বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘজীবী হােক
সূর্য ঘােষাল
সেই খুব ছেলেবেলায় পড়েছিলাম সতেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা—কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল ইত্যাদি। আর কবিতাটির প্রতি স্তবকের শেষ লাইন
‘সে আমাদের বাঙলাদেশ
আমাদের এই বাঙলা রে।
তারপর কত ঘটনা ঘটেছে। দেশ ভাগ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ লিখতে বাঙলাদেশ কথাটা কখন ভুলেই গিয়েছি। সীমান্তের ওপারের অঞ্চলটাকে পূর্ব পাকিস্তান’ বলতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। এধারে বয়সও বেড়েছে, প্রথম যৌবনের সেই আবেগমুগ্ধ মনও আর নেই। এমন সময় হঠাৎ বাঙলাদেশের স্বাধীন সরকারের পূর্ব পাকিস্তানের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ’ রাখার ঘােষণার সমস্ত অনুভূতি যেন অকস্মাৎ ঝনঝন করে বেজে উঠল । অতীতের বিস্মৃত ভাবাবেগ যেন দুকূল ছাপিয়ে চিন্তা ভাবনা সবকিছুকে একাকার করে দিয়ে গেল। বহুকালের হারানাে আবেগকে আবার যেন ফিরে পেলাম।
সীমান্তের এক অতি নির্জন প্রান্তে সিমেন্ট দিয়ে গাঁথা পােস্টের মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে । ছিলাম। পােস্টারটি ওধারে লেখা পাকিস্তান আর এধারে লেখা পাকিস্তান আর এধারে লেখা ইন্ডিয়া। একটা জমির আলের ওপর পােস্টটা। জমিটা পতিত। ওপারের জমিটাতেও ক’ বছর চাষ হয়নি। চৈত্রশেষের কালবৈশাখীর বৃষ্টিতে পায়ের পাতা ডােবা ঘাস হয়েছে দুটো জমিতেই। সামনে পেছনে মাঠময় বাবলাগাছ, কোথাও বা আম কি কাঁঠালের বাগান, জমির আলে এখানে সেখানে আশ-শেওড়া, মাঠের গাছে গাছে নানান ধরনের পাখির কিচির-মিচির। ওপারে মেঠো রাস্তা দিয়ে একখানা টোপর-ঘেরা গােরুর গাড়ি যাচ্ছে, চারপাঁচ জন লােক হনহন করে কোথায় চলেছে। এপারে আমার পেছনেই এক যুদ্ধ মুসলমান চাষি ‘হেই’ ‘হেই’ করে জমিতে লাঙল ডাকাচ্ছে, পেছন থেকে ভেসে আসছে চৈত্র-গাজনের ঢাকের ড্যাং ড্যাং শব্দ, আর এই সবকিছু মিলে মুখের সামনে আদিম বাঙলার শান্ত সরুপদ্রব রূপটি যেন প্রকাশিত হয়ে বয়েছে।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বাঙলাদেশের তিনজন মানুষ। এঁদের মধ্যে একজন মাত্র দু বছর বয়সে পঃ বাঙলা ছেড়ে গিয়েছিলেন, আর দুজন জীবনে এই প্রথম আসছেন হিন্দুস্তানে। এঁদের মধ্যে একজন মেহেরপুরের মহকুমা আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, অপর দুজনও আওয়ামী লীগের কর্মী। তিনজনেরই চোখে মুখে ভয় উৎকণ্ঠা উত্তেজনা। এঁদের মধ্যে যিনি দু বছর বয়সে চলে গিয়েছিলেন তিনি। সেই বিস্মৃত গ্রামের অজানা আত্মীয়স্বজনদের কাছে চলেছেন মেয়েদের রাখার কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখতে।
‘কিন্তু মেয়েদের সরাবেন কেন? আপনি হলেন একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী। আপনী যদি মেয়েদের সরান তাে অন্য লােকে কী করবে? তারা ত ভয়ে সব পালিয়ে আসবে? ‘কী করব বলুন? আমার বাড়িটা মেহেরপুর-চুয়াডাঙার পাকা সড়কের ধারে। আমার না সরালে কোন উপায় নেই।
‘কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সরাবেন কেন? নিজের দেশে আশেপাশের গ্রামে রাখুন।
ভদ্রলােক চুপ করে রইলেন। আমি একটু থেমে জিজ্ঞেস করলাম ফ্রন্টে গিয়েছেন? নিজে যুদ্ধ করেছেন?’
‘না, আমরা ঠিক যুদ্ধ করিনি? তবে চুয়াডাঙা, কুষ্টিয়া এইসব জায়গায় তৈরি হচ্ছি। কালও দুশাে জনকে পাঠিয়েছি বিভিন্ন গ্রাম থেকে।
‘আপনারা চলে এলে যুদ্ধ করবে কে? ‘আমরা তাে আসব না। শুধু মেয়েদের সরিয়ে দেব। ‘আচ্ছা যুদ্ধটা কীরকম হচ্ছে একটু বােঝাতে পারেন?
ভদ্রলােক বললেন, ‘ওরা শহরগুলাের ওপর বােমা ফেলে সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। আর পাকা রাস্তা ধরে ট্রাক-বােঝাই সৈন্য নিয়ে এগুচ্ছে। পথের দুধারের গ্রামগুলাে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে, আর জীবন্ত মানুষ সবাইকেই প্রায় মেরে ফেলছে।
‘এর বিরুদ্ধে কিভাবে আপনারা দাঁড়াবেন ভাবছেন?
‘আমাদের লােক রয়েছে, মনােবল রয়েছে, কিন্তু অস্ত্র নাই। অস্ত্র পেলে আমরা ভয় করি না। এখন দরকার অ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফট গান আর কামান।
‘কিন্তু কোনাে দেশ যদি এগুলাে না দেয় তাহলেও যুদ্ধ আপনারা নিজে চালাতে পারবেন?
ভদ্রলােক চুপ করে রইলেন। বললেন, ‘বােমাতেই সব গােলমাল করে দিচ্ছে। বােমাকে ঠেকাব কী করে?
আমি বললাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সমগ্র পৃথিবীতে যা বােমাবর্ষণ হয়েছে আমেরিকা এই ক বছরে ভিয়েতনামে বােমাবর্ষণ করেছে তার চেয়ে বেশি। কিন্তু তবু আমেরিকা সেখানে জিততে পারছে না কেন?
ভদ্রলােক আবার নীরব, আমি বললাম পৃথিবীতে যুগে যুগে মানুষের অভ্যুত্থানের ইতিহাস আলােচনা করলে দেখা যায় সংগ্রামের সূচনায় নিপীড়িত মানুষের হাতে অস্ত্র বিশেষ থাকেই না। দাস-বিদ্রোহের যুগে রােমানদের তুলনায় দাসেদের কি ভালাে অস্ত্র ছিল? সামন্ত-যুগে কৃষক বিদ্রোহের সময় কৃষকদের হাতেই বা কী অস্ত্র ছিল? ফরাসী বিপ্লবের সময়, রুশ বিপ্লবের সময় অস্ত্র কোনাে সমস্যা সৃষ্টি করেনি। সংগ্রামের একটা স্তরে শত্রুর অস্ত্রই জনগণের হাতে এসে যায়। বিপ্লবের আগে অস্ত্র নিয়ে মাথা ঘামায় সন্ত্রাসবাদীরা সেই জন্যে অস্ত্রের ব্যাপারটা আমার মাথায় ঠিক ঢুকছে না। আমি ভাবছি আপনারা মিটিং, মিছিল, সমাবেশ অর্থাৎ জনসাধারণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে যােদ্ধা গ্রুপ গঠন প্রভৃতি না করে আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন? পাকি সৈন্য তাে এখন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ? এখানে এলে কী করে ঠেকাবেন সেটাই প্রধান সমস্যা নয় কি?
ভদ্রলােক যে কোনাে কারণেই হােক আর কথা বাড়াতে চাইলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, সীমান্ত দিয়ে। ঢােকায় কোনাে বিপদ আছে কিনা? তারপর চলে এলেন।
মনটা এমনিতে বিরক্ত ছিল, আরও বিরক্ত হয়ে উঠল বিরক্ত ছিল কারণ রেডিয়াের প্রচার, খবরের কাগজের গরম গরম লেখা সত্ত্বেও সীমান্ত ঘুরতে এসে হতাশ হয়েছি। হতাশ হয়েছি এই জন্যে যে এপারওপার কোনাে দিকেরই সাধারণ মানুষের কাছে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির এই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে রাজনৈতিক বক্তব্য কোনাে দলই তুলে ধরছে না। এপারের সাস্তুহারা ছেলেদের দু-একজনের মুখে শুনেছি ‘ঠিক হইছে। যেমন একদিন আমাগাে দাড়াইছিল…।
জবাবও শুনেছি—“না রে মানুষ বিপদে পড়ছে…।
বয়স্ক মানুষকে বলতে শুনেছি, যা হয় হােক, এখন যাওয়া-আসা, ব্যবসা-বাণিজ্য চালু হইলে মঙ্গল।
ছাত্রদের মিছিলে ধ্বনি শুনেছি, তােমার দেশ আমার দেশ বাঙলাদেশ।
সীমান্তের গ্রামগুলােয় জিজ্ঞেস করেছি, তােমরা ভােট দিয়েছ কাকে?
‘বামপন্থী দলকে। আমাদের এখানে এবার অমুক জিতেছে।
‘বাঙলাদেশের যুদ্ধ নিয়ে কোন মিটিং হয়নি?
না মাশায়। ভােটের পর আর কেউ আসেনি।
রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের দেখেছি রিলিফ নিয়ে ব্যস্ত।
অথচ এই মুহূর্তে বাঙলাদেশে যা ঘটছে ইতিহাসে তার কি কোন তুলনা আছে? ইতিহাসে যারা সুপণ্ডিত তারা এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবেন। কিন্তু আমার ভাসা-ভাসাজ্ঞান নিয়ে আমি দেখছি আফগানিস্তান থেকে ব্রহ্মদেশ, হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত বিস্তৃত এই বিশাল উপমহাদেশ যা সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তান নামে দুই ভূখণ্ডে বিভক্ত, এই অঞ্চলে স্মরণাতীতকালের মধ্যে এইটাই হলাে সবচেয়ে প্রবলভাবে উত্থিত জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম। নিজেদের ভাষা, নিজেদের সংস্কৃতি, নিজেদের ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ যুদ্ধ করছে পৃথিবীর সর্বাধুনিক মরণাস্ত্রে সজ্জিত একদল হানাদারের বিরুদ্ধে, যারা এই মানুষদের ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, স্বাধীনতার আকাঙ্খ সবকিছু ধ্বংস করে দিতে চায়।
এর সঙ্গে কিসের তুলনা চলে? মােঘল যুগে মারাঠা কি রাজপুতদের সংগ্রাম? মৌর্য যুগ কি গুপ্ত যুগের আঞ্চলিক বিদ্রোহ? ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কোন অধ্যায়?
বােধ হয় না। এত ব্যাপক মানুষ নিয়ে এত বড় অভ্যুত্থান বােধহয় অতীতে আর কখনও হয়নি।
আর এই বিরাট রাজনৈতিক সংগ্রামকে কিছু ওষুধ, টাকা রিলিফ দিয়ে কি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, যদি তার সঙ্গে সঠিক রাজনৈতিক কার্যকলাপ অনুপস্থিত থাকে?
