You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.30 | ভুট্টো কি এখনও স্বপ্ন দেখছেন? | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ভুট্টো কি এখনও স্বপ্ন দেখছেন?

মি. জুলফিকার আলি ভুট্টো হয় অতিশয় নির্বোধ, না হয় তিনি এখনও স্বপ্নের রাজ্যে বিচরণ করছেন। নইলে যে বাংলাদেশ দীর্ঘ ন’মাস ধরে পাকিস্তানের কবল থেকে বিচ্ছিন্ন হবার জন্যে সংগ্রাম চালাবার পর এখন স্বাধীন ও সার্বভৌম অস্তিত্ব নিয়ে জ্বলন্ত সত্যের মতাে বিরাজমান, তাকে তিনি এখনও ফিরে পাবার আশা করেন? কিংবা রাজস্থানের গঙ্গানগর সেকটরে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে ভারতীয় বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালানাের দুর্মাত হয়? নাকি লড়াই করে এখনও তার আশ মেটে নি, আর তিনি ভুলে গেছেন যে, তার প্রায় এক লক্ষ সৈন্য এই মুহূর্তে ভারতের হাতে বন্দী?
নিবোধ, কিংবা স্বপ্নচারী, কিংবা বেপরােয়া জঙ্গীবাদী, মি. ভুট্টো যেটাই হয়ে থাকুন না কেন, তাতে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, পাকিস্তানের এই মুহূর্তের স্বার্থ রক্ষা করার পক্ষে তিনি সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত ব্যক্তি। পাকিস্ত েিনর মানুষ এই কথাটা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারে ততই তাদের পক্ষে মঙ্গল। এই স্টান্টবাজ রাজনীতিকের ভাওতায় ভুলে তারা যদি তার ওপর সমুদয় আস্থা সমর্পণ করে বসে থাকেন তাহলে তারা শুধু নিজেদের জন্যে আরাে বৃহৎ সর্বনাশই ডেকে আনবেন। কেননা বাইশটি বিত্তশালী পরিবারের পাসপাের্ট আটক, কিংবা প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাইনে না নেওয়া, কিংবা কোনাে প্রকাশ্য সরকারি স্থানে নিজের ছবি টাঙ্গাতে না দেবার মধ্যে যে নতুন চমকই থাকুক না কেন, মি. ভুট্টো আসলে সেই পুরানাে জমানাকেই নতুন সাজে সাজিয়ে হাজির করতে চাইছেন। এত বড় একটা বিপর্যয়ের পরে যে-ধরনের আত্মােপলদ্ধি প্রয়ােজন ছিল এখনাে পর্যন্ত তাঁর কথায়-বার্তায় কিংবা অনুসৃত নীতিতে তার কোনাে পরিচয় নেই। ক্ষমতা লাভের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি অনেক হাত-পা ছুড়েছেন, কিন্তু অতীতের ভুলত্রুটী সংশােধনের দিকে তিনি এক-পাও অগ্রসর হন নি। শেখ মুজিবুর রহমানকে যদি তিনি কারান্তরাল থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন তবে সেটা বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানে আনবার সুযােগ-সন্ধানের ফিকিরে, কেননা মুজিবকে এখনও গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। একে কি আত্ম সংশােধন বলে? এবং এখনও তিনি যুদ্ধবিরতির পরবর্তী ব্যবস্থাগুলি নিয়ে কিংবা বন্দী প্রত্যর্পণের বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আলােচনা আরম্ভে উৎসাহ দেখান নি। তার বদলে তার সৈন্যরা এখনও মাঝে মাঝেই ভারতীয় সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। একেও কি আত্মসংশােধন বলা যায়? বাস্তব অবস্থাকে এখনও অস্বীকার করতে চেয়ে মি. ভুট্টো উত্তেজনা অনাবশ্যক জইয়ে রাখছেন, এবং এমন একটা পরিণতির দিকে যাচ্ছেন যেখানে ভারতের সঙ্গে আরেক দফা সংঘর্ষ অনিবার্য। কারণ। বাংলাদেশ এখন একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য। এই সত্যকে অম্লান রাখবার জন্যে ভারত অঙ্গীকারবদ্ধ ; আর ভারতের বিরুদ্ধে কোনাে জঙ্গী অভিসন্ধি নয়াদিল্লী মুখ বুজে সহ্য করবে না। এবং ভারতের সঙ্গে কোনাে নতুন সংঘর্ষ মি. ভুট্টোর কিংবা পাকিস্তানের মানুষ কাউকেই লাভবান করবে না।
তার চাইতে পাকিস্তানের এখন যেটুকু আছে সেটুকু রক্ষার জন্যেই মি. ভুট্টো সচেষ্ট হােন। তিনি তাে পাকিস্তানকে এক এবং অবিচ্ছেদ্য দেখতে চান। আল্লাহর দোয়ায় এখন তাে তা-ই হয়েছে। আগে ছিল দুই পাকিস্তান- এক হাজারের বেশি মাইলের ব্যবধানে। এখন পাকিস্তান কেমন সুন্দর একটি অখণ্ড ভৌগােলিক অস্তিত্ব লাভ করেছে। পরম যত্নে এখন তাকেই তিনি লালন করুন। কেননা তার প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া দরকার। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি বাংলাদেশ বিছিন্ন হওয়ার ফলে আরও শােচনীয়। আর প্রতিটি মানুষই তার জেহাদী নেতৃত্বের প্রতি অনুগত নয়। বেলুচিস্তানের দাঙ্গা ভবিষ্যতে আরেকটা বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি তার সাধের জাতীয় কোয়ালিশনের সঙ্গে সংশ্রব না রাখাই শ্রেয় মনে করেছে। এগুলিই তার পক্ষে যথেষ্ট বড় সমস্যা। তিনি এখন ঐ কাজেই আত্মনিয়ােগ করুন। ভারতের বিরুদ্ধে আর কোনাে রকম মতলব আঁটার চিত তিনি ত্যাগ করুন। আর বাংলাদেশকে ফিরে পাবার কথা তিনি ভুলে যান। এই বিপুল রক্তক্ষয়ের পরে বাংলাদেশ আর শিথিলতম সূত্রেও পাকিস্তানের সঙ্গে আবদ্ধ হতে পারে না। যা ঘটে গেছে, এমন কি মুজিবের নিজেরও ক্ষমতা নেই তাকে পাল্টে দেবার। দলের সহযােগীদের ও দেশের মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি একটা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসবেন, একথা যদি মি. ভুট্টো ভেবে থাকেন, তবে তিনি মস্তবড় ভুল করছেন। তার চাইতে মুজিবের সঙ্গে আলােচনার ভণিতাটুকু বর্জন করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে তিনি সসম্মানে মুক্তি দিয়ে অতীতের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করুন। তাতেই ইহজীবনে তার সুকৃতির ভাণ্ড পূর্ণ হবে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭১