You dont have javascript enabled! Please enable it! অপারেশন- ব্লিট্জ থেকে অপারেশন-সার্চলাইট | মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.) - সংগ্রামের নোটবুক

অপারেশন- ব্লিট্জ থেকে অপারেশন-সার্চলাইট

মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)

রাজনৈতিক-সামরিক বিবর্তন

উনসত্তরে পাকিস্তানের বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ক্ষোভ ও প্ৰতিবাদ আন্দোলনের আকারে চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়। এ ক্ষোভের নিয়মতান্ত্ৰিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে সত্তরের ৭ ডিসেম্বরের ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’-এর মাধ্যমে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে। জাতীয় পরিষদের মোট ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ লাভ করে ১৬০টি আসন এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) লাভ করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন ৮১টি। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশ-পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানে একটি আসনও লাভ করেনি। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো এলাকার কোনো জনগোষ্ঠীকেই প্রতিনিধিত্ব করেনি। অপরদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পিপিপি পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৩৮ আসনের মধ্যে ৮১টি আসন লাভ করে। উল্লেখিত ৪টি প্রদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ আসন লাভ করলেও পূর্ব পাকিস্তানে একটি আসনও পিপিপি লাভ করেনি। আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে সাতটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, কিন্তু পিপিপি পূর্ব পাকিস্তানে একটি আসনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি। বাস্তবে পিপিপি’র কোনো অফিস বা কোনো কার্যক্রমই ছিল না পূর্ব পাকিস্তানে। পার্লামেন্ট পদ্ধতির গণতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচনে বিজয়ী নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে সরকার গঠন করার জন্য প্রেসিডেন্ট কর্তৃক আহবান জানানোর কথা। নির্বাচনের ফলাফলে পাকিস্তানের দুই অংশের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন ক্ষমতা হস্তাত্মরে প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। ভুট্টো তার নিজের স্বার্থে সমস্যাটিকে আরো জটিল করে তোলেন। এই প্রচ্ছন্ন হুমকিতে, তার দলের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে পারবে না। রাজনৈতিক সমঝোতার অচলাবস্থা প্রধানত এখান থেকেই শুরু। অন্যদিকে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ আসনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ তার ৬ দফাকে তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টো নির্ধারণ করে। কিন্তু ৬ দফার প্রতিটি দাবিই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বাৰ্থসম্পৃক্ত ও বাঙালিদের অধিকার সম্পর্কিত। এ নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতিসত্তার বা চারটি প্রদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় ছিল না। রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টিতে এটিও ছিল একটি কারণ। পশ্চিম পাকিস্তানের একটি মহল এ অবস্থায় প্রশ্ন তোলে, একটি প্রদেশ (পূর্ব পাকিস্থান) কী করে পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশকে শাসন করবে? পশ্চিম পাকিস্তনেরই কিছু প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ যারা পূর্ব পাকিস্তানের এবং বাঙালিদের অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন তারা বলেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা যদি তেইশ’ বছর পূর্ব করতে পারবে না। তবে মূল সমস্যা ছিল আপাতদৃষ্টির বাইরে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা কখনোই এটা মেনে নিতে পারেননি যে, বাঙালিরা পাকিস্তানের ক্ষমতার মসনদে বসবে। হাতেগোনা কয়েকজন রাজনীতিবিদ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদরাও এমনই ভাবতেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করায় এবং সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করায় ভুট্টোর কাছে জেনারেল ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য অস্বচ্ছ হওয়া শুরু হয়। ভুট্টো ইয়াহিয়াকে একদিকে আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনার বিষয়ে ও অপরদিকে পাকিস্তনের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্বন্ধে বোঝাতে সচেষ্ট থাকেন। প্ৰাথমিক এ অবস্থায় ইয়াহিয়া তার নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন এবং ভুট্টোর প্রস্তাবনায় কান দিলেও তা বাধ্যবাধকভাবে মানেননি। ভুট্টোর কাছে ইয়াহিয়া খান ক্রমেই অনির্ভরশীল হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে ভুট্টো, ইয়াহিয়ার উচ্চপদস্থ নীতিনির্ধারক এবং বাঙালি বিদ্বেষী জেনারেলদের সঙ্গে গোপন পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যস্ত থাকেন। এদের অন্যতম ছিল লে. জেনারেল এসজিএমএম পীরজাদা, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান। পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধ এবং অতঃপর ১০ জানুয়ারি ১৯৬৬-র স্বাক্ষরিত তাসখন্দ চুক্তির পর আইয়ুব তার প্রকৃত ক্ষমতার ভিত্তি (সশস্ত্ৰ বাহিনীর) ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং ১৯৬৬ সালে সশস্ত্ৰ বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল মোহাম্মদ মূসার অবসর গ্রহণের পর তার অবস্থা আরো দুর্বল হয়ে যায়। আইয়ুব ভেবেচিন্তে এবং বহু বিষয় বিবেচনা করে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে কমান্ডার-ইন-চিফ মনোনয়ন করেন। বিবেচনার ও ভাবনার এ প্রক্রিয়ায় আইয়ুবের মাথায় ইয়াহিয়ার সামরিক যোগ্যতা ও দক্ষতার বিষয়গুলো আসেনি এবং ইয়াহিয়াকে এ মনোনয়ন দিতে আইয়ুবের অনুগত এবং আইয়ুবের ধারণা ছিল, ইয়াহিয়া রাজনীতিতে অনাগ্রহী ও সিরিয়াস ধরনের জেনারেল নন এবং তিনি রাতে ভোগ-বিলাসেই তৃপ্ত থাকবেন। কিন্তু আইয়ুবের বড় ভুল ছিল ইয়াহিয়ার সঙ্গে লে. জেনারেল পীরজাদার দীর্ঘ বন্ধুত্ব ও নিবিড় সখ্যতা উপেক্ষা করা। পীরজাদা মেজর জেনারেল হিসেবে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত আইয়ুবের মিলিটারি সেক্রেটারি ছিলেন এবং তার হার্ট অ্যাটাকের পর তাকে এই নিয়োগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

পীরজাদা ছিলেন অত্যাধিক উচ্চাভিলাষী এবং প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে এভাবে বের হয়ে আসার অপমান তিনি ভুলতে পারেননি। ভুট্টোকেও ১৯৬৬ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করা হয়। ভুট্টোও এ অপমানের জন্য আইয়ুবকে ক্ষমা করেননি। পীরজাদা এবং ভুট্টোর মধ্যে তাদের দুয়ের শত্ৰু আইয়ুবের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের প্রশ্নে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এই ভুট্টো-পীরজাদা অক্ষ উনসত্তরে আইয়ুবের পতন এবং একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙনে প্রভূত অবদান রাখে। ইয়াহিয়ার বিশ্বস্ত এক জেনারেল সত্তরের ডিসেম্বরের শেষে ঢাকায় গভর্নর হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন) নৈশভোজের পর আলাপচারিতার এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তাত্মর প্রসঙ্গে বলেন, “চিন্তা করো না, আমাদের শাসন করার সুযোগ এই কালো বেজন্মাদের আমরা দেব না।”

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একাত্তরের ১২ জানুয়ারি থেকে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা সফর করেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার সঙ্গীরা ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে আলোচনা শেষে ৩০ জানুয়ারী করাচি ফেরত যান। ঢাকা সফরকালে ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের ফলাফল ইয়াহিয়াকে সম্ভষ্ট করতে পারেনি। ঢাকা ত্যাগের আগে ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিচলিত ও দুশ্চিন্তাগ্ৰস্ত ইয়াহিয়া বলেন, ‘তাকে (মুজিব) জিজ্ঞাসা করুন। তিনি পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী। তিনি যখন আসবেন এবং ক্ষমতা গ্ৰহণ করবেন তখন আমি থাকবো না। খুব শিগগিরই সরকার তার হবে’। ভুট্টো তার পাঞ্জাবের লারকানার জমিদার বাড়ির বাংলো ‘আল মরতুজায়’ ১৭ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের ‘হাঁস শিকারের’ আমন্ত্রণ জানান। ধারণা করা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত এখানেই গ্ৰহণ করা হয়। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর এ বৈঠক ‘লারকানা ষড়যন্ত্ৰ’ নামে অভিহিত।

জানুয়ারির শেষ নাগাদ ইয়াহিয়া-ভুট্টো এবং শেখ মুজিব তাদের নিজ নিজ অবস্থান সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে যান, তারা তাদের নিজ নিজ পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে থাকেন। শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আহবান জানানোর জন্য প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেন। অপরদিকে রাজনীতিবিদদের মধ্যে আরো আলোচনার জন্য সময় প্রয়োজন-এই যুক্তিতে ভুট্টো ইয়াহিয়াকে অধিবেশন পৌঁছানোর দাবি করতে থাকেন। পাকিস্তান রক্ষার এবং রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের প্রায় সব পথ ক্রমেই রুদ্ধ হয়ে আসতে থাকে।

১১ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে এক দীর্ঘ বৈঠকে মিলিত হন। দু’দিন পর (১৩ ফেব্রুয়ারি) ইয়াহিয়া খান ঘোষনা করেন ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ভুট্টো তীব্ৰ প্ৰতিবাদে ফেটে পড়েন। তিনি ঘোষণা করেন, তার এবং শেখ মুজিবের মধ্যে সমঝোতার আগে কোনোভাবেই অধিবেশন বসতে দেয়া হবে না। ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার বিরুদ্ধে পেশোয়ারে এক সংবাদ সম্মেলনে হুমকি প্ৰদান করে ভুট্টো বলেন, অন্যথায় তিনি ‘খাইবার থেকে করাচি’ পর্যন্ত বিপ্লব শুরু করবেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া তার বেসামরিক মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেন। এর ফলে ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের আর কোনো বেসামরিক প্রতিনিধিত্ব রইল না। এর দুদিন পর ১৭ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া তার গভর্নর ও আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকদের এক সভা ডাকেন।

জিএইচকিউ (General Headquarters) রাওয়ালপিন্ডিতে বৈঠক বসবে ২২ ফেব্রুয়ারি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে গভর্নর ভাইস এডমিরাল এসএম এহসান এবং সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান সভায় যোগ দেবেন।

জিএইচকিউ’র ২২ ফেব্রুয়ারির সভায় পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের কর্তৃত্বের স্থলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ কঠোরভাবে আরোপ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। উল্লেখ্য, নির্বাচনী প্রচারণার জন্য সত্তরের ১ জানুয়ারি থেকে সামরিক আইন শিথিল করা হয়। ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আর সামরিক আইনের শিথিলতা তুলে নেয়া হয়নি। সামরিক আইন প্রয়োগ বা পুনঃপ্রয়োগের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি তখন অনেক বদলে গেছে। ২২ ফেব্রুয়ারি সভায়ই আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, পূর্ব পাকিস্তানে কর্তৃত্ব আরোপের জন্য এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সামরিক বাহিনী ব্যবহার করার। তার আগে শেখ মুজিবুর রহমানকে ৬ দফার প্রশ্নে ছাড় দেয়ার এবং পূর্ব পাকিস্তান পরিচালনার ভার আওয়ামী লীগের হাতে তুলে না নেয়ার অনুরোধ করে একটি শেষ চেষ্টা করার উদ্যোগ গ্ৰহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই প্ৰয়াসের সঙ্গে সঙ্গে সামরিক প্ৰস্তুতিও অব্যাহত থাকবে। সামরিক পদক্ষেপের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে আরো সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শেখ মুজিবের সঙ্গে শেষ উদ্যোগ গ্রহণের দায়িত্ব দেয়া হয় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস এডমিরাল এসএম এহসান এবং সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে। একই সঙ্গে ২২ ফেব্রুয়ারির সভায় নির্দেশানুযায়ী ঢাকাস্থ হেডকোয়ার্টার ১৪ ডিভিশন একটি অপারেশন প্ল্যান প্রণয়ন করে। অপারেশনটির নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন ব্লিটজ’ (Op-Blitz)। এই অপারেশন পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল যদি শেখ মুজিবের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে নিরসন করা না যায় তবে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে আক্ষরিক অর্থে সামরিক আইন পুনঃপ্রয়োগ করা। পরে লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের নির্দেশে ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারস-এ একটি চূড়ান্ত রূপ দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে হাসান জহীর (একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানে কর্তব্যরত পাকিস্তানি সচিব) তার বই দি সেপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান-এ (পৃ. ১৪৮) বলেন, ইত্যবসরে ইস্টার্ন কমান্ডের শক্তি বৃদ্ধির জন্য সৈন্য ও যুদ্ধসামগ্ৰী পাঠানো হচ্ছিল।

পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড রহিতকরণ এবং সামরিক কার্যক্রম গ্রহণের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীর আপদকালীন পরিকল্পনা ‘অপারেশন-ব্রিট্রিস’ ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে এক সময়ে চূড়ান্ত হয়ে যায় এবং এর বিষয়বস্তু ফরমেশন কমান্ডারদের জানিয়ে দেয়া হয়। মার্চের মাঝামাঝি রাজনৈতিক আলোচনার জন্য ইয়াহিয়ার ঢাকা পৌছার আগেই সেনাবাহিনী, প্রয়োজন হলে (পূর্ব পাকিস্তানের) পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্ৰহণ করার জন্য প্ৰস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলে। এই অপারেশন পরিকল্পনা কার্যকরী করার সময় আর আসেনি। পূর্ব পাকিস্তানে ঘটনা দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে।

১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকা আসেন। তার সফরসঙ্গী হন জেনারেল আব্দুল হামিদ খান, চিফ অব স্টাফ, লে. জেনারেল এসজিএমএম পীরজাদা, প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার এবং তার উচ্চপদস্থ সামরিক সহকর্মীরা। ইয়াহিয়ার এই ঢাকা সফরের তারিখ ও সময় গোপন রাখা হয়। ঢাকা বিমানবন্দরে (তেজগাঁও বিমানবন্দর) অভাবনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। প্রেসিডেন্ট সফরের শিষ্টাচার অনুযায়ী কোনো বেসামরিক কর্মকর্তা বা মিডিয়াকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। ইয়াহিয়া বিমানবন্দর থেকে সোজা গাড়িতে গভর্নর হাউসে চলে যান। ফার্মগেট ও রাস্তার অন্যান্য অংশে জনগণের স্থাপিত ব্যারিকেড থাকায় ইয়াহিয়ার জন্য একটি ছোট হেলিকপ্টার (Allouette-III) উড়ন্ত অবস্থায় রাখা হয়েছিল। হেলিকপ্টারের এ ব্যবস্থাটি করা হয়েছিল অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে। পূর্ব নির্দেশ একটি সভা করেন। উত্তেজিত ইয়াহিয়া অবাধ্য মুজিব তার মতানুযায়ী আচরণ না করলে তার উত্তর কীভাবে দিতে হবে তা তার জানা আছে বলে জানান। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পাকিস্তানি অফিসাররাও এখানকার পরিস্থিতির সম্বন্ধে কম-বেশি অবহিত ছিলেন। ইয়াহিয়ার এ উচ্চারণে হঠাৎ সভায় স্তব্ধতা নেমে আসে। অস্বন্তিকর কয়েক মুহূর্তে অতিবাহিত হওয়ার পর দীর্ঘদেহী, সুঠাম গড়নের এবং সমান্তরাল কাঁধের এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে কিছু বলার জন্য ইয়াহিয়ার অনুমতি চান। ন্যায় ও সত্যের কঠোর প্রবক্তা এ ব্যক্তির নাম এয়ার কমোডর জাফর মাসুদ। পিএএফ বেস, ঢাকার বেস কিমান্ডার। মিট্টি মাসুদ নামে তিনি সমধিক পরিচিত। সাহসী বৈমানিক। যে তিনজন পাইলট একজন। ১৯৫৮ সালে ১৬টি স্যাবর জেটের ফরমেশনকে খাড়াভাবে আকাশে তুলে বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করেন। তাকে বলার অনুমতি দেয়া হয়। ‘স্যার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। সমস্যা মূলত রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যা সমাধান প্রয়োজন, অন্যথায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ এবং শিশু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’ ইয়াহিয়া তার চোখের ভারি ভ্রূ কাঁপিয়ে এবং মাথা দুলিয়ে জবাব দেন–‘মিট্টি আমি জানি, আমি জানি’। এয়ার কমোডর জাফর মাসুদ বসে পড়লেন। (পরবতী সময়ে এ অফিসার অপারেশন-সার্চলাইটের পরিকল্পনা অনুযায়ী তার বিমান ও বৈমানিক ব্যবহার করতে অস্বীকৃতি জানান। তাকে পাকিস্তানে বদলি করা হয়, বিচার করা হয় এবং চাকুরিচ্যুত করা হয়। ৭ অক্টোবর ২০০৩ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।) ১৬ মার্চ ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে প্রথম আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। ১৭ মার্চ সন্ধ্যায় মে. জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ইয়াহিয়া ও মুজিবের মধ্যে অনুষ্ঠিত দিনের আলোচনার ফলাফল জানতে লে. জেনারেল টিক্কা খানের কাছে যান। লে. জেনারেল টিক্কা খান জবাব দেন, ‘তুমি যা সামান্য জানো, আমিও ততটুকুই জানি’। খাদিম হোসেন রাজা বলেন, ‘কিন্তু স্যার, অকুস্থলের ব্যক্তি হিসেবে যেন আপনি অসতর্ক অবস্থায় না পড়েন সেজন্য আলোচনার অগ্ৰগতি সম্বন্ধে জানা আপনার অধিকার।’ সে সন্ধ্যায়ই টিক্কা খানের স্টাফ কার প্রেসিডেন্ট হাউসে প্রবেশ করে। জানা যায়, ইয়াহিয়া খান তাকে বলেন, ‘বেজন্মাটা (মুজিব) ঠিকমতো আচরণ করছে না। তুমি তৈরি হও।‘ টিক্কা খান রাত দশটায় জিওসিকে (মে. জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা) টেলিফোন করে বলেন, ‘খাদিম, তুমি এগিয়ে যেতে পারো।’

১৮ মার্চ সকালে জিওসি’র অফিসে মে, জেনারেল রাও ফরমান আলী খান এবং মে, জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ১৪ ডিভিশনের অফিসে হালকা নীল প্যাডে পেন্সিলে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শক্তি প্রয়োগের অপারেশনাল অর্ডার লিখে ফেলেন। অপারেশনটির নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন-সার্চলাইট’। ২০ মার্চ বিকালে ঢাকা সেনানিবাসের ফ্ল্যাগ সন্টাফ হাউসে অপারেশনাল অর্ডারটি চিফ অব স্টাফ জেনারেল আব্দুল হামিদ খান এবং লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পড়ে শোনানো হয়। ৫ মার্চ লে. জেনারেল ইয়াকুব গভর্নর এবং ইস্টার্ন কামান্ডার হিসেবে পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হলেও তাকে তার প্রতিস্থাপক আসা পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়। লে. জেনারেল টিক্কা খান ৭ মার্চ বিকেলে ঢাকা পৌছেন এবং এদিন রাতেই লে. জেনারেল ইয়াকুবের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেন। সামান্য পরিবর্তন করে তারা অপারেশন অর্ডারটি অনুমোদন করেন। অর্ডারে একটি নির্দিষ্ট দিনে যখন শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগ নেতারা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গভর্নর হাউসে বৈঠকরত থাকবেন তখন তাদের গ্রেফতার করার কথা উল্লেখ ছিল। অর্ডারটি অনুমোদন করার সময় ইয়াহিয়া এটিতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক আলোচনার জন্য আমার উপর জনগণের আস্থা আমি হত্যা করতে পারি না। গণতন্ত্রের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আমি ইতিহাসে যেতে চাই না।’ এভাবেই ২০ মার্চ পৃথিবীর অন্যতম গণহত্যার পরিকল্পনা অপারেশন-সার্চলাইট চূড়ান্ত রূপ পায়।

