৬ মার্চ ১৯৭১ঃ আজকের এদিনে
ষষ্ঠ দিনে আন্দোলন
ঢাকায় ষষ্ঠ দিনের মতো হরতাল পালনকালে সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে আসে।
ছাত্রলীগ রাজপথে লাঠি মিছিল করে। মহিলা আওয়ামী লীগ শহীদ মিনারে সমাবেশ করে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন। সাংবাদিক সমাজ ও লেখক সংঘ বাইতুল মোকাররম এলাকায় সভা ও শোভাযাত্রা করে। সাধারন শিক্ষক সমাজ শহীদ মিনারে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন। ওয়ালি ন্যাপ নিউমার্কেট এলাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ করে। বাংলা ন্যাশনাল লীগ পলটনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। মহিলা পরিষদ বাইতুল মোকাররম এলাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ করে। বাংলা একাডেমীতে শিল্পী সমাজ সমাবেশ করে।
ঢাকা জেলের গেট ভেঙ্গে ৩৪১ জন কয়েদীর পলায়ন।
সকাল ১১টার দিকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের প্রধান গেট ভেঙ্গে এবং পিছনের দিকের দেয়াল টপকে ৩৪১ জন কয়েদী পালিয়ে যায়। পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে ৭ জন কয়েদী নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়। আহতদের কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদের মদ্ধে ১৬ জনকে সেই দিনেই গ্রেফতার করা হয়েছে। সকালের খাবার নিয়ে বিরোধের জের হিসাবে এই ঘটনা ঘটে। কয়েদীদের সাথে সংঘর্ষে ৬ জন গার্ড একজন অফিসার আহত হন।
খুলনা
খুলনায় ৫মার্চ সংঘর্ষে ১৮ জন নিহত ৬৪ জন আহত। নিহতদের মধ্যে ১১ জন কাবুলিওয়ালা। ১৮ জনের ৩ জন নিহত হয় খুলনার দৌলতপুরে। পাওয়ার হাউজের সামনে বোমা বিস্ফোরণে ফাতেমা নামে এক যুবতী নিহত হয়।
সাতক্ষীরায় অস্রের দোকান লুট করতে গিয়ে দোকান মালিকের গুলিতে এক রিকশা চালক মারা যায়। খুলনা জেলায় এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে ২৯ জন। রিকশা চালক হত্যার প্রতিবাদে খুলনায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের যৌথ সমাবেশ হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন এমএনএ শেখ আব্দুল আজিজ, এমএনএ সালাহ উদ্দিন ইউসুফ, আব্দুল গফুর, এমপিএ হাবিবুর রহমান, ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম। (নোটঃ হাবিবুর রহমান পরে দেশের ভিতরেই আতাত করে ছিলেন।)
এদিন সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যায়।
আওয়ামী লীগ
প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের অব্যবহিত পরেই শেখ মুজিবের ধানমণ্ডির বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাখার ওয়ার্কিং কমিটির এক যুক্ত জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকায় অবস্থানরত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরাই কেবল এ বৈঠকে অংশ গ্রহন করেন। বিকেল ৪ টায় শুরু হওয়া এ বৈঠক গভীর রাত পর্যন্ত চলে। এই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের আলোকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আওয়ামী লীগের মহিলা শাখা আজ শহীদ মিনারে সমাবেশ ও শহরে বিশাল মিছিল বের করে। দলের সাত জন মহিলা এমএনএ সভায় উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বক্তব্য রাখেন মিসেস বদ্রুন্নেসা, নুর জাহান মুরশিদ, নীলিমা ইব্রাহীম, সাজেদা চৌধুরী ও রাফিয়া আখতার ডলি।
এদিকে ঢাকায় হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে পাঞ্জাব আওয়ামী লীগ লাহোরের গুলবাগে বিক্ষোভ মিছিল করার সময় আওয়ামী লীগের ২ কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি বিএ সলিমি এবং মালিক সরফরাজ সহ ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উভয় নেতা সকালেই ঢাকা থেকে লাহোর পৌঁছান। আটকদের মধ্যে স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত কিছু বাঙালি ছাত্র আছেন।
ছাত্রলীগ সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকি ছাত্রলীগের নামে চাদা আদায়ের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারন করেছেন।
ছাত্রলীগ ও ডাকসু এক বিবৃতিতে গুদামজাত খাদ্য বাজারে ছেড়ে দেয়ার আহবান জানিয়েছেন।
আগামী কাল রেসকোর্সে আওয়ামী লীগের জনসভা।
আওয়ামী লীগ এমএনএ তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবের ৭ মার্চ এর ভাষণ বেতারে সরাসরি প্রচারের দাবী জানিয়েছেন।
বিশিষ্ট সাংবাদিক রাজনীতিক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন।
ঢাকা উত্তর মহকুমা সাধারন সম্পাদক কাজী মোজাম্মেল হক টঙ্গীতে নিরস্র শ্রমিকের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের নিন্দা করেছেন।
মওলানা ভাসানী
মওলানা ভাসানী সন্তোষ থেকে এক বিবৃতিতে বলেন ঐক্যবদ্ধ মুক্তিসংগ্রাম শুরু করার জন্য জনগনের প্রতি আহবান জানান। তিনি এক্ষেত্রে দলাদলি ও সঙ্কীর্ণতা পরিহার করার জন্য তাদের প্রতি আহবান জানান। মুক্তি সংগ্রামে তার দল যে কোন দলকে সর্বপ্রকার সহযোগিতা করবে। আগামী ৯ মার্চ পল্টন সভায় তিনি এ বিষয়ে চূড়ান্ত ডাক দিবেন।
বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ
বাংলা একাডেমীর উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ এক সভায় স্বাধিকার আন্দোলনে যে কোন ত্যাগ স্বীকারের শপথ করেন। লায়লা আরজুমান্দ বানুর সভাপতিত্তে অনুষ্ঠিত এ সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন পটুয়া কামরুল আহসান। তিনি তার বক্তৃতায় বলেন বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনে শিল্পীরাও বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখতে পারে। অভিনেতা মোস্তফা তার বক্তৃতায় বলেন স্বাধিকার আন্দোলনে ইয়াহিয়ার সর্বশেষ বক্তব্য বাঙ্গালীদের জন্য অপমানজনক। খান আতাউর রহমান বলেন আজ থেকে জনতার দাবীকে গানে গানে বেক্ত করার জন্য তিনি তরুন কণ্ঠশিল্পী বাহিনী গড়ে তুলবেন। আজ থেকে তিনি তার মহল্লা মালিবাগ সিদ্ধেশ্বরীতে প্রতিদিন গন আসর বসাবেন। সভায় আরও বক্তব্য রাখেন মোস্তফা জামান আব্বাসি, আনোয়ার হোসেন, হাসান ইমাম, রাজ্জাক, ওয়াহিদুল হক, আতিকুল ইসলাম, শামসুল হুদা চৌধুরী, সংবাদ পাঠক সিরাজুল মজিদ মামুন, তাকুল ইসলাম। সভা শেষে শিল্পীরা মিছিল করে সারা শহর প্রদক্ষিন করে এবং বেতার ও টেলিভিশন অফিসের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করে। বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দেন রাজ্জাক, হাসমত, আলতাফ মাহমুদ, ফেরদৌসি রহমান প্রমুখ।
চলচ্চিত্র শিল্পের ৩৩ জন শিল্পী এক বিবৃতিতে বলেন পূর্ব বাংলার ন্যায্য অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখার সংকল্প ব্যক্ত করা হয়। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন আব্দুল জব্বার খান, খান আতাউর রহমান, সালাহউদ্দিন, ইফতেখারুল আলম, মোশাররফ হোসেন চৌধুরী, মুস্তাফিজ, আনোয়ার হোসেন, শবনম, রাজ্জাক, রোজী সামাদ, কবরী, আজিম, সুজাতা, আবুল খায়ের, সুলতানা জামান, কিউ এম জামান, ই আর খান, মোস্তফা, আব্দুস সামাদ, নারায়ন ঘোষ, সত্য সাহা, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, চিত্ত চৌধুরী, মিলন, আলমগীর কুমকুম, হায়দার আলী, সুবল দাস, রাজ, আখতার হোসেন, নুরুল হক বাচ্ছু, আলতাফ মামুন, সুচন্দা, জহির রায়হান।
নোটঃ খুব নগণ্য সংখ্যকই পরে একাত্ম হয়েছিলেন।
পলটনে ওয়ালী ন্যাপ এর জনসভা
নিউমার্কেটের সামনে বিকেল ৩টায় ওয়ালী ন্যাপ এর এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জন সভায় প্রাদেশিক ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ এর সভাপতিত্তে অনুষ্ঠিত এ সভায় আরও বক্তব্য রাখেন দলের কেন্দ্রীয় নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, জনসভায় প্রাদেশিক ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বলেন গত কয়েকদিনে বাংলায় যে রক্তাক্ত সংগ্রাম শুরু হয়েছে তা বাংলাদেশের শোষণ মুক্তির সংগ্রাম। তিনি বলেন এখন পর্যন্ত যারা প্রান দিয়েছেন তারা ৬ বা ১১ দফার জন্য প্রান দেননি তারা প্রান দিয়েছেন শোষণ মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য। নিহত এসব বীর সৈনিকদের সংগ্রামে যদি কোন দল এগিয়ে না আসে তবে তার দল একাই তাদের সংগ্রামে শামিল হবে। মহিউদ্দিন তার বক্তৃতায় বলেন পার্লামেন্ট দ্বারা বাংলার সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় তিনি আন্দোলন সংগ্রাম তীব্রতর করার জন্য জনগনের প্রতি আহবান জানান। মতিয়া চৌধুরী তার বক্তৃতায় বলেন শাসক গোষ্ঠী যত রক্তপাত ঘটাবে বাংলার আন্দোলন তত তীব্র হবে। তিনি নিরীহ জনগনের উপর গুলি চালানো বন্ধের আহবান জানিতে বলেন অন্যথায় তারাও যথাযথ ভাসায় তার প্রত্যুত্তর দিবে। তিনি বাংলার জনগনের ন্যায় বালুচদের ও একইরকম আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানান।
আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সভা
আওয়ামী লীগ অফিসে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ঢাকা শহর কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রত্যেক ইউনিয়ন (ওয়ার্ড) থেকে বাহিনীর আগত লিডার এবং ডেপুটি লিডার গন উপস্থিত ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন বাহিনীর কেন্দ্রীয় প্রধান আব্দুর রাজ্জাক। সভায় শহর বাহিনী প্রধান ফজলুর রহমান বক্তব্য প্রদান করেন। আব্দুর রাজ্জাক তার বক্তৃতায় বলেন যে কোন চক্রান্ত মোকাবেলায় বাহিনীকে সজাগ থাকতে হবে। তিনি আসন্ন রেসকোর্স ময়দানের সভার শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। যে সকল বীর শহীদান বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় শহর কমিটির প্রতি ইউনিয়ন থেকে ১০০ জন সদস্য সকাল ১০ টা থেকে রেসকোর্সে দায়িত্ব পালনের জন্য উপস্থিত হবেন।
মওলানা মতিন
থানভি গ্রুপ জমিয়ত পূর্ব পাকিস্তান ভাইস প্রেসিডেন্ট মওলানা মতিন জাতীয় সংহতি বজায় থাকে এবং জাতীয় আদর্শ সম্বলিত শাসনতন্ত্র প্রনয়নের জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।