You dont have javascript enabled! Please enable it! মেহেরুন্নেসা - সংগ্রামের নোটবুক
মেহেরুন্নেসা
কবি মেহেরুন্নেসা ১৯৪২ সালের ২০ আগস্ট কলকাতার খিদিরপুরে জন্ম নেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে তাদের পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। তাঁর পরিবার ঢাকার মিরপুরে বাস করতে শুরু করে। মেহেরুন্নেসার ডাকনাম রানু।  মেহেরুন্নেসা স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করার সুযােগ পাননি। মা, বড়বােনের সহযােগিতা আর নিজের চেষ্টাতেই তিনি লেখাপড়া শিখেছেন। তার বাবা ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন। ছােট দুই ভাই আর মাকে নিয়ে গড়া ছােট্ট পরিবারের হাল ধরবার জন্য তাঁকে উপার্জনে নামতে হয়। পত্রিকায় কপি লেখা আর প্রুফ দেখার কাজ শুরু করেন তিনি। এরপর এক সময় চাকরি নেন ফিলিপস কোম্পানিতে।
নিজের অপার সম্ভাবনা আর কবিতার প্রতি ভালােবাসা ব্যয় হয়ে যাচ্ছিল ছােট দুই ভাইকে মানুষ করতে গিয়েই। মাত্র দশ বছর বয়সেই এই সংগ্রামী নারীর কবিপ্রতিভার প্রকাশ ঘটে। তার প্রথম কবিতা ‘চাষী’ প্রকাশিত হয় “দৈনিক সংবাদ পত্রিকার ‘খেলাঘর’ পাতায় ১৯৫২ সালে। এরপর ‘বেগম’ পত্রিকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের পায় সব পত্রিকাতেই তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তার কোনাে বই প্রকাশিত হয়নি। বাংলা একাডেমির পাঠের আসরে প্রায়ই পাওয়া যেত প্রাণবন্ত হাস্যোজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ছিপছিপে এই কবিকে মেহেরুন্নেসা ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে সংগ্রাম কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী এজেন্ট হিসাবে মিরপুরে দায়িত্ব। পালন করেন। তিনি বন্ধু কাজী রােজীর সাথে মিলে গঠন করেন অ্যাকশন কমিটি। এই কমিটির উদ্যোগে মিরপুরে নিয়মিত মিছিল-সমাবেশ হতাে। অসম্ভব সাহসী মেহেরুন্নেসা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযােগী অবাঙালিদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ২৩ মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে নিজের বাড়ির ছাদে উড়িয়েছিলেন স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজের পতাকা।  ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের সেই উত্তাল দিনগুলােতে মেহেরুন্নেসা লিখেছিলেন। তার জীবনের শেষ কবিতা ‘জনতা জেগেছে’, যা প্রকাশ হওয়ার পর সবার মাঝে। সাড়া ফেলেছিল। এ কবিতায় তিনি লিখেছিলেন :
মুক্তি শপথে দীপ্ত আমরা দুরন্ত দুর্বার, সাত কোটি বীর জনতা জেগেছি, এই জয় বাঙলার।
বাঁচবার আর বাঁচাবার দাবী দীপ্ত শপথে জ্বলি,
আমরা দিয়েছি সব ভীরুতাকে পূর্ণ জলাঞ্জলি।
কায়েমী স্বার্থবাদী হে মহল! কান পেতে শুধু শােনাে
সাতকোটি জয় বাঙলার বীর! ভয় করি নাকো কোনাে।
বেয়নেট আর বুলেটের ঝড় ঠেলেচিরবিজয়ের পতাকাকে দেবাে,
সপ্ত আকাশে মেলে। আনাে দেখি সাত কোটি এই দাবীর মৃত্যু তুমি, চিরবিজয়ের অটল শপথ, এ জয় বাঙলা ভূমি। জামায়াত নেতা যুদ্ধাপরাধী কাদের মােল্লার বিচারের সময় ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে’ জবানবন্দি দিয়েছিলেন শহীদ মেহেরুন্নেসার বন্ধু কবি কাজী রােজী। তার বর্ণনা থেকে উঠে এসেছে মেহেরুন্নেসার ভূমিকা এবং সে সময়ের পরস্থিতি। তিনি বলেছেন : একাত্তরে নিহত কবি মেহেরুন্নেসা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল।
আমরা একই এলাকায় থাকতাম। একাত্তরে মিরপুরে অবাঙালি ও বিহারীরা বাঙালিদের ভীষণভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করত। এ থেকে রেহাই পাবার জন্য ঐ। নির্বাচনের সময় আমরা একটা অ্যাকশন কমিটি গঠন করি। আমি ছিলাম ঐ কমিটির সভাপতি, কবি মেহেরুন্নেসাসহ আরও অনেকে ছিল সদস্য। মিরপুরের অবাঙালিরা এজন্য আমাদের প্রতি বৈরী মনােভাব পােষণ করত। এটা বুঝতে পেরে আমরা অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন। মিটিং-মিছিল করতে থাকি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে আমি ও মেহেরুন্নেসাসহ অনেকেই রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলাম। এই ভাষণ ছিল স্বাধীনতার ডাক। এরই মধ্যে চলে আসে ২৫ মার্চ। সেদিন সকালে আমি মিটিং করছিলাম। বুঝতে পারছিলাম একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। মিটিং শেষ করে বাসায় ফেরার পর খবর পেলাম, আমার ও কবি মেহেরুন্নেসার বাসায় তল্লাশি হবে। কারণ, অ্যাকশন। কমিটিতে আমরা দুজন ছিলাম নারী সদস্য। আমি যখন জানতে পারলাম, আমার বাসায় তল্লাশি হবে, তখন মেহেরুন্নেসার বাসায় খবর পাঠালাম। বললাম, আমি। আজই বাসা ছেড়ে চলে যাব। তােমরাও অন্যত্র চলে যাও। এ খবর পাওয়ার পর মেহেরুন্নেসা তার ছােট ভাইকে দিয়ে আমার বাসায় খবর পাঠাল যে সে, তার মা ও দুই ভাইকে নিয়ে কোথায় যাবে? আমি বুঝলাম, বাড়ি থেকে চলে যাওয়া একান্ত প্রয়ােজন।
কিন্তু মেহেরুন্নেসা তার মা ও ভাইদের নিয়ে কোথায়ও যেতে না পেরে নিজেদের। বাসতই ছিলেন। ২৭ মার্চ কুখ্যাত রাজাকার কাদের মােল্লার নেতৃত্বে একদল রাজাকার এবং অবাঙালি মিরপুর ৬ নম্বর ডি ব্লকে অবস্থিত মেহেরুন্নেসাদের বাসায় হামলা চালায়। ‘মুশরিক’, ‘কাফের’, ‘ভারতের দালাল’ ইত্যাদি বিশেষণ দিয়ে প্রথমে ওরা মেহেরুন্নেসার দুই ভাইকে কোপাতে শুরু করে। এটা দেখে মেহেরুন্নেসার মা। কোরান বুকে চেপে ধরে ওদের কাছে কাকুতিমিনতি করে বলেছিলেন, “আমরা। মুসলিম, আমাদের মেরাে না।”  কিন্তু কোনাে আবেদনেই কাজ হয়নি। মায়ের চোখের সামনেই ওরা প্রথমে দুই ছেলেকে জবাই করে হত্যা করে এবং এরপর মেহেরুন্নেসার ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে একটু একটু করে হত্যা করে। মেহেরুন্নেসাকে হত্যা করার পর তাঁর দেহ থেকে মাথা আলাদা করে সেটা চুল দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে টাঙিয়ে দিয়েছিল আর দেহটা কাপড় শুকানাের তারে কাপড় শুকাবার মতাে করে ঝুলিয়ে রেখেছিল ঘাতকের দল। এই বীভৎস পৈশাচিকতার পুরােটাই তারা দেখতে বাধ্য করেছিল মেহেরুন্নেসার মাকে! সবশেষে ওরা মেহেরুন্নেসার মাকেও জবাই করে হত্যা করে।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা