লড়াই-ক্ষ্যাপা জুলফিকার
এক সময় পাকিস্তান পিপলস পার্টি নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো সাড়ম্বরে ঘােষণা করেছিলেন যে দরকার হলে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে হাজার বছর লড়াই করে যাবার জন্য তৈরি আছেন। বাঙলাদেশে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর হাতে পাকিস্তানি দখলদার সেনারা প্রচণ্ড মার খেয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু জুলফিকার আলি ভুট্টোর লড়াইয়ের সাধ নাকি এখনও মেটেনি। পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে হাতে ক্ষমতা পাবার পরই এক বেতার বক্তৃতায় ভুট্টো গলাবাজি করে ঘােষণা করেছেন, ভারত যে অপমানের বােঝা চাপিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান তার বদলা নেবেই। অর্থাৎ সােজা কথায়, বাঙলাদেশ আত্মসমর্পণ করতে এবং পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে পাকিস্তান বাধ্য হয়েছে বটে কিন্তু পাকভারত উপমহাদেশে আবার লড়াই বাঁধাবার চেষ্টা সে ছাড়বে না, শান্তি স্থায়ী হতে সে দেবে না—এ কথাটাই ভুট্টো জানাতে চান।
কথায় বলে কারাে পৌষ মাস, কারাে সর্বনাশ। ভুট্টোর পরামর্শে চলতে গিয়ে ইয়াহিয়া খার সর্বনাশ হয়েছে, সর্বনাশ তিনি ডেকে এনেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কপালে, সর্বনাশ করেছেন বাঙলাদেশের অগণিত সাধারণ মানুষের। কিন্তু কপাল ফিরেছে মি. ভুট্টোর। ভদ্রলােক ক্ষমতার গদিতে বসার জন্য ঘুরঘুর করছিলেন কিন্তু জুত করতে পারছিলেন না। সামরিক কর্তারা ক্ষমতা আঁকড়ে বসেছিলেন রাওলপিণ্ডিতে ভুট্টো প্রায় বেকার। পুরাে বেকার অবশ্য ছিলেন না। সামরিক জুন্টার ফুটফরমাস খাটছিলেন; ছুটছিলেন পিকিংয়ে চৌ এন-লাই এর কাছে দরবার করতে, উড়ে গিয়ে জুড়ে বসছিলেন ওয়াশিংটনে নিকসনের পদ-মর্দন করতে। তাতে সামরিক কর্তাদের কাছ থেকে ইনামও মিলেছিল। কিন্তু কেবল তাতে তুষ্ট হতে পারছিলেন না ভুট্টো।
ভুট্টো চিরদিনই চেয়েছেন নিজের হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা। কিন্তু সে পথে বাধা ছিল বিস্তর। পাকি জাতীয় পরিষদে বাঙালিরা হয়েছিল গত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ঐ ব্যবস্থা চালু থাকলে ভুট্টোর স্বপ্ন। কোনদিনই সফল হবার আশা ছিল না। ভুট্টো তাই সে ব্যবস্থা বানচাল করার পরামর্শ দিলেন ইয়াহিয়া খা আর তার সাকরেদদের। এক ঢিলে তাতে অনেক পাখি মরল। মুজিবর রহমানের আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা গেল এবং শেষ পর্যন্ত সেই পরামর্শের ধাক্কায় ইয়াহিয়া খা গদি থেকে ছিটকে পড়ে গেলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে বটে কিন্তু রাওয়ালপিণ্ডিতে ভুট্টো এখন একচ্ছ ‘সম্রাট’ । প্রেসিডেন্টের অধীনে প্রধানমন্ত্রী নয়, খােদ প্রেসিডেন্ট স্বয়ং। এমনকি মার্শাল ল পরিচালক হিসেবে সবার দণ্ডমূণ্ডের কর্তা। ভুট্টোর প্রাণে তাই পুলকের অন্ত নেই।
কিন্তু পুলক প্রকাশ করার বিপদ আছে। তাতে নিজের চামড়া বাঁচানাে দায়। ভুট্টো অবশ্য তারস্বরে চেচিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে, পাকিস্তানের কপাল যে পুড়েছে তার জন্য দায়ী ইয়াহিয়া এবং সামরিক গােষ্ঠী, দায়ী আমলার দল। অর্থাৎ এ-ব্যাপারে তিনি নেহাৎ নিরপরাধ ভালােমানুষ। কিন্তু পাকিস্তানের মানুষের কাছে অনেক কথা, অনেক দিন ধরে শাসকচক্র গােপন রাখার চেষ্টা করলেও তারা এটুকু জানে যে বাঙলাদেশে সামরিক বর্বরতার পিছনে বেসামরিক যে ব্যক্তিটি সবসময় কলকাঠি নেড়েছেন তার নাম জুলফিকার আলি ভুট্টো যার রাজনীতির মূলধন চিরকেলই ছিল ভারতের বিরুদ্ধে সীমাহীন বিদ্বেষ। ইতিমধ্যেই তাই কোনাে কোনাে মহলে ভুট্টোর বিরুদ্ধেও বিক্ষুদ্ধ মনােভাব প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক পরাজয়ের ক্রোধ আর ক্ষোভের অভিব্যক্তির ধাক্কাটা যাতে নিজের ঘাড়ে না পড়ে তাই ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের বিক্ষুব্ধ মানুষেকে নতুন করে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন। হুক্কার দিয়ে বলেছেন—এ অপমানের প্রতিশােধ নেবাে, কিছুতেই ছাড়বাে না ভারতকে। আর সেই সঙ্গে স্তোকবাক্য শােনাচ্ছেন, বাঙলাদেশ হাতছাড়া হয়ে গেছে বটে কিন্তু তবু কাগজে কলমে গােটা পাকিস্তান থাকবেই। প্রেসিডেন্টের গদিতে বসে প্রথম বক্তৃতায় ভুট্টো জানিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অবিভাজ্য অংশ। সামরিক কর্তাদের কার্যকলাপের ফল যদি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ক্রুদ্ধ হয়ে থাকেন তবে তারা যেন আমাদের ক্ষমা করেন। যে ভুট্টো বাঙলাদেশের মানুষকে মানুষ বলেই গণ্য করতেন না—তার সুর কী নরম, কী মধুর। কিন্তু নরম গরম কোন সুরেই বাঙলাদেশ আর পূর্ব পাকিস্তানের হবে না। ভুট্টো নিজেও সেটা ভালাে করেই জানেন। তবু কেন খাতায় কলমে পূর্ব পাকিস্তানকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা?
এর একটা উদ্দেশ্য পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষকে ধাপ্পা দেওয়া আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে ঝামেলা বাধানাের সুযােগ খোজা। পূর্ব পাকিস্তান খাতায় কলমে রেখে দিলে ভারতের বিরুদ্ধে বিষােদগারের সুযােগ জুটবে বলে সম্ভবত ভুট্টোর ধারণা হয়েছে। ভারতের উদ্দেশ্যে উপদেশ দিয়ে তাই এই পাকিস্তানি বীর বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তান জয় করে ভারতের আত্মহারা হওয়া উচিত নয়। তাদের উচিত পূর্ব পাকিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে নেওয়া।
প্রক্তন পূর্ব পাকিস্তান এবং এখনকার স্বাধীন বাঙলাদেশ সম্বন্ধে ভুট্টো যত কম মাথা ঘামান ততই মঙ্গল। ভারতে যে পূর্ব পাকিস্তন জয় করেনি তা বাঙলাদেশের মানুষ নিজেদের রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতা থেকেই জানেন। ভারতীয় বাহিনী যতশীঘ্র সম্ভব বাঙলাদেশ থেকে চলে আসবে, প্রয়ােজনের অতিরিক্ত এক দিনও সেখানে থাকবে— একথা আমাদের প্রধানমন্ত্রী অনেক আগেই প্রকাশ্যে ঘােষণা করেছেন। বাঙলাদেশের সঙ্গে ভারতের মৈত্রীবন্ধন সুদৃঢ় হয়েছে পাকিস্তানি ফৌজের অত্যাচার থেকে বাঙলাদেশেল সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বাঁচানাের জন্য প্রতিবেশী এই দু দেশের মানুষের ঐক্যবদ্ধ সগ্রামের ভিতর দিয়ে। এই মৈত্রীর ইমারতের ফাটল ধরাবার সাধ্য ভুট্টো কেন, কারুরই নেই। ভারতীয় জাওয়ানরা বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে যে বিপুল সংর্ধনা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পাচ্ছেন তার তাৎপর্য নেহাত রাজনৈতিক অন্ধ ছাড়া সকলের কাছেই পরিষ্কার।
বিন্দুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান থাকলে ভুট্টো শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দিয়ে এবং বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে এখনও বাঙলাদেশের মানুষের ক্ষমা পাবার অধিকার অর্জন করতে পারেন। ভারতের সঙ্গেও তা হলে পাকিস্তানের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারে।
কিন্তু সে পথ মাড়াতে ভুট্টো রাজি নন। এখনও তিনি তরবারি আস্ফালন করছেন। কিন্তু ভাঙা কোমর নিয়ে তার আস্ফালন নেহাতই হাস্যকর। তিনি হয়তাে ভাবছেন গায়ের ব্যথা মরলে, চীন-মার্কিন সাহায্যের টনিক খেয়ে আর-একবার ভারতের সঙ্গে পাঞ্জা কষার চেষ্টা করবেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষেরও চোখ খুলছে। ভুট্টোর সে ধরনের সাধ থাকলেও সে সাধ মেটাবার সুযােগ পশ্চিম পাকিস্তানের লােক তাকে দেবে কি? ভারত বিরােধী পাগলামির ফল কী হয় তা তাে তারা হাতে-নাতে প্রমাণ পেয়েছে।
সূত্র: সপ্তাহ, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১