You dont have javascript enabled! Please enable it! 1948 | ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা কে বা কারা? - সংগ্রামের নোটবুক

ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা কে বা কারা?

কালের বিবর্তনে সত্য উঠে আসে। কিন্তু সত্যটা জানতে দলিলের বিকল্প নেই। সেই সময়কার অনেকেই অনেক বই লিখেছেন। কিছু কিছু অতিরঞ্জিত থাকা স্বাভাবিক। সেকারণে সকলের থেকে তথ্য নিয়ে হয়ত কিছুটা সত্যের কাছাকাছি পৌঁছানো যায়। ছাত্রলীগ যাদের হাতে গড়া তাদের সকলকেই ইতিহাস মনে রাখবে। যার অবদান যতটুকুই হোক না কেন। প্রশ্ন হচ্ছে কার কথা আমরা গ্রাহ্য করব? অনেকের সাথেই অনেকের কোন্দল সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় তারা তথ্য মোডিফাই করেছেন। তবু শত্রু-মিত্র সকলেরটা আপাতত নথিভুক্ত করি। আসুন তবে দেখা যাক।

১। এপ্রসঙ্গে শুরুতেই আসবে অসমাপ্ত আত্মজীবনী। এর ৮৮-৮৯ পৃষ্ঠায় এব্যাপারে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু নিজে। যদিও মূল দলিল বা ডায়েরির স্ক্যান কপি বইতে নেই। সেই হিসেবে এটাকে ডিক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট হয়ত অনেকে স্বীকার করবেন না। বলতে দ্বিধা নেই, অনেক গবেষক মনে করেন এখানে কিছুটা এডিটিং করা হয়েছে। এখানে ৪ তারিখের মিটিং এর স্থান বলা হয়েছে ফজলুল হক মুসলিম হলের কনফারেন্স রুম। আর এদিন কে কে উপস্থিত ছিলো সেটা উল্লেখ নাই। তবে তার আগে যাদের সাথে বঙ্গবন্ধুর কথা হয়েছে তাদের নাম আছে। সেগুলো হচ্ছে, আজিজ আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা [1], অলি আহাদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, দবিরুল ইসলাম, নইমুদ্দিন, মোল্লা জালালউদ্দিন, আবদুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম। [2, pp. 88–89] এই নামগুলোর মধ্যে অলি আহাদের লিখিত বই সম্পর্কে পরের পয়েন্টে লিখছি।

২। এরপর আসে অলি আহাদের বই। বইয়ের নাম, “জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫”। এর ৪১ থেকে ৪৩ নং পাতায় এবিষয়ে উল্লেখ আছে। উল্লেখ্য, অলি আহাদ অতি মাত্রায় বঙ্গবন্ধু বিরোধী। বিস্তারিত জানতে বইয়ের শুরুতে দেয়া লেখকের কথাগুলো পড়লেই বুঝতে বাকি থাকবেনা। এই বইতে ৪ তারিখের মিটিং এর স্থান বলা হয় ফজলুল হক মুসলিম হলের মিলনায়তন। [3, p. 41] এখানে কিছুটা বিস্তারিত পাওয়া যায়। বলা হয়, “সেই মুহূর্তে ঘটনাচক্রে ফেনী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নাজমুল করিম উপস্থিত ছিলেন। আমরা তাহাকেই সভাপতি করিয়া সভার কাজ আরম্ভ করি। সভায় নূতন ছাত্র সংগঠন সাম্প্রদায়িক না অসাম্প্রদায়িক হইবে এই প্রশ্নে উপস্থিত অনেকের সহিত আমার মতানৈক্য দেখা দেয়। আমি সংগঠনের অসাম্প্রদায়িক নামের পক্ষে ছিলাম। যাহা হউক, অধিকাংশের মতের পক্ষে স্বীয় প্রস্তাব প্রত্যাহার করিয়া অবশেষে আমরা সর্বসম্মতিক্রমে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ” গঠন করি।

জনাব নঈমুদ্দিন আহমদকে ও আমাকে আহবায়ক করিয়া যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তান ও ঢাকা শহর কমিটি গঠন করা হয় এবং নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের সদস্য করিয়া পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়।

