You dont have javascript enabled! Please enable it! চিশতী শাহ্ হেলালুর রহমান - সংগ্রামের নোটবুক
চিশতী শাহ্ হেলালুর রহমান
ছাত্রনেতা ও সাংবাদিক চিশতী শাহ্ হেলালুর রহমানের জন্ম ১৯৪৯ সালে বগুড়ার রহমান নগরে। তার বাবা চিশতী মনসুর রহমান, মা সাজেদা খাতুন। দুই ভাই ও দুই বােনের মধ্যে তিনি সবার বড় ছিলেন। তিনি ১৯৬৫ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯৬৭ সালে আই. এ. পাস করেন। এরপর ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে বি. এ. (অনার্স) পাস করে এম, এ. ভর্তি হন। চিশতী শাহ হেলালুর রহমান ১৯৭০-‘৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন। তিনি নিউক্লিয়াস’ বা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন ও একাত্তরের অসহযােগ আন্দোলনে সক্রিয় সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেছেন। চিশতী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের সময় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা পতাকা দিবসে পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের প্যারেডে তিনি নেতৃত্ব দেন।
তৎকালীন খ্যাতনামা ‘দৈনিক আজাদ পত্রিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি (১৯৭০-১৯৭১) ছিলেন চিশতী শাহ হেলালুর রহমান। থাকতেন সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তখন ইকবাল হল) ২১২ নম্বর কক্ষে। তিনি হল ছাত্র সংসদের পাঠাগার সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়া তিনি মাঝেমধ্যে কবিতা লিখতেন। চিশতী মােটা কালাে ফ্রেমের এবং খুব ভারী কাচের চশমা পরতেন। চুলের মাঝখান দিয়ে সিথি করতেন। হাসিখুশি মুখের চিশতীকে অনেকের মাঝে সহজেই আলাদা করা যেত।
তার বন্ধু কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষ্য থেকে জানা যায়, ২৫ মার্চের রাতে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে রাখা অস্ত্রগুলাে বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জে পাচার করার দুঃসাহসিক দায়িত্ব পালনকারীদের দলে চিশতীও ছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আক্রমণ করতে পারে জেনে বিপ্লবী পরিষদের অন্য সদস্যরা যখন রাত সাড়ে ১১টার দিকে জহুরুল হক হল ছেড়ে নদীর ওপারে চলে যান, তখন চিশতীকেও তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যেতে রাজি হননি। চিশতী বলেছিলেন, কয়েকজন বন্ধু ও ছাত্রলীগকর্মী রাত্রে হলে তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। তাদের সবাইকে নিয়ে পরদিন ২৬ মার্চ তিনি নদীর ওপারে চলে যাবেন। | চিশতী শাহ্ হেলালুর রহমানের ভূমিকা ও মৃত্যু সম্পর্কে তার সহপাঠী ও বাংলা। একাডেমির সাবেক কর্মকর্তা মফিজুল ইসলামের ‘আমার বন্ধু রচনা থেকেও বেশ। কিছু বিষয় জানা যায়। মফিজুল লিখেছেন : সাবেক ইকবাল হলে মার্চের ৫ তারিখে চিশতী প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাকে উর্ধ্বে তুলে ধরে সালাম জানায় ও শপথ গ্রহণ করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। তাঁর সাথে ছিলেন হল সংসদের তত্ত্বালীন সহসভাপতি জনাব জিন্নাত আলী, ছাত্রলীগের হল শাখার দফতর সম্পাদক গােলাম মােস্তফা ও আমি।
পঁচিশে মার্চ রাতে হানাদার বাহিনী যখন ঘুমন্ত ছাত্রদের ওপর বৃষ্টির মতাে গুলিবর্ষণ শুরু করে তখন চিশতী দোতলায় ওর জানালার পাশের হল আর অডিটোরিয়ামের মাঝামাঝি শেডটির ওপর লাফিয়ে পড়ে। সারাটা রাত ওই শেডের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকে চিশতী। পরদিন ভােরে হানাদার বাহিনীর কেউ কোথাও আছে কিনা দেখার জন্য চিশতী যখন মাথাটা সামান্য উঁচু করলাে, তখনই পাহারাদার পাকিস্তানি সেনার নজরে পড়ে যান তিনি। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে অবস্থানকারী পাকিস্তানি মেজরের কাছে।  দৈনিক আজাদের বিশ্ববিদ্যালয় রিপাের্টার হিসাবে নিজের পরিচয় পেশ করলাে চিশতী। কিন্তু শেষ রক্ষা হলাে না। হলের পেছনদিক থেকে ডাইনিং হলের দিকে যেতে যে সরু রাস্তাটা তারই পাশে ড্রেনের কাছে গাছটির নিচে দাঁড় করিয়ে পর পর তিনটি গুলি করা হলাে চিশতীকে। প্রথম গুলিটি যখন ওর বুকের বামপাশ ভেদ করে বেরিয়ে গেল, তখনই তিনি ‘জয় বাংলা’ বলে চিল্কার করে উঠেছিলেন। চিশতী কি কোনাে বধ্যভূমিতে পচে গলে মাটির সাথে গিয়েছিল, নাকি বর্বর বাহিনী পেট্রোল দিয়ে তার দেহটা জ্বালিয়ে দিয়েছিল, তা আমরা কেউ জানতে পারিনি। (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড) কবি নির্মলেন্দু গুণ ২৭ মার্চ সকালে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের মাঠে চিশতী শাহ্ হেলালুর রহমানের বিকৃত লাশটি পড়ে থাকতে দেখেছিলেন বলে জানিয়েছেন। চিশতি শাহ্ হেলালুর রহমান অবিবাহিত ছিলেন। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে চিশতী হেলালুর রহমানের নামে একটি পাঠকক্ষ থাকলেও সবার মুখে মুখে সেটি ‘এক্সটেনশন রিডিং রুম’ নামেই পরিচিত।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা