You dont have javascript enabled! Please enable it! এস, এম, ফজলুল হক - সংগ্রামের নোটবুক
এস, এম, ফজলুল হক
রাজশাহী সরকারি কলেজের গণিতের শিক্ষক এস. এম. ফজলুল হকের জন্ম নওগাঁ জেলা সদর থেকে আট-দশ মাইল পশ্চিমে নওগাঁ-হাপানিয়া মহাসড়কের পাশে মােহনপুর গ্রামে, ১৯৩৬ সালে। তাঁর বাবা গুল মােহাম্মদ, মা ফতেমন বেওয়া। গুল মােহাম্মদ কৃষি বিভাগে চাকরি করতেন। ফজলুল হক ১৯৫২ সালে চক্-আতিথা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গণিতে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। তার এলাকায় তিনিই প্রথম ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৫৪ সালে আই. এ. ও ১৯৫৬ সালে বি. এ. পাস করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এম, এসসি, পাস করেন।
ফজলুল হকের শিক্ষক-জীবন শুরু হয় ১৯৬০ সালে, নওগাঁর বশিরউদ্দিন মেমােরিয়াল কলেজে প্রভাষক হিসাবে। ১৯৬৫ সালে তিনি ময়মনসিংহ আনন্দ মােহন কলেজে বদলি হন। এর কয়েক মাস পর তিনি রাজশাহী কলেজে যােগ দেন। মিষ্টি স্বভাবের কারণে শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি বেশ প্রিয় ছিলেন। নাটক ও আবৃত্তিতে ছিল তাঁর বিপুল উৎসাহ। সুবক্তা হিসাবেও তার সুনাম ছিল। অনেক বিতর্ক প্রতিযােগিতায় তিনি অংশ নেন। শিক্ষানুরাগী ফজলুল হকের চেষ্টায় মােহনপুর গ্রামে ‘হাপানিয়া হাই স্কুল’ ও ‘হাপানিয়া ইউনিয়ন ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়। একাত্তরের মার্চে অসহযােগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি নওগাঁয় তার গ্রামের বাড়িতে চলে যান। ২৫ এপ্রিল সকালে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযােগী একদল অবাঙালি তার গ্রামের বাড়িতে আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনারা বাড়ি ঘিরে ফেলে এস, এম, ফজলুল হক, তার মা ও ভাইবােনকে গুলি করে হত্যা করে। সেদিন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে এ বাড়িতে মােট ১২ জন শহীদ হন। ফজলুল হকসহ কাউকে কবর দেওয়া যায়নি। কোনােরকমে গর্ত খুঁড়ে এক-একটা গর্তে দুই থেকে। তিনজনকে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় তাঁর ভাগিনা ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মাে, এনামুল হকের কাছ থেকে। তাদের বাড়ি ছিল সান্তাহার রেলওয়ের পাশে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অবাঙালিদের অত্যাচারের ভয়ে তিনি মামাবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এনামুল বলেছেন : ২৫ এপ্রিল সকাল ছয়টায় আমরা বাড়ির বাইরে বসে ফজলু মামাসহ কয়েকজন। রেডিওতে খবর শুনছিলাম। এমন সময় মামাবাড়ির পূর্বদিক থেকে গােলাগুলির।
শব্দ ভেসে আসে। আমরা দেখতে পেলাম, লােকজন মাঠের দিকে দৌড়াচ্ছে। আমরা খবর শােনা বন্ধ করে দ্রুত বাড়ির ভেতরে যাই। আমার মামাদের বাড়িটা ছিল ওই এলাকায় বেশ বড় এবং মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা। মামার কয়েকজন আত্মীয়ও এই বাড়ির বিভিন্ন ঘরে আশ্রয় নেয়। একটু পর স্বাধীনতাবিরােধী। বিহারিদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা মামাবাড়িতে প্রবেশ করে। ফজলু মামা, নানি, আমি ও মা একটা ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। পাকিস্তানি । সেনারা এই ঘরের দরজা লক্ষ্য করে গুলি করা শুরু করে। আমার মা ও নানির। মাথায় গুলি লাগে। তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। গুলিতে ঘরের দরজার খিল। খুলে যায়। তখন ফজলু মামা ও আমি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াই।। বারান্দায় আসামাত্র সেনারা ফজলু মামার বুক লক্ষ্য করে গুলি করে। তিনি । কালেমা পড়তে পড়তে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আমি দৌড়ে আবার ঘরের ভেতরে যাই। সেনারা বিহারিদের সহযােগিতায় আমাকে ঘর থেকে বের করে আনে। ওই ঘরে আমার আরেক মামা মােখলেস লুকিয়ে ছিলেন। তাঁকেও তারা। টেনেহিঁচড়ে বের করে আনে। তাঁকে ঘর থেকে এনে আমার সামনেই প্রথমে গুলি করে। তারপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে। এরপর আমাকেও মারার জন্য। দাঁড় করায়। তখন তাদেরই কয়েকজন আমার বয়স কম বলে বাধা দেয়। ঘটনাচক্রে আমি বেঁচে যাই। বাড়ির বাইরের ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন ছােট মামা, আজিজুল মামা, জব্বার নানা, হামিদ নানা, আবদুল নানা ও ইয়াসিন নানা। তারা পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় বাড়ির সামনে পুকুরপাড়ে পাকিস্তানি সেনা ও বিহারিরা তাদের আটক করে। তাদের প্রথমে গুলি, পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। একমুহূর্তে সবকিছু শেষ হয়ে যায়। এরপর পাকিস্তানি সেনাদের উপস্থিতিতে বিহারিরা মামাবাড়িতে লুটপাট করে। তারপর আগুন। লাগিয়ে চলে যায়। (প্রথম আলাে, সাক্ষাঙ্কার, ৮ মার্চ ২০১৫)।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা