আমাদের মানিক ভাই
মানিক মিয়াকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর লেখা
গভীর রাত। পিন্ডি থেকে টেলিফোনে খবর পেলাম, মানিক ভাই আর আমাদের মাঝে নেই। মনে হলাে চারদিক যেন ভয়ানক ফাঁকা, শূন্য, একেবারেই অন্ধকার। দাউ দাউ করে জ্বলছিল যেন এক মশাল, প্রজ্বলিত অগ্নিশিখায় চারপাশ ঝলমল, নাট্যশালার মহাসমারােহ; সব থেমে গেল। এ যেন মুহূর্তের অনুভূতি। একটি সংবাদ, একটি বার্তা, মাত্র একটি ঘটনা যে কতবড় হৃদয়বিদারক হতে পারে, কত বেশি মর্মান্তিক হতে পারে, তারই প্রমাণ। পর মুহর্তে আমার মানসে ফুটে উঠল দূর অতীত। ১৯৪৩ সন। মরহুম হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর বাসভবনে কলকাতায় তার সাথে আমার পরিচয়। একই নেতার দুই শিষ্য, যেন একই পিতার দুই সন্তান। বিগত পঁচিশ বছরের মধ্যে কোনদিনই আমরা বিচ্ছিন্ন হই নি, কোন ঘটনা আমাদের মধ্যে বিভেদ টানতে পারে নি। নেতা মারা যাবার পরেও আমরা এক ও অভিন্ন ছিলাম। বর্ষার মেঘরাজির ন্যায় তাঁর অপার স্নেহ সর্বক্ষণ আমাকে ঘিরে থাকত। বিশাল বারিধির ন্যায় তার প্রশান্ত বিপুল বক্ষে আমার ঠাই হয়েছিল। কোন ষড়যন্ত্র, কানকথা, নিন্দাবাক্য সেখান থেকে আমাকে দূরে ঠেলে দিতে পারে নি। আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল আবেগমিশ্রিত, হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতির রসে সিক্ত। মানিক ভাইর ভালােবাসার কথা আমি কোনদিনই ভুলতে পারব না। আজ মানিক ভাই সম্পর্কে লিখতে বসে আমার কলম বার বার থেমে যাচ্ছে, আমার ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে, হয়ত ভাববার ক্ষমতাও। তবুও মানিক ভাই সম্পর্কে আমার যেটা ব্যক্তিগত অনুভূতি, তা আমি প্রকাশ করব। মানিক ভাইর কর্মময় জীবনের পরিধি খুবই ব্যাপক ও বিস্তৃত। তাঁর সাথে আমার পঁচিশ বছরের পরিচয়ের ইতিহাস এদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ভাবধারার ঘাতপ্রতিঘাত, উত্থান-পতন, আলােড়ন-আন্দোলন, অগ্রগতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত। বাংলা ও পরবর্তীকালে পাকিস্তানের রাজনীতিতে মানিক ভাইর আসন দর্শকের গ্যালারিতে ছিল না। দূরত্ব বজায় রেখে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পৃষ্ঠপােষক বলে তিনি আরাম-আয়েশ ভােগ করেন নি; বিপদসংকুল দুর্গম পথে পা বাড়িয়েছেন। নিজ জীবনের ঝুঁকি এবং অত্যাচার ও নিপীড়নের মারগুলাে মাথায় পেতে নিয়ে তিনি গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে এগিয়ে নেবার কাজে আত্মনিয়ােগ করেছিলেন। ত্যাগৱতী শহীদ সােহরাওয়ার্দীর বিমূর্ত দেশ প্রেমিকতা, স্বাদেশিকতা তাকে প্রভাবিত করেছিল। গণশক্তির উপর ছিল তার প্রগাঢ় আস্থা। নিয়মতান্ত্রিক গণ-অভ্যুত্থানকে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি ছিলেন ইবনে খালেদুন ও রুশাের প্রকৃতিদত্ত মানব স্বাধীনতা ও প্রজাতন্ত্রের জাগ্রত চিন্তাবাহী, লিংকনের “Government of the people. by the people, and for the people”-এর পূজারি, প্রকৃতি প্রদত্ত বৈচিত্র মেনে নিয়ে “সব মানুষ সমান” এই তত্ত্ববাদে বিশ্বাসী।
নীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। একান্ত কঠিন ও নিতান্ত অনমনীয়। পাষাণ প্রাচীরের ন্যায় অটল। কায়েমী স্বার্থের নিক্ষিপ্ত শরগুলাে তার বক্ষে এসে ভেঙে ভেঙে পড়েছে। ইত্তেফাক বারবার বন্ধ হয়ে গেছে। মানিক ভাই টলেন নি। রােগাক্রান্ত হয়ে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে দিন কাটিয়েছেন। তবু আপস করেন নি। মানিক ভাই ছিলেন কর্মবাদী পুরুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন, কাজের মাঝেই মানুষ বেঁচে থাকে। পদের মাঝে নয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সনের নির্বাচন, ‘৬২র গণ-জাগরণ, ‘৬৫ সনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, ১৯৬৬ সন ও তার পরবর্তীকালের স্বায়ত্তশাসন কায়েমের গণঅভ্যুত্থানে মানিক ভাই নেতৃত্ব দিয়েছেন। কর্মী ও নেতাদের। দিকনির্দেশ করেছেন। লেখনীর দ্বারা আমাদের দাবি-দাওয়াকে জনগণের দরজায় পৌছিয়ে দিয়েছেন, বিরুদ্ধ শক্তিগুলাের আক্রমণ প্রতিহত করেছেন। নিজের জন্যে কোনদিন তিনি কিছু চান নি। একটু ইঙ্গিত করলে, সামান্য আভাস দিলে, একটু পট-পরিবর্তন করলে প্রভূত ঐশ্বর্য মানিক ভাইর পায়ের কাছে এসে জমা হতাে। সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর একবার আমি নিজে। তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি হবার জন্যে অনুরােধ জানিয়েছিলাম, মানিক ভাই হেসে বলেছিলেন, “সংগঠন আপনাদের, কলম আমার।” প্রত্যাখানের কি অপূর্ব সুন্দর পদ্ধতি। ১৯৫৫ সনে তাকে গণপরিষদের সদস্যপদ গ্রহণের জন্যে বলা হয়েছিল। তিনি সেদিনও তা গ্রহণ করেন নি। আমার জানা আছে, আইয়ুব শাসনামলে তাকে বহুবার উচ্চ পদমর্যাদার প্রলােভন দেখানাে হয়েছে। তিনি ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিছু না চেয়ে দেবার যে প্রেরণা মানুষকে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দান করে, মানিক ভাইর মধ্যে সেই তাগিদ ছিল একান্ত আন্তরিক। অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি ইত্তেফাক দাঁড় করিয়েছিলেন। বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের অসহযােগিতা, অসহিষ্ণুতা, প্রতিকুল প্রতিবন্ধকতা ইত্তেফাকের যাত্রাপথে কন্টক হয়ে দেখা দিয়েছিল। আর্থিক অসচ্ছলতা ছিল আর একটি বড় বাধা। তাঁর সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্য করবার ক্ষমতা ছিল নিতান্ত সীমাবদ্ধ ও অপ্রতুল। ইচ্ছে থাকলেও কিছু করবার ক্ষমতা তাদের ছিল না। একমাত্র নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের দ্বারাই তিনি ইত্তেফাক’ বাঁচিয়ে রেখেছেন। নিজের কর্ম দ্বারা তিনি বড় হয়েছেন। উপর থেকে কেউ তাকে টেনে তােলেন নি। বাংলার সবচাইতে জনপ্রিয় সাংবাদিক ছিলেন মানিক ভাই। কলামিস্ট হিসেবে খােদাপ্রদত্ত গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। সমস্যা-সচেতনতা, বাস্তবাশ্রিত আবেগ, অনুভূতির তীব্রতা, ভাষার সাবলীল গতি, বােধগম্যতা, যুক্তি-আশ্রয়ী মননশীলতা তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য। শক্ত বিষয়বস্তুকে সহজবােধ্য করে পরিবেশন করবার ভাষা-চাতুর্য তিনি রপ্ত করতে পেরেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনের নির্ভীকতা ও সততা তাঁর রচনাগুলােকে প্রভাবিত করেছে। জীবনের ন্যায় লেখার মধ্যেও তিনি কোনদিন মিথ্যার প্রশ্রয় দেন নি। তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল গণমুখী। জনগণের কথা বলার জন্যেই তিনি লেখনী হাতে নিয়ে ছিলেন। জনগণের ভাষায় তিনি কথা বলতেন। অলঙ্কারের বাহুল্যচমক তার বিষয়বস্তুকে কোনদিন আবৃত করতে পারে নি। তিনি নিজে সৃষ্টি করেছিলেন এক নতুন সাংবাদিক ভাষা। কঠিন তাত্ত্বিক আলােচনার মাঝে রসালাে গ্রামীণ গল্প ও সর্বজনপরিচিত কাহিনী সংযােগ করে তিনি তাঁর রচনাগুলােতে প্রাণসঞ্চার করতেন। শব্দ সংগ্রহ ও প্রয়ােগে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক ও সিদ্ধহস্ত। তাঁর ব্যবহৃত শব্দগুলাে অনেক সময় নিজস্ব আভিধানিক অর্থ ছাড়িয়ে নতুন অর্থ ব্যক্ত করত।
তিনি ছিলেন উঁচুদরের গাল্পিক। রসিয়ে গল্প বলার ব্যাপারে তার সমকক্ষ আমি আর কাউকে দেখি না। Wit ও Humour-এর অপূর্ব সমন্বয় ঘটত তাঁর আলাপ-আলােচনায়। লেখার মধ্যেও আমরা এর প্রভাব দেখতে পাব। তত্ত্বগত তার্কিক আলােচনার পাশাপাশি সাধারণ রসালাে গল্পগুলাে স্থান পেয়েছে। তাকে ভুল বুঝবার অবকাশ ছিল প্রচুর। যেন ক্ষ্যাপা দুর্বাশা। সব সময় যেন বিক্ষুব্ধভাব। আসলে তিনি ছিলেন ঘাের বিপ্লবী; অন্যায়, অত্যাচার, জালেম, জুলুমের বিরুদ্ধে সর্বদা খড়গহস্ত। উৎপীড়ন, নির্যাতনকারীদের প্রতি মারমুখী। অন্তরে তিনি ছিলেন কোমল। ভালােবাসা, স্নেহ, মমতার জারক রসে ভঁর মন ছিল সিক্ত। মানিক ভাই ভালােবাসতে জানতেন। প্রাণ দিয়ে তিনি ভালােবেসেছিলেন বাংলাদেশকে। এদেশের মাটিকে, মানুষকে। তারুণ্যের প্রতি ছিল তার সীমাহীন পক্ষাপাতিত্ব। তরুণ রাজনৈতিক কর্মী ও নির্যাতনভােগীদের প্রতি তাঁর ছিল অন্তরের অশেষ দরদ। শেষের দিককার লেখাগুলােকে একেবারে নিজেকে উজাড় করে তিনি ধরা দিয়েছিলেন এঁদের কাছে। তিনি ছিলেন এক সার্বক্ষণিক প্রেরণা। অতি বড় দুর্দিনেও তার উপর আমরা ভরসা রাখতে পেরেছি। কাছে গিয়ে সাহস ফিরে পেয়েছি।
তিনি নিষ্ঠাবান সংগ্রামী ছিলেন। সংগ্রামীদেরকে তিনি ভালােবাসতেন। তিনি ছিলেন ভয়ানক আবেগপ্রবণ। তাঁর হৃদয়ের সৃজনশীল তন্ত্ৰীগুলাে সামান্য আলােড়নে ঝঙ্কার তুলতাে। অনুভূতি প্রবণ মন তার ক্ষুদ্র কারণে বিস্ফোরিত হতাে। আগ্নেয়গিরির ন্যায় দাউ দাউ করে জ্বলে উঠত। এরই মধ্যে ছিল একটা যুক্তিনির্ভর মনন। যাকে তিনি আক্রমণ করতেন, আঘাত করবার জন্যে উদ্যত হতেন, যুক্তি নিয়ে, শুভবুদ্ধি নিয়ে, সৎ বাসনা নিয়ে, মানুষের কল্যাণের ইচ্ছে নিয়ে উপস্থিত হলে তার কথাই শুনতেন। ফলে তাঁর জীবনে দেখেছি এক অপূর্ব ভারসাম্য। মানিক ভাই ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সাদাসিধে। বিলাস ও বাহুল্যকে তিনি কোনদিন কাছে ঘেঁষতে দেন নি। সামান্য আসবাবে সজ্জিত ছিল ‘ইত্তেফাক অফিসে তাঁর ব্যক্তিগত বসবার ঘরখানি। একখানা মাত্র ডেকচেয়ার; সহযােগীদের জন্যে অতি সাধারণ টেবিল, ক’খানা চেয়ার, একটা বইয়ের আলমারি। সেদিন পর্যন্ত পুরাতন একখানা ভাঙা হিলম্যান গাড়ি ব্যবহার করেছেন মানিক ভাই। ভাঙা নড়বড়ে। মাঝপথে সেটা বন্ধ হয়ে যেত। তবুও মানিক ভাই পাল্টাতে চান নি। বুড় ড্রাইভার ও পুরাতন গাড়ি তাকে পেয়ে বসেছিল। শুনেছি, ছেলে মেয়েরা অনেক কষ্টে শেষতক সেটাকে বিদায় করতে সক্ষম হয়েছিল। মানিক ভাই ছিলেন ঘাের সংসারী। নিজে তিনি বাজার করতেন। মাছ কিনবার দিকে তাঁর ছিল ঝোক। ভাবীকেও তার সাথে যেতে হতাে হাটেবাজারে। ছেলে-মেয়েদেরকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালােবাসতেন। অমন স্নেহপ্রবণ পিতৃহৃদয়ের পরিচয় আমি আর পাই নি। মানিক ভাই জানতেন, কি করে ক্ষমা করতে হয়। এই গুণটি তিনি নেতা শহীদ সােহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে অর্জন করেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে মারাত্মক লােকসান ঘটিয়ে তাঁর কাছে এসে দাঁড়ালে তিনি ক্ষমা করে দিতেন। সর্বোপরি মানিক ভাইকে আমরা পেয়েছি এক ঐতিহাসিক ব্যক্তি হিসেবে। মহাকালের আবর্তন-বিবর্তনের পথে যে মশালধারী বীর সেনানীরা আপন জীবনের স্বাক্ষর রেখে যায় ইতিহাসের পাতায়, মানিক ভাই তাদেরই একজন। এদেশের সত্যিকার ইতিহাস যদি কোনদিন লেখা হয়, তাহলে সেখানে মরহুম তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া) তার সত্য আসনটি পাবেন ও অমর-অক্ষয় এক প্রজ্বলিত জ্যোতিষ্কের ন্যায় সেখানে বিরাজ করবেন। ধন্য বাঙালি জাতি, যে তাঁকে বক্ষে ধারণ করেছিল । ধন্য বাংলার সাংবাদিক পরিমণ্ডল, যে তাকে নিজেদের জগতে পেয়েছিল। ধন্য আমরা সকলে যে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার ঘনিষ্ঠ। সাহচর্য পেয়েছিলাম। অকালে পরপারে পাড়ি জমিয়েও মানিক ভাই আমাদের সকলের মাঝে বেঁচে রইলেন। দেশের বিশেষ করে পূর্ববাংলার জন্য আজ এক সঙ্কটময় ক্রান্তিকাল। এ ক্রান্তিকালে মানিক ভাইর তিরােধান শুধু আমার বা আমাদের জন্য নয়, সাড়ে ছয় কোটি মানুষের জন্য এক বিরাট বিপর্যয়। আমরা পথ প্রদর্শককে হারিয়েছি। কিন্তু সেই পথের রেখা আমরা কিছুতেই মুছে যেতে দেব না। বরং, তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে তাঁরই পতাকা হাতে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। পথ কন্টকাকীর্ণ, এতদিন যিনি ছিলেন পাশে সাহস ও ভরসার মতাে, তিনিও নেই। তবু আমার একান্ত প্রার্থনা, যে পতাকা বহনের দায়িত্ব আমরা পেয়েছি, তাকে সার্থক লক্ষ্যে পৌছে দেবার শক্তিও যেন অর্জন করতে পারি। চিরবিশ্রামে শায়িত মানিক ভাইর স্মৃতির প্রতি এটাই হবে আমার শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ্য।
সূত্র – ইত্তেফাক, সোমবার, ৯ জুন ১৯৬৯