মােকাররম হােসেন
মােকাররম হােসেনের জন্ম পাবনায়। তার বাবার নাম মােতাহার হােসেন, মায়ের নাম রােকেয়া বানু। মােতাহার হােসেন ছিলেন শিক্ষক। মােকাররমের ডাকনাম মুকুল। মুকুল পাবনা জি. সি. আই. থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৬৬ সালে এ, সি, ই, পাস করে পাবনা জেলা কাউন্সিলের প্রকৌশলী হিসাবে যােগ দেন। ১৯৭১ সালে তিনি পাবনা জেলা কাউন্সিলে সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ছাত্রজীবনে মুকুল ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক ও সমাজকর্মী। ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তঃস্কুল ফুটবল প্রতিযােগিতায় মুকুল পাবনা দলের নেতৃত্ব দেন। তরুণ মােকাররম হােসেন মুকুল পাবনার একজন খ্যাতিমান ফুটবলার হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর পাবনার বাঙালি পুলিশ এবং ই. পি, আর, সদস্যরা পাকবাহিনীর প্রতিরােধে নামে। তাদের সাথে পাবনার তরুণ-যুবকরাও শামিল হন। তারা সাধারণ অস্ত্র নিয়েই পাকবাহিনীর প্রতিরােধে ঝাপিয়ে পড়েন। বাবার লাইসেন্স করা দোনলা বন্দুক নিয়ে মুকুলও সেই প্রতিরােধ সংগ্রামে সামনের কাতারে ছিলেন। তারা পাকবাহিনীর বেশ কিছু অস্ত্রও দখল করতে সমর্থ হন। যাদের কোনাে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ ছিল না, তাদেরও অস্ত্র চালানাে শেখানাে হয়। অন্য প্রশিক্ষকদের সাথে মুকুলও নবাগত মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ করেছেন।
মুক্তিযােদ্ধারা ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা শহর মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। কিন্তু পাবনা দখলের জন্য পাকবাহিনী বিমানযােগে বােমা হামলা শুরু করে এবং ভারী অস্ত্র নিয়ে পাবনা হামলা চালায়। এ অবস্থায় পাবনার মুক্তিযােদ্ধারা আর। প্রতিরােধ টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হননি। মুকুল তাঁর আপন তিন ভাই মােশারােফ হােসেন রঞ্জু, মােস্তাক হােসেন অঞ্জু ও মনসুর হােসেন মঞ্জুকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। তাদের বড় ভাই মােজাম্মেল হােসেন তখন মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডিং অফিসার হিসাবে যুদ্ধ করছেন। মুকুলের স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা থাকায় তাকে গ্রামে তাঁর বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর মুকুল-মজুদের বাবা-মা প্রথমে পালিয়ে পাশের গ্রামে আশ্রয় নেন। পরে তারা চলে আসেন ঢাকার মগবাজারের মধুবাগে, বড় ছেলে মােজাম্মেল হকের বাসায়। কিছুদিন পর মােজাম্মেলের দুটি বাড়ির একটি রাজাকার বাহিনী দখল করে নেয় এবং সেখানে তাদের দফতর বানায়। ইতােমধ্যে মুকুলের মাও খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ খবর জানতে পেরে মুকুল, মঞ্জু ও রঞ্জু ১০ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার মধুবাগের বাসায় আসেন বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে। পরদিন রাতেই তাদের চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু পাক হানাদারদের সহযােগী বাহিনীর মাধ্যমে এ খবর জানাজানি হয়ে যায়। ১১ ডিসেম্বর বিকালে একদল পাকিস্তানি সেনা বাড়িটি ঘিরে ফেলে। তারা প্রথমে ভেবেছিলেন, যুদ্ধ করবেন। কিন্তু বাড়ির সদস্য ও আশেপাশের মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে বিনা প্রতিরােধে তারা ধরা দেন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। তাদের সাথে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যায় তাদের বােনের স্বামী ইউসুফ আলীকেও। এরপর থেকে তাদের আর কোনাে খোঁজ মেলেনি, তাদের মরদেহও পাওয়া যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেওয়ার আগে মােস্তাক হােসেন অঞ্জু ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, মনসুর হােসেন মঞ্জু পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বাের্ডের (ওয়াপদা) হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা এবং ইউসুফ আলী ছিলেন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের কর্মকর্তা। তাদের আরেক ভাই মােশারেফ হােসেন রঞ্জু ছিলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র, তিনি ১৯৭১ সালের পাকিস্তানিদের সাথে সরাসরি যুদ্ধে শহীদ হন। এক পরিবারের পাঁচজন সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হওয়ার ঘটনা বিরল। কিন্তু তারপরও এ পরিবারের শহীদদের এখনও কোনাে স্বীকৃতি মেলেনি। যদিও ১৯৭৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পাবনা সফর করার সময় শহীদ জননী রােকেয়া খাতুনকে সার্কিট হাউসে ডেকে নিয়েছিলেন। একটি জাতীয় দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাঙ্কারে শহীদদের বােন মকবুলা মঞ্জুর শােভা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন : “বেঁচে থাকা আমার দুই ভাই তাে কিছু পায়নি, শহীদদের সন্তানরাও সরকারের নজরে পড়ল না! মুক্তিযুদ্ধে এক সন্তান হারিয়েই অনেকে শহীদ মাতা হয়েছেন! অথচ আমাদের পরিবারের চার সন্তান ও এক জামাই দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করল, তাদের সবাই ভুলতে বসেছে। স্বীকৃতিটুকুও দেওয়া হয়নি।” (জনকণ্ঠ, ১১ ডিসেম্বর ২০১৭) শহীদ মােকাররম হােসেন মুকুলের স্ত্রীর নাম হেনা। তাদের একমাত্র ছেলের নাম বিপ্লব।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা