স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ভাঙনের মুখে
ইতিমধ্যে আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও পশ্চিম বাংলায় সরকারি হিসাবমতাে প্রায় ৫৫ লাখ পূর্ববাংলার শরণার্থী এসেছেন। এই উদ্বাস্তু স্রোত কবে থামবে, এরা কবে স্বদেশে ফিরে যাবে তা কেউ জানে না। কিন্তু অবস্থা দেখে স্পষ্ট, পাকিস্তানের জঙ্গীশাসক এক ঢিলে দুই পাখি মারতে উদ্যত। পূর্ব বাংলার অভ্যন্তরে ১০ লাখ, মুক্তিকামী বাঙালীকে হত্যা করেছে, আর ইতিমধ্যে ৫৫ লাক বাঙালী হিন্দু ও মুসলমানকে দেশছাড়া করে ভারতে ঠেলে দিতে পেরেছে। কার্যত পাকিস্তান এই ভাবেই ভারতে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বের বিবেক এখনও অবিচলিত, ভারত সরকার এখনও সুকঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের সমর্থনে পাকিস্তানকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছেন না। বাংলাদেশকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়াই এখন বড় কথা নয়, এখন সবচেয়ে বড় কথা কি উপায়ে এই লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে স্বদেশে সম্মানে পাঠান। সম্ভব। কার্যত ভারত বাংলাদেশের প্রশ্নে ধৈর্যের শেষ পর্যায়ে যেমন উপস্থিত, তেমনি তা বৈদেশিক নীতি ও দেশরক্ষা নীতি অগ্নিপরীক্ষার সামনে।
দিল্লীর শেষ খবর, ১৫ই জুনের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রশ্নে একটা সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন। কেন্দ্রীয় তিনমন্ত্রী। বিশ্বের দরবারে ভারতের বক্তব্য রাখবার জন্য রওনা হয়ে গেছেন। আর প্রধানমন্ত্রী সীমান্ত রাজ্যগুলাে সফর করে শরণার্থী স্রোতজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ মূল্যায়ন করতে আসছেন। কাজেই খুব শীঘ্রই জানা যাবে ভারত কি পথ নেবে। ভারত শরণার্থীদের প্রশ্নে এবং বাংলাদেশের প্রশ্নে এক সংকটের মুখে।
প্রথম দিকে, ভারত সরকার ভেবেছিলেন মাত্র বিশ লাখ শরণার্থী ভারতে আসতে পারে। কিন্তু ইতিমধ্যে এই সংখ্যা তিনগুণ হয়ে গেছে। ভারতের কর্তৃপক্ষ এখন বলছেন, এই শরণার্থীদের ছ’মাস সেবা করার জন্যই তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন। ভারতের কর্তৃপক্ষ হয়তাে ভেবেছেন যে, এর মধ্যেই বিশ্বের জনমত, শক্তিশালী দেশগুলাে বাংলাদেশের পক্ষে এবং ভারত কর্তৃক অনুসৃত পন্থার সমর্থনে আসবেন। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী বলেছেন, তিনি বাংলাদেশের ব্যাপারে রাজনৈতিক সমাধান চান। কিন্তু এই রাজনৈতিক সমাধানের সূত্র কী হবে তা তিনি বলেন নি। কিন্তু অবস্থার মূল্যায়ন থেকে স্পষ্ট ভারত সামরিক সমাধানের প্রশ্নটা সাময়িকভাবে চাপা দিলেও এখনও একেবারে ত্যাগ করেন নি।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় গৃহীত সর্বসম্মত প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি ও অস্ত্র সাহায্য দানের জন্য দাবী করা হয়েছিলাে। কিন্তু কেন্দ্র এ পর্যন্ত কোনটাই প্রত্যক্ষভাবে প্রহণ করেন নি। রাজ্যের শাসক কংগ্রেস থেকে শুরু করে মুসলিম লীগ পর্যন্ত কোয়ালিশনের সকল দলই এই প্রস্তাবের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু কেন্দ্র কিছু উচ্চবাচ্য করতে এরা এখন শরণার্থী সেবা নিয়েই দিবারাত ব্যস্ত। অন্য উপায় ভাবছেন না। কিন্তু সি পি আই অস্ত্র সাহায্যের প্রশ্নটা ছাড়তে রাজী নন। বােধহয়, রাজনৈতিক ও সামরিক উভয় সমাধানের সূত্র সমানভাবে কার্যকর করারই তারা পক্ষপাতী। এর কারণ বােধহয় এই যে, বাংলাদেশে কমিউনিষ্ট পার্টি মুক্তি সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছে শুধু তাই নয়, গেরিলা সংগ্রামে কয়েকটি জেলায় এই দলের লােকেরাও রয়েছেন। কাজেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে সেখানকার কমিউনিষ্ট পার্টি যাতে যােগ্য প্রভাব বিস্তার করতে পারে তার দিকটাও ভারতের কমিউনিষ্টরা দেখছেন। আওয়ামী লীগই সব ক্ষমতা পারে বা ভােগ করবে এটা কোন কোন বামপন্থী দল সহজে মানতে রাজী নয়। তাই সমাধান সূত্র নিয়ে ভিন্ন মত এসেছে। সি পি এম-এর কোন অনুরক্ত দল বা অনুগামী গােষ্ঠী এখনও বাংলাদেশে গড়ে উঠেনি। তাই মৌলানা ভাসানীর মারফৎ বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশের সম্ভাব্য সূত্রটা বিচার করছিলেন। কিন্তু মৌলানা তাদের এখন পর্যন্ত নিরাশই করছেন।
সি পি এম আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের রাজনীতি সমর্থন করেন না বা পছন্দও করেন না। বরং সমালােচনাও করেন। কিন্তু বাংলাদেশে যে জাতীয় অভ্যুত্থান ঘটেছে, মুক্তির জন্য যে বিরাট প্রয়াস চলছে তাকে একেবারে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তারা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন।
কিন্তু ক্রমশ দেখছি সি পি এম বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রশ্নে যেন একটু দূরে সরে গেছে। বরং আগত শরণার্থীদের মধ্যে কাজ করে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কার্যকারিতার দিকে যুবজনের মনকে প্রভাবিত করার প্রশ্নটা তাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে রাজ্যের বামপন্থীরা জানেন যে, এই লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর অভাব-অভিযােগ, বঞ্ছনা ও তাড়নাকে কেন্দ্র করে তারা রাজ্যব্যাপী আন্দোলনের মারফৎ পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারত সরকারকে নাজেহাল করার বহু সুযােগ এদের হাতে আসবে। তাই এরা শরণার্থী শিবিরে কাজ করার দিকে ঝুকেছেন।
পশ্চিম বাংলায় যারা চীনের রাজনীতির অনুগামী আছেন তারা যে বাংলাদেশের আন্দোলনকে মনে প্রাণে স্বাগত জানাচ্ছেন না তার বহু প্রমাণ আছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরের পিকিং পন্থীদের সঙ্গে এই রাজ্যের চীনাপন্থীদের সংযােগ হয়েছে কিনা, তার তথ্য এখনও সরকার জানাননি।
শরণার্থীরা আগামী দু’মাসের মধ্যে স্বদেশে ফিরে যাবে—এই আশা নিয়ে যারা এখনও রাজনৈতিক অঙ্ক তৈরী করছেন তাদের শুধু অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করতে অনুরােধ করবাে। আগামী দু’মাসের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ইয়াহিয়ার সেনারা চলে যাবে বা সৈন্যরা সব খতম বা পর্যুদস্ত হবে এমন ভবিষ্যৎ বাণী করা যায় না। আর ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীকে বিতাড়ন করতে হলে ভারতকেই সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিতে হবে। তার অর্থ সামরিক শক্তি প্রয়ােগ। কিন্তু বিশ্বের জনমত এখনও ভারতের এই সূত্র পছন্দ করছেন না। কাজেই শরণার্থীদের সেবা ও সাহায্যের জন্য ব্যাপকতর ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা নিতে হােতে পারে। যারা দেশবিভাগের দিন থেকে বলে এসেছিলেন, পূর্ববাংলার উদ্বাস্তুরা ফিরে যাবে এবং যার জন্য নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছিলেন তারা যে ভ্রান্তপথ নিয়েছিলেন ইতিহাস তাই প্রমাণ করেছে। এখনও পশ্চিমবাংলায় পূর্ববঙ্গ থেকে পূর্বে আগত দশ লক্ষ উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের অপেক্ষায় নরক যন্ত্রণা ভােগ করছেন। তাদের জন্য এখনও সরকার কিছু করেন নি। পূর্ববাংলায় ফেলে আসা সম্পত্তির কোন ক্ষতিপূরণ পাকিস্তান থেকে আদায় করা হয়নি। এই ভালমানুষীর ফল ভােগ করছে ভারত। তার ওপর নতুন করে এসেছে ৫০ লাখ শরণার্থী, এই সংখ্যা শীঘ্রই এক কোটিতে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। এখনই সময় থাকতে শরণার্থীদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ও বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত সরকার সুস্পষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভারতের পক্ষে যুদ্ধ ছাড়া কোন গতান্তর থাকবে না। কিন্তু ভারত কী যুদ্ধের পথ নেবে?
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৪ জুন ১৯৭১