You dont have javascript enabled! Please enable it! একাত্তরের কথকতা - অনারারী ক্যাপ্টেন মো. আফাজুল হক - সংগ্রামের নোটবুক

একাত্তরের কথকতা – অনারারী ক্যাপ্টেন মো. আফাজুল হক

এক.

বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে। আমরা বাঙালি দামাল ছেলেরা দলে দলে যোগ দিচ্ছি মুক্তিযুদ্ধে। দেশ মাতৃকাকে মুক্ত না করা পর্যন্ত নিস্তার নেই আমাদের। কিন্তু অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমাদের না ছিল পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ না ছিল উন্নত প্রশিক্ষণ। সেই লক্ষ্যে মাত্র কয়েক সপ্তাহের হলেও প্রশিক্ষণ চাই। ভারতের পানিঘাটা। মুক্তিযুদ্ধের অনেকগুলো প্রশিক্ষণ শিবিরের একটি। জংগলাকীর্ণ সুউচ্চ বৃক্ষরাজির ছায়াতলে এর অবস্থান। একই সময়ে ছয়টি উইং পাঁচ সপ্তাহের অনিয়মিত যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছি। আমি ছিলাম ডেল্টা উইং এর অধীনে। এ উইং-এ আমরা ছিলাম ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধা। প্রশিক্ষণের শুরুতেই ভাষা একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। প্রশিক্ষকবৃন্দ হিন্দিভাষী। যত রকম হুকুম নির্দেশ সবই দেন হিন্দিতে। আমরাও বাধ্য হয়েই হিন্দি ভাষা রপ্ত করেছি এবং মনোযোগর সাথে কঠোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। অবশ্য বাঙালিদের জন্য এটা কোনো সমস্যা নয়। যে কোনো কঠিন কিছু হলেও অল্প সময়ে রপ্ত করতে বাঙালিরা পটু, বিশেষ করে ভাষার ক্ষেত্রে। আর এখনতো আমাদের জীবন মরণ সমস্যা মোকাবেলা করা প্রয়োজন। সুতরাং হিন্দি ভাষা আয়ত্তে আনতে আমাদের খুব সময় লাগলো না। হিন্দি ভাষার সঙ্গে আবার বাংলা ভাষার একটা চমৎকার মিল আছে। তাই দু’সপ্তাহের মধ্যেই হিন্দি ভাষাটা প্রায় আয়ত্তে এসে গেল। কথা বিনিময়ে কিছুটা অসুবিধা থাকলেও বিষয়বস্তু বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি। মনে হয়, এ কাজটা ভিন্নভাষী ব্যক্তিদের পক্ষে বাংলা ভাষা রপ্ত করা অপেক্ষা এভারেষ্ট শৃংগ জয় করা অধিক সহজ কাজ। আমাদের উইং কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন সোলেমান ইকবাল। একজন তুখোড় সামরিক অফিসার হিসাবে তার খ্যাতি আমাদের সবার মুখে মুখে। ইউনিভার্সিটির সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী ছিলেন তিনি। আমাদের প্রশিক্ষণার্থী মুক্তিযোদ্ধা সমরঞ্জন রায়ের দ্বারা বাংলা শেখার চেষ্টা করেছেন। “তুমি ভালো আছ?” বাক্যটি পাঁচ সপ্তাহ ধরে শিখলেন। তদুপরি উচ্চারণ করতেন “তুমি বালো আছে?” এতেই বিদেশীদের বাঙলা ভাষা শেখার অপরাগতা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম। প্রশিক্ষণার্থীরা সবাই হিন্দি ভাষা শিখতে উঠে পড়ে লেগে গেছি। দৈনন্দিন যে কোনো ছোট খাটো কথোপকথনেও হিন্দি ভাষার ব্যবহার চালাতে লাগলাম। নিজ ভাষা যেন আমাদের মুখ থেকে গেল হারিয়ে। নতুন ভাষা শেখার আগ্রহে কটাদিন বেশ উৎসাহের সাথেই কাটল। কিন্তু কেন জানি না ক’দিনেই আমার অপর ভাষা আয়ত্ব করার উদ্দীপনায় হঠাৎ ভাটা পড়ল। মনটা অস্থির হয়ে উঠলো নিজ গ্রামের ভাষায় কথা বলার জন্য। চিত্তকে তৃপ্ত করার জন্য আর মনটা যেন নষ্টালজিয়ায় না ভুগে সে জন্য মাঝেমাঝে বন্ধুদের সাথে বাংলা কথা বলতে চাইতাম। কিন্তু আশ্চর্য! আমি বাংলায় প্রশ্ন করলেও বন্ধুদের কাছ থেকে জবাব আসতো হিন্দিতে। কদাচিৎ কেউ কেউ বাংলা বললেও হিন্দি ভাষার দাপটে তাদেরও সংলাপে মাতৃভাষা খুঁজে পাওয়া যেত না। প্রত্যেকটি কথাবার্তায় ইথারে ভেসে আসততা হিন্দির ধ্বনি ব্যাঞ্জনা। সব কিছু মিলে ভাষার ক্ষেত্রে কেবল যেন একটা ভেজাল জীবনের মধ্যে ডুবে গেলাম। মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য হৃদয় আকুলি বিকুলি করে উঠতো। মাঝে মধ্যে মনে হতো আমরা বোধহয় শুধু খোলস বদল করে চলেছি। আমাদের পূর্ব প্রজন্ম উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, রক্ত দিয়েছে। এখন হিন্দি ভাষা আগ্রহ ভরে রপ্ত করছি আমরা তাদেরই মাত্র এক ধাপ পরের প্রতিনিধি। কী আশ্চর্য! আসলে মানুষ বোধহয় প্রয়োজনের শৃঙ্খলে বন্দী। তবুও এই ভেবে স্বস্তি পাচ্ছিলাম যে, ভাষা প্রতিষ্ঠার যে যুদ্ধ তারা শুরু করে গিয়েছিল আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বাংলার স্বাধীনতা এনে তার সমাপ্তি টানবো আশা করছি। প্রশিক্ষণের সময় শেষ হতে চলল। এলো শিক্ষামূলক সফরের পালা। নির্ধারিত দিনে যাত্রা করলাম কার্শিয়াং শহরের উদ্দেশ্যে। আমাদের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন সোলেমান ইকবাল। তিনি ভারতীয় কাশ্মীর এলাকার মুসলমান। একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী তিনি। পাঁচ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ সময়ে তার উৎসাহ ও স্নেহ ভালোবাসার ছোঁয়া সবাইকে বিমোহিত করেছিল। সব সময় আমাদের কাছে থাকতেন। তিনি যেন শুধু পরের তরে। তার নিজের আরাম আয়েস বলতে কিছু নেই। আমরা দেশ ছেড়েছি পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন ফেলে এসেছি, যুদ্ধের মুখখামুখি হবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু সর্ব বিরহে ভারাক্রান্ত আমাদের মনকে তিনি রাখতেন চাঙ্গা করে। তার জানা ছিল সবার নাম। সবার ব্যক্তিগত ব্যাপার সম্পর্কে ছিলেন