উনসত্তরের ২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতা গ্ৰহণ করে দেশে সামরিক আইন জারি করেন। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শক্তি (Combat and combat support force) ছিল; তিনটি ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড নিয়ে একটি ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন (১৪ ডিভিশন), ৬টি পিটি-৭৬ উভচর ট্যাঙ্ক নিয়ে একটি ক্যাভালরি ট্রপ এবং ১টি কমান্ডো ব্যাটালিয়ন। মোট ১৪,৫০০ সৈন্য। ঢাকায় অবস্থিত ১৬টি এফ-৮৬ (গ্রাউন্ড অ্যাটাক এয়ারক্রাফট) নিয়ে বিমান বাহিনীর একটি স্কোয়াড্রন। চট্টগ্রাম নৌ-ঘাঁটিতে ৪টি গানবোট এবং ১টি সহায়তাকারী জাহাজ (Support Ship) নিয়ে নৌ-বাহিনীর একটি ক্ষুদ্র দল। বিমান ও নৌ-বাহিনীর মোট জনবল ছিল প্ৰায় ১,০০০। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আরোহণ করে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন। একাত্তরের ৩০ জানুয়ারি দুই কাশ্মিরী যুবক ইন্ডিয়ান এয়ারলাইসেন্সের ‘গঙ্গা’ নামের একটি ফকার (এফ-২৭) বিমান ভারতীয় কাশ্মিরের রাজধানী শ্ৰীনগর থেকে হাইজাক করে লাহোরে নিয়ে যায়। তারা লাহোর বিমানবন্দরে বিমানের ক্রু এবং যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। ভুট্টো তাৎক্ষণিকভাবে এ ছিনতাইকারীদের ‘জাতীয় বীর’ আখ্যায়িত করেন। পরদিন (৩১ জানুয়ারি) টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে ঘটা করে বিমানটিকে বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনার পর ভারত তার দেশের ওপর দিয় পাকিস্তানের সব ধরনের বিমান উডডয়নের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে করাচি থেকে পাকিস্তানি বিমান সিংহলের (বর্তমান শ্ৰীলংকা) হয়ে ঘুরে ঢাকা আসতে বাধ্য হয়। ১০০০ নটিক্যাল মাইলের দূরত্বের পরিবর্তে এ পথে দূরত্ব দাঁড়ায় প্রায় তিনগুণ। এতে পাকিস্তান বিমানবাহিনী এবং পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিআইএ) পরিবহন কার্যক্রম গুরুতরভাবে ব্যাহত হয়। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পরিবহন বিমান বহরে ৫টি সি-১৩০বি এবং ১টি সি-১৩০ই বিমান ছিল। প্ৰত্যেকটি বিমানের ৯২ জন আরোহী (ক্রু ব্যতীত) পরিবহন করার ক্ষমতা ছিল। সি ১৩০ই ব্যতীত অপর সি-১৩০বি বিমানগুলোকে সিংহলের রাজধানী কলম্বো বিমানবন্দরে জ্বালানি সংগ্ৰহ করতে হতো। পিআইএ-এর ছিল ৭টি বোয়িং ৭০৭ এবং ৪টি বোয়িং ৭২০টি বিমান। এগুলোর পরিবহন ক্ষমতা ছিল যথাক্রমে ২০২ জন এবং ১১২ জন আরোহী (ক্রু ব্যতীত)। বোয়িং বিমানগুলো কলম্বোয় জ্বালানি সংগ্ৰহ না করেই বা কোথাও না নেমেই করাচি থেকে ঢাকা যাতায়াত করতে পারতো। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর এবং পিআইএয়ের ৭৫% পরিবহন ক্ষমতা ব্যবহার করে এবং সবক’টি বোয়িং বিমান সৈন্য পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হবে হিসেবে একবারে বিমানে ২০০০ সৈন্য পরিবহন করা সম্ভব হতো। করাচি থেকে ঢাকা উডডয়নে বোয়িং ৭০৭ বিমানের জন্য প্রয়োজন হতো ৫ ঘন্টা এবং সি-১৩০বি বিমানের জন্য ১১ ঘন্টার অধিক (কলম্বোয় জ্বালানি সংগ্রহের সময় ব্যতীত)। বিমানগুলোর এ পথ একবার অতিক্রম করার পর রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনে পরিবহনে কালক্ষেপণ হতো। বিমানে পরিবহনের এই জটিল কার্যক্রম সামরিক অপারেশন পরিকল্পনা হিসেবে প্রণীত হয়। অপারেশনটির নাম দেয়া হয় অপারেশন-গ্রেট ফ্লাই-ইন (Op-Great Fly-In)

১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ এই ৩১ দিনে মোট ১৪টি বেসামরিক সামুদ্রিক জাহাজ করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পৌঁছে। এগুলোর মধ্যে ছিল ১০টি মালবাহী জাহাজ, ১টি যাত্রীবাহী জাহাজ এবং ৩টি যাত্রী-পণ্য পরিবহনকারী জাহাজ। এই জাহাজগুলোর মধ্যে ২টি জাহাজে করাচি বন্দর থেকে সৈন্য উঠতে দেখা যায়, তবে সৈন্যসংখ্যা নির্ধারণ করা যায়নি। বাঙালিদের দৃষ্টি এড়াতে সৈন্যদের বেসামরিক পোশাকে বিমানে ঢাকা আনা হতো। কিন্তু বিমান থেকে অবতরণের পর ঢাকা বিমানবন্দরে ফল-ইন হয়ে মার্চ করে তারা যখন যেতো তখন তাদের পরিচয় আর গোপন থাকতো না। বিমানে সৈন্যরা হালকা অস্ত্র ও ব্যক্তিগত মালামালসহ আসতো। ভারি অস্ত্র এবং গোলাবারুদ চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হতো সমুদ্রপথে ।

২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত বিমানে করে দু’টি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন, ২২ বেলুচ রেজিমেন্ট এবং ১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (এফএফ) রেজিমেন্ট ঢাকায় আনা হয়। ঢাকায় অবস্থিত ৫৭ ব্রিগেডকে আদেশ দেয়া হয় ব্যাটালিয়ন দুটিকে তাদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে। ১৩ এফএফ-কে ঢাকা সেনানিবাসে রেখে ২২ বেলুচকে স্থান দেয়া হয় ইপিআর সদর দফতর, পিলখানায়। যুক্তি দেয়া হয়, ঢাকা সেনানিবাসে সৈনিকদের স্থান সংকুলান করা যাচ্ছে না। ২৫ মার্চ রাতে এই ২২ বেলুচ ইপিআর-এর বাঙালি সদস্যদের হত্যা ও গ্রেফতার করে।

২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২৫,০০০ (Combat and Combat Support)। একাত্তরের ১ মার্চের আগে পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি মাত্র ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন মোতায়েন ছিল-১৪ ডিভিশন। চারটি ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড ছিল এই ডিভিশনের অধীনে। এছাড়া ঢাকায় একটি বিমানঘাটি এবং চট্টগ্রামের একটি নৌঘাঁটি ছিল।

পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী

সেনাবাহিনী

হেডকোয়ার্টারস ইস্টার্ন কমান্ড, ঢাকা-লে. জেনারেল টিক্কা খান। হেডকোয়ার্টারস ১৪ ডিভিশন, ঢাকা-মে. জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা। গভর্নরের বেসামরিক বিষয়ক উপদেষ্টা-মে, জেনারেল রাও ফরমান আলি খান।

ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন-১১টি, ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট-৪টি, ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন-১টি, আমার্ড রেজিমেন্ট-১টি [এম-২৪ (শ্যাফে) ট্যাংক], এন্টি-এয়ারক্রাফট রেজিমেন্ট ১টি, ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স-৩টি, ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মড স্কোয়াড্রন-১টি (পিটি-৭৬) এবং ইন্ডিপেনডেন্ট মর্টার ব্যাটারি-১টি।

এই  ফিল্ড  ইউনিটগুলো  ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানে  নন-অপারেশনাল ইউনিট বা স্থাপনা ছিল-

স্টেশন হেডকোয়ার্টার, ঢাকা; ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার, চট্টগ্রাম; পাকিস্তান অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি, গাজীপুর; সেন্ট্রাল অর্ডন্যান্স ডিপো, ঢাকা; অ্যামুনেশন ডিপো, রাজেন্দ্রপুর; এম্বারকেশন ইউনিট, চট্টগ্রাম। তাছাড়া ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) এবং জেনারেল হেডকোয়ার্টারস (জিএইচকিউ), রাওয়ালপিন্ডির সরাসরি অধীনে জিও-পলিটিক্যাল সার্ভের (Geo-Political Survey) কয়েকটি শাখা এবং ফিন্ড ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের কয়েকটি শাখা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে।

বিমান বাহিনী

পিএএফ বেস, ঢাকা। বেস কমান্ডার-এয়ার কমোডর মোহাম্মদ জাফর মাসুদ

১৬টি এফ-৮৬ (স্যাবর) গ্রাউন্ড অ্যাটাক এয়ারক্রাফট, ২টি এমআই-৮ এবং ২টি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার (চালনার জন্য ৭ জন পাইলট)।

এ হেলিকপ্টারগুলো পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত ৪ আর্মি এভিয়েশন স্কোয়াড্রন থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আনা হয়। সাময়িকভাবে এ হেলিকপ্টার বহরের নাম দেয়া হয় ‘লজিস্টিক ফ্লাইট’ বা সংক্ষেপে ‘লগ ফ্লাইট’ (Log Flight)। মেজর সৈয়দ লিয়াকত বোখারী ছিলেন ‘লগ ফ্লাইটের’ অফিসার কমান্ডিং। (২৫ মার্চের পর গোটা স্কোয়াড্রনটি ঢাকায় আনা হয়। আগস্ট মাসে মেজর বোখারী লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি পান)।

 

নৌবাহিনী

হেডকোয়ার্টাস-চট্টগ্রাম

কমোডর কমান্ডিং ইস্ট পাকিস্তান (COMCEP)-রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ শরীফ। ৪টি গানবোট (Brooke Marine Patrol Craft)-পিএনএস ঢাকা, পিএনএস রাজশাহী, পিএনএস যশোর, পিএনএস, কুমিল্লা।

পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সামরিক প্ৰস্তুতি

একাত্তরের ২৫ মার্চের আগেই পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি হতে থাকে। কোনো সামরিক উদ্দেশ্য বা বহিঃশত্রু মোকাবেলা নয়, একান্তই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। দু’বছর আগে (২৫ মার্চ ১৯৬৯) যখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান দেশে সামরিক আইন জারি করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, প্ৰধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পাকিস্তান সামরিক অধিষ্ঠিত হন তখন পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। সামরিক শাসক হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাহ্যত চলনে-বালনে এবং আচরণে ছিলেন আন্তরিক। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার কথা স্বীকার করলেন, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের আশ্বাস দিলেন এবং সশস্ত্ৰ বাহিনীতে এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনে বাঙালির অংশীদারিত্ব বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিও দিলেন।

ঊনসত্তরের গণঅভু্যুত্থান পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসক ও রাজনীতিবিদদের প্রচলিত এবং মূল বিশ্বাসে আঘাত হানে। এই দুই শ্রেণীর বিচক্ষণ ও দূরদশী ব্যক্তিরা গুরুত্বসহকারে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার বিষয়ে বিচলিত হয়ে ওঠেন। অপরদিকে প্রচলিত ভাবনার এবং অদূরদর্শী নীতিনির্ধারকরা ক্রমেই পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমানোর দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত সমাধানের পথ খোজে ব্ৰতী হন। কারো কাছেই এটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়েনি-কেবল স্বাধীনতাই ছিল পূর্ব পাকিস্তানে সময়ের একমাত্র সমাধান।

ঊনসত্তরের গণআন্দোলন দমনে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর অন্যান্য ইউনিটের সঙ্গে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়গুলোও নিয়োগ করা হয়। যে ক্ৰোধ আর ঘূণা নিয়ে অবাঙালি সৈন্যরা বাঙালিদের ওপর নির্যাতন করে স্বভাবতই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা আদেশ পেয়ে সাধ্যমতো তা করা থেকে বিরত থাকে। ঊনসত্তরের নভেম্বর বিহারি-বাঙালি দাঙ্গা দমনেও বাঙালি সৈন্যদের নিয়োগ করা হয়। বাঙালি সৈনিকরা দাঙ্গা দমনে বাঙালিদের পক্ষ নেয় বলে তারা লক্ষ্য করে। বাঙালি সৈন্যদের এ আচরণ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত সামরিক নীতিনির্ধারকদের চোখ এড়ায়নি। জাতীয়তাবাদী চেতনায় পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত বাঙালি সৈন্যরা উজ্জীবিত হয়ে যাবে-এ চিন্তা তাদের গভীর উদ্বিগ্নতায় আচ্ছন্ন করে ফেলে। বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী চেতনায় বাঙালি সৈনিকরা সংক্রমিত হয়ে যাবে-এই ভয়ে ভীত হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাকিস্তানি সামরিক নীতিনির্ধারকরা। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের যে ভবিষ্যতে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না, সে বিষয়ে তারা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যান। সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসন মোকাবেলায় এই বাঙালি সৈন্যদের ভূমিকা কী হবে তা নিয়েও তারা সন্দিহান হয়ে ওঠেন। মনোগত ও আবেগগতভাবে বাঙালি সৈন্যরা যে বাকি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে নেই, তাও তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। এ বিষয়গুলো নিয়ে পাকিস্তানিরা আগেও যে ভাবেনি তা নয়। কিন্তু এখন যে করণীয়াটুকু করার তার সময় যে শেষ এবং তারা কালক্ষেপণ করে ফেলেছেন তা পরিস্কার উপলব্ধি করেন। এমতাবস্থায় ঢাকাস্থ ১৪ ডিভিশনের জিওসি মে, জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা পূর্ব পাকিস্তানে আরো অবাঙালি সেনা ইউনিট পাঠানোর জন্য এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদের অবাঙালি ইউনিটে বদলি করে অবাঙালি সৈন্যদের দিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য সংখ্যা পূরণের লিখিত প্ৰস্তাব জিএইচকিউ রাওয়ালপিন্ডিতে পাঠান।

১৪ ডিভিশনের জিওসি’র এই চিঠির প্রস্তাবনা জিএইচকিউর নীতিনির্ধারকদের গায়ে বাতাস লাগাতে পারেনি। এর যৌক্তিক কারণ ছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া উনসত্তরের ২৫ মার্চ ক্ষমতা আরোহণের পর স্বীকার করেন, পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়েছে এবং তার সরকার এই প্ৰভেদ দূরীকরণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্ৰহণ করবে। ২৮ জুলাই ১৯৬৯ ইয়াহিয়া এক বেতার ভাষণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের বর্তমান সংখ্যা দ্বিগুণ করার কথা ঘোষণা করেন এবং বলেন, বৈষম্য দূরীকরণে এটি একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ মাত্র। সংখ্যা দ্বিগুণ করলেও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের সংখ্যা দাঁড়াতো ১৫% । তখন বাঙালির অনুপাত ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬%। মে. জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা নীতিনির্ধারকদের চাপ দিতে থাকেন তার এই যুক্তিতে যে, পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার জন্য তার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। এরই মধ্যে মে. জেনারেল খাদিম জিএইচকিউ থেকে একটি ‘অতি গোপনীয়’ চিঠি পান। চিঠিতে তার প্রস্তাব বাস্তবায়ন সম্পর্কিত নির্দেশনা আছে মনে করে চিঠি খুলে তিনি আবিষ্কার করেন অন্য কিছু। চিঠিতে কমান্ডার-ইন-চিফের (ইয়াহিয়া) আদেশের বরাত দিয়ে বলা হয়, কেবল বাঙালি সৈন্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আরো দুটি (৮ এবং ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) গঠন করার। এ পর্যন্ত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাতটি ব্যাটালিয়ন ছিল, যার চারটি ১, ২, ৩ এবং ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। জিএইচকিউর চিঠি পেয়ে মে, জেনারেল খাদিম উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠেন। তিনি এই আদেশের পরিণতি এবং তার আগেকার প্রস্তাবের যৌক্তিকতা বোঝাতে পরদিনই রাওয়ালপিন্ডি পৌছেন। তিনি সামরিক নীতিনির্ধারকদের বোঝাতে চেষ্টা করেন, তাদের উদ্দেশ্য যদি পূর্ব পাকিস্তানে একটি ‘বাঙালি সেনাবাহিনী’ তৈরি করা হয় তবে ঠিক আছে। আর উদ্দেশ্য যদি হয় পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করা, তবে তার প্রস্তাব বাস্ত বায়ন আবশ্যক। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া ছিল বাস্তবিকই কঠিন। রাজনৈতিক বিবেচনায় ইয়াহিয়া খানকে সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের সংখ্যা বাড়ানোর আদেশ দিতে হয়েছে একরকম বাধ্য হয়েই। পাকিস্তানের সেনানায়কদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি যত না ছিল রাজনৈতিক ততটা ছিল সামরিক বিবেচনা প্রসূত। সিদ্ধান্ত গ্রহণে এহেন দোদুল্যমান অবস্থায় যা হয় তাই হলো। ইয়াহিয়া উভয় চাপে একটি সঠিক সিদ্ধান্তের স্থানে একটি ‘আপোস’ সিদ্ধান্ত প্ৰদান করলেন। প্রেসিডেন্ট এবং কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল ইয়াহিয়া আদেশ দিলেন ২৫% বাঙালি সৈনিককে পরীক্ষামূলকভাবে ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, বেলুচ এবং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অন্তর্ভুক্ত করে এই শূন্যতা অবাঙালি সৈন্য দিয়ে পূরণ করতে। উদ্দেশ্য, এই পরীক্ষা সফল হলে বাঙালি-অবাঙালি ভবিষ্যতে মিশ্রণের এ অনুপাত আরো বাড়ানো। পরে যেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নাম এবং কিছু বাঙালি সৈনিক ব্যতীত বাঙালি ইউনিট বলতে বস্তুত কিছুই না থাকে। এই প্রক্রিয়ায় ৩১ ডিসেম্বর (১৯৭০) তখন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত ১ম, ২য়, ৩য় এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সম্মিলিত এক কোম্পানি সৈনিকদের ১৯ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (এফএফ) রেজিমেন্টের অন্তর্ভুক্তি প্যারেড (Induction Parade) আয়োজন করা হয় ঢাকা স্টেডিয়ামে। অত্যন্ত সতর্কতা ও কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে এই প্যারেডের ব্যবস্থা করা হয়। ১৪ ডিভিশনের জিওসি মে. জেনারেল খাদিম হোসেন রাজাসহ অন্যান্য সিনিয়র অফিসার বাঙালি সৈনিকদের বিদ্রোহের আশঙ্কায় শঙ্কিত ছিলেন। শেষতক অনুষ্ঠানটি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত রাজনীতিবিদদের সামরিক বাহিনী সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ও জ্ঞান দুই ছিল সীমিত। ফলে তারা সেনাবাহিনীতে চলমান এই কর্মকান্ড সমন্ধে সচেতন ছিলেন না। সত্তরের জানুয়ারি মাসে যশোর সেনানিবাসে এমন একটি অন্তর্ভুক্তি প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক প্ল্যাটুন সৈনিক ২৫ বেলুচ রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয় আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের মূল ভিত্তি ছিল আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচি। গোটা বাঙালি জাতি তখন এই কর্মসূচি নিয়ে স্বাধিকার অর্জনে আন্দোলনরত। ৬ দফার শেষ দাবিই ছিল ‘আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে। সামরিক বাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়নগুলো এবং পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) উইংগুলোকে পাকিস্তানকরণের যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা অগ্রসর হচ্ছিল সে সম্বন্ধে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের অজ্ঞতা ও অনাগ্রহ ছিল মারাত্মক ক্ষতিকর। আঞ্চলিক নিরাপত্তার উদ্দেশ্য যে আধা-সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের দাবিতে রাজনীতিবিদরা তখন আন্দোলনরত, বাঙালি এ সৈনিকরা ছিল সে ভাবি বাহিনী গঠনের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ। রাজনৈতিক আলোচনায় অথবা রাজনৈতিক দাবির আকারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি কখনোই ওঠেনি।

৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ ছিল ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তখন জয়দেবপুর রাজবাড়িতে অবস্থান করছে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। লে. জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন (বাঙালি), কর্নেল কমান্ড্যান্ট, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী (অব.); কর্নেল (জুলাই ১৯৭০ সালে ব্রিগেডিয়ার) মাহমুদুর রহমান মজুমদার, কমান্ড্যান্ট, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারসহ চাকরিরত এবং অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র বাঙালি অফিসাররা এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া তখন ঢাকাস্থ ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারস-এ কর্তব্যরত সব সিনিয়র অফিসারও উপস্থিত ছিলেন। গভর্নরের বেসামরিক বিষয়ক উপদেষ্টা মে. জেনারেল রাও ফরমান আলী খান হাজির ছিলেন। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়-১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮, ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯, ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-৪, ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩ সালে। উনসত্তরে যে জাতীয়তাবাদী চেতনায় বাঙালি আন্দোলিত হয়, তার হাওয়া বাঙালি সৈনিকদের গায়েও লাগে। কাকতালীয়ভাবে উপরোক্ত চারটি ব্যাটালিয়নের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীই ফেব্রুয়ারি মাসে। সত্তর এবং একাত্তরে এ ব্যাটালিয়ন চারটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হয় ভিন্নরকম উপলব্ধি এবং অনুভূতির মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানিরা বাঙালি সৈন্যদের এ মৌনতা ও উদ্বিগ্নতা অবলোকন করে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে। তারা ক্রমাগতভাবে আতঙ্কিত হতে থাকে এই ভাবনায়, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই ব্যাটালিয়নগুলো হয়ত বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে প্ৰকাশ্যে একাত্মতা ঘোষণা করবে। একাত্তরের মার্চ মাসের শুরু থেকেই বাঙালি সৈনিকরা গোপনে তাদের প্রস্তুতি গ্ৰহণ করতে থাকে। তারা পরিষ্কার উপলব্ধি করে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হয়ত তাদের হত্যা বা নিরস্ত্র করবে। তারাও গোপনে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র তাদের সঙ্গে রাখতে থাকে-সামরিক আইনে যা অনুমোদিত নয়। অবাঙালি অধিনায়ক এবং অফিসাররা এসব জেনেও হস্তক্ষেপ করতে সাহস পাননি। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭০ সালে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং এর অব্যবহিত পরই চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার আদেশ আসে। লে. কর্নেল মোশতাক আহমেদ (বাঙালি) ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মনোনীত হন। ডিভিশন হেডকোয়ার্টারস থেকে তাকে ব্রিফিং নিয়ে কর্মস্থল চট্টগ্রামে যেতে আদেশ দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ১৪ ডিভিশন হেডকোয়ার্টারসের বাথরুমে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তার মৃত্যুর বিষয়ে দ্বিমত আছে। পাকিস্তানিরা তাকে গুলি করে মারে, না তিনি আত্যহত্যা করেন তা নিরূপণ হয়নি।

সত্তরের সেপ্টেম্বরের শুরুতে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর আবদুল রশিদ জানজুয়া (অবাঙালি) পদোন্নতি পেয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কত্ব গ্ৰহণ করেন। এর অল্পদিন পর ২য় ইস্ট বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক হিসেবে যোগদান করেন। তার স্থলে ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭০ মেজর কাজী মোহাম্মদ সফিউল্লাহ ২ ইস্ট বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক হয়ে আসেন। ঢাকাস্থ ৫৭ ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর, মেজর খালেদ মোশাররফকে তার আগেকার ইউনিট ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, কুমিল্লা সেনানিবাসে বদলি করা হয় উপ-অধিনায়ক হিসেবে। তিনি একাত্তরের ২২ মার্চ কুমিল্লায় যোগদান করেন। তাছাড়া ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নামে ছাত্রদের সামরিক প্ৰশিক্ষণের জন্য একটি ব্যাটালিয়ন ছিল ঢাকা সেনানিবাসে। এটি অন্যান্য ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের মতো নিয়মিত পদাতিক ব্যাটালিয়ন ছিল না। এ ব্যাটালিয়নটির নাম ছিল ‘ন্যাশনাল সার্ভিস ব্যাটালিয়ন’। অল্প কয়েকজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও) এবং স্বল্প সংখ্যক নন-কমিশন্ড অফিসার (এনসিও) কেবল প্রশিক্ষণের জন এই ব্যাটালিয়নে নিয়োজিত ছিল। ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল মুয়ীদউদ্দিন আহম্মেদ (বাঙালি) ।

সত্তরের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় বাঙালিদের মধ্যে অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্য এবং চোখে নতুন স্বপ্ন এনে দেয়। বাঙালি রাজনীতিবিদরা ফেব্রুয়ারি মাস থেকে প্রায় অচলাবস্থায় পৌঁছে যাওয়া রাজনৈতিক সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান খোঁজায় ব্যস্ত থাকেন। বিভিন্ন সেনানিবাসে বাঙালি সৈনিক ও অফিসারদের মধ্যে বিরাজ করে চরম অনিশ্চয়তা। বিরাজমান সমস্যা তারা কিছুটা উপলব্ধি করলেও সেনাবাহিনীর কঠোর শৃঙ্খলা ও পাকিস্তানিদের নিবিড় তদারকির মধ্যে তাদের বস্তুত কিছুই করার ছিল না। সে বিবেচনায় ইপিআর-এর সৈনিকরা ভালো অবস্থায় ছিল। বেসামরিক ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ এবং আলাপ-আলোচনার তাদের যথেষ্ট সুযোগ ছিল। পিলখানার সদর দফতর ছাড়া সেক্টর সদর দফতর, উইং সদর দফতর, বিওপিগুলোর (বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট) অবস্থান ছিল যথাক্রমে জেলা শহর, মহকুমা শহর এবং সীমান্তবতী অঞ্চলে। ইপিআর সৈনিকরা তাদের সাধ্যমতো প্ৰস্তুতি নেয়। উইং সদর দফতরের অবস্থা ছিল একটু ভিন্ন। প্রতি উইংয়ে উইং কমান্ডার ছিলেন একজন মেজর। দু’জন ক্যাপ্টেন, কখনো কখনো একজন ক্যাপ্টেন সহকারী উইং কমান্ডার হিসেবে থাকতেন।

উইং মেডিকেল অফিসার হিসেবে আমি মেডিকেল কোরের একজন ক্যাপ্টেন (ডাক্তার) থাকার কথা থাকলেও প্রায়ই কেউ পোস্টেড থাকতো না। সেক্টর সদর দফতরে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল এবং সেক্টর উপ-অধিনায়ক ছিলেন মেজর । একজন মেজর (ডাক্তার) থাকতেন সেক্টর মেডিকেল অফিসার হিসেবে। ইপিআর-এর সব অফিসারই সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে নিয়োজিত থাকতেন এবং এরা প্ৰায় সবাই ছিলেন অবাঙালি। সৈনিকদের ক্ষেত্রে প্রায় ৯৫% ছিল বাঙালি। সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার বিপদের ঝুঁকি নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে জাতীয় পরিষদের সদস্য কর্নেল এমএজি ওসমানী (অব.) এবং ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের এবং নীতিনির্ধারক পর্যায়ে যোগাযোগ করেন। তারা সেনানিবাসগুলোর ভেতরের পরিস্থিতি ও বাঙালি সৈনিকদের প্রতি সম্ভাব্য নির্দেশ ও ভবিষ্যৎকরণীয় সম্বন্ধে জানতে চান। তারা পাকিস্তানি সৈনিকদের চরম বাঙালিবিদ্বেষমূলক আচরণ ও যুদ্ধ প্রস্তুতির বৃত্তান্ত ও বর্ণনা করেন। উত্তরে এ অফিসারদের অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেয়া হয় এবং বলা হয়, সময় এলে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হবে। অপরদিকে পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানে বাড়তি সৈন্য সঞ্চালন করতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অতিরিক্ত সৈন্যই কেবল আনা হচ্ছিল না, বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ অফিসার ও কয়েকজন বাড়তি জেনারেলও আনা হয়। বাঙালি রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের নেতারা বরাবরই সামরিক বিষয়গুলোর ওপর রাজনৈতিক বিবৃতি দিয়ে তৃপ্ত থাকেন।

বস্তুত বাঙালি সৈনিকরা, যদি কোনো রাজনৈতিক সমাধানে পৌছানো না যায় তাহলে যে সম্ভাব্য সশস্ত্ৰ সংগ্রাম ও প্রতিরোধের জন্য যে অপরিহার্য হয়ে উঠবে সে ভাবনায় কেউই ভাবিত হয়নি। ইপিআর-এর বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরাও একই পরিস্থিতিতে থাকে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৮টি ব্যাটালিয়নের মধ্যে ৫টি ব্যাটালিয়ন তখন পূর্ব পাকিস্তানে। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যশোর সেনানিবাসে, ২য় ইস্ট বেঙ্গল জয়দেবপুর রাজবাড়ীতে, ৩য় ইস্ট বেঙ্গল সৈয়দপুর সেনানিবাসে, ৪ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কুমিল্লা সেনানিবাসে, ২৫ মার্চে ব্ৰাহ্মণবাড়িয়ায় এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহরের এলাকায় অবস্থিত ছিল। বাকি তিনটি ব্যাটালিয়ন ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পাকিস্তানি সামরিক নীতি-নির্ধারকরা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে, পূর্ব পাকিস্তানে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেয়া হলে বাঙালি সৈনিকরা বিদ্রোহ করবে এবং প্রথম প্রতিরোধ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলো থেকেই আসবে। ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সত্তরের ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠার পরপরই ৮ম ইস্ট বেঙ্গলকে পশ্চিম পাকিস্তানের খারিয়া সেনানিবাসে বদলি করার নির্দেশ আসে। নির্দেশ মতো ব্যাটালিয়নের ভারি সব অস্ত্রসহ এক কোম্পানি সৈন্য অগ্রগামী দল হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তান চলে যায়।

বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের আক্রমণের মুখে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলোর সংঘবদ্ধ ও পরিকল্পিত প্রতিরোধ এড়ানের জন্য ব্যাটালিয়নগুলোকে বিভিন্ন অজুহাতে সেনানিবাসগুলোর বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ পর্যায়ে বাঙালি সৈনিকরা কোথাও কোথাও স্থানীয় জনসাধারণ এবং রাজনীতিবিদদের সংস্পর্শে আসেন। এ ক্ষেত্রে তারা গোপনে সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রস্তুতিও নিতে থাকেন। কিন্তু এর সবই ছিল বিচ্ছিন্ন ও সমন্বয়হীন। ইবিআরসি, ৫টি ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন এবং ১৭টি ইপিআর উইং, পুলিশসহ অন্যান্য আধাসামরিক বাহিনীর মধ্যে কোনো যোগাযোগ ও সমম্বয় ছিল না। জেলা পুলিশ এবং আনসারদের অস্ত্র ও গুলি মহকুমা সদরে ট্রেজারিগুলোতে থাকতো। আনসারদের জন্য সংরক্ষিত রাইফেল সংগ্রহ ও ব্যবহারের কোনো কেন্দ্রীয় নির্দেশনা ছিল না। যদিও ২৫ মার্চের পর প্রায় ক্ষেত্রেই ট্রেজারির অস্ত্ৰ মুক্তিযোদ্ধারা হস্তগত করতে সক্ষম হয়।

মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি সৈন্য, ইপিআর, পুলিশ এবং আনসারদের সংখ্যা

ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের সৈন্য-৩,৫০০, ইবিআরসিতে রিক্রটসহ (প্ৰশিক্ষণরত সৈনিক) সৈন্য-২,৫০০, ইপিআর-১৫,০০০, বিভিন্ন হেডকোয়ার্টার এবং ইস্ট বেঙ্গল ১,৫০০, বিমান বাহিনী ও নৌ-বাহিনীতে চাকরিরত-৫০০, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন ইউনিট থেকে ছুটি ভোগরত-১,০০০, যুদ্ধের জন্য ইচ্ছুক এবং শারীরিকভাবে সুস্থ অবসরপ্রাপ্ত ১০,০০০ মোট ৩৪,০০০ সৈন্য। তাছাড়া রাইফেল পরিচালনায় প্ৰশিক্ষণপ্ৰাপ্ত পুলিশ-২০,০০০ এবং আনসার ১০,০০০ গোটা প্রদেশে ছড়িয়ে ছিল। মোদ্দাকথা পাকিস্তানিদের সশস্ত্ৰ আক্রমণ প্ৰতিহত এবং প্রতিরোধ করার জন্য সর্বমোট ৬৪,০০০ লোক পূর্ব পাকিস্তানে উপস্থিত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যসংখ্যা ছিল ২৫,০০০। তাছাড়া সব বাঙালি জনগণ ছিল পাকিস্তানবিরোধী (হাতেগোনা অল্প কিছু লোক ব্যতীত) এবং স্বাধীনতার জন্য অথবা পাকিস্তানি সামরিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বা সহায়তা করতে সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত। যেসব বাঙালি ঠিকাদার বিভিন্ন সেনানিবাসে পচনশীল খাবার (মাছ, মাংস, মুরগি, ডিম, দুধ, সবজি, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি) সরবরাহ করত তারাও সব সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে রশদ ও টিনজাত খাদ্যের ওপর তখন তাদের নির্ভর করতে হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তখন কাৰ্যত দখলদার বাহিনী ও অবাঞ্ছিত হিসেবে দেখা হয়। বাস্তবে তারা সেনানিবাসগুলোতে অবরুদ্ধ হয়ে থাকে। এত বিপুল জনসমর্থন এবং বিশাল যুদ্ধক্ষম লোকবল সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়নি। এদের সংগঠিত করে পরিকল্পিতভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য কাজে লাগাতে পারলে পাকিস্তানিরা নির্বিচারে হত্যা করার সুযোগ পেতো না। মুক্তিযুদ্ধ এত রক্তাক্ত এবং প্রলম্বিত হওয়ারও প্ৰয়োজন হতো না।

একাত্তরের মার্চের ১-১০ তারিখের মধ্যে ভারতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল মধ্যবর্তী নির্বাচন এবং ভারতের পঞ্চম সাধারণ নির্বাচন। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস (আই) নির্বাচনে জয়ী হয়। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ১২ নভেম্বর ১৯৬৯ কংগ্রেস থেকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ইন্দিরা গান্ধীকে বহিষ্কার করা হয়। ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেস (আই) নামে বিভাজিত দল তৈরি করেন একাত্তরে যাদের নির্বাচনী প্লোগান ছিল—‘গরিবি হটাও’। কংগ্রেস (এম) নির্বাচনী স্লোগান দেয় ‘ইন্দিরা হটাও’। অনিশ্চিত এবং অস্থির অবস্থায় ইন্দিরার বিজয় ছিল পরবর্তী বিচারে একটি মাইলফলকতুল্য ঘটনা। কাজেই নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক প্রচারণা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের জন্য ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করতে পারেনি। এমনকি ইন্দিরা গান্ধী সরকার গঠনের পরে ২৫ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত যে অল্পদিন সময় পেয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক মূল্যায়নের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (RAW-Research and Analysis Wing) আরএন কাও-এর নেতৃত্বে ১৯৬৮ সালে গঠিত হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের অনাগ্রহ ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ না পাওয়ার কারণে তাদের কাজের পরিধি ও দক্ষতা ছিল সীমাবদ্ধ। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মে, জেনারেল জেএফআর জ্যাকব বলেন, ‘র’ আমাদের তেমন কিছুই দিতে পারেনি। (The Research and Analysis Wing (RAW) gave us next to nothing) (Surrender at Dacca-Birth of a Nation, p. 47)

উপসংহার

ইতিহাসে ‘যদি’ শব্দের কোনো স্থান নেই। একাত্তরের মার্চে সৈন্য সংখ্যার আধিক্য ছিল বাঙালিদের। সর্বোপরি ছিল গণমানুষের অকুণ্ঠ ও শেষ সম্বলের সমর্থন। কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা ছিল প্রকট। তারপরও করণীয় কাজ করা হয়নি। আমরা যুদ্ধবাজ জাতি নই। সব সমস্যার সমাধান আমরা শান্তিপূর্ণভাবে চাই, যতক্ষণ না পর্যন্ত যুদ্ধ অপরিহার্য না হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের ওপর ভবিষ্যতের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে যেন একাত্তরের শিক্ষা ভুলে না যাই।