You dont have javascript enabled! Please enable it! ১৯৬৯ গন অভ্যুত্থানে পশ্চিম পাকিস্তানী ছাত্রনেতা তারিক আলি  - সংগ্রামের নোটবুক

১৯৬৯ গন অভ্যুত্থানে পশ্চিম পাকিস্তানী ছাত্রনেতা তারিক আলি
ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলো আগস্ট ২০১৪,
তারিক আলি : ১৯৬৯-৭০ সালে যখন আমি ঢাকায় ছিলাম, তখন এখানে শক্তিশালী আশাবাদ দেখেছি। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় জনসভায় আমিই প্রথম স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বলেছিলাম, ‘স্বায়ত্তশাসন তোমাদের কিছুই দেবে না, তোমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের দিকেই যাওয়া উচিত। নইলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তোমাদের ধ্বংস করে দেবে।’ এটাই আমি বলেছিলাম। সাংবাদিকেরা এতই নার্ভাস হয়েছিল শুনে, তারা আমার বক্তৃতার পুরোটা প্রকাশ করেনি। কিন্তু কথাটা শেখ মুজিবের কানে গিয়েছিল এবং তিনি সন্ধ্যায় তাঁর বাসায় দেখা করতে বললেন। সেখানে তিনি আমাকে বললেন, ‘আমি শুনেছি তুমি কী বলেছ। কিন্তু তুমি কি নিশ্চিত, তুমি কি নিশ্চিত?’ আমি বললাম, ‘আমি নিশ্চিত। আমি পাকিস্তানি শাসকদের ভালো করে জানি। তারা তোমাদের ধ্বংস করবে। তোমাদের প্রস্তুত থাকা দরকার, সে জন্যই আমি এটা বলেছি। তারা স্বায়ত্তশাসন দেবে না, তারা ছয় দফা মানবে না। তোমাদের স্বাধীনতার দিকেই যাওয়া উচিত।’ কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে একদমই একমত হলেন না। যা হোক, সে সময়ের আলোড়ন, আন্দোলন, রাজনৈতিক সচেতনতার মাত্রা এত বিস্ময়কর ছিল, এত উঁচু মাপের ছিল! এমনকি যারা স্কুল-কলেজে যাননি তাঁদের কাছেও সবকিছু পরিষ্কার ছিল। তখন বাংলাদেশিরা ভিন্ন এক দেশের স্বপ্নে আকুল হয়ে উঠেছিল। আমাদেরও আশা ছিল, বাংলাদেশ মুক্তিকামী প্রগতিশীল রাষ্ট্র হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা হয়নি।

তিনি ছিলেন বাংলাদেশের পরীক্ষিত ও অকৃত্রিম বন্ধু। একজন পাকিস্তানী হয়ে বাংলাদেশের জনগণের ওপর চালানো বর্বর গণহত্যার প্রতিবাদ করে নিজ দেশে গ্রেফতার হয়েছিলেন তাহিরা মাজহার আলী খান। উনিশ শ’ একাত্তর সালে লাহোরে গণহত্যা বিরোধী প্রথম বিক্ষোভ মিছিল হয়েছিল তার নেতৃত্বে। ওই মিছিলে স্বৈরশাসকদের প্রতিনিধিরা তার মুখে থুথু ছিটিয়েছে, বিশ্বাসঘাতক বলে গালি দিয়েছে। কিন্তু মানবিকতার পক্ষের অবস্থান থেকে একটুও টলাতে পারেনি তাকে। তার জীবনটাই এমন, সংগ্রামমুখর। একটুখানি আর্থিক সুবিধা এবং সামাজিক অবস্থান ধরে রাখতে ভোল পাল্টাতে যাদের সামান্য দ্বিধা হয় না তাদের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন কি বর্ণাঢ্য আয়েশী জীবন তিনি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছিলেন। দাঁড়িয়েছিলেন সাধারণ মানুষের পক্ষে। আমৃত্যু সম্পৃক্ত থেকেছেন প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মকা-ে। বাবা সিকান্দার হায়াত খান। অবিভক্ত পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের প্রতি বিশেষ আনুগত্যের জন্য যিনি স্যার উপাধি পেয়েছিলেন।

মমতাজ দৌলতানা নামে বাবার পছন্দের পাত্রকে প্রত্যাখ্যান করে সতেরো বছর বয়সে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলেন মাজহার আলী খানকে। বাবার সম্মতি নিয়েই। পরবর্তীতে দক্ষ লেখক ও সাংবাদিক মাজহার আলী খান বিয়ের সময় ছিলেন ‘বেকার’। সক্রিয়ভাবে কাজ করছিলেন শ্রমিক ও কৃষক সংগঠক হিসেবে। তার বাবা নবাব মুজাফফর আলী খান ছিলেন পাঞ্জাব মন্ত্রিসভার সদস্য। পারিবারিক সম্পর্কে তাহিরা-মাজহার ছিলেন চাচাতো ভাইবোন। বিয়ের পর দুজনেই বনেদি পারিবারিক ঐতিহ্য ছিন্ন করে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়েন। তাহিরা কাজ করেছেন বিশেষ করে রেলওয়ে শ্রমিক ও তাদের পরিবারের মধ্যে। সেই সময় লাহোরে সাইকেল চেপে বিলি করেছেন কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা। লাহোরে প্রগতিশীল লেখক সংঘ গড়ে উঠেছিল তাহিরা-মাজহারের বাড়িতে। ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, আহমেদ নাদীম কাশমি, সাজ্জাদ জহির প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে এ সংগঠন গড়ে তোলেন তারা। তাদের প্রথম পুত্র আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী তারিক আলী খান।

সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়সহ আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা ওঠানামা কোন কিছুই তাহিরা ও তার স্বামীকে সংগ্রামী জীবনের অঙ্গীকার থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। দুই হাজার পনের সালের মার্চ মাসে সত্তর বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাহিরা ছিলেন এ প্রজন্মের তরুণদের সব ধরনের প্রতিবাদী আন্দোলনের সামনের সারিতে। আইয়ুব খান থেকে শুরু করে জিয়াউল হকের সময় পর্যন্ত স্বৈরশাসকবিরোধী প্রায় সব আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিলেন তাহিরা এবং মাজহার আলী খান। জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনামলে নতুন করে ইসলামী করণ এবং বৈষম্যমূলক নানা আইনী উদ্যোগ, নারী ও নাগরিক অধিকার খর্ব করার চেষ্টা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদ করেছেন তাহিরা। সামরিক শাসকের দমন পীড়ন সয়েছেন। জেল খেটেছেন। জিয়াউল হক ও পরের ক্ষমতাসীনদের পক্ষে গনবিরোধী অনেক আইন প্রনয়ন করা সম্ভব হয়নি এ ধরনের প্রতিবাদের ফলে।

তাহিরা খানের উদ্যোগে উনিশ শ’ আটচল্লিশ সালে পাকিস্তানে প্রথম প্রকাশ্যে নারী দিবস পালিত হয়েছিল। তার সঙ্গে ছিলেন আরও ক’জন উদ্যমী নারী। পাকিস্তান গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার উদ্যোগে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নারী আন্দোলন পূর্ণতা পাবে না। তাই পাকিস্তানে শ্রমিক ও নারী অধিকার আন্দোলনকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার কারণে বেনজীর ভুট্টোসহ নেতৃস্থানীয় নারীরা অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তার সঙ্গে পরামর্শ করতেন। তিনটি বামপন্থী দলের এ্যালায়েন্স আওয়ামী ওয়ার্কার্স পার্টি গঠিত হওয়ার আগে তিনি পাকিস্তান ন্যাশনাল ওয়ার্কার্স পার্টির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো ব্যক্তিগতভাবে তাহিরা এবং মাজহারের বন্ধু ছিলেন। কিন্তু আদর্শগত দিক থেকে তারা সবসময়ই তার প্রতিক্রিয়াশীল কাজের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। যেমন সমালোচনা করেছেন তাহিরার বাবা সিকান্দার হায়াত খানের ব্রিটিশ আনুগত্য নীতির। ভুট্টো যখন ক্ষমতায় আসেন তারিক আলী তখন পাকিস্তানের বাইরে ছিলেন। ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক ভীতি থেকে ভুট্টো তারিক আলীর পাকিস্তানে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এ ঘটনায় তাহিরা ভুট্টোকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার দায়ে অভিযুক্ত করে তীব্র সমালোচনা করলে ভুট্টো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হন।

শুধু একাত্তর সালে নয় বাংলার বিপদে আগেও বাঙালীর পাশে দাঁড়িয়েছেন তাহিরা মাজহার আলী খান। তেতাল্লিশের মন্বন্তরে সহায়তা দেয়ার জন্য লাহোরে গঠিত ত্রাণ তহবিলে নিজের সোনার গয়নাসহ পারিবারিকভাবে পাওয়া রতœালঙ্কার তুলে দিয়েছিলেন। নিজের সম্পদ বিলিয়ে দেয়ার দৃষ্টান্ত তার স্বামীর জীবনেও আছে। ‘ভিউ পয়েন্ট’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন মাজহার আলী খান। যার অফিস ছিল লাহোরের কেন্দ্রে তার বাড়িতে। ইটভাটা শ্রমিক ইউনিয়নের অফিসের জন্য জায়গার প্রয়োজন হলে সেটি তিনি শ্রমিক ইউনিয়নকে দিয়ে দেন।

তেইশ মার্চ তার মৃত্যুর দু’বছর পুরো হবে। তিনি মারা যাওয়ার পর পাকিস্তান ও ভারতে শ্রমিক ও নারী আন্দোলন কর্মীদের পক্ষ থেকে শোক ও শ্রদ্ধার প্রকাশ যেভাবে ঘটেছে বাংলাদেশে সেরকম কিছুই হয়নি। তবে দু’হাজার তের সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বৈদেশিক বন্ধু’ সম্মাননা দিয়ে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছিল তাকে।