অবহিত। আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটানোর জন্য থাকতেন ব্যাপৃত। অবসরে নিজে গান গেয়ে, অভিনয় করে, কবি আবৃত্তি করে, কৌতুক বলে আমাদের মশগুল রাখতেন। আমরা আনন্দ হৈ হুল্লোরে অংশগ্রহণ করে ভুলে যেতাম সকল ব্যক্তিগত গ্লানি। থাকা খাওয়া ও চিকিৎসার সেবায় পরিপূর্ণ করে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দিলেন যা পরবর্তীতে কাজে কর্মে কখনো ভুলিনি। বিভিন্ন অপারেশন যখন কৃতকার্য করেছি তখন বুক ভরে সহযোদ্ধাদেরও বলতে শুনেছি “আমরা ক্যাপ্টেন সোলেমান -এর সাগরেদ।” ক্যাপ্টেন সোলেমান বলতেন,  “ভালো প্রশিক্ষণই হল শ্রেষ্ঠ কল্যাণ।” কমান্ডার হিসাবে প্রশিক্ষণের মতোই প্রশিক্ষণার্থীদের সব ধরনের সমস্যা দেখাও ছিল তার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। একদিনের ঘটনা। কে যেন রিপোর্ট করলো, তাকে দেয়া খাবারে পেট ভরছে না। অমনি ক্যাপ্টেন সোলেমান তার বিছানা পেট্টা নিয়ে রান্নার তাঁবুতে হাজির। সার্বক্ষণিক তদারকি করে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদারকে শিখিয়ে দিলেন রেশনের অভাব হয় না। নির্ভুল ব্যবস্থাপনা দিয়ে সবাইকে তুষ্ট করা যায়। চুলার ধুয়ায় তার চোখ ফুলে গেল। তবু সপ্তাহ খানেক রান্নার তাঁবু থেকে তাকে সরানো গেল না। শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই জোর অনুরোধ জানালে নিজ তাঁবুতে যেতে রাজি হলেন। পা টেনে টেনে আট হাজার ফুট উঁচুতে উঠে গেলাম। এটাই কার্শিয়াং শহর। পানিঘাটা থেকে আঁকাবাঁকা সর্পিল পথ। প্রায় ১১ মাইল দূরত্ব। পাথরের পর্বত কেটে নির্মিত হয়েছে রাস্তা। একধারে সুদৃশ্যময় সুউচ্চ পর্বতমালা অন্য ধারে অতল গভীর হ্রদ। পর্বত চুইয়ে রাস্তার উপর দিয়ে বইছে পানি। রাস্তাটা পিচ্ছিল হয়ে মরণ ফাঁদ রচনা করেছে। একবার পা ফসকে গেলে অতল হ্রদে পড়ে নিশ্চিত মৃত্যু। দু’একখানা গাড়ি অতি ধীরে ধীরে উঁচু ঢাল অতিক্রম করে চলেছে। একেবারে পর্বতের মাথায় কার্শিয়াং শহর। ভারতের অন্যতম স্বাস্থ্যকর স্থান এই মনোরম কার্শিয়াং। প্রাকৃতিক দৃশ্যে সাজানো। প্রকৃতির বর্ণাঢ্য সমারোহে পরিপুষ্ট নিসর্গের যুক্ত উপহার বিধাতা যেন নিজ হাতে ঢেলে দিয়েছেন এর সমৃদ্ধিতে। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু দেখতে ইচ্ছা হয়। দেখতে দেখতে মন ভরে যায়। ক্ষণকালের জন্য হলেও হৃদয় হারিয়ে যায় প্রকৃতির সৌন্দর্যের উৎসবে। পৃথিবীর দিগন্ত রেখাটা কার্শিয়াং থেকে মনে হয় অনেক প্রশস্ত। আর মনে হয় এ শহরের চতুর্দিকে বিশাল ক্যানভাসের উপর শিল্পী যেন নিপুণ হাতে এঁকেছেন শ্যামল রং-রমণীর দু’টো বিস্তৃতি আঁখি। চারিদিকে শুধু সবুজ আর শ্যামলের মেলা। আমরা ঘোরাফেরাতেই আছি। উপভোগ করছি প্রকৃতির রূপসুধা। হঠাৎ দক্ষিণ দিক থেকে ঘন কালো মেঘ ভেসে এসে আমাদের গা ভিজিয়ে দিয়ে গেল। গায়ে হাত দিয়ে দেখি কাপড়চোপড় ভেজা ভেজা। যে মেঘ শুধু এতদিন আকাশে দেখেছি, সে মেঘের শীতল স্পর্শ পেয়ে মনটাও যেন কোমল হয়ে উঠলো। পাহাড়ের গায়ে বাধা পেয়ে মেঘ আবার রওনা করলো দক্ষিণ দিকে। কী অদ্ভুত সে দৃশ্য। ভূগোলে পড়েছি, বাংলাদেশের উত্তরে পাহাড় আছে। সে পাহাড়ে মেঘ বাধা পেয়ে আবার ফিরে আসে আর বাংলাদেশের মাটিকে উপহার দেয় বৃষ্টি। যে বৃষ্টিতে দেশের মাঠ ভরে উঠে শস্য-শ্যামলা ফসলে। আমরা কিছুক্ষণের জন্য মেঘের মধ্যে হারিয়ে গেলাম। আবার মেঘ সরে গেল। আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম। এ যেন এক দিবা স্বপ্নের মতো ব্যাপার। পানিঘাটা থেকে রাতে কার্শিয়াংকে দেখেছি যেন তারকা ভরা নভোমণ্ডলীয় শহর। কৃষ্ণকায় রজনীতে যেন দৃশ্যমান ছায়া পথ। আসলে এ সব ছিল বিদ্যুৎ বাতির খেলা। সেই তারার শহরে নিজেকে দেখে বড় খুশি লাগলো।

কার্শিয়াং অসমতল উঁচুনিচু ভূমির ভাঁজে ভাঁজে রচিত হয়েছে মানুষের আবাস। পাথরের ইটে নির্মিত হয়েছে এ সব বাড়ি ঘর। ফটকে দাঁড়িয়ে প্রহরায় আছে হাফসীর মতো লোমওয়ালা ভুটিয়া কুকুর। অপরিচিত লোক দেখলেই সিংহের মতো গর্জে উঠে আর সে শব্দ পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে মনে হয় যেন পাহাড়টা ভেঙে পড়বে। তী তরুণীরা দোকানে পসরা নিয়ে বসেছে। ২৫ পয়সায় ইয়া বড় একটা আনারস কেটে খেতে দিল এক তরুণী দোকানদার। অতি সস্তা ফল। কোমল হাতের যত্নে কেটে লবন মসলা মেখে পরিবেশন করা সেই রমণীর আপ্যায়ন ভোলার মতো নয়। পাহাড়ি এলাকায় ব্যবসা বাণিজ্য মেয়েরাই করে। বুড়ির ফিতা মাখায় এটে কুঁজো হয়ে চলে মাইলের পর মাইল। প্রচলিত আছে এ সব মেয়েরা নাকি পর্বতের জাহাজ। সত্যিই পর্বতের পাহাড়ি রমণী। পর্বতের শিলার মতো শক্ত তাদের দেহ। আমাদের বাঙালি মেয়েদের মতো ঠোট রঙীন করে গায়ে হাওয়া লাগানোর সময় তাদের কোথায়। দেখলাম, শহরটিতে বসবাসরত সবাই হিন্দি ভাষাভাষী। অন্য ভাষার লোকজন থাকলেও পরিবেশের অভাবে নিজ ভাষা বলতে পারে না। শিক্ষা সফর শেষ করে ফিরছি। পথে একজন প্রৌঢ় আমাদের উদ্দেশ্যে বাংলায় প্রশ্ন করলেন “আচ্ছা ভাই, আপনারা কি মুক্তিযোদ্ধা? আমাদের লীডার শামসুল ভাই বললেন “হ্যা আমরা মুক্তিযোদ্ধা”। লােকটির মুখে বাংলা কথা শুনে বিস্ময়ে তাকালাম, কী যে ভালো লাগল বোঝাবার নয়। যারা অবচেতনেও নিজ ভাষার তীব্র অভাব বোধ করছিলাম, সবাই লোকটিকে ঘিরে ধরলাম। নানা জনে নানা প্রশ্ন করতে লাগলাম তাকে। অবাক হলাম এই পাহাড়ি ভুটিয়াদের জায়গায় বাঙালি বাবু থাকে কী করে? জানা গেল লোকটির আদিবাস বাংলাদেশের ফরিদপুরে। পাক আমলে হিন্দু মুসলিম রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার এক পর্যায়ে ভারতে চলে আসেন এবং জীবনের তাগিদ তাকে কার্শিয়াং শহরে নিয়ে এসেছে। লোকটি বললেন, “বীর মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা, আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি বাংলাদেশটা যতশীঘ্র সম্ভব স্বাধীন হোক। আমি আমার স্মৃতি বিজড়িত পৈতক ভিটাবাড়ি শুধু একবারটি দেখব। আর আত্মীয় স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলা ভাষায় দু’টো কথা বলে মন তৃপ্ত করব। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। অন্তত একবার এ সুযোগ পাবার ভাগ্য যেন ঈশ্বর আমার কপালে রাখেন।” দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে কাঁদো কাঁদো গলায় উচ্চারণ করলেন, “হায় বাংলা, কতদিন আমি তোমার রূপ দেখিনি। কতদিন | আমি তোমার ভাষায় কথা বলিনি।…. সেদিন তাকে আমি একটা প্রশ্ন করলে ব্রিতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।” পাঁচ সপ্তাহ মুক্তচিত্তে বাংলা ভাষা বলতে না পারায় আমার হৃদয়ে যে ক্ষুধা লেগেছে, আপনি অনেক বছর বাংলা বলতে না পেরে এ হিন্দি রাজ্যে কী করে আছেন? লোকটি যেন বোবা হয়ে গেলেন। চোখ মুখ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে এলো আমার প্রশ্নের জবাব। দেখলাম, তার গণ্ডদেশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অশ্রুর নহর। আমি তার চোখে যেন দেখলাম বাংলার পদ্মা, মেঘনা, যমুনার উচ্ছল তরঙ্গ প্রবাহ।

প্রশিক্ষণ শিবির থেকে চলে যাবার দিনে ক্যাপ্টেন সোলেমানের কাছ থেকে বিদায় নেয়া আমাদের জন্য বড় কষ্ট হয়ে উঠলো। বিদায়ের সময় সমুপস্থিত। কনভয় প্রস্তুত। দীর্ঘদেহী শিখ ড্রাইভাররা গাড়ির স্টিয়ারিং এর পাশে দণ্ডায়মান। শুধু হুকুমের অপেক্ষা। আমরা অধীর আগ্রহে ক্যাপ্টেন সোলেমানের জন্য অপেক্ষা করছি। আশীর্বাদ নেব, উপদেশ নেব। কিন্তু তাঁর খোঁজ নেই। শেষ পর্যন্ত আমাদের দলনেতা শামসুল ভাইসহ আমরা ক’জন তার তাঁবুতে গেলাম। দেখলাম বিছানায় মুখ গুঁজে কাঁদছেন। আমাদের উপস্থিতিতে মাথা উঠালেন। বললেন, “এ ক’সপ্তাহে তোমরা যে মায়া জালে জড়িয়েছ— তোমাদের সামনে গেলে আমার চোখ দুটোর পানি থামাতে পারব না। তার কান্না দেখে আমরাও হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলাম। অনুরোধ জানালাম, “স্যার আপনার আশীর্বাদ ছাড়া আমরা যুদ্ধে যেতে অক্ষম। সবাই আপনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আমাদের সাথে তিনি আসলেন। শুরু হলো কান্নার ঝড়। প্রত্যেককে পৃথক পৃথক ভাবে বুকে জড়িয়ে কয়েক মিনিট ধরে কাঁদলেন। পুত্রবৎ স্নেহে মাথা ও দেহ বুলিয়ে দিলেন। কান্না স্তিমিত হলে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা রাখলেন। ইংরেজিতেই বক্তৃতা দিয়েছিলেন। যার অর্থ হল মুক্তিকামী ভায়েরা। পরাধীনতার কাছে কখনো মাথা নোয়বে না। জীবন বাজি রেখে হানাদারদের বিদেয় করো বাংলার মাটি থেকে। যুদ্ধে অনেকে জীবন হারাবে। দেশ স্বাধীন হলে তোমরা নিজ দেশে চলে যাবে। তোমাদের কারো সাথে হয়তো আর দেখা হবে না। আমার আন্তরিক আশীর্বাদ রইল সবার প্রতি। মনে রেখো, জীবনের চাইতে দেশ অনেক বড়। খোদা হাফেজ।” আমরা গাড়িতে উঠেছি। শুনলাম ক্যাপ্টেন সোলেমান আমাদের সাথে যাবার অনুমতি পেয়েছেন। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এ ধরনের একটি আবেদন আগেই করেছিলাম। থুকুড়াবাড়ী ইয়ুথ ক্যাম্পে এসে একটা অপারেশন দলের নেতৃত্ব নিলেন। গোলন্দাজ বাহিনীর মর্টার সাপোর্টের ব্যবস্থা হল। লাহিড়ী হাটের পাকিস্তান বাহিনীর অত্যন্ত শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙে দিতে সক্ষম হলাম সেই অপারেশনে। আমাদের হস্তগত হল প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র, গোলাবারুদ। ফিরে এসে খুব উল্লসিত হলাম। ক্যাপ্টেন সোলেমান আমাদের সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। আমাদের সাফল্য যে প্রকারান্তরে তারই সাফল্য এ ভেবে খুব আনন্দ অনুভব করলেন। তারপর হঠাৎ নীরব হয়ে আকাশ পানে চেয়ে রইলেন। চক্ষু দু’টো তার ছল ছল করে উঠলো। তার এ আকস্মিক নীরবতার রহস্য তখন স্পষ্ট করে বুঝিনি। কিন্তু এখন মনে হয় সেদিন কি তিনি | তার নিজ মাতৃভূমি কাশ্মীরের স্বাধীনতার স্বপ্নই দেখছিলেন? দুই. যুদ্ধের স্মৃতি চিরকালই বিভীষিকাময়। তবুও বিপদ সংকুল মুহূর্তের ছোট বড় সকল | ঘটনাই এমন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো ভাস্বর হয়ে আছে যা কখনও ম্লান হবার নয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এমন অনেক বেদনাদায়ক অথচ অনুপম অনির্বাণ দৃশ্যাবলী মনের স্মৃতির কোঠায় চিত্রিত রয়েছে যা ভাষায় প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার কর্তৃক গেরিলা দলভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দৈনিক ২ টাকা হারে ভাতা দেয়া হতো। এই স্বল্প আর্থিক ভাতায় আমাদের দৈনন্দিন ব্যয়ভার বহন করা ছিল দুঃসাধ্য। সে সময় স্থানীয় জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য সহযোগীতা না পেলে যুদ্ধ করা কঠিন হয়ে পড়তো; বিশেষ করে