকলেই গোল হয়ে বসে পড়তাম এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতাম।প্রবাসী মুজিবনগর সরকার কতৃক সাম্রিক বিবেচনায় পূরো বাংলাদেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগকরে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ, সেক্টরের অধীনস্থ বিভিন্ন রনাঙ্গনের সংবাদ, বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সফল অভিযান, ন্তুন মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ এবং তাদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা, শ্রী দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় পঠিত খবরের মধ্যে শরনার্থীদের সমস্যা, দেশে-বিদেশে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের জনমত গঠন, কুটনৈতিক তৎপরতা ও প্রশাসনিক নির্দেশনা সহ দেশাত্মবোধক গান শুনতাম। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের নেতা- কর্মীদের দ্বারা পাকিস্তানের পক্ষে দালালী এবং বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী তৎপরতা, রাজাকার ও শান্তি কমিটি সহ (না) পাক বাহিনীর নৃশ্নগসতা ও বর্বরতার খবরাখবরও আমরা শুনতাম। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ঢাকাইয়া ভাষায় জনাব এম.আর.আখতার মুকুল পঠিত “চরমপএ “ আমাদেরকে খুবই আনন্দ দিত। চরমপত্রর দু’একটি নমুনা পাঠকদের উপভোগের জন্য এখানে তউলে ধরছিঃ ঢাকা শহ্রে আবার পইট কারবার হইছে। খবর পাইয়া গবর্নর ঠ্যাটা মালেক্যার কি কাপুনি? বেডার ফুলপ্যান্ট অক্ক্রে ভিইজ্যা গ্যাছে। এই বিচ্চুগুলা মানুষ না আর কিছু? এরা আইয়ুব খানের পেয়ারা প্রাক্তন গবর্নর মোনায়েম খাঁ –রে মার্ডার করছুইন। বুধবার রাইতে মাত্র দুইজন বিচ্ছু এই করবার করছে। সাত বছরের গবর্নর মোনাইম্যারে বিচ্ছুগুলা খোদ ঢাকা টাউনে মেরামত কইর্যা ফেলাইছে।লগে লগে মছুয়ারা বেডারে মেডিকলে আনছিলো। হারা রাইত ধইর্যা দম খিচতে খিচতে বৃসসুদবার আল্লার রাইত পোহানের লগে লগে মোনাইম্যায় অক্করে ফ্যাল পাইড়া আজরাইল ফেরেশতার দরবারে যিয়া ‘ইয়েচ ছ্যার’ কইছুইন’। … আতঁকা আমাগো ঢাকার গবর্নমেন্ট হাউসে ঠাস কইর্যাই একটি আওয়াজ হইলো। ডরাইয়েন না, ডরাইয়েন না। ব্রিগেডিয়ার বশীরের কাছ থাইক্যা তেলিফোনে মোনাইম্যার মার্ডার হওনের খবর পাইয়া ঠ্যাটা মালেক্যা চেয়ার থনে চিত্তর হইয়া পইড়া গেছিলেন । …এই দিককার কারবার হুনছেন নি? লন্ডনের সানডে টাইমস মতিঝেলে বিচ্চুগুলো যে বোমাবাজী করছে তার ফডো ছাপাইয়া দিছে । ছদর ইয়াহিয়ার কি রাগ! ঢাকার গবর্ণমেন্ট হাউসের পোয়া মাইলের মাইদ্দে এই রকম কারবার কেতমে হইলো? জেনারেল পিঁয়াজি, ঠ্যাটা মালেক্যায় কি বইস্যা বইস্যা গাব দিতাছে নাকি? Sunday Times এর এক সাদা চামড়ার আংরেজ রিপোর্টার বঙ্গাল মুলুকের হগগল রিপোর্ট আর পিকচার বগলদাবা কইর্যা অক্করে লন্ডনে যাইয়া হাজির । ব্যাডায় লিখছে, খোদ ঢাকা টাউন আর তার আশেপাশে বিচ্চুগুলোর বেশুমার কারবার চলতেছে । পরায় আটশ’বিচ্চু এই কামের মধ্যে লাইগ্যা পড়ছে । দিনকা দিন হেইগুলোর লম্বর বাইড়্যা যাইতেছে । সাদা চামড়া দেইখ্যা জেনারেল রাও ফরমান আলী অক্করে খুশিতে গুলগুল্লা! বযাডায় একটুক ঘোরাঘুরি করবার পারমিশন দিছিলো । ব্যাস উলডা কারবার হইয়া গেছে । আংরেজের বাচ্চায় লিখখিস, ঢাকায় মছুয়ারা কতকগুলো কাঠের মিস্ত্রী ধইর্যা নিয়া রাইত দিন লম্বা লম্বা সাইজের বাকস বানাইতাছে । হানাদার অফিসাররা পটল তোলনের লগে লগে এইসব বাকসের মাইদ্দে ভইর্যা সব লাশ পাকিস্তানে পাডাইতাছে । পি.আই.এ. লাশ-ঢওয়াইন্যা খেপ মারতে মারতে অস্থির হইয়া উঠছে । Sunday Times-এর রিপোর্টার আর একটা জব্বর কথা কইছে । বঙ্গলা মুলুকে এখন এক লাখ বিচ্চু ইচ্ছামত কারবার চলতাছে । আর মুচয়ারা বাংকারের মধ্যে বইস্যা খালি ইয়া নফসি করতাছে । এই দিকে গেল এতোয়ারের রাইতে রেডিও গায়েবী আওয়াজ অক্করে কাপে-কাপের কারবার কইরা বইছে । এক ব্যাডায় লেকচার দেওনের টাইমে কইছে, ‘হানাদার সোলজারগো শ্যাষ পর্যন্ত পালাইতেই হইবো । এগো Mind খুবই দুবলা । এরা হগগলেই ভেড়ুয়া মার্কা । কেইসডা কি? হাতি ঘোড়া গেল তল, মালেক্যায় বলে কত জল? জেনারেল ওমর, জেনারেল মিঠঠা খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল তিক্কার মতো ব্যাডার থুড়ি মাইরা বাহাত্তুর ঘন্টার মাইদ্দে বঙ্গাল মুলুক দখল করবো বইল্যা যে চাপাবাজী করছিল হেই ওমর, মিঠঠা, পীরজাদা, টিক্কা হগগলেই লেজ গুটাইয়া রাওয়ালপিন্ডিতে ভাগছে । সব মওলবী সা’বেই অখন বঙ্গাল মুলুকের বেলায় Deaf & Dumb স্কুলের হেডমাষ্টার হইছে । এলায় ভোদাই ঠ্যাটা মালেক্যারে সামনে দিয়া জেনারেল পিঁয়াজী, জেনারেল ফরম্যান, জেনারেল রহিম, ব্রিগেডিয়ার ফকির মোহাম্মদ, ব্রিগেডিয়ার আতা, রিয়ার এডমিয়াল শরিফ মাঠে নামছে ।
লগে লগে ছল্লাৎ কির্যা খালি আওয়াজ হইতাছে। মাঠ খুবই পিছলা কিনা- তাই ব্যাডারা খালি আছাড় খাইতাছে। আর মেজর সিদ্দিক সালেক সমানে Hand Out আর Press Note ছাড়তাছে। বিচ্চুগুলার কারবারের খবর আইলেই ‘হিন্দুস্তানীরা করছে’ কইতে হইবো। আইজ কাইল আবার নয়া ভ্যাস ধরছে।Publicity দেওনের টাইমে কইতাছে ইন্ডিয়া আর বিচ্চুরা মিইল্যা কারবার করতাছে। মছুয়াগুলা আখেরি দম ছাড়নের খবর আইলেই বাঙালি মাইয়া আর গেদা পোলা মারতাছে কইয়া বোগাচ Publicity দিতাছে। কিন্তুক কোনাডাই আর কামে আইতাছে না। সকাল-দুপুর-বিকাল-রাইত রেডি ও গায়েবী আওয়াজে খালি কাঁন্দাকাটির আওয়াজ। গেছি- গেছি,বিচ্চুরা কোবাইয়া মারলোরে, কোবাইয়া মারলো। নোয়াখালী- ফেনী, কুমিল্লা- ময়নামতী, আখাউড়া- শালদিয়া ছাতক- সুনামগঞ্জ এলাকায় দিন কয়েক ধইর্যান বিচ্চুগুলার গাজুরিয়া মাইর শুরু হইয়া গেছে। মছুয়াগুলার ভাগনের রাস্তা পর্যন্ত বন্ধ। অনেক জায়গায় বিচ্চুরা মছুয়াগো ঘেরাও দিয়া বইয়া আছে- দেখি দানাপানি ছাড়া কয়দিন চিরকিৎ রাখতে পারো। এইদিনকার কারবার হুঞ্ছেন নি? বিচ্চুগুলা আইজ-কাইল ‘দমাদম মস্ত কা লান্দর’ কাম শুরু কির্যা। দিছে। এতো কইর্যা আংরেজ গো না করতাম বঙ্গালা মুলুকে ব্যবসা বনিজ্যডা দুই চাইর মাস একটু ক্ষ্যান্ত দাও। নাঃ- তাগো চিরকিৎ হইছিল। ‘সিটি অব সেন্ট আলবানস’ নামে আংরেজগো একটা জাহাজ হাঁটি হাঁটি পা- পা কইর্যান যেই চালনা বন্দরের কাছে গেছে, অমনেই শুরু হইলো গুম গুমা গুম। কি হইলো? কী হইলো? এই বন্দরের বগল দিয়া না মছুয়ারা আছিলো? তা হইলে বিচ্চুরা আইলো কই থাইক্যা?ও মাই গড! পোলাপানে তা’ হইলে মছুয়া মাইর্যাক সাবাড় করতাছে। এইডা ভিয়েত্নাম থাইক্যাও ডেইনগারাস। খবর নাই, পাতি নাই খালি কোবাড়া যাইতাছে। এই না কইয়া আংরেজ জাহাজটা লেংড়াইতে লেংড়াইতে কোনো মতে কইলকাত্তার দিকে গ্যাছেগা। অ্যাঃ অয়াঃ। ঢাকা টাউনে বিচ্চুগুলার কুফা কারবার সামনে চলতাছে। রেডিও গায়েবী আওয়াজের একজন মছুয়া ইঞ্জিনিয়ার পটল তুলছে। বায়তুল মোকাররমের সামনে বোমা মাইর্যাম পাঁচজন দালাল হালাক হইছে। ঠ্যাটা মালাক্যয় ভয়ে অক্করে থর থর কইর্যাে কাঁপতে শুরু করছে। গবর্নমেন্ট পাবলিসিটির কবি আবুল হোসেন সা’ব, একটুকু হিসাব কইর্যা চইলেন। আপনে যেমন লাগে আইজ- কাইল দৌড়াদৌড়ি বেশি করতাছেন। …আরে এইটা কি? এইটা কি? আমাগো বকশি বাজারের নাড়ুয়া ছক্কু মিয়া কাঁদতাছে কীর লাইগ্যা? কী হইছে? আমাগো ছক্কুরে মারলো কেডা? পরনের তপন দিয়া নাক চোখের পানি মুইছ্যা ছক্কু কইলো, ‘ভাই সা’ব, বিচ্চুরা এর মাইদ্দেই ঠ্যাটা মালেক্যার পেয়ারা আল সামস আলবদরের কোবায়া তকতা বানাইছে। মওলবী বাজারের কসাইরা যেমতে, কইর্যা খাসীর চাম খোলে,বিচ্চুরা সামস-বদরের হেইরকম কারবার কইরা ফেলাইছে। লাশের অক্করে পাহাড় হইয়া গেছে। আমি কইলাম ‘আবে এই ছক্কু-কেইসডা একটুক খুইল্যা ক’। আমিতো আল সামস আর আলবদরে চিনতে পারলাম না। এইগুলা কি জিনিষ? ছক্কু গলার মইদ্দে একটা জোর খ্যাকরানি দিয়া কইলো, ‘ভাইসা’ব আপনে আখন্ব আন্ধারের মাইদ্দে রিছেন। ঠ্যাটা মালেক্যায় রাজাকারগো ঠিক মতন ঠাহর করনের লাইগ্যা একেক জেলায় একেক নাম দিতাছে। সামস আর বদর হইতাছে জামাতে ইসলামীর ট্রেনিং দেওয়া রাজাকার কোম্পানির নাম। ঢাকার গর্ভণমেণ্ট হাউসের বিলেক বোর্ডের মাইদ্দে এই সব নাম লেখা রইছে। বিচ্চুগুলার ঘষাঘষীর কারবার হইলে চক দিয়া বোর্ডের মাইদ্দে লিইখ্যা থোয় ৮ই নভেম্বর আল- শামসের ২৬২ জন কইম্যা গেল। ৯ই নভেম্বর আল বদরের ১৯২ জন ছারেন্ডার করলো। পাবলিকের ভোগা মারনের লাইগ্যা রাজাকারগো ইসলামী নাম দিয়া গোলাম আজম-ঠ্যাটা মালেক্যা- পিয়াজী কি খুশি? কিন্তুক অখন বোর্ডের মাইদ্দে চক দিয়া লম্বর লেখতে লেখতে মওলবীসা’বগো হাত খড়ি মাটির গুড়ায় সাদা হইয়া গ্যাছে। অ্যাঃ অ্যাঃ! চুষ পায়জামার জেলা সিলেটে হাসপাতালের মাইদ্দে জখমি মছুয়াগো আর জায়গা হইতাছে না। এইদিকে কুমিল্লা সেক্টরে বিচ্চুগুলা গ্রামের পর গ্রাম মিক্ত করতাছে। গ্রাম-শহর, নগর-বন্দর, ন্দী- নালা হগগল জায়গায় হাজারে হাজারে বিচ্চু খালি মছুয়াগো ধাওয়াইয়া বেড়াইতাছে। পাইলেই মাইর, পাইলেই মাইর। চাইর দিকে আওয়াজ উঠছে ‘জিন্না মিয়ার