(১) নঈমুদ্দিন আহমদ (রাজশাহী) আহবায়ক, (২) আবদুর রহমান চৌধুরী (বরিশাল), (৩) শেখ মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর), (৪) অলি আহাদ (কুমিল্লা), আহবায়ক ঢাকা শহর কমিটি (৫) আজিজ আহমদ (নােয়াখালী), (৬) আবদুল মতিন (পাবনা), (৭) দবিরুল ইসলাম (দিনাজপুর), (৮) মফিজুর রহমান (রংপুর), (৯) শেখ আবদুল আজিজ (খুলনা), (১০) নওয়াব আলী (ঢাকা), (১১) নূরুল কবির (ঢাকা সিটি), (১২) আবদুল আজিজ (কুষ্টিয়া), (১৩) সৈয়দ নূরুল আলম (ময়মনসিংহ), (১৪) আবদুল কুদুস চৌধুরী (চট্টগ্রাম)। শেখ মুজিবুর রহমান তখন ঢাকা ছিলেন না এবং এই সংগঠন সম্পর্কে তিনি কিছুই অবহিত ছিলেন না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, সাংগঠনিক কমিটিতে তাহার অন্তর্ভুক্তি তিনি সানন্দেই গ্রহণ করিবেন। এবং তিনি সত্যই কোন দ্বিধাদ্বন্দ বা অনীহা প্রকাশ না করিয়া বরং সংগঠনকে দৃঢ় ও মজবুত করিবার প্রয়াসে সর্বশক্তি নিয়ােগ করিয়াছিলেন। উল্লেখ্য যে, অধুনা অনেকেই শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা বলিয়া প্রচার করিতেছেন। কিন্তু ইহা ইতিহাসের বিকৃতিমাত্র।“ [3, pp. 41–42]

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে,  এখানে দাবী করা হচ্ছে শেখ মুজিব সেদিন মিটিং এ উপস্থিত ছিলেন না। যেহেতু অলি আহাদ বঙ্গবন্ধু বিরোধী সেহেতু এই তথ্যটি যাচাই করা দরকার। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু কি সেদিন উপস্থিত ছিলেন না? তাঁর লেখা ডায়েরীতে ওইদিনের উপস্থিতি সম্পর্কে সরাসরি কিছু পাওয়া যায়নি। তিনি লিখেছেন ভাববাচ্যে। “১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখে ফজলুল হক মুসলিম হলের এসেম্বলি হলে এক সভা ডাকা হল, সেখানে স্থির হল একটা ছাত্র প্রতিষ্টান করা হবে। যার নাম হবে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’।“ [2, p. 88] এবং অসাম্প্রদায়িক বিষয়টা অর্থাৎ দলের নামের সাথে ‘মুসলিম’ শব্দ রাখার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “নইমউদ্দিনকে কনভেনর করা হল। অলি আহাদ এর সভ্য হতে আপত্তি করল। কারণ সে আর সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্টান করবে না। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নাম দিলে সে থাকতে রাজি আছে। আমরা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম এবং বললাম, ‘এখনও সময় আসে নাই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করতে হবে। নামে কিছুই আসে যায় না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে, তবে নাম পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবে না। কয়েক মাস হল পাকিস্তান পেয়েছি। যে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পেয়েছি, সেই মানসিক অবস্থা থেকে জনগণ ও শিক্ষিত সমাজের মত পরিবর্তন করতে সময় লাগবে’।“ [2, p. 89] তাহলে এই অংশে দেখা যাচ্ছে, অলি আহাদের সাথে ‘মুসলিম’ শব্দ রাখা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। সেই তর্ক কি বঙ্গবন্ধু ৪ তারিখের আগের আলোচনায় তুলেছেন? নাকি ৪ তারিখে?

৪ তারিখের মিটিং কে ডেকেছিলো?

অলি আহাদ লিখেছেন, “এই সময়ে আমি জাতীয় ছাত্র সমস্যা নিরসনের ঐতিহাসিক প্রয়ােজনেই নূতন ছাত্র সংগঠন গঠন করিবার তাগিদ তীব্রভাবে বােধ করিতেছিলাম। তাই একমনা ছাত্র নেতৃবৃন্দের সহিত প্রাথমিক আলােচনা করিয়া ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারী অপরাহ্নে ফজলুল হক হল মিলনায়তনে এক ছাত্র কর্মীসভা আহবান করি।“ [3, p. 41] তাহলে দেখা যাচ্ছে, অলি আহাদ এখানে ক্রেডিট নিতে চাচ্ছেন। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখে ফজলুল হক মুসলিম হলের এসেম্বলি হলে এক সভা ডাকা হল” [2, p. 88] – অর্থাৎ তিনি ডেকেছেন কিনা তা স্পষ্ট নয়।

একইভাবে তিনি ডায়েরির ৯২ নং পাতায় লিখেছেন, “কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হল বাংলা। মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদ্দন মজলিস যুক্তভাবে সভা আহবান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল।“ [2, p. 92] অর্থাৎ এখানেও এমনভাবে “গঠন করল” শব্দ ব্যবহার করেছেন যাতে মনে হয় এই গঠন করার কাজটিতে তিনি ছিলেন না।

৩। শেখ হাসিনা সম্পাদিত Secret Document of Intelligence Branch on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman বইটির প্রথম খণ্ড অনেক আশা নিয়ে খুলেছিলাম। কারণ এখানে পাকিস্তানি গোয়েন্দা নথি থেকে অসংখ্য অজানা তথ্য বেরিয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই বইয়ের প্রথম খণ্ড, যেটায় ১৯৪৮ সালের দলিল অন্তর্ভুক্ত আছে, তার প্রথম দলিলটার তারিখ ১৩ জানুয়ারি ১৯৪৮। [4, p. 3] অর্থাৎ ৪ জানুয়ারির দলিলগুলো বাদ দেয়া হয়েছে। যেসব ছোটখাট বিষয়েও পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নথিতে লিখে রেখেছিল, তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ৪ জানুয়ারির এত বড় একটা ঘটনার আগে-পরের বিষয় নিশ্চয়ই তারা লিখেছিল। শেখ হাসিনা কেন সেটা সম্পাদনা করেছেন জানতে পারিনি এখনো। এই বইটাতেও প্রয়োজনীয় অনেক দলিলের স্ক্যান কপি দেয়া হয়নি। বইটা যখন বের হয় আমাদের আশা ছিলো অন্তত অনলাইনে সেগুলো ডিক্লাসিফাই করে দেয়া হবে। যেহেতু বইতে সব দেয়া যায়না যায়গা স্বল্পতার কারণে। এখনো আশায় আছি যে তারা দলিলগুলো পড়ার সুযোগ করে দেবেন। গর্বের সাথে উল্লেখ করছি, ব্যক্তিগতভাবে আমি বইটা থেকে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক তথ্যগুলো অনুবাদ করে যাচ্ছি, যার ২ টা খণ্ড শেষ হয়েছে। সে যাক, এই বইয়ের ১৪৬ থেকে ১৪৮ নং পাতায় ১ মে ১৯৪৯ তারিখে গোয়েন্দা বাহিনীকে দেয়া কিছু তথ্য আছে যেটি বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর করা। সেখানে তিনি বলেছেন,

“১৯৪৭ সালে আমি সিলেটের ৩০০ ভলান্টিয়ারের দায়িত্বেও ছিলাম। এছাড়াও আমি ১৯৪৩-৪৮ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিলর ছিলাম। ১৯৩৮-৪৭ সাল পর্যন্ত আমি সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সদস্য ছিলাম। দেশভাগের পর থেকে আমি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এর একজন সদস্য হিসেবে কাজ করছি। সি.পি. কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের অন্য কোন রাজনৈতিক দলের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।“ [4, p. 148] তাহলে দেখা যাচ্ছে, ১৯৪৯ সালে বঙ্গবন্ধু বলছেন তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এর একজন ‘সদস্য’ হিসেবে কাজ করেছেন। ঐদিনের বিবৃতিতে পূর্বেকার বিভিন্ন সংগঠনে কি কি পদে ছিলেন সেটিও সেখানে উল্লেখ করা আছে। দলিলটি সেই হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

৪। এরপর আসে তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরী। ১৯৪৮ সালের ডায়েরীতে মোটামুটি আকারে তিনি সেসময়কার বিষয়গুলো লিখেছেন। এই বইটিও টাইপ করা। অর্থাৎ মূল লেখার স্ক্যান কপি যুক্ত হয়নি। তবে তাজউদ্দীন আহমদ আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুগত ছিলেন; এবং তাঁর সন্তানেরাও এখনো দলের অনুগত। ফলে এই দলিলটিতে বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগের প্রতি বায়াসনেস থাকতে পারে। যদিও আমরা যে সময়টা নিয়ে আলোচনা করছি সেসময়ে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়নি। সে যাই হোক, যেহেতু এই ডায়েরিতে ৪ জানুয়ারির আগের থেকে উল্লেখ আছে সেহেতু এখানে আরও কিছু তথ্য পাওয়া যায়। যেমন, ৫ দিন আগে ৩০ ডিসেম্বর ১৯৪৭ তারিখে ডায়েরিতে লেখা, “সন্ধ্যা পৌনে ৭ টায় কামরুদ্দিন সাহেবের কাছে গেলাম। আমার পরে নাইমুদ্দিন, শওকত, আজিজ সাহেব এবং তারপর রহিম মোক্তার, আতাউর রহমান সাহেব এলেন।“ [5, p. 167] ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৭ তারিখে বিকেল ৫ টায় ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের মেইন হোস্টেলের একটি ঝগড়া থামিয়ে ৩৬ নং রূমে সংসদীয় রাজনীতি ও অন্যান্য বিষয়ে কথা শেষে ফিরে আসেন। [5, pp. 167–168] ১ জানুয়ারি ১৯৪৮ তারিখে লিখেছেন, “বিকেল ৫ টায় কামরুদ্দিন সাহেবের বাসায় গিয়ে দেখি তিনি বাইরে গেছেন। সুতরাং তাঁর সঙ্গে দেখা হলাে না। সেখানে আজিজ সাহেব, নাইমউদ্দিন সাহেব, নুরুল হুদা ও আর একজন ভদ্রলােক এলেন। তাদের সঙ্গে সন্ধ্যে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত কথা বললাম। ৭টায় নাইমউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে চক হয়ে ফিরে এলাম।“ [5, p. 169] ৩ জানুয়ারি লিখেছেন, আড়াইটায় নাইমউদ্দিন সাহেব এলেন। সাড়ে তিনটায় অলি আহাদ এলে নাইমউদ্দিন সাহেব চলে গেলেন । সাড়ে ৪টায় অলি আহাদ চলে গেলেন। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রেল লাইনের ধারে ঘুরলাম। ফেরার সময় নুরুল আলম, রশীদ ও আজিজ সাহেবের সঙ্গে দেখা হলাে। রশীদ জানাল যে, শামসুল হক সাহেব মহিউদ্দিন সাহেবকে এক চিঠিতে লিখেছেন, তিনি করাচি ও লাহােরে যুব লীগ সংগঠিত করছেন।“ [5, p. 170] ৪ তারিখে লিখেছেন,  “বেলা ১২টায় আমাদের দলীয় আলােচনার কথা জানাতে কামরুদ্দীন সাহেবের কাছে গেলাম। নাইমউদ্দিন সাহেব নেই। তােয়াহা সাহেব, অলি আহাদ, ফজলুর রহমান, একজন নতুন সদস্য এবং আরেকজন ভদ্রলােক সে সময় তার ওখানে উপস্থিত ছিলেন। মূলত এফ রহমানকে লক্ষ্য করে সদস্য পদের যােগ্যতা দিয়ে কথা হলাে। দলের একটা রেজুলেশন গ্রহণের সিদ্ধান্ত হলাে। আমি প্রস্তাব করলাম। (১) আমাদের কর্মসূচি যুক্তির মাধ্যমে সবার সামনে তুলে ধরতে হবে এবং কোনােভাবেই ধর্মকে এর সঙ্গে জড়ানাে হবে না। (২) ওলেমাদের মাধ্যমে পবিত্র গ্রন্থের বৈষম্যমূলক অপব্যাখ্যাকে আমরা প্রত্যাখান করব মাত্র, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। দুপুর ২টায় আমরা ওখান থেকে বেরুলাম। অলি আহাদ ও আমাকে তােয়াহা সাহেব মমতা রেস্টুরেন্টে ভারী নাস্তা করালেন।“ [5, p. 171] ৫ জানুয়ারি লিখেছেন, “বেলা সাড়ে ১২টায় বাহাউদ্দিন এলাে। তার সঙ্গে দেড়টা পর্যন্ত কথা হলাে। তাদের বাড়ি সম্পর্কে আমি যা শুনেছি তা স্বীকার করল। নাইমউদ্দিন সাহেব ও অলি আহাদ এলেন। বিকেল সাড়ে ৪টায় ডা. করিমের সঙ্গে দেখা করার জন্য বেরুলাম। তার বাবা ও চাচা এসেছেন। তাদের সঙ্গে তার রুমে দেখা হলাে। এরপর তাদের সঙ্গে হাফিজউল্লাহ কটেজে গেলাম। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মৌলভীবাজারে পূর্ব কোণায় দাড়িয়ে ডা. করিমের সঙ্গে কথা বললাম।“ [5, p. 172] ৮ জানুয়ারি লিখেছেন, “সকাল সােয়া ৯টায় নাইমউদ্দিন সাহেব এসে জানালেন যে, উর্দু-বাংলা বিরােধের সূত্র ধরে আমাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে এবং বলিয়াদি প্রেস থেকে আমাদের প্যালেট পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছে। বেলা ২টায় বেরিয়ে সলিমুল্লাহ কলেজে গেলাম। কলেজে পরীক্ষা চলছে। সেখান থেকে ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজে এলাম। ছাত্ররা নতুন চাকরির নিয়ােগ থেকে বাঙালিদের বাদ দেওয়ার অভিযােগ করল। দলিল ও মােখলেস তাদের কোনাে কথাই শুনছে না। তারা ক্রুদ্ধ। নাজিরাবাজার, কসাইটুলি হয়ে কামরুদ্দীন সাহেবের বাসায় গেলাম। তিনি বাড়িতে নেই। কসাইটুলিতে রুস্তম ও অপর দুই জনের সঙ্গে দেখা হলাে। এরপর পাটুয়াটুলিতে ওয়াসিউল্লাহর সঙ্গে দেখা করলাম। বিকেল সাড়ে ৫টায় নবাবপুর হয়ে কার্জন হলে গিয়ে দেখি জনাব রেজা বক্তৃতা করছেন। তার বক্তৃতার শেষাংশ শুনলাম। ড. হাসানও বক্তৃতা দিলেন। সভা ৬টায় শেষ হলাে। তােয়াহা সাহেব, অলি আহাদ ও ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের কয়েকজন ছাত্রদের সঙ্গে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বর্ধমান হাউজে গেলাম। প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দিন ও শিক্ষামন্ত্রী জনাব আবদুল হামিদের সঙ্গে প্রতিনিধি হিসেবে আমরা সাক্ষাৎ করলাম। সেখানে সচিব করিমও উপস্থিত ছিলেন। ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত কথা হলাে। প্রতিনিধি হিসেবে জনাব শফিউল আযমও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। সাড়ে ৮টায় ফিরলাম।“  [5, p. 174]