আর এই রাজনৈতিক কার্যকলাপ অনুপস্থিত বলেই আমাদের দেশের মুসলমানদের একটা বৃহৎ অংশ আজ বাঙলাদেশের এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে সন্দেহের চোখে দেখছে। এর কোন বহিঃপ্রকাশ নেই কিন্তু গ্রামে গ্রামে, হাটেগঞ্জে ফিসফিস করে তাদের মধ্যে প্রচার হচ্ছে অনেক সংগ্রাম করে মুসলমানরা পাকিস্তান পেয়ে ছিল, আওয়ামী লীগ সেটা ধ্বংস করে দিতে চায়। একেবারে সীমান্তের ধারের গ্রাম থেকে পশ্চিম। বাঙলার অভ্যন্তর পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে এই ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে চলেছে।
এর সঙ্গে আমাদের দেশের সংবাদপত্র আর রেডিয়াের প্রচারও কম ক্ষতি করছে না। হত্যা, বীভৎসতা নারীধর্ষণের এমন সব রােমহর্ষক বিবরণ তারা দিচ্ছে বা ছাপছে যে এপারের চেয়েও ওপারে গ্রামের মানুষের। মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে বেশি। অবশ্য এ কথা ঠিক যে অত্যাচারীর প্রতিটি অত্যাচারের বিবরণ প্রকাশ করতে হবে যাতে অপরাধী তার কোনাে অপরাধ গােপন করতে না পারে, কিন্তু সেটা এমনভাবে প্রকাশ করতে হবে যাতে মানুষ অত্যাচারীর প্রতি ঘৃণায় ফেটে পড়ে। কিন্তু তা না হয়ে সে প্রচারে যদি মানুষ আতঙ্কিত হয়। তাহলে তা অত্যাচারীকেই সাহায্য করে। শুরু থেকে যদি রাজনৈতিক সক্রিয়তা থাকত তাহলে তিন হাজার মাইল সীমান্তের গ্রামগুলাে আজ হয়ে উঠত বাঙলাদেশের সংগ্রামের সমর্থনে এক-একটি রাজনৈতিক দুর্গ। কিন্তু তা হয়নি। ক্ষোভের কথা হলেও এটা আজ রূঢ় বাস্তব সত্য।
আর উপরে? আওয়ামী লীগ গড়েছিল ভােটের সংগঠন। সেই ভােটের সংগঠন হঠাৎ গৃহযুদ্ধের মুখােমুখি হয়ে রীতিমতাে নাকানিচোবানি খাচ্ছে।
সেই সময়ে কথা হচ্ছিল একজন মুক্তিযােদ্ধার সঙ্গে, হার্ডিঞ্জ ব্রিজে লড়াই করে পিছিয়ে এসেছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা এই যে আপনারা লড়াই করছেন এর কোন কেন্দ্রীয় কম্যান্ড আছে, না যে সেখানে যেমনভাবে লড়ছে।
‘কোন কেন্দ্রীয় কমান্ড নেই’ মুক্তিযােদ্ধাটি সরলভাবে বললেন, ‘বিভিন্ন অঞ্চলে যে যা বুঝছে করছে।’ “আচ্ছা, আপনাদের ওখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অবস্থা কী?
‘মুসলিম লীগ চুপ করে রয়েছে, মস্কোপন্থীরা, ভাসানী গ্রুপ সক্রিয় ভাবে যুদ্ধ করছে, তােহা গ্রুপ নীরব আর আলাউদ্দিন মােতিনের গ্রুপ অস্ত্র সরিয়ে রাখছে।
‘কেন?’
‘তারা বলছে—এটা তাে আসল মুক্তিযুদ্ধ নয়, ভবিষ্যতে যখন আসল মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবে তখন এইসব অস্ত্র আমাদের কাজে লাগবে।’
এরপরে চব্বিশে এপ্রিল কথা হচ্ছিল কুষ্টিয়ার এক ভদ্রলােকের সঙ্গে। ভদ্রলােক রাজনীতি-সচেতন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা কয়েকদিন আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের গ্রামের রিপাের্ট ছিল মুসলিম লীগ চুপ করে রয়েছে, জমিয়েত উলেমাও কোনাে সক্রিয় বিরােধীতা করেনি। কিন্তু ইদানীং খবরের কাগজে দেখছি লীগের লােকেরা পাক সৈন্যদের গুপ্তচরের কাজ করছে। অবস্থার এ পরিবর্তন হলাে কেন?
ভদ্রলােক একটু চুপ করে থেকে বললেন ‘এর কারণ আওয়ামী লীগ। কী রকম?