পাকিস্তান-আজিমপুরের গোরস্থান’। হের লাইগ্যাই কইছিলাম কেইসটা কি? আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর। ছেরাবেরা। অক্ক্রে ছেরাবেরা। বঙ্গাল মুলুকে হানাদার সোলজারগো অবস্থা অক্করে ছেরাবেরা হইয়া গ্যাছে। এক রামে রক্ষা নাই, সুগ্রিব দোসর। হাজারে হাজার বাঙালি বিচ্চুগো গাবুর মাইরের চোটে যখন সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়া সোরজারগো হালুয়া অক্করে টাইট হইয়া গ্যাছে, ঠিক হেই টাইমে মিত্র বাহিনী আইস্যা, আরে মাইর রে মাইর! ওয়ান্ড- এর বেষ্ট মছুয়া এয়ার ফোর্স পয়লা দিনা দুই কুচকাচ কইর্যাা অক্করে জমিনের মাইদ্দে হমান হইয়া গ্যাছে। এয়ার মাইদ্দে কড়া কিছিমের কারবার কইর্যাে হানাদার সোলজারগো মেরামত করেছে। আতঁকা আমাগো ছক্কু মিয়া কইলো , ভাইসা’ব আমার বুক্টা ফাইট্যা খালি কান্দন আইতাছে।ডাইনা মুড়া চাইয়া দেহেন। ওইগুলা কী খাড়াইয়া রইছে। কী লজ্জা! কী লজ্জা! মাথাডা এয়াংগেল কইর্যান তেরছী নজর মারতেই দেহীকী, শও কয়েক মছুয়া অক্করে চাউয়ার বাপ মানে দিগম্বর সাধু হইয়া খাড়াইয়া রইছে। ব্রিগেডিয়ার বশীর জিগাইলো ‘তুম লোগকো কাপড় কিধার গিয়া?’ জবাব আইলো-যশোর সার্ট, মাগুরায় গেঞ্জী, গোয়ালন্দে ফুলপ্যান্ট আর আরিচার আন্ডার ওয়ার থুইয়া বাকী রাস্তা খালি চিল্লাইতে চিল্লাইতে আইছি-‘হায় ইয়াহিয়া, ইয়ে তুমনে কেয়া কিয়া?- হামলোগ তো আভি নাংগা মছুয়া বন পিয়া। কি পোলারে বাঘে খাইলো? শ্যাষ। আইজ থাইখ্যা বঙ্গাল মুলুকে মছুয়াগো রাজত্ব শেষ। ঠাস কইয়্যা আওয়াজ হইলো। কি হইলো? কি হইলো । ঢাকাক্যান্টমেন্টে পিয়াজী সা’বে চেয়ার থনে চিত্ত্র হইয়া পইয়া গেছিলো। আট হাজার আষ্টশ’ চুরাশি দেন আগে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট তারিখে মুছলমান- মুছলমান ভাই ভাই কইয়া, করাচী- লাহুর পিন্ডির মছুয়া মহারাজ্রা বঙ্গাল মুলুকে যে রাজত্ব কায়েম করছিল, আইজ তার ‘খতম তারাবী হইয়া হেল।বাঙ্গালী পোলাপান বিচ্চুরা দুইশ পয়ষষ্টি দিন ধইর্যার বঙ্গাল মুলুকের ক্যাদো আর প্যাঁকের মাইদ্দে World-এর Best পাইটিং ফোর্সগো পাইয়া,আরে বাড়িরে বাড়ি। ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়াগুলা ঘঁৎ ঘঁৎ আতকা আমাগো চক বাজারের ছক্কু মিয়া ফাল পাইড়্যা উডলো, ‘ভাইসা’ব, আমগো চক বাজারের চৌ- রাস্তার মাইদ্দে পাথর দিয়া একটা সাইনবোর্ড বানামু। হেইডার মাইদ্দে কাউলারে দিয়া লেখাইয়া দিয়া লেখাইয়া লমু,১৯৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গাল মুলুকে মছুয়া নামে এক কিছিমের মাল আছিলো। হেগো চোটপাট বাইড়া যাওনের গতিকে হাজারে হাজার বাঙালি বিচ্চু হেগো চুটিয়া-মানে কিনা পিঁপড়ার মতো ডইল্যা শেষ করছিল। এই কিছিমের গেনজামেরি কেতাবের মাইদ্দে লিইখ্যা থুইছে ‘পিপীলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে’। ঢিক্কা- মালেক্যা গেল তল, পিঁয়াজ বলে কত জন? …. সেনাপতি ইয়াহিয়া খান যখন আন্তাজ করতি পারলো যে, কোনো ট্রিকসই আর কাম হইতাছে না, তকখ পাকিস্তান আর বঙ্গাল মুলুকের লাড়াইডারে ইন্ডিয়া- পাকিস্তানের গেনজম বইল্যা চালু করনের লাইগ্যা ভট কইর্যায় বইলো, ‘আমি কিন্তু আর নিজেরে আটকাইয়া রাখতে পারতেছিনা,আমার লগে নতুন মামু রইছে, বুড়ো চাচা রইছে। আমি ইন্ডিয়া Attack করমু’। দিনা দশেকের মাইদ্দে আমি একবার করমু। এইবার আমি নিজেই পিন্ডির থনে বর্ডারে যামুগা। যেই কাথা, হেই কাম। মাথার Upper Chamber খালি ছদর ইয়াহিয়া-যা থাকে ডুঙ্গির কপালে কইয়া কারবার কইর্যাদ বইলো। কিন্তু মওলবী সা’বরে আর Border এ যাইতে হইলো না।
আতঁকা শরাবন তহুরার গিলাস টেবিলের উপর ঠকক্কিরা থুইয়া দ্যাহে কী লাড়াই রাওয়ালপিন্ডার দরজায় আইস্যা হাজির হইছে। পাশে আজরাইল ফেরেশতা খাতা হাতে খাড়াইয়া রইছে। খাতায় লেখা সাদাপাকা মোটা মোটা ভূরু- ওয়ালা আগা মোহাম্মাদ ইয়াহিয়া খান,পিতা UnKnown. এইদিকার খবর হুনছেন নি? সবই হবুর কারবার। হবু পেরধান মন্ত্রী চুরুল আমীন, হবু দেশরক্ষা মন্ত্রী মিয়া মোমতাজ মোহাম্মদ দৌলতানা, হবু যোগাযোগ মন্ত্রী আগায় খান পাছায় খান খান আব্দুল কাইয়ুম খান,হবু পোষ্টাপিসের মন্ত্রী ইসলামের যম গোলাম আজম আর হবু ফরিন মিনিস্টার মদারু ডুট্রো। কেউই শপথ লইতে পারে নাইকা- টাইম শর্ট। বঙ্গাল মুলুকের বিচ্চুগো গাজুরিয়া মাইর শুরু হইয়া গেছে। ঠ্যাটা ম্যালেক্যার কী কাঁপন! মওলবী সা’বে বাংকারের মাইদ্দে বইস্যা বল পয়েন্ট কলম দিয়া গবর্নরের পদ থাইক্যা ইস্তফা দিছে। এরেই কয় ঠ্যালার নাম জশমত আলো মোল্লা। বাডয় তার স্যাঙ্গাৎগো লইয়া কী সোন্দর হোটেল Intercontinenral এর মাইদ্দে হান্দাইছে। কিন্তু মওলবী সা’ব বহুত লেইট কইর্যাo ফেলাইছে। আপনার ঘেটুগো খবর কি? ছহি আজাদ পত্রিকার হরলিক্সের বোতল ছৈয়দ ছাহাদৎ হোসেন, মর্নিং নিউজের এসজিএম বদরুদ্দিন, ছালাউদ্দিন মোহাম্মদ, সংগ্রাম পত্রিকার মাওলানা আখতার ফারুক্যা, দৈনিক পাকিস্তানের আহসান আহম্মদ আশক, পাকিস্তান অবজার্ভারের খাসির গুদার শুরুয়া খাওইয়্যা মাহবুবুল হাক, নেশন্যাল বুরোর দাঁড়ি নাই মাওলানা ডাঃ হাসান জামান, খোন্দাকার আবুল হামিদ এসব মালেরা অখন কি করবো? প্রাত্তন ফরিন মিনিস্টার হরিবল হাক চৌধুরীর কোন খবর নাইক্যা- সিলেটের হারু মাল চুষ পাজামা মাহমুদ আলীর কোনো আও- শব্দ পাওয়া যাইতাছে না। কি হইলো? এদ্দিন তো শাহ মোহাম্মদ আজিজুর রহমান আর দরদী সংঘের দালাল সম্রাট এ. টি. সাদ’দিরে লঅয়া খুবই তো ফাল পাড়াতাছিলা- মাল- পানি জিন্দাবাদ। এলায় হের করবা কি? আমার সাজানো বাগান হুকায়া গেল। অ্যাঃ এয়াঃ একটিং জাতিসংঘে মদারু ভুট্রো জেনারেল পিঁয়াজীর ছারেন্ডারের খবর পাইয়া একটিং করেছে।পয়লা গরম, তারপর গরম, হেরপর আরে কান্দনের কান্দন! পকেটের রুমাল বাইর কইর্যা চোখ মুইচ্ছ্যা নাক Clear কইরা লইলো। চিল্লাইয়া কইলো, ‘ছারেন্ডার- ছারেন্ডার তো I Impos- অসম্ভব। আমরা ছারেন্ডার করমু না। আমি পাইট করমু’। এই না কইয়া মদারু মহারাজ আতঁকা গতরের জামাকাপড় থুড়ি- ফ্রান্স-বৃটেনের খসড়া প্রস্তাব টুকরা কইর্যাট ছিইড়্যা ফেলাইয়া ঘেটমেট কইর্যাা বাইরাইয়া গেল। বাইরাইনের টাইমে ইন্ডিয়া-রাশিয়ার লগে ফ্রান্স-বৃটেনেরে তুফান গাইল, সাদা চামড়ার জান্টেল্ম্যান্রা খালি কইলো, ‘যার লাইগ্যা চুরি করি,হেই কয় চুর’।
জাতিসংঘ থাইক্যা আগাশাহীর রুমে আহনের লগে লগে মওলবী সা’ব খবর পাইলো, ‘খেইল খতম, পয়সা হজম।আট হাজার আষ্টশ চুরাশী দিনের সোনার হাঁস, মানে কিনা বঙ্গাল মুকুলসহ পাকিস্তান নামে দেশটা শ্যাষ হইয়া গেছে। আমগো ছক্কু মিয়া একটা গুয়ামরি হাসি দিয়া গালটার মাইদ্দে খ্যাকরানি মারলো। কইলো, ‘ভাই সা’ব ২৬শে মার্চ এই মদারু ভুট্রো ঢাকার থনে করাচীতে ভাগোয়াট হইয়া এলান করছিল,আল্লায় সারাইছে,ছদর ইয়াহিয়া বেশুমার বাঙালি মার্ডারের অর্ডার দেওনের গতিকে পাকিস্তানডা বাইচ্যা গেল। এলায় কেমন বুঝতাছেন? বিচ্চুগো বাড়ির চোটে হেই পাকিস্তান কেমতে কিইর্যাত ফাঁকিস্তান হইয়া গেল? হেইর লাইগ্যা কইছিলাম, কি পোলারে বাঘে খাইলো?শ্যাষ। অইজ থাইক্যা বঙ্গাল মুলুকে মছুয়াগো রাজত্ব শ্যাষ। আইজ ১৬ই ডিসেম্বর।চরমপত্রের শ্যাষের দিন। আপনাগো বান্দার নাম কইয়া যাই। বান্দার নাম এম আর আখতার মুকুল। আমাদেরকে, মুক্তিযোদ্ধোদেরকে,এবং বাংলাদেশের ভিতরে- বাইরে কোটি কোটি বাঙ্গালিকে যা সবচে’বেশি উজ্জিবীত করতো,মনোবল জাগাত,আগুনের মতো তাঁতিয়ে তুলত এবং স্বদেশ ভূমিকে শত্রু-মুক্ত করার অদম্য সাহস ও প্রেরনা জোগাত তা হল “ব্জ্র কন্থ”। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ দু’টো শব্দ ভেসে আসত ‘ব্জ্র কন্থ’। পরমুহুর্তেই ক্ষনিকের জন্য ঝন ঝনাত ধরনের এক রকম রনবাদ্য বেজে উঠত এবং জলদগম্ভীর কন্থে ভেসে আসত বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়কার বিভিন্ন ভাষণ ও স্বাক্ষাতকারের ছোট ছোট অংশ। বজ্রকন্ঠের সময় অনেককে তড়াক করে লাফিয়ে উথতে,দাঁত কড়মড় করতে, মাঠে বসা অবস্থায় মাতিতে জোরেশোরে বেদ্ম কিল মারতে এবং অতি উত্তেজনায় ‘জয় বাংলা’ জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে গলা ফাটাতে দেখেছি। ব্জ্র কণ্ঠ আমাদেরকে যেন Electricuted করত। পরবর্তীতে যুদ্ধ ক্ষেত্রে, বাংকারে বসে যখন ভরাট গলার ‘ব্জ্রকন্থ’ শুন্তাম, রক্তে আগুন ধরে যেতো। মনে হতো, এটিই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত দিক নির্দেশনা ও প্রকৃত ক্কম্যান্ড।তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আর বজ্রকণ্ঠর ইতিহাস এক ও অবিভাষ্য। মন চাইতো লাফিয়ে উঠে তখনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে। চরমভাবে উত্তেজক ও উদ্দীপক ‘বজ্রকন্ঠের’ দু’ একটি নমুনাঃ ১। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাঙ্গালার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়; ২। ২৩ বছরের করুন ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস- এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ৩। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। আমরা ব্যাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাওয়া চেষ্টা করেছি তখনি তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