পাকসেনাদের মতো জগত বিখ্যাত চৌকষ বাহিনীর বিরুদ্ধে কৃতিত্ব অর্জন করা কোনো ভাবেই সহজসাধ্য ছিল না। অকৃত্রিম নিবেদিত প্রাণ দেশপ্রেমিক জনগণ অনেক সময় নিজে উপোস করেও মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যপণ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন। ধনী-দরিদ্র সবাই যার যার সাধ্যমতো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অকৃপণ উদার হৃদয়ে প্রসারিত করেছেন সাহায্যের হাত। তাদের ক’জনের কথাই আজ আমরা মনে রাখতে পেরেছি। কিংবা তাদের অবদানকে মূল্যায়ন করার কতটুকু প্রয়োজন বোধ করি। কিন্তু দুর্দিনে অজপাড়াগাঁর ঐ সব অখ্যাত ব্যক্তিরাই আমাদের থাকা খাওয়া ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে আত্মোৎসর্গ পর্যন্ত করেছেন। কালাতিক্রমের কারণেই কি না জানি না। সম্ভবত আমাদের মনের দৈন্য তাদের কথা ভুলিয়ে দিয়েছে। একদিনের কথা। আমাদের ২২ জন মুক্তিযযাদ্ধার দুপুরের খাবারের যোগাড় নেই। কী করি? বর্তমান পঞ্চগড় জেলার (বৃহত্তর দিনাজপুরের পঞ্চগড় মহকুমা) আটোয়ারী উপজেলায় পাকিস্তানি বর্বর সেনাদের অত্যাচারে হাট বাজার, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ সবকিছু প্রায় বন্ধ ছিল। আমরা সে স্থানেই হাইড-আউট করে নিশিদিন যাপন করি আর সুযোগ সুবিধামতো পাক সেনাদের রাতের ঘুম দিনের আরাম হারাম করার জন্য আচম্বিত আক্রমণ করি এবং ফিরে আসি। কিন্তু আমাদের পেটপূজার ব্যবস্থা কী? তড়েয়া হাট সংলগ্ন বড় ধাপ, ছোট ধাপ, প্রেমগঞ্জ, কাটালী এসব গ্রামে ছিটে ফোঁটা ক’জন লোক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তখনও নিজ বাড়িতে থাকতেন। বাকী অধিকাংশই পাক সেনাদের ভয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন সীমান্ত এলাকায় নতুবা ভারতীয় শরনার্থী শিবিরে। আমরা নিরুপায়। টাকা থাকলেও সরবরাহ নেই। সেদিন দেড় বেলা প্রায় অনশনে কেটে গেল। অনন্যোপায় হয়ে এক সংগতিপন্ন অথচ বিধ্বস্ত পরিবার কর্তাকে অনুরোধ জানাতে বাধ্য হলাম আমাদের দুপুরের আহারের ব্যবস্থা করার জন্য। তিনি সলজ্জভাবে অপরাগতা প্রকাশ করলেন, কেন না পাক সেনাদের অত্যাচারে তার অবস্থাও অত্যন্ত বিপন্ন। সব কিছুই অচল। তখন পাশে দাঁড়ানো ছিলেন একজন সত্তরোর্ধ্ব বদ্ধ। এতক্ষণ আমরা তাকে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল করিনি। আমাদের অভূক্ত অসহায় অবস্থার কথা হয়তো তিনি শুনে থাকবেন। জীর্ণ বস্ত্রে শীর্ণ দেহখানি আধো ঢাকা। শীতের প্রকোপে এবং বয়সের অমোঘ নিয়মে শরীরের ত্বক বন্ধুর হয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশের মতো শত সহস্র খাল বিলের সৃষ্টি হয়েছে। বৃদ্ধটি আমাদের কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালেন। আমরা এ উপেক্ষিত বৃদ্ধকে দূরে চলে যাবার জন্য ধমক দিতে যাব ঠিক সেসময় তিনি আমাকে আনুমানিক আধা-সের চাল নিতে অনুরোধ করলেন। ক্ষীণদেহী লোকটির অতিদারিদ্র্যের ছাপ সুস্পষ্ট। কাঁধে একটি ছেড়া বস্ত্রের পোটলা। তার দিকে মনোযোগ দেয়ার মানসিকতাও তখন অনুপস্থিত। কিন্তু তার চাল দান করার ইচ্ছা আমাকে আকৃষ্ট করল। বৃদ্ধের ডান কাধে হাত রেখে বিনীতভাবে বললাম, “চাচা, আমরা সংখ্যায় ২২ জন। আপনার আধা-সের চাল দিয়ে আমাদের কিছু হবে না। কিন্তু বৃদ্ধটি নাছোড়বান্দা। তার আধাসের চাল নিতে খুব অনুনয় করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তার কাকুতির কাছে পরাজিত হলাম। নেহায়েত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হলাম বৃদ্ধের দান গ্রহণ করতে। চাল দিতে দিতে বৃদ্ধটি যা উচ্চারণ করলেন তাতে আমার ভিমড়ি যাওয়ার অবস্থা। তিনি বললেন, “মুই বাপ একজন ভিক্ষুক মানুষ। গ্রামের লোকজনও বেশি নেই। যা দু’চারজন আছে তাদের আপন আপন অসুবিধাও ঢের। ভিক্ষা খুব একটা পাওয়া যায় না। মোর লগত একসের চাল আছে মোটে। এগৃথেকেই আধা-সের দিমু। মোর ঘরত কিছু নেই বাবা, আর কী দিয়ে তুমাল্লাক সাহায্য করমু। এ কীসের চালের সবটাই দিবার পারনুহে, কিন্তু শরীলটা আইজ ভালো নেই। ভিক্ষা করবার তাকত পাই না। তাই কোনোরকমে বাকী আধা-সের চাল রান্না করে পানিভাতে স্ত্রী, বিধবা মেয়েটি আর মুই রাতটা কাটায় দিমু”। বহুধা রংয়ের কাড়া আকাড়া চালগুলো দেখেই বুঝলাম বহুঘর থেকে সংগৃহীত। ভিক্ষার চাল দান হিসেবে নিতে আমার দ্বিধা হল। আমি বৃদ্ধটিকে অনুরোধ জানালাম, “চাচা মিয়া, আপনি যে মহানুভবতা, যে ত্যাগ দেখিয়েছেন সেটাই যথেষ্ট, আপনার চাল ফিরিয়ে নিন”। বৃদ্ধ এবার অশ্রুসজল চোখে জবাব দিলেন, “বাবাজি, মুই বৃদ্ধ মানুষ। যুদ্ধে যাবার শক্তি মোর শরীলে নেই। তাছাড়া মাের যুবক ছেলেও নেই যে, যুদ্ধে পাঠিয়ে মুক্তিযোদ্ধার বাবা হমু। বাংলাদেশ স্বাধীন করতে কত মানুষ কতভাবে অবদান রাখছেন। কেউ ধন দিচ্ছেন, কেউ জান দিচ্ছেন। অনেকেই মান হারাচ্ছেন। কিন্তু মোরত কিছুই নেই। মুই ধন সম্পদ শূন্য। জানটার যেটুকু আছে তা শুধু যমদূতের জন্য। মোর এই ভিক্ষা করা চালটাও নিলে অন্তত নিজে নিজে সুখ পামু যে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার আল্লাহ তৌফিক দিল”। বৃদ্ধের দন্তহীন ফোকলা মুখের দৃঢ় আশা আর সজল নয়ন দুটোর করুণ চাহনী দেখে তার দানকে প্রত্যাখ্যান করার সাহস আমার হল না। আমি এবার শুধু বললাম, “চাচা মিয়া, আমাদের জনপ্রিয় দেশটাকে শত্রুমুক্ত করতে অনেক লোকের অসংখ্য সাহায্য, অসীম ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে এবং আরো হতেই থাকবে, কিন্তু আপনি আপনার দেহ নিংড়ানো সঞ্চয়ের অর্ধেক দান করে যে দৃষ্টান্ত রাখলেন তার তুলনা নেই। আপনি প্রশিক্ষণ নেননি, অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হননি। তবু আপনি একজন সুযোগ্য সক্রিয়  নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা। তখন আমার আবেগও বাধভাঙা জোয়ার হয়ে উঠল। আমি বললাম, আর আপনাকে নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা থাকতে দেব না। এই নিন আমার হাতিয়ারটা স্পর্শ করুন”। আমার হাতের এস-এল-আর হাতিয়ারে তার হাত ছোঁয়ালাম। তার হাতেই ককিং হ্যান্ডেল ধরে কক করালাম। ট্রিগারে আঙুল দিয়ে ফায়ার করার পদ্ধতি দেখিয়ে দিলাম। এরপর আমি ঘোষণা করলাম, “আজ থেকে আপনিও সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হলেন। হয়ত অসংখ্য সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা এদেশের জন্য জানপ্রাণ দেবে। বহু বিত্তবান তাদের ধন সম্পদ উৎসর্গ করবে। তবু আপনার ভিক্ষালব্ধ সঞ্চয়ের অর্ধেক দান করে যে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন তার দাম জগত সমান, এর পরিমাণ সমস্ত জলরাশি অপেক্ষাও বেশি”। এ কথাগুলোর কতটা সরবে আর কতটা নীরবে বলেছিলাম আজ আর মনে পড়ছে। আর কথাগুলোর কতটুকু ঐ বৃদ্ধ বুঝেছিলেন তাও নির্ণয় করতে পারিনি। একাত্তরের সেই দানশীল বৃদ্ধ এখন বেঁচে থাকার কথা নয়। সেদিন ফেরার সময় পঞ্চগড় জেলার স্থানীয় ভাষায় অশ্রুভেজা চোখ আর ভাঙা অস্পষ্ট উচ্চারণে বৃদ্ধটি বলছিলেন, “মুই মুক্তিফৌজ হইচুরে (আমি মুক্তিফৌজ হলাম)”। সীমান্ত এলাকায় অসংখ্য ব্যক্তির দান দক্ষিণা আমরা পেয়েছি। জনযুদ্ধে জনসমর্থন ও অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধন সম্পদ দিয়ে কিংবা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যারা সাহায্য সহযোগীতা করেছেন তাদের অবদানকে বিরাট করে দেখা দরকার। এদেশের অসংখ্য সহজ, সরল লোকদের অকৃত্রিম ও সক্রিয় সহযোগিতা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তারা নিজেদের শত অসুবিধার মধ্যেও মাতৃক্রোড়ের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের আগলে রেখেছে। জীবন বাজি রেখে পাক সেনাদের গতিবিধি আমাদের জানিয়েছে। ভাতের থালার অর্ধেক আমাদের দিয়েছে। স্বাধীনতার জন্য আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার এমন স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণের স্মৃতি মনে করলে বিমুগ্ধ হয়ে যাই। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। এ ব্যস্ততার ভিড়ে এসব ব্যক্তিদের ক্ষুদ্র বৃহৎ অবদানকে মনে পড়ে। আজও কখনো বিজয় দিবসে কিংবা স্বাধীনতা উৎসবে যখন নিরিবিলিতে থাকি কিংবা একাত্তরের বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস পড়ি তখন মনে পড়ে কমাস হাড়সর্বস্ব দন্তহীন ঐ বৃদ্ধের কথা, নির্ণয় করতে ইচ্ছে হয় তার দানের মূল্য, আর একটি বাক্য প্রতিধ্বনিত হয় “মুই মুক্তিফৌজ হইচুরে”। তিন. ১৭ নভেম্বর ৭১। আটোয়ারী এ্যাম্বুশের জন্য এ দিনটিই নির্ধারিত হলো। নভেম্বরের মাঝামাঝিতে এ্যামবুশের এ স্পট ঠিক হয়ে গিয়েছিল। পঞ্চগড়ের আটোয়ারী থানা সদরে অবস্থিত নিরাশি হাট। রবি ও বৃহস্পতিবারে হাটটি বসে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় লোকদের দ্বারা নিরাশি হাট থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনাকাটা করে আনতাম। কিন্তু নিরাশি হাট পাকসেনাদের দখলে। হানাদাররা এখানে খবরদারী করতে আসে। তাদের উদ্দেশ্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাটবাজারের সুযোগ নষ্ট করা, সন্দেহভাজন লোকদের পাকড়াও করা আর দালাল মীরজাফরদের যোগসাজোসে মুরগি-খাসীসহ অন্যান্য সামগ্রী জোর করে নিয়ে যাওয়া। পাক সেনাদের অত্যাচারে লোকজন অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশ্বস্ত ইনফরমারের মাধ্যমে জানলাম, শত্রু সেনারা সংখ্যায় পনেরো বিশ জন। তারা একটি টহল দল হিসেবে হাটে এসে সকাল নয়টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত খবরদারী করে। এটা ওটা ইচ্ছেমতো নিয়ে ফিরে যায়। কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস করে না। রুহিয়া-পঞ্চগড় পাকা সড়ক তাদের যাতায়াতের পথ। পর পর তিনজন ইনফরমার থেকে অভিন্ন রিপোর্ট পাওয়া গেল। আমরা নিশ্চিত হলাম যে ফাঁদ পাতলে এ শিকার ফাঁদে পা ফেলবেই। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় অপারেশনটা তিনটি গেরিলা দল মিলে সম্মিলিতভাবে করবো। গেরিলা নিয়মে আমরা ক্ষুদ্রাস্ত্র বহন করি। এস এম জি, এল এম জি, এস এল আর ইত্যাদি ছাড়া শক্তিশালী অন্যকোনো হাতিয়ার আমাদের ছিলনা বললেই চলে। কদাচিৎ কোনো কোনো দলের সাথে হয়তোবা একটি করে টু-ইঞ্চ মর্টার পড়তো। তবে বিস্ফোরক দ্রব্যের সরবরাহ ছিল পর্যাপ্ত। হাই এক্সপ্লোসিভ, করডে সেফটি ম্যাচ, সেফটি ফিউজ, ডেটেনেটর এসবের অভাব ছিলনা। গভীর রাতে পাকসেনাদের বাংকারের আশে পাশে বিস্ফোরণ ঘটাই। ব্যস, রাতের ঘুম তাদের হারাম হয়ে যায়। আমাদের কাজ হলো, ব্রীজ ভাঙা, কারখানা ধ্বংস করা, রেল লাইন উড়িয়ে দেয়া; রাস্তাঘাট বিচ্ছিন্ন করা এবং বিদ্যুৎ ও টেলিফোন খুঁটি কেটে দেয়া। হিট এন্ড রান পদ্ধতিতে শত্রুবাহিনীকে ত্যাজবিরক্তে রাখা। গেরিলা দলগুলোতে আঠার থেকে বাইশজন পর্যন্ত জনবল থাকতো। অন্ততঃ আট-দশটি হ্যান্ড গ্রেনেড একটি কাপড়ের থলেতে রাখতাম। রাতে ওটা বালিশ হিসাবে কাজ করতো। দু’একটা প্রাইম করেও রাখা হতো তাৎক্ষণিক ব্যবহারের জন্য। আজ তা মনে করে গা শিহরে ওঠে। ভাগ্যিস গ্রেনেড ভর্তি ব্যাগ আমাদের মাথাটা উড়িয়ে নিয়ে যায়নি। আগের রাত দ্বিপ্রহরের পর রওনা করলাম। এ্যামবুশ স্পটের কাছাকাছি ওৎ পেতে থাকবো। উত্তরবঙ্গের হাড় কাঁপানো শীত আমাদের হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিল। তীব্র ঠাণ্ডা বাতাস। আমরা ঠকঠক করে কাঁপছি। গা বরফের মতো শীতল হয়ে গেছে। আমাদের পরনে হাফশার্ট কিংবা গেঞ্জি। নিম্নাঙ্গে লুঙ্গি কিংবা হাফপ্যান্ট। পাদুকাবিহীন পা। কোমরে বাঁধা থাকতো একটি গামছা। শীতবস্ত্রহীন প্রচন্ড শীতের মধ্যেও আমরা নিরস্ত্র হলাম না। বাংলাদেশ সরকারের দেয়া পঞ্চাশ টাকা পকেট মানি দিয়ে পেট পূজা করাই দুস্কর। কাপড়, চোপড় কেনার প্রশ্নই আসে না। প্রচণ্ড শীতে লোহা নাকি কুকড়ে যায় এ বাক্যটি সেদিন আমাদের সামনে বাস্তব হয়ে এল। ঠাণ্ডায় হাতের আঙুল অকেজো প্রায়। অস্ত্রগুলোও বরফ-শীতল হয়ে গেছে। হাতিয়ারে বোন্ট ঠেলাতো দূরের কথা প্যান্টের বোতাম লাগানো দায়। কিন্তু মনোবলের সেকি দোর্দন্ড জোর। কোন বাঁধাই হিসাবে অনুভূত হচ্ছে না। নেশার ঘোরে শুধু শত্রু নিধনের কথাই ভাবছিলাম। রাতের মধ্যেই আমরা পজিশনে চলে গেলাম। কুসার ক্ষেত (আখ) ও বাঁশ বনের মধ্যে ঘুপটি মেরে ইঁদুর ধরা বিড়ালের মতো বসে থাকলাম। এ্যামবুশের স্পটটা বেশ চমৎকার। রাস্তার একটি বিপদজনক মোড়। আমাদের বিপরীত দিকে একটি ছোট খাল। তাছাড়া নভেম্বরের মাঠভরা ধানক্ষেত। পাকসেনাদের পালাবার মতো সুবিধাজনক পথ নেই। এ্যামবুশের জন্য এটাই আদর্শ স্থান। দিনের নয়টা পেরিয়ে গেল। শীতের শিশিরসিক্ত পোশাক গায়েই শুকিয়ে গেল কিন্তু শত্রুর দেখা নেই। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। পূর্বরাতে নানা টেনশনে পেটে দানাপানি পড়েনি। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের দেয়া দৈনিক ২ টাকার ভাতা দিয়েই আমাদের তিনবেলার খাবার ব্যবস্থা করতে হতো। গ্রামের লোকদের সক্রিয় সহযোগিতা অত্যন্ত স্মরণযোগ্য। গেরিলাদের প্রয়োজনে যে কোন সাহায্য করতে সাধারণ লোকজন ছিল অকৃপণ হস্ত। কিছু নাস্তা যোগাড় করার জন্য পার্শ্ববর্তী গ্রাম সুখাতীতে গেলাম। গ্রামবাসীরা। আমাকে চাউলের ব্যবস্থা করে দিলেন। গ্রামের বউ-ঝিয়েরা চাউলগুলো ভেজে পেয়াজলবন-তেল মেখে আমার হাতে দিলেন। আমি এ্যামবুশ স্পটের দিকে রওনা হলাম। পিছন ফিরে দেখি একটি শিশু আমাকে অনুসরণ করে দৌড়াচ্ছে। থামলাম। শিশুটিকে কাছে ডেকে বললাম, থোকা তুমি কোথায় যাবে?” শিশুটির বয়স আট/নয় বছরের বেশি নয়। শীর্ণ দেহখানি দেখে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে অনাদর, অবহেলা আর অযত্নে পরিত্যক্ত বাগানের চারার মতো শুকিয়ে গেছে। শিশুটি নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। কৌতূহল ভরে তাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, কী খোকা, তুমি মুক্তিযোদ্ধা হবে?” তৎক্ষনাৎ একলাফে আমার পা জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, “হাঁ ভাইজান মুই মুক্তিফৌজ হবার চাহাচু”। পঞ্চগড় এলাকার ভাষায় শিশুটি মুক্তিযোদ্ধা হতে চায়। আমি অবাক হলাম। আমার কৌতূহল আরো বেড়ে গেল। বাংলার একটি কচি শিশুও মুক্তিযোদ্ধা হতে চায়। কী আশ্চর্য! একাত্তরে স্বাধীনতাকামী পাগল প্রায় আবাল বৃদ্ধবনিতার অন্তরপোষিত ইচ্ছার প্রতীক হয়ে এলো এ শিশুটি। এমন দুর্বল দেহের একটি কচি-শিশু। তার মুক্তিযোদ্ধা হয়ে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সাহস দেখে মুগ্ধ হতে হল। কিন্তু এ অকুতোভয় হওয়ার পিছনে যে কারণ জানলাম তা অত্যন্ত মর্মান্তিক। জানতে পারলাম তার নাম সালাউদ্দিন। বেশ ক’বছর আগে তার বাবা একমাত্র শিশু পুত্র রেখে এ মায়ার ভুবন ত্যাগ করেছেন। শেষ আশ্রয় তার মাকেও পাকসেনারা ধরে নিয়ে গেছে। হয়ত পৈশাচিক লালসার শিকার হয়েছে তার মা। বাবা নেই, মা নেই। কী হবে আর বেঁচে থেকে। বললাম “যুদ্ধ করতে পারবে?” তার কোমল হাতের শক্ত মুষ্ঠি আর দৃঢ় চিত্ত দেখে বেশ অবাক হতে হল। চিবুক ধরে মনে মনে বললাম, সালাউদ্দিন, তোমার নামে একজন মুসলমান মহাবীর ছিলেন। তার ভুবন কাঁপানো শৌর্যবীর্য ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। জানিনা কত দীর্ঘ হবে আমাদের এ লড়াই। আমরা যদি এ যুদ্ধ শেষ করতে না পারি তবে তোমাদের মতো পরবর্তী প্রজন্মের দরকার হবে। আমাদের এ হাতিয়ার তুলে দেব তোমাদেরই হাতে। প্রিয়তম এ বাংলাদেশটাকে যে কোনো মূল্যে মুক্ত করতেই হবে।” ছেলেটি আমার কথা কতটুকু শুনেছিল কিংবা কী বুঝেছিল জানিনা। নাছোড়বান্দা ছেলেটিকে একা ফেলে যেতে পারিনি। পরবর্তীতে সে আমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমারের কাজ করেছিল। ভিক্ষার থালা নিয়ে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটি থেকে অনেক তথ্য আমাদের দিয়েছিল। জানিনা একাত্তরের সেই দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটি এখন কোথায় কীভাবে আছে। আজও তার অনাদর অবজ্ঞাপূর্ণ জীবনের পরিবর্তন ঘটেছে কী না কে জানে। আমাদের এ অভাগা জাতি এমন ক’জন ক্ষুদে বীরের খবর রাখার ফুরসৎ পেয়েছে। এ্যাম্বুশ সাইটে যখন ফিরে এলাম তখন প্রায় দিনের এগারটা। আমার নাস্তা বিতরণ শেষ না হতেই কাটআপ পার্টি সিগন্যাল দিয়ে বসল। শক্র ফাঁদে পড়েছে। শুরু হল ফায়ার। বেশ কিছু অস্ত্র গোলাবারুদ দখল করা হল। রাস্তায় পড়ে রইল বেশ কয়েকটি লাশ। কিছু সংখ্যক পাক সেনা অবশ্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো। তা সত্ত্বেও সেদিনের এ্যাম্বুশে শক্রর টহল দলের ব্যাপক ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছিলাম আমরা। লাশ থেকে ইউনিফরম খুলে নেয়া হয়। মৃতদেহ আনার চেষ্টা ত্যাগ করলাম। বিস্তর ধানক্ষেত অতিক্রম করে মৃতদেহ আনা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। দুদিন পরে আমাদের অপারেশনের প্রতিক্রিয়া হিসাবে পাকসেনারা আমাদের গোপন আস্তানা আক্রমণ করে। আর্টিলারী গোলা পড়তে লাগল। পাকসেনাদের তীব্র আক্রমণে আমরা গোপন আস্তানা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম। শুরু হল গ্রামবাসীর উপর অত্যাচার। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিল। আট দশজন গ্রামবাসীকে হত্যা করল। আমাদের আশ্রয় দানকারীদের ধরে নিয়ে গেল। নিয়ে গেল কয়েকজন যুবতীকে। এক ঘণ্টার মধ্যে গ্রামবাসীর সবকিছু তছনছ হয়ে গেল। ধন গেল, জান গেল, মান ইজ্জত সবই গেল। আমার আজও মনে পড়ে গ্রামবাসীর সেই গগন বিদার আর্তচিঙ্কার, বাঁচাও…….বাঁচাও……..বা…….চা………….!!! চার. আমাদের দেশ মুক্ত হতে যাচ্ছে এখবর নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে জেনে গেলাম। ব্যাপারটি বেশ চমক সৃষ্টি করল আমাদের কাছে। সংবাদটা শুনে গা কীভাবে ঝংকার দিয়ে উঠেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমরা রীতিমতো থতমতো খেয়ে গেলাম। সংবাদটাতে সন্দেহের উদ্রেক হল। কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছ থেকে প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তি পাবার আগাম খবর পাওয়া গেল যে, তাকে নিছক মজাকের সাথে উড়িয়ে দেয়া যায় না। নভেম্বরের মাঝামাঝিতে আটোয়ারী থানার নিরাশি হাটের সন্নিকটে পাক সেনাদের টহল দলকে এ্যামবুশে ফেললাম। জানমাল বেশ ক্ষতি করা গেল। দখলকৃত অস্ত্র গোলাবারুদ জমা দেয়ার জন্য থুকুড়াবাড়ি ইয়ুথ ক্যাম্পে হাজির হলাম। উদ্দেশ্য দু’টো। প্রথমটা সাকসেসফুল এ্যামবুশের জন্য বাহবা নেয়া। দ্বিতীয়টি হল এ্যামবুশে অপারেশনে ক্ষয়কৃত এ্যামুনিশন পূরণ করার জন্য আবেদন জানানো। আমাদের আশা ছিল এবার নিশ্চয়ই আরো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক এ্যামুনিশন পাব। যা দিয়ে, আমাদের অভাবনীয় বর্ধিষ্ণু সাহসকে কাজে লাগাতে পারব। কিন্তু আমাদের বাড়তি আশাকে ছাইচাপা দেয়ার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো কাপ্টেন শিবুরাম। তিনি থুকুড়াবাড়ি ইয়ুথ ক্যাম্পের দায়িত্বে আছেন। আমার জানা নেই ইয়ুথ ক্যাম্পে এই ভারতীয় ইয়ং ক্যাপ্টেন শিবুরামের কী দায়িত্ব ছিল। তবে এত চৌকষ, কর্মঠ, নিষ্ঠাবান ব্যক্তি আমার চোখে দ্বিতীয়টি পড়েনি। ধর্মে শিখ সম্প্রদায়ের লোক। প্রথাগতভাবে লম্বা শিররুহ, গোঁফ শুশ্রু থাকার কথা। শিখ ধর্মানুযায়ী মাথাটি ঢেকে থাকবে পাগড়ী দিয়ে। কিন্তু বাস্তবে ওসবের বালাই নেই। তবে তিনি যে শিখ সম্প্রদায়ের লোক সেটা প্রমাণের জন্য হাতে ধাতবের শুধু একটি চুড়ি রেখেছেন। সৈনিক কাট মাথার চুল। দাড়ি মোটেই নেই। ছোট করে ছাটানো গোঁফ। হাতের চুড়িটা দেখলে শিবুরাম নামের কারণেই হিন্দু বলে ভ্রম হওয়া বিচিত্র নয়। সাদা হাফপেন্ট, সাদা গেঞ্জি পরেই রাতদিন থাকতেন। গেরিলা দলগুলোকে অপারেশনে প্রেরণ করার জন্য সমর সজ্জিত করেন। কোথায় কীভাবে অপারেশন করতে হবে তার ব্রিফিং দেন। আবার অপারেশন শেষে গেরিলা দলগুলোর কাছ থেকে অস্ত্র সন্ত্র জমা নেন। অপারেশনের রিপোর্ট গ্রহণ করেন। কোথায় তিনি নেই। রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টাই তাকে তৎপর দেখেছি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্থায়ীভাবে প্রেরিত গেরিলা দলগুলোকে ভাতা প্রদান, অস্ত্র সন্ত্র সরবরাহ করা এবং বিভিন্ন অপারেশনাল অগ্রগতির রিপোর্ট নেয়া সর্বত্রই তিনি হাজির। তিনিই একমাত্র ভারতীয় কর্মকর্তা কুড়াবাড়ি ইয়ুথ ক্যাম্পে নিয়োজিত ছিলেন। তাই তার বিকল্প ভাববার অবকাশ ছিল না। আটোয়ারী অপারেশনে দখলকৃত শত্রু সেনার ইউনিফরম, অস্ত্র ও এ্যামুনিশন ক্যাপ্টেন শিবুরামের নিকট জমা দেয়া হল। আমাদের দলনেতা আইয়ুব ভাই অনুরোধ করলেন। বললেন “স্যার অপারেশনে আমার দলের প্রচুর এ্যামুনিশন শেষ হয়েছে। পুনরায় অপারশেন করতে হলে প্রচুর গোলাবারুদ চাই”। ক্যাপ্টেন শিবুরাম আমাদের বেশ প্রশংসা করলেন। এ্যামবুশের কৃতকার্যর জন্য ধন্যবাদও দিলেন। তারপর নীরব হয়ে রইলেন। খানিকক্ষণ পর বললেন, “বহুত আচ্ছা মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, বহুত আচ্ছ”। এরপর হিন্দি ইংরেজি মিশ্রিত ভাষায় আমাদের যা জানালেন তা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। তিনি বললেন, “তোমাদের আর কোনো কিছু সরবরাহ করা হবে না অপারেশনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। হাইড আউটে টিকে থাকতে না পারলে সীমান্ত এলাকায় ফিরে এসো। কিংবা চলে এসো ভারতস্থ ইয়ুথ ক্যাম্পে। মোট কথা তোমাদের আর যুদ্ধ করার দরকার নেই।” আমরা এমন অনাকাতক্ষীত কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। বললাম, “স্যার আপনি বলেন কী? যুদ্ধ না করলে এদেশ স্বাধীন হবে কী করে? এরপর আইয়ুব ভাই সহ কানাকানি করতে লাগলাম। মনে মনে শালার বেটা’ বলে গালি দেয়া বাকী থাকল না। এভাবে রণভঙ্গ দেয়ার জন্য অভিশম্পাত দিলাম। শালা মালাউন, আমাদের সাথে বেঈমানী! রাগে দুঃখে আইয়ুব ভাইয়ের চোখ দিয়ে ছলছল করে অশ্রু ঝরতে লাগল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় একথা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ছায়া আমাদের আঘাত হানল। আমরা যেন মারাত্মক হোচট খেলাম। ক্যাপ্টেন শিবুরাম অনিতদূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছেন। তাকে তখন নাট্যমঞ্চের ভিলেন চরিত্রের অভিনেতা মনে হচ্ছিল। সহসা যিনি আমাদের অসহায় মনের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করতে সক্ষম হলেন। এরপর আমাদের ঈশারায় তাকে অনুসরণ করতে নির্দেশ দিলেন। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হয়ে পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। ক্যাপ্টেন শিবুরাম একটি কক্ষে ঢুকেই বাংলাদেশের একটি ম্যাপ হাতে নিলেন। আমরা দেখলাম ম্যাপটির উপর লাল কালিতে অংকিত কতকগুলো স্থল বিভাজন রেখা। তারপর আমাদের উদ্দেশ্যে | নাতিদীর্ঘ বক্তব্য দিলেন। তিনি বললেন, প্রত্যেকটি আর্মস এ্যামুনিশন এখন মূল্যবান। ভারত সরকার গেরিলা যুদ্ধের ইতি ঘটানোর নির্দেশ জারি করেছেন। ব্যাপরটি যদিও টপসিক্রেট তবুও বলছি, তোমাদের দেশটাকে স্বাধীন করে দেয়ার জন্য ভারতীয় বাহিনী সম্মুখ যুদ্ধে লড়বে। তোমরা আমাদের সাথে সাথে থাকবে। পুরো রণাঙ্গনকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। সর্বোচ্চ দু’সপ্তাহের মধ্যে স্বাধীন হয়ে যাবে বাংলাদেশ। সত্যি কথা বলতে কি আমরা এখন শুধু সুপ্রীম কমান্ডের অপেক্ষায় আছি। এমন একটা হট | নিউজ অবিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু বিশ্বাস করাও বেশ কঠিন। যে ভারত ছিল পাকিস্তানের চোখের বালি। আমরাও সেই পাকিস্তান ওয়াতনের মুশরেকী অঞ্চলের লোক। সেই চিরশত্রু দেশ আরেক শত্রু দেশের জন্য এতদিন কোটি শরনার্থীর বাড়তি ঝামেলা পোহাচ্ছে। আমরা পাচ্ছি অস্ত্র, গোলাবারুদ, প্রশিক্ষণ, পেয়ে চলেছি ভাতা ও পকেটমানি। এখন কী না আমাদের পক্ষে হতে যাচ্ছে সর্বোচ্চ উৎসর্গ। একেবারে জীবন দান। যুদ্ধ মানেই জীবন ক্ষয়। পরের জন্য বিশেষ করে শক্রর জন্য জীবন দান করা সত্যি সত্যিই হবে কি? আমরা কি সত্যিই পেতে চলেছি স্বাধীনতা? আসবে কি আমাদের দীর্ঘ প্রতিক্ষীত মহামূল্যবান মুক্তি? এবং এত শীঘ্রই? আমি অনেকের মুখে শুনেছি আমাদের দেশ স্বাধীন করে দেয়ার বিনিময়ে যদি কেউ বাংলাদেশের দুইহাত মাটিও চায় আমরা তাই দেব। তবু আর এই কষ্ট সহ্য হয় না।

আমাদের আত্মীয় স্বজনেরা সহ সকল শরণার্থীরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কবলে শরণার্থী শিবিরগুলোতে কলেরা, বসন্ত রোগে লোক মারা যাচ্ছে হাজারে হাজার। লক্ষাধিক গেরিলা যোদ্ধা নিরাশ্রয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যেথায় সেথায়। স্বাধীনতা পাওয়ার অনন্ত পথ আর কতদূরে কেউ জানে না। সবার এই কামনা, শেষ হোক এ দুর্গম দুর্বার দীর্ঘ পথ। দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে বিদায় নিলাম। ফিরে গেলাম খালি হাতে হাইড আউটে। আমাদের গেরিলা সহকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। গোলাবারুদ না দেয়ার অজুহাতে সম্ভবত এই আকাশ কুসুম গল্পের অবতারণা করলেন ক্যাপ্টেন শিবুরাম। তবু কি আর করার আছে। অসহায় হয়ে বিনা অপারেশনে নিজেদের টিকিয়ে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকল না। অধীর অপেক্ষায় রইলাম সেই সুদিনের জন্য। অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান হলো। ডিসেম্বর মাসের তিন তারিখে ভারতীয় বাহিনী ঝাপিয়ে পড়ল পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। নয় মাসের সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা ও ধৈর্য্যের সমাপ্তি ঘটতে লাগল। আমাদের ডাক পড়ল। ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সাথে মিশে গেল মুক্তিপাগল গেরিলা যোদ্ধারা। এবার সম্মুখ যুদ্ধ। শুরু হল এগিয়ে যাবার পালা। আর, হিট এন্ড রান নয়। এবার অগ্রাভিযান, আক্রমণ, রেইড, চার্জ, দখল, ডিফেন্স ইত্যাদি ইত্যাদি। সর্বান্তে প্রতিক্ষিত বিজয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

অনারারী ক্যাপ্টেন মো. আফাজুল হক জন্ম : ১৫ জুলাই ১৯৫৮, ঠাকুরগাঁও। শিক্ষা: খোচাবাড়ি হাইস্কুল এবং রুহিয়া মহাবিদ্যালয়, ঠাকুরগাঁও। রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে বিএ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ ও এলএলবি। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন এবং অনারারী ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসরগ্রহণ। বিভিন্ন সেবামূলক কাজে জড়িত।

Reference: স্বাধীনতা ৩ – মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া