ভদ্রলােক বললেন, ইয়াহিয়ার সঙ্গে যে এগার দিন আপস আলােচনা হয়েছিল সে সময়টা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব গ্রামের দিকে কোন প্রতিরােধ-সংগঠন গড়ে নাই। তারপর পাক ফৌজের আক্রমণ শুরু হওয়ার পর অধিকাংশ জায়গায় আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্যরা নিজের নিজের এলাকা। ছেড়ে চলে গিয়েছে। এখন মুসলিম লীগ ও জমিয়েত উলেমার নেতারা আক্রন্ত শহরে ও গ্রামে গিয়ে। লােককে বােঝাচ্ছে—এই যে তােমার স্ত্রী মরল কি স্বামী মরল, কি ছেলে মেয়ে মরল, তােমার ঘর বাড়ি ভাঙল, এর জন্যে দায়ী আওয়ামী লীগ। তারা তােমাদের আগে সাবধান করে দেয়নি কেন? তারা চলে যাওয়ার সময় তােমাদের সরে যেতে বলেনি কেন? এর ফলে জনগণের একাংশের মধ্যে তারা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারছে। হয়তাে খেয়াল হবে—পঁচিশ মার্চের পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ নেতাদের আত্মগােপন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তারা যদি তা করতেন অর্থাৎ নিজের এলাকা ছেড়ে না আসতেন তাহলে অবস্থা হয়তাে আরও ভালাে হত।
‘আপনি কি সঠিক রিপাের্ট দিচ্ছেন?
‘আমি যা ঘটছে তাই বলছি। তাছাড়া এভাবে স্বাধীন বাঙলাদেশ সরকার গঠন করাটাও আওয়ামী লীগের পক্ষে ঠিক হয়নি?
‘কেন?”
‘আজ বাঙলাদেশে এমকাত্র আওয়ামী লীগই তাে লড়ছে না। ভাসানীর দল, মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, আনসার বাহিনী সহ আরও বহু ব্যক্তি, সশস্ত্র সংগঠন, বহু প্রতিষ্ঠান আজ এই স্বাধীনতা সংগ্রামের শরিক। সবাইকে বাদ দিয়ে একমাত্র আওয়ামী লীগের সরকার গঠন তাদের খুব বেশি অনুপ্রাণিত করবে না। সবচেয়ে ভালাে হতাে যারা এই মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করছে তাদের সব অংশের প্রতিনিধি নিয়ে একটা সর্বদলীয় সরকার গঠন করলে।
আমি বললাম, কেন মেজর ওসমানিকে তাে মন্ত্রিপরিষদে নেওয়া হয়েছে।
‘মেজর ওসমানি ই পি আর কি আনসার কারও প্রতিনিধি নন। তিনি একজন প্রাক্তন সৈনিক। এ ছাড়া আপনাদের রেডিও আর সংবাদপত্রগুলােও আমাদের ক্ষতি করছে।
‘কী রকম?
‘তারা মুজিব বাহিনী বলছে কেন? মুজিব বাহিনী কর্তৃক প্রতিরােধ কি আক্রমণ বলে তারা অন্যদলগুলাের মনে বিরূপতার সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আজ তাে মুজিব বাহিনী একা লড়ছে না। লড়ছে বহুজন এবং তারা সবাই মুক্তিযােদ্ধা, এটাই আমাদের বড় পরিচয়।
একটু ভীত হয়ে বললাম, এর ফলে কি মুক্তিসংগ্রামে কোন বিভেদ আসবে বলে মনে হয়?
ভদ্রলােক দৃঢ়স্বরে বললেন, না। কারণ যে গভর্নমেন্ট গঠন করা হয়েছে ঐ গভর্নমেন্টকে মেনে নিয়েই আমরা লড়ব। আমরা জানি আজ এ যুদ্ধ যদি আমরা পরাজিত হই তাে আমাদের বাঙালি জাতিসত্তাই বিপন্ন হয়ে পড়বে। আমাদের লড়তে হবে, এবং জিততে হবে, এটাই বড় কথা। আর এই লড়াইয়ের ভেতর দিয়েই একটা প্রকৃত মুক্তিফ্রন্ট গড়ে উঠবে।’
আমি বললাম, আচ্ছা আর-একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করি। পাকিফৌজ এভাবে দেশটাকে ধ্বংস করে ফেলছে কেন? স্কুল, কলেজ, ইউনিভারসিটি, হাসপাতাল, কল-কারখানা, গ্রাম, শহর, মানুষজন সব কিছু ধ্বংস করে ভবিষ্যতে ওরা দেশটাকে শাসন করবে কী করে? অবশ্য যদি যুদ্ধে জেতে?
ভদ্রলােক বললেন, একটা ঘটনা স্মরণ রাখবেন : যে ইন্দোনেশিয়ার দু-তিন দিনে ব্যাপক গণহত্যার সময় জাকার্তায় যে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত।
ভদ্রলােক একটু চুপ করে রইলেন। তারপর আরও কিছু কথা হলাে বিভিন্ন রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে। সবশেষে ভদ্রলােক বললেন, ‘ওসব কথা এখন নয়। এখন আমরা জীবন-মরণ সংগ্রাম করছি শত্রুর বিরুদ্ধে। এখন আমাদের দরকার সাহায্যের। এমনকি নৈতিক সাহায্যের মূল্যও আজ আমাদের কাছে কম নয়। আপনারা যে যেভাবে পারেন সেই টুকু সাহায্য করলে আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
ভদ্রলােক সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনায় কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন কিন্তু আমার মনে হয় সাহায্য করে। আমাদের কৃতার্থ হওয়ার প্রয়ােজন বেশি। তার কারণ, এটা তাে অন্য দেশের একটা গৃহযুদ্ধ নয়, এ যুদ্ধ যে আমাদের বাঙালি জাতিসত্তাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে নতুন করে গড়ে দিচ্ছে। এ যুদ্ধে হারজিত যাই হােক, তার প্রতিক্রিয়া আজকের চেয়েও অনেক বেশি করে অনুভূত হবে আগামী মুখগুলােতে। এ যুদ্ধ গড়ে তুলবে এমন এক মানসিকতা যাতে আমাদের চিন্তা ভাবনা সাহিত্য সংস্কৃতি সব কিছুরই রূপ আমূল বদলে যাবে।
তারই কিছু কিছু চিহ্ন চোখে পড়ল ঘুরতে ঘুরতে। চৈত্রসংক্রান্তির গাজনের দিন। একেবারে সীমান্তের একটি গ্রামে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে বেলা তিনটে এইরকম সময় খেতে বসেছি, এমন সময় হঠাৎ বাড়ির ছােট মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল ‘এ, সি একটা লােককে মেরে ফেলেছে।
সে কী মেরে ফেলেছে কী? আমাদের বিধবা গৃহকত্রী মেয়েকে জেরা করলেন। মেয়ে বলল ‘হ্যা মেরে ফেলেছে। এক চড় মেরেছে আর লােকটা পড়ে মরে গিয়েছে। ‘আমাদের গায়ের লােক? না। পাকিস্তানি।
‘তা এ সি-কে লােকে ধরে মারতে পারছে না? অরাজক নাকি’ বলতে বলতে পরিবেশন ভূলে গৃহমন্ত্রী ছুটলেন, আমরাও কোন রকমে খেয়ে ছুটে গেলাম দেখতে। গাজনের শিবমন্দিরে মাটির তৈরি বিরাট শিবের মূর্তি। বড় ষাঁড়ের ওপর বসে রয়েছে, মাথায় জটা, হাতে ত্রিশূল। দুপাশে আরাে দুটো প্রেতের মূর্তি। কাঠামাের নিচে ফুল, নৈবেদ্য, পুরােহিতের আসন, ঘণ্টা, শাঁখ। আসনের নিচেই শােয়ানাে রয়েছে এক দাড়িওয়ালা মুসলমান। মটকারকাপড়-পরা পুরােহিত তার মুখে জলের ছাট দিচ্ছেন, দুজন মেয়ে মাথায় হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করছে আর গাঁয়ের যুবকরা ভিড় হাঠাও’ বলে চারিধারে জমে ওঠে লােকজনকে ধাক্কাধাক্কি করে সরিয়ে দিচ্ছে। জীবনে ‘এ ধরনের অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে হবে কল্পনাও করিনি কোনদিন। ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশে মৌলালি, কলুটোলা দিয়ে হাঁটতে গা ছমছম করত। সেদিন কমিউনিস্ট পার্টির ভলেন্টিয়ার হিসাবে স্কোয়ডে স্লোগান দিতাম-কংগ্রেস, লীগ, কমিউনিস্ট এবং ও, হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই। একবার একটা গ্রামে দাঙ্গা থামাতে গিয়ে রামদার মুখে পড়েছিলাম, ঘটনাচক্রে বেঁচে গিয়েছি। এ সব অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু এই যে চোখের সামনে শিবের গাজনের নিচে শায়িত মুসলমানের মুখে পুরােহিত জল দিচ্ছে, আর হিন্দু মেয়েরা হাওয়া করছে—এরকম ঘটনার সম্ভাবনার কথা ছিল স্বপ্নেরও অগােচরে।
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম এক পাশে। এই অজস্র কলরব থেকে ঘটনাটা জানা অসম্ভব। একটি বছর বারাে বয়সের ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞাস করলাম। সে যা বলল তা হলাে লােকটা কিছুক্ষণ আগে সীমান্ত অতিক্রম করে এসে শিবের বটতলায় বসে জিরুচ্ছিল। এমন সময় অসিস্ট্যান্ট কমান্ডার চেক পােস্ট তদন্ত করতে এসে ওর পায়ে পাকিস্তানের এক বিশেষ ধরনের জুতাে দেখে দেখে ডেকে জিজ্ঞেস করে নামধাম, তারপর চড় মেরে দেয়।
মােটামুটি বুঝলাম ব্যাপারটা ইতিমধ্যে লােকটির জ্ঞান ফিরেছে। তাকে ধরাধরি করে এনে শুইয়ে দেওয়া হলাে বটতলায়। ইতিমধ্যে এ সি-ও চেক পােস্ট থেকে বেরিয়ে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের সমস্ত লােক তাকে ঘেরাও করল, কেন মেরেছেন ওকে? কী অধিকার আছে মারার।
অনেকক্ষণ কথা কাটাকাটি চলল। এ সি প্রথমে কারফিউ করে দেব’ ‘অ্যারেস্ট করব’ বলে শাসাল, তারপর জনতার উগ্ররূপ দেখে বলল, ও গুজব ছড়াচ্ছিল। বলল, মেহেরপুরে বােমা পড়েছে। মিথ্যা কথা বলেছে তাই আস্তে মেরেছি। ও ভয়ে ফিট হয়ে গিয়েছে। বলে লােকটির কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মিটমাট করে নিল।
এর আগে কৃষ্ণনগরে দেখেছি হিন্দু মুসলমান নারী শিশু আসছে বাস টেম্পাে বােঝাই হয়ে, কেউ বলে দিলে জাত বােঝার উপায় নেই। জলঙ্গীর স্কুলে দেখেছি একই কথায় হিন্দু-মুসলমান পরিবার পাশাপাশি শুয়ে রয়েছে। বহরমপুরে লঙ্গরখানায় দেখেছি হিন্দু-মুসলমান মেয়ে পাশাপাশি বসে খিচুড়ি খাচ্ছে। সিঁথিতে সিঁদুর ছাড়া বােঝাবার উপায় নেই কে কোন সম্প্রদায়ের।
সম্প্রদায়িকতার মহাপাপ একদিন আমাদের শুভচেতনাকে গ্রাস করেছিল। তাই সেদিন আমরা প্রতিবেশীর ঘর জ্বালিয়েছি, মেয়েদের সম্মান নষ্ট করেছি, মানুষকে হত্যা করেছি। সেই পাপের রেশ এখনও ধুয়ে মুছে যায়নি। প্লেগের মতাে এখনও মাঝে মাঝে সেই ব্যাধি আমাদের আক্রমণ করে। কিন্তু মুক্তিসংগ্রামের লেলিহান আগুন সেই পাপকে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে।
এই আগুনে এমনিভাবেই পুড়ে যাচ্ছে আমাদের আরও বহু পাপ বহু সংস্কার বহু জড়তা, বহু সংকীর্ণ চিন্তাধারা। ইতিহাসের দহন থেকে সৃষ্টি হচ্ছে এক নতুন বাঙালি জাত। স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে বাঙলা মায়ের বহু তরুণ সন্তান আত্মাহুতি দিয়েছে, পূর্বঞ্চলের রক্তরাঙা মাঠ ঘাট নদী প্রান্তর ভেদ করে সেই মুক্তিসূর্য উঠছে। মেঘ তাকে সাময়িকভাবে আড়াল করতে পারে, কিন্তু অচিরে এ মেঘ কেটে যাবে, নতুন দিনের সুপ্রভাতে আমরা বন্দনা করে বলতে পারব।
‘ভেঙেছে দুয়ার এসেছে জ্যোতির্ময়/তােমারি হউক জয়’ বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘজীবী হােক।
সূত্র: সপ্তাহ, ৭ মে ১৯৭১