৪। কী পেলাম আমরা? আমরা পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমন থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমরা দেশের গরীব- দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে। তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। ৫। আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের উপর হত্যা করে হয়- তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রিল,প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে ‘শ্ত্রুর’ মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি- তোমরা বন্ধ করে দেবে।নির্দিধায় বলা যায় যে, এটি ছিলো আমাদের জন্য এ অঞ্চলের ভারতীয়দের একটি বড় রকমের ত্যাগ। এ প্রসঙ্গে আরো দু’টো ক্তহা বলা প্রয়োজন। প্রথমত, বাংলাদেশ কবে স্বাধীন ৬। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো।— সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবানা।আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবেনা। ৭। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। ৮। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। প্রতিবেশী ভারতীয়দের উদারতা ও সহ্নদয়তাঃ আমাদের প্রশক্ষিন ক্যাম্পটি পালাটানা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন ও মাঠে স্থাপিত। অনিবার্য কারনেই স্কুলটি অনিদির্ষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য পালাটানা এলাকার শিশুদের পড়াশোনা বন্ধ।নির্দিধায় বলা যায় যে, এটি ছিল আমাদের জন্য এ অঞ্চলের ভারতীয়দের একটি বড় রকমের ত্যাগ। এ প্রসঙ্গে আরো দু’টো কথা বলা প্রয়োজন। প্রথমত, বাংলাদেশ কবে স্বাধীন হবে সে ব্যাপারে তখনো পর্যন্ত কারো কোনো ধারনাই ছিল না। স্বাধীনতার জন্য একটা দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ে আমরা জড়িয়ে পড়েছিলাম। শত্রু- মুক্ত করে দেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আমাদের বছরের পর বছর, এমনকি ১০/১৫ বছর ও লেগে যেতে পারে এভাবেই প্রশিক্ষনকারীন সময়ে আমাদেরকে বলা হচ্ছিল। ভারতীয়রা ও তাই মনে করত। সুতরাং ঐ অনিশ্চয়তার মধ্যেও আমাদেরকে সাদরে বরণ করা, আশ্রয় দেয়া, আমাদেরকে প্রশিক্ষনের জন্য স্বতস্ফূর্তভাবে বাচ্চাদেরকে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেয়া নিশ্চয়ই অনেক বড় মানসিকতা ও উদারতা ছাড়া ও এটি ছিল বড় রকমের উৎসর্গ ও ত্যাগ। দ্বিতীয়ত সমগ্র ভারতে এরকম হাজার হাজার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ বন্ধ করে দিয়ে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং ও লক্ষ লক্ষ শরনার্থীর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখানে স্মরন করা যেতে পারে যে, যুদ্ধের ভয়াভতা,অত্যাচার, নির্যাতন এবং জীবন-সম্পদ-সম্ভমের অনিশ্চয়তার কারনে প্রায় এক কোটি ব্যাঙালি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো। থাকার আশ্রয় ছাড়াও এদের প্রায় সকলের জন্যি রেশনের মাধ্যমে চাল-ডাল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিনা মূল্যে সরবারহ করা হত। এসবের জন্য ভারত সরকার এবং ভারতের জনগনের কী পরিমান অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছিল তার মোটামুটি একটা হিসাব হয়তো বের করা যাবে। কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারতের কী পরিমান ক্ষতি হচ্ছিল তা ছিল হিসেব- নিকেশের অনেক উর্ধে। ফিরে আসি পালাটানায়। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে, বিশেষ করে আসাম ও ত্রিপুরায় কাঁঠালও চিনি-চম্পা কলা বেজায় সস্তা। ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি এবং টাকা পয়সার অভাবের কারনে এক কোঁস কাঁঠাল খাওয়ার ভাগ্য আমাদের ছিলনা। অথচ ক্যাম্পে বসেই আমরা আশে পাশে থাকা গাছ- পাঁকা কাঁঠালের মো-মো সুগন্ধ অনুভব করতাম। অনেক্কে এ ব্যাপারে আফসোস করতেও শুনেছি। কাঁঠালের সম্মন্ধীয় ব্যাপারে ছেলেদের এ আফসোস, অতৃপ্তি ও হাহাকারের কথা কীভাবে জানি বাইরে জানাজানি হয়ে গেল। এ-কান সে- কান হতে হতে ছোট বিষয়টি পুরা এলাকায় আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হলো। শেষ পর্যন্ত একদিন সকালে এলাকার প্রতিটি পরিবারের পক্ষ থেকেই ক্যাম্পের গেটে কাঁঠাল পাঠান শুরু হল। এ ব্যাপারে প্রচার ও সমন্বয়ের দায়ীত্ব পালন করল স্থানীয় যুবকগন। কাঁঠালের স্তুপ বাড়তে বাড়তে তা ছোট খাটো একটি পাহাড়ের রূপ নিলো। এলাকার জনগণের আন্তরিক অনুরোধে এবং ক্যাম্প কমান্ড্যান্টের অনুমতি ক্রমে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি প্রশিক্ষনাথীকে একটি করে কাঁঠাল প্রদাব করা হল। অপার্যপ্ত খাবার ও কঠোর পরিশ্রমের ফলে ছেলেদের শরীর-মন প্রায় শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ দিন ধরে একবারের তরে ও ফলমূলও দুধ- মিষ্টি খাওয়া হয়নি তাদের। সুতরাং উপহার হিসেবে পাওয়া সুমিষ্ট ও রসালো সেই কাঁঠাল আমরা খেলাম পেট পুরে ও প্রান ভরে। সে-যে কী তৃপ্তিদায়ক এক ব্যাপার ছিল তা আজ আর কিছুতেই বোঝানো যাবে না। তৃপ্তিতে,আনন্দেও কৃতজ্ঞতায় মন্টা ভরে গিয়েছিল। ঝ. বানরের বাঁদরামি। ট্রেনিং শেষে, যুদ্ধ- যাত্রার পূর্বে, আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পাহাড় বেষ্টিত এক গভীর অরন্যে। সেখানে আমরা রাইফেল, এসএলার, এলএমজিও স্টেন গান দিয়ে গুলি করে এবং গ্রেনেড ছুড়ে অস্ত্র চালনার ব্যাপারে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম। তবে ট্রেনিং সেন্টার থেকে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ফায়ারিং রেঞ্জ এ যাত্রার এক পর্যায়ে আমরা যখন ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাম তখনই এক অভাবনীয় ঘটনা। আমরা ‘সিংগেল লাইনে’ এগুচ্ছিলাম। চারদিকে ছোট-বড় হরেক রকম গাছের ঘন অরণ্য। গাছের ঘনত্ব এত বেশি ছিল যে সুর্যের আলো পুরোপুরি দেখা যাচ্ছিল না। বিরাজ করছিলো এক ধরনের আলো- আধাঁরের পরিবেশ।
যে, যুদ্ধের ভয়াভতা,অত্যাচার, নির্যাতন এবং জীবন-সম্পদ-সম্ভমের অনিশ্চয়তার কারনে প্রায় এক কোটি ব্যাঙালি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো। থাকার আশ্রয় ছাড়াও এদের প্রায় সকলের জন্যি রেশনের মাধ্যমে চাল-ডাল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিনা মূল্যে সরবারহ করা হত। এসবের জন্য ভারত সরকার এবং ভারতের জনগনের কী পরিমান অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছিল তার মোটামুটি একটা হিসাব হয়তো বের করা যাবে। কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারতের কী পরিমান ক্ষতি হচ্ছিল তা ছিল হিসেব- নিকেশের অনেক উর্ধে। ফিরে আসি পালাটানায়। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে, বিশেষ করে আসাম ও ত্রিপুরায় কাঁঠালও চিনি-চম্পা কলা বেজায় সস্তা। ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি এবং টাকা পয়সার অভাবের কারনে এক কোঁস কাঁঠাল খাওয়ার ভাগ্য আমাদের ছিলনা। অথচ ক্যাম্পে বসেই আমরা আশে পাশে থাকা গাছ- পাঁকা কাঁঠালের মো-মো সুগন্ধ অনুভব করতাম। অনেক্কে এ ব্যাপারে আফসোস করতেও শুনেছি। কাঁঠালের সম্মন্ধীয় ব্যাপারে ছেলেদের এ আফসোস, অতৃপ্তি ও হাহাকারের কথা কীভাবে জানি বাইরে জানাজানি হয়ে গেল। এ-কান সে- কান হতে হতে ছোট বিষয়টি পুরা এলাকায় আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হলো। শেষ পর্যন্ত একদিন সকালে এলাকার প্রতিটি পরিবারের পক্ষ থেকেই ক্যাম্পের গেটে কাঁঠাল পাঠান শুরু হল। এ ব্যাপারে প্রচার ও সমন্বয়ের দায়ীত্ব পালন করল স্থানীয় যুবকগন। কাঁঠালের স্তুপ বাড়তে বাড়তে তা ছোট খাটো একটি পাহাড়ের রূপ নিলো। এলাকার জনগণের আন্তরিক অনুরোধে এবং ক্যাম্প কমান্ড্যান্টের অনুমতি ক্রমে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি প্রশিক্ষনাথীকে একটি করে কাঁঠাল প্রদাব করা হল। অপার্যপ্ত খাবার ও কঠোর পরিশ্রমের ফলে ছেলেদের শরীর-মন প্রায় শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ দিন ধরে একবারের তরে ও ফলমূলও দুধ- মিষ্টি খাওয়া হয়নি তাদের। সুতরাং উপহার হিসেবে পাওয়া সুমিষ্ট ও রসালো সেই কাঁঠাল আমরা খেলাম পেট পুরে ও প্রান ভরে। সে-যে কী তৃপ্তিদায়ক এক ব্যাপার ছিল তা আজ আর কিছুতেই বোঝানো যাবে না। তৃপ্তিতে,আনন্দেও কৃতজ্ঞতায় মন্টা ভরে গিয়েছিল। ঝ. বানরের বাঁদরামি। ট্রেনিং শেষে, যুদ্ধ- যাত্রার পূর্বে, আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পাহাড় বেষ্টিত এক গভীর অরন্যে। সেখানে আমরা রাইফেল, এসএলার, এলএমজিও স্টেন গান দিয়ে গুলি করে এবং গ্রেনেড ছুড়ে অস্ত্র চালনার ব্যাপারে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম। তবে ট্রেনিং সেন্টার থেকে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ফায়ারিং রেঞ্জ এ যাত্রার এক পর্যায়ে আমরা যখন ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাম তখনই এক অভাবনীয় ঘটনা। আমরা ‘সিংগেল লাইনে’ এগুচ্ছিলাম। চারদিকে ছোট-বড় হরেক রকম গাছের ঘন অরণ্য। গাছের ঘনত্ব এত বেশি ছিল যে সুর্যের আলো পুরোপুরি দেখা যাচ্ছিল না। বিরাজ করছিলো এক ধরনের আলো- আধাঁরের পরিবেশ।
ঝরা পাতার উপর দিয়ে হাঁটার সময় মুচ-মুচ ধরনের এক প্রকার শব্দ হচ্ছিল। তার সাথে যুক্ত হয়েছিল নাম-না-জানা অসংখ্যা পাখির কুজন এবং কখনো –কখনো পলায়নপর ভীত-সন্ত্রস্থ পাখিকূলের ডানার আওয়াজ ও ভয়- পাওয়া ডাক। কাঠবিড়ালীর সংখ্যা প্রচুর। ধূসর রং এর কাঠবিড়লী ছাড়াও বিভিন্ন রং ও বর্নের বিরল প্রজাতীর কাঠবিড়ালী ছিল দেখার মত। ২/৩ কিলমিটার গভীরে যাওয়ার পরই ঘটলো অভূতপূর্ব ও অদ্ভূত সে ঘটনা।পদ-যাত্রার এ পর্যায়ে চলার পথে দেখা গেল ৬/৭ টি বানর,আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক বিস্ময়ে। যতই চলতে লাগলাম ততই তাদের সংখ্যা বাড়তে লাগল।বানরদের মধ্যে কেউ কেউ নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে আমাদের ডানে,বাঁয়ে ও সামনে দিয়ে আমাদের মতো একই গতিতে হেঁটে এগিয়ে চলছে।বানদের আরেকটি অংশ আমাদের মাথার উপর দিয়ে গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।এক গাছ থেকে আরেক গাছে এবং এক ডাল থেকে আরেক ডালে অবলিলাক্রমে ও নিপুনভাবে তারা লাফ দিয়ে দিয়ে এগুতে লাগল।গাছ থেকে থেকে গাছে এবং ঝুলন্ত ডাল থেকে আরেক ডালে তাদের চলার গতি এতো অবাধ ও নিখুঁত ছিল যে তা আমাদেরকে সতিই অবাক করল।এক পর্যায়ে আমাদের মনে হল যে সাম্নে,দানে,বায়ে এবং উপর দিয়ে বানরেরা যেন আমাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু কিছুক্ষন পর কিচির-মিচির শব্দ করে তারা হঠাৎ অতি দ্রুত গতিতে সামনের দিকে-চলে গেল। কেন এভাবে তারা চলে গেল? কে জানে! বান্রের কান্ড- কারখানা এবং হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে করতে আমরা এই গতিতে এগিয়ে চলেছি। প্রকৃতি নীরব ও প্রশান্ত। মিনিট চল্লিশেক পর হঠাৎ ডান, বাম ও উপরের গাছে আবার দেখা গেল অসংখ্য-অগনিত বানর। আগের তুলনায় এখানে এদের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। দাঁত বের করে খেক- খেক করে হাসছে আর দুহাত দিয়ে একযোগে করতালি দিচ্ছে তারা। কিছু বানর আবার গাছের পাতা ছিঁড়ে আলতোভাবে নিচের দিকে ছেড়ে দিচ্ছে। ছেঁড়া পাতা আমাদের মাথায় ও শরীরে এসে পড়েছে। বিষয়টি আজ আমাকে ভাবিয়ে তোলে।এ কি শুধুই বান্রের বাঁদরামি ছিল? মনে পড়ে, ব্যক্তিগতভাবে সেই সময় আমি বিস্মিত, রোমাঞ্চিত ও পুলকিত বোধ করেছিলাম। বানরকুল অবশ্য আর অগ্রসর হয়নি। আমাদের চলার গতি ছিল অবিচ্ছিন্ন ও বিরতীহীন। এক সময় আমরা পৌভহে গেলাম আমাদের গন্তব্যস্থল-ফায়ারিং রেঞ্জ এ। কিন্তু ভুলতে পারছিলাম না বানর কুলের অপ্রত্যাশিত ও অব্যখ্যাত বন্ধুসুলভ আচরনের অনন্যসাধারন এ বিষয়টি। ঞ. মাগার কোন শালা পায়দা কিয়াঃ আবহাওয়া যেদিন ভাল থাকতো সেদিন খাওয়া দাওয়া এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্টানমালা শোনার পর ও আমরা মাঠে বসে আড্ডা দিতাম, সুখ-দুঃখের গল্প করতাম। ফেলে আসা স্বদেশ ভূমি এবং মা-বাবা-ভাই- বোন-বন্ধু-বান্ধবদের কথা, যুদ্ধ- যাত্রার জন্য প্রবাসে কঠর -কঠীন সামরিক প্রশিক্ষনের কথা, দেশের অভ্যন্তরে ও সীমান্ত এলাকায় চলমান যুদ্ধের কথা, বঙ্গবন্ধুর কথা, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা,হানাদার বাহিনীকে না মেরে কীভাবে ধরে প্যাঁদানো দেয়া যায় এবং সর্বোপরি স্বদেশের স্বাধীনতার কথা আলাপে উঠে আসত। পরিবেশ যখন ভারী হয়ে উঠতো, মন যখন খারাপ হয়ে যেতো তখন কেউ কেউ এহিয়ে আসত তাদের রসালো কেচ্ছা- কাহিনী- গল্প ও কৌতুকের ডালি নিয়ে। সবাই মিলে খুব হাসতাম। আমোদজনক একটা পরিবেশ তৈরি হত। প্রফুল্ল মন নিয়ে ঘুমাতে যেতাম। যারা রসাত্বক গল্প এবমগ দ্ম- ফাটানো হাসির কৌতুক পরিবেশ্ন করত, তাদের মধ্যে অন্যত্ম ছিলো হাদী। ২২/২৩ বছরের হাদী পেশায় ছিলো একজন ফেরিওয়ালা।গ্রাম-গঞ্জের হাট বাজারে ঘুরে ঘুরে সে বিক্রি করত বাতের বড়ি ও চির ক্রিমির ঔষধ। হাটের দৃশের মত হাদীকে মাঝখানে রেখে আমরা চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়াতাম, আর হাদী দারুন রসিকতা ও দক্ষতার সাথে বাতের বড়িও কৃমির ঔষধ বিক্রির অভিনয় করত। আমরা তা দারুন ভাবে উপভোগ করতাম। কৃএিম ভাবে পেট ফুলিয়ে সে যখন কৃমির ঔষধের প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা বনর্না করত তখন আন্রা হেসে গড়িয়ে পড়তাম। বুড়োদের গেঁটে বাত, আম বাত, শির বাত সহ হরেক রকম বাতের অসুখের মহৌষধ হিসেবে বাটিকাগুলো বিক্রি করার সময় বাতের ব্যাথায় মুখ বিকৃত করে সে যখন কঁকিয়ে উঠত তখন আমরা কি যে মজা পেতেম তা বনর্না করার সাধ্য আমার নেই। হাদীর কণ্ঠ ও কণ্ঠের উচ্চারন, ছন্দ,তাল ও লয় ছিল অপূর্ব। অর্ধ- শিক্ষিত এ ছেলেটি এলুয়মিনিয়ামের খাওয়ার প্লেট উপুর করে তার উপরে হাতের দশ আংগুল দিয়ে তব্লার খই ফুটিয়ে এক্টার পর একটা গান গাইত,তখন আমরা তন্ময় হয়ে উপভোগ করতাম। রবীন্দ্র,নজরুল,পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, আধুনিক, জারী গান, সারী গান—সব গানি সে গাইতো। যেন তালিমপ্রাপ্ত সুশিক্ষিত ও প্রশিক্ষত একজন পেশাদার একজন গুনী শিল্পী। এক জোৎস্নালোকিত মনোরম সন্ধ্যায় আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনছিলাম। খবরে বলা হচ্ছিল, পাকিস্তান বর্বর বাহিনী কর্তৃক মা-বোন –স্ত্রীদের নির্মম ও হ্নদয়বিদারক ধর্ষনের কথা। এ জানোয়ারা কোনো কোনো অঞ্চলে এমনকি বৃদ্ধাও শিশুদেরকেও রেহাই দিচ্ছে না। হাদী নিরবে উঠে চলে গেল তার ব্যারাকে। বসে গেল কাগজ কলম নিয়ে। লিখে ফেলল একটা কাওয়ালী। পরর্বতী ৩ দিন মাঠের এক কোনে ৬/৭ জন সাথী নিয়ে চললো তার রচিত কাওয়ালীর সুর সৃজন, তালিম ও রিহার্স্যাল। চতুর্থ দিন ‘কাওয়ালী’ হাদী তার দল বল নিয়ে থালার তবলা সহ বসে পড়ল মাঠের মাঝখানে। স্বরচিত কাওয়ালী শোনাবে সে। প্রথমে আ-আ-আ-আ-করে ২/৩ মিনিট গলা সাধল। তারপর মিনিট খানেক গলা সাধার পর শুরু হলো তার এবং তার দলের কাওয়ালী। কী গলা! কী গাওয়ার ঢং!পরিবেশনার কী মুনশীয়ানা!এক কথায় অসাধারন। অপূর্ব। কাওয়ালীর দু’একটি লাইন আজো আমার মনে পড়েঃ হাদীতো শাদী কারকে বিদেশ মে আ- গিয়া ইধার খবর আয়া মেরা এক লেড়কী পায়দা হো- গিয়া মাগার কোন শালা পায়দা কিয়া তেল্যা চোরামে খালিয়া- হ্যায় হায়, তেল্যা চোরামে খালিয়া হায়, তেল্যা চোরামে খালিয়া! ‘তেল্যা চোরামে খালিয়া হায়’ বলতে বলতে হাদী ও তার দল তবলা এবং হাত- তালি বাদ দিয়ে ডান হাত দিয়ে আলতো করে বাম বুকে থাবড়াতে লাগল। এতে বুকের উপরকার সমবেত আওয়াজের আবেদন আর কাওয়ালীর বানীর মর্মকথা মিলে একটি উপভোগ্য, কিন্তু করুন ও বিষন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হলো। এক সম য় কাওয়ালী শেষ হল। কিন্তু হতবাক হয়ে আমরা দেখলাম, হাদীর দু’চোখে অশ্রুর বন্যা। ট্রেনিং শেষে হাদীকে আমার কোম্পানীতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। পরবর্তীতে তাকে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট্র ‘সি’ কোম্পানিতে নায়েব সুবেদার সেকান্দার সাহেব এর অধীনে ন্যস্ত করা হল। মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তির পরে স্বাধীন বাংলাদেশে পূর্নগঠিত ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে হাদী রয়ে গেলো। যতদূর শুনেছি পরবর্তীতে সুবেদার হিসেবে হাদী আর্মি থেকে অবসর নিয়েছে। জানিনা গুনী ও স্পর্শকাতর হ্নদয়ের শিল্পী, কঠিন, অবিচল ও দূর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা হাদী সহ অন্য প্রশিক্ষনার্থী বন্ধু ও সহ যোদ্ধাগন আজ কোথায়।
গোলাম মুস্তাফা জন্ম’২০শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫০’ ফেনী। আলী আজম হাই স্কুল, ফেনী ৯১৯৬৮)। ১৯৭০ সালে ফেনী কলেজ থেকে এইচএসসি। ১৯৭৬ সালে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ মাস্টার্স।গর্বিত রোটারিয়ান গোলাম মুস্তাফা মানুষকে ভালোবেসে সমাজের কম ভাগ্যবান্দের ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট। ২০১৩-২০১৪ সালের জন্য তিনি বেটারি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর নির্বাচিত গভর্নর। একাত্তের গোলাম মুস্তাফা ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সাথে গনযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করেন। কমান্ডিং স্টাফ অফিসার ও পাইওনিয়ার প্লাটুনে একাংশের কমান্ডার হিসেবে মিক্তুযুদ্ধে বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
Ref: স্বাধীনতা মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া