এরপরে প্রায় প্রতিদিনই নইমুদ্দিন সাহেবের সাথে কাজ করেছেন তাজউদ্দীন। কিন্তু এর মধ্যে কোথাও শেখ মুজিব নামটি নেই। এথেকে অলি আহাদের মন্তব্যটি সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহের সৃষ্টি হয়।

এখন একটা বিষয়ে তথ্যের প্রয়োজন দেখা দিল। বঙ্গবন্ধু ডায়েরীতে লিখেছেন, “এক মাসের ভিতর আমি প্রায় সকল জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমউদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্ত সকল কিছুই প্রায় আমাকেই করতে হত“ – এই বিষয়টা। [2, p. 89] এরজন্য তাজউদ্দীনের ডায়েরির পরের পাতাগুলো উলটাতে থাকি। ২৩ জানুয়ারি লিখেছেন, “সােয়া ১টায় বেরিয়ে দেড়টায় মুসলিম লীগ অফিসে এলাম। সেখানে সালেহ, শওকত ও মুজিবের সঙ্গে ২টা ৩০ মি. পর্যন্ত কথা বললাম।“ [5, p. 185] ২৪ জানুয়ারি তারিখে সকাল সোয়া ৮ টায় তাজউদ্দীনের কাছ থেকে দলের সংবিধানের কপি নিতে আসে নইমুদ্দিন। [5, p. 186] ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ তারিখে লিখেছেন, “দেড়টায় নারায়ণগঞ্জে রহমতউল্লাহ ইনস্টিটিউটে পৌছলাম। রহমতউল্লাহ ইনস্টিটিউটে নির্বাচন হবে। সেখানে মুজিব, হযরত আলী, শওকত ও সালেহ আগে থেকেই উপস্থিত। নির্বাচন শুরু হলাে ৩টায়। আমরা বাসে করে সাড়ে ৬টায় ফিরলাম।“ [5, p. 199] অর্থাৎ এদিন মূলত নির্বাচনের জন্য কাটল। ৪ ফেব্রুয়ারি লিখেছেন, “১টার দিকে অলি আহাদ এলাে। বেলা ২টায় এফএইচএম হলে তােয়াহা সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। ইয়ুথ কনফারেন্সই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে স্বীকৃতি দেওয়ায় শাহ আজিজুর রহমান পরাভূত।“ [5, pp. 201–202] এভাবে ৪ মার্চ পর্যন্ত টানা ২ মাস ডায়েরীতে আর কোথাও শেখ মুজিবের নাম শুধু দুইদিন পাওয়া গেল – একটি ২৩ জানুয়ারি লীগ অফিসে যাবার কারণে, আরেকটি নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন উপলক্ষে। [5, pp. 185, 199] জেলাভিত্তিক কমিটি করা নিয়ে কিছুই পাওয়া গেলনা। যদিও এরমধ্যে বারবার নইমুদ্দিনের সাথে দেখা হয়েছে। তাহলে এটা হয়ত ধরে নেয়া যায় যে এক মাসের মধ্যে জেলাভিত্তিক কমিটি হয়নি। এরকম কোন কমিটি অন্য কোন বইতেও পাওয়া যায়না। উল্লেখ্য, মার্চের দিকে ভাষা সংগ্রাম প্রকট আকার ধারণ করে। নেতাদের ব্যস্ততা কমিটি করার পরিবর্তে বরং আন্দোলনের দিকেই বেশী দেখা যায়।

৫। এরপর যে বইটির নাম উল্লেখ করা যায় সেটির নাম, আওয়ামী লীগঃ উত্থান পর্ব – ১৯৪৮-১৯৭০, লিখেছেন মহিউদ্দিন আহমদ। এখানে বেশ কিছু তথ্য উল্লেখ করা আছে। এবং সেই সাথে কিছু পর্যবেক্ষন দেয়া আছে। এখানেও অলি আহাদের বইয়ের ১৪ সদস্যের আহবায়ক কমিটির তালিকাটা আছে। [6, p. 28] একই সাথে শেখ মুজিবকে নিয়ে থাকা বিতর্কের উল্লেখ আছে। [6, p. 28] তবে এখানে ২৯ নং পৃষ্ঠায় নতুন একটি তথ্য আসে। তা হল মুসলিম শব্দটি বাদ দিতে অলি আহাদের মত তোয়াহাও ছিলেন। অর্থাৎ দুই জন। [6, p. 29] এর বেশী এখানে প্রাসঙ্গিক কিছু নেই। এরপর ভাষা আন্দোলন প্রকট আকার ধারণ করে যা তাজউদ্দীনের ডায়েরীর সাথে মেলে। ২ মার্চ একই স্থানে অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে তমুদ্দুন মজলিশ, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, গণ আজাদি লীগ এবং বিভিন্ন হলের ছাত্র সংসদ ও প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি পূর্ণাংগ কমিটি করা হয়। এরা পরের দিন ৩ মার্চ একটি বিবৃতি প্রকাশ করে যাতে ১১ জনের স্বাক্ষর আছে। [6, pp. 29–30] এই ১১ জন বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে স্বাক্ষর করেন। এদের মধ্যে ক্রমিক ৩ এ নইমুদ্দিন আহমদের নাম আছে ‘আহবায়ক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ হিসেবে এবং ক্রমিক ১২ তে অলি আহাদের নাম আছে ‘আহবায়ক, ঢাকা শহর ছাত্রলীগ’ হিসেবে। [6, p. 30] এখানে তাজউদ্দীন বা বঙ্গবন্ধুর নাম নেই। এই তথ্যটি তাজউদ্দীনের ডায়েরীর সাথে মেলে। তবে ১১ তারিখের আন্দোলনে শেখ মুজিব ছিলেন। [5, p. 226] বঙ্গবন্ধুর ডায়েরী থেকে জানা যায়, ১১ তারিখের ৩ দিন আগ পর্যন্ত তিনি আন্দোলনের কাজেই ঢাকার বাইরে ছিলেন। [2, p. 92], [6, p. 30] তাহলে এই সময়ে বঙ্গবন্ধু ঢাকার বাইরে থাকলে পাকিস্তান গোয়েন্দা রিপোর্ট কী বলে? ফিরে যাই Secret Document of Intelligence Branch on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Vol – I, বইয়ে। এখানেও দেখা যায় সেই প্রথম দলিল (১৩ জানুয়ারি ১৯৪৮ এর) থেকে পরের দলিলটি ৩ মার্চের। [4, p. 5] অর্থাৎ মাঝের ৪৯ দিনের কোন দলিল যুক্ত হয়নি। ৩ মার্চ তিনি ঢাকা ছিলেন। [4, p. 5] ৪ মার্চ থেকে ১০ মার্চের কোন দলিল নেই। এরপর ১১ মার্চের দলিল আছে যাতে বঙ্গবন্ধুর এরেস্ট হবার কথাটা ১ লাইনে দেয়া হয়েছে। [4, p. 8] যদিও বঙ্গবন্ধু লিখেছেন সেদিন ৭০-৭৫ জনকে ধরে নেয়া হয়েছে। [2, p. 93] (তাজউদ্দীন লিখেছেন ৬৯ জনের কথা। [5, p. 226]) অতএব, এই দালিলিক বইতেও ৪ মার্চ থেকে ১০ মার্চের কোন তথ্য পাওয়া গেলনা।

৬। পরের বইয়ের নাম,  “ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য”, লেখক আবদুল মতিন, আহমদ রফিক; বইয়ের ৫৭ নং পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা ত্যাগের পর সংগ্রাম পরিষদের যে শেষ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় সেখানে নঈমুদ্দিনের ছাত্রলীগ ও তমদুন মজলিস নিজ নিজ দলীয় কৃতিত্ব দাবি করে পরিবেশ দূষিত করে তােলেন এবং সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মজলিস কর্মী শামসুল আলম অক্ষমতার দায়ে পদত্যাগ করে মােহাম্মদ তােয়াহাকে অফিসের কাগজপত্র বুঝিয়ে দেন।“ [7, p. 57] অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে এখানে ছাত্রলীগকে সরাসরি “নঈমুদ্দিনের ছাত্রলীগ” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। তা হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের জন্য গঠিত সংগ্রাম পরিষদে  নঈমুদ্দিনের ছাত্রলীগ ও তমদুন মজলিস – দুটো সংগঠনের নাম বলা হয় যাদের মধ্যে দলীয় কৃতিত্ব নিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি হয়। [7, p. 57] তবে পূর্বের বইতে আমরা পেয়েছি যে মূলত সংগ্রাম পরিষদে আরও অনেকগুলো সংগঠন জড়িত ছিল এবং তাদের বিভিন্ন গ্রুপের পক্ষ থেকে ১১ জনের স্বাক্ষর সম্বলিত বিবৃতি ৩ মার্চ প্রকাশিত হয়েছে। [6, p. 30] অথচ এই দলিলটি পাকিস্তান গোয়েন্দা রিপোর্টে অর্থাৎ Secret Document বইতে পাওয়া যায়নি। এখানে অন্য একটি দলিল যুক্ত হয়েছে যার টাইটেল দেয়া হয়েছে, “ ’পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রদের কাছে বিলি করা একটি লিফলেট” এবং এই দলিলের ৪ নাম্বারে শেখ মুজিবের নাম রয়েছে; এবং ক্রমিক এক থেকে তিন নম্বরের নামগুলো বইতে দেয়া হয়নি। [4, p. 6] এছাড়া পূর্বেকার বইয়ের কমিটির তালিকা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর নাম ক্রমিক ৩ এ আসার কথা, ৪ এ নয়। [6, p. 27] (এই দলিলের ব্যাপারে “পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড”, লেখক বদরুদ্দিন উমর, পৃষ্ঠা ১৯৩ ও ১৯৬, বইতে উল্লেখ আছে। ১৯৬ নং পাতায় বঙ্গবন্ধুর ক্রমিক ৪ নং দেখানো হয়েছে। [8, p. 196]) সে যাই হোক, এথেকে আরও একটি তথ্য ধারণা করা যায়। সেটি হল, বঙ্গবন্ধু যে লিখেছেন এক মাসের মধ্যে জেলাভিত্তিক কমিটি করেছেন সেরকম কিছু গোয়েন্দা বাহিনী দুই মাসের রিপোর্টেও পায়নি। [4, pp. 1–9] অতএব সেটিরও আপাতত কূলকিনারা পাওয়া গেলনা।

৭। এবারের বইয়ের নাম, “পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড)”, লেখক বদরুদ্দিন উমর। এখানে শুরুতেই বদরুদ্দিন উমরের পিতার পরিচয় বলা দরকার। “অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্ট লীগের প্রাক বিভাগ জেলা কমিটি সমুহে মূল দলের প্রাদেশিক সাধারন সম্পাদক আবুল হাসিম (বদর উদ্দিন উমর এর পিতা) এর দাপট থাকায় আবুল হাসিম কলকাতায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এসকল নেতারা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তথা মুজিব গ্রুপেই চলে আসে।“ [9] এখানে জানা যায়, অলি আহাদ ও তোয়াহা অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান চেয়েছিলেন। কিন্তু তা না হওয়ায় তারা প্রতিষ্ঠানটির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলেন। যদিও পাবনার আবদুল মতিন তাদের কিছুদিনের জন্য সংগঠনে বহাল থেকে অসাম্প্রদায়িক হিসেবে চালাতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তারা সেটা মেনে নেন নাই এবং মিটিং এর পরে মুসলিম ছাত্রলীগের সাথে আর সম্পর্ক রাখেন নাই। [8, p. 197] এদিকে নইমুদ্দিন ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে বহিষ্কৃত হন। কেন্দ্রীয় অর্গানাইজিং কমিটি পুনর্গঠিত হলেও এর প্রথম প্রাদেশিক নির্বাচন সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ এর আগে সম্ভব হয়নি। [8, p. 197] এই বইতে অলি আহাদের বই সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে। এখানে দাবী করেছে যে অলি আহাদ মিটিং এর স্থান বলেছিল সলিমুল্লাহ হলে। [8, p. 197] কিন্তু অলি আহাদের বইতে দেখা গেল, না, সে ফজলুল হক হলের কথাই লিখেছে। [3, p. 41] তবে, সলিমুল্লাহ হলের কথা পাওয়া যায় মহিউদ্দিন আহমদের বইয়ের ৩৬ নং পাতায়। সেখানে দেখা যায়, ১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি জুলুম প্রতিরোধ দিবসের সভা শেষে সলিমুল্লাহ হলের ১২ নং কামরায় অলি আহাদ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক করার প্রস্তাব দেন। এইদিনে শেখ মুজিব, আব্দুর রহমান চৌধুরী ও নইমুদ্দিন আহমদ বিরোধিতা করলে প্রস্তাব বাতিল হয়। অলি আহাদ পদত্যাগপত্র দিলে শেখ মুজিব সেটা ছিঁড়ে ফেলেন। তখন ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল্লাহ কায়সার ও বাহাউদ্দিন চৌধুরী অলি আহাদকে ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দিতে অনুরোধ করলে সে বলে, “পদত্যাগ করলেও আমি ছাত্রলীগের সহযোগী হিসেবেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিব।“ [6, p. 36] অর্থাৎ বদরুদ্দিন উমরের তথ্যের কিছুটা গোলমাল আছে।

আওয়ামী লীগঃ উত্থান পর্ব – ১৯৪৮-১৯৭০ – মহিউদ্দিন আহমদ, বইয়ের ৩৯ নং পাতায় দেখা যায়, ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে কারাগারে যাওয়ার পরেই শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্র রাজনীতির ইতি ঘটে। ঐ বছর ২৩ জুন ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। ২৭ জুন শেখ মুজিব জেল থেকে ছাড়া পান। শুরু হয় নতুন দলের রাজনীতি। [6, p. 39] অর্থাৎ এথেকে দেখা যাচ্ছে, ১৫ মাস ছাত্রলীগ করার সময় পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

বইটিতে আরও লেখা হয়েছে, “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল সভা ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার তাজমহল সিনেমা হলে শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে শুরু হয়। সম্মেলনে দবিরুল ইসলাম ও খালেক নেওয়াজ খানকে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি করা হয়। এটি ছিল ছাত্রলীগের সঙ্গে শেখ মুজিবের শেষ আনুষ্ঠানিক বৈঠক। সভাপতির ভাষণে তিনি ঘােষণা দেন, তিনি যেহেতু আর ছাত্র নন, এই প্রতিষ্ঠানে তিনি আর সদস্য হিসেবে থাকবেন না।“ [6, p. 39]

সেই সময়কার আরও ঘটনা সংশ্লিষ্ট বইতে পাওয়া যায় যেখানে উপরোল্লেখিত ব্যক্তিদের নাম অসংখ্যবার এসেছে। কাজেই ইতিহাসের নিরপেক্ষ বিবেচনায় দেখা যায় সকলেই নিজের অর্জনকে নিজ আবেগ দিয়ে প্রকাশ করেছেন বলে অনেক সময় ইচ্ছায় অনিচ্ছায় নিজেদের কাজকে বড় করে দেখার চেষ্টা করেছেন। তবে বাস্তবে সকলের যথেষ্ট অংশগ্রহণের প্রমাণ পাওয়া যায়। আমি আশা করি যেসব প্রশ্নের উত্তর এখনো পাইনি বা ভুল বুঝেছি বা অতিরক্ত আরও তথ্য যেসব বইতে পাঠকরা পড়েছেন তারা আমাকে জানাবেন। কাজটা চলমান আছে, শেষ হয়নি। আপনাদের অংশগ্রহণের ফলে আসল সত্যটা জানতে পারবো আশা রাখি।

পুনশ্চঃ

কোন্‌টি আসল ছাত্রলীগ?

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০ থেকে ১৯৭১ – ডঃ মোহাম্মদ হাননান বইয়ের ১০৪ নং পাতায় এসম্পর্কে যা লেখা ছিলো তা হুবহু উল্লেখ করা হল। “২০ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাসের সংসদ প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটি বৈঠক করার চেষ্টা করেন।  কিন্তু সেখানে জগন্নাথ হলের প্রতিনিধি থাকায় জিন্নাহ শেষপর্যন্ত ছাত্রদের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেননি।

এছাড়া ২৩ মার্চ তিনি নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এই দুই উপদল মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় ২৩ মার্চ দুইদলের শাহ আজিজ ও মাজহারুল কুদ্দুস এবং মোহাম্মদ তোয়াহা, নইমুদ্দীন আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেন।  প্রথম দিনের বৈঠকে জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকেই স্বীকৃতি দান করেন। কিন্তু পরদিনের বৈঠকে শাহ আজিজ কতকগুলি পুরনো ‘আজাদ’ ও ভারতীয় পত্রিকা নিয়ে যান এবং জিন্নাহর কাছে এটা প্রমাণ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ আসলে কমিউনিস্ট। ফলে জিন্নাহ তার পূর্বমত পরিত্যাগ করেন।  কিন্তু পূর্ব থকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে এ খবর প্রচার করে দেন যে, জিন্নাহ তাদের সংগঠনকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং সকল ছাত্রদের উচিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগে যোগদান করা। “ [10, p. 104]

References:

[1]    “Toaha, Mohammad – Banglapedia.” http://en.banglapedia.org/index.php?title=Toaha,_Mohammad (accessed May 17, 2020).

[2]    রহমান শেখ মুজিবুর, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, 1st Editio. The University Press Limited.

[3]    আহাদ অলি, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫, 4th Editio. Bangladesh Co-operative Book Society Ltd., 1982.

[4]    S. Hasina, Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Vol I 1948-1950. Hakkany Publisher’s, 2018.

[5]    রিমি সিমিন হোসেন, “তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৪৭-১৯৪৮,” 1st Editio., Pratibhas, 1999.

[6]    আহমদ মহিউদ্দিন, আওয়ামী লীগঃ উত্থান পর্ব ১৯৪৮ – ১৯৭০. Prothoma, 2016.

[7]    আবদুল মতিন আহমদ রফিক, ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য, 3rd Editio. Shahitya Prakash, 1991.

[8]    উমর বদরুদ্দীন, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি. আনন্দধারা প্রকাশনী.

[9]    “ছাত্রলীগের ইতিহাস | সংগ্রামের নোটবুক.” https://songramernotebook.com/archives/8577 (accessed May 17, 2020).

[10]   হাননান ডঃ মোহাম্মদ, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০ থেকে ১৯৭১. Agamee Prakashani, 1984.