এস. এ. মান্নান (লাডু ভাই)
খ্যাতিমান ক্রীড়া সাংবাদিক লাডু ভাইয়ের বাবা-মায়ের দেওয়া নাম। শেখ আবদুল মান্নান। ইংরেজি পত্রিকায় সাংবাদিকতার সুবাদে অনেকেই তাকে এস. এ. মান্নান নামেই চিনতেন। কিন্তু তার ওইসব নাম হারিয়ে গিয়েছিল ছােট-বড় সকলের শ্রদ্ধা-ভালােবাসা মাখা ‘লাডু ভাই’ নামের আড়ালে। লাডু ভাই সােচ্চার ছিলেন ক্রীড়াক্ষেত্রে দুই পাকিস্তানের বৈষম্য নিয়ে। সে সময় পাকিস্তানের সব ক্রীড়া ফেডারেশনের দফতর ছিল লাহাের কিংবা করাচিতে। অর্থ যা বরাদ্দ হতাে, ৯০ শতাংশই ব্যয় হতাে পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে এক টিনের বেড়ার ঢাকা স্টেডিয়াম ছাড়া তেমন কোনাে ক্রীড়া অবকাঠামােই গড়ে ওঠেনি। ছিল না কোনাে সুইমিংপুল। ঢাকা স্টেডিয়ামেই ফুটবল, ক্রিকেট, হকি থেকে কাবাডিও অনুষ্ঠিত হতাে। পূর্ব পাকিস্তান স্পাের্টস ফেডারেশন খরচ করার জন্য পেত নামমাত্র অর্থ। পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকার পাতায় এসব নিয়েই লেখালেখি করতেন তিনি। অন্য প্রতিবেদকদের দায়িত্ব দিতেন এসব অবিচার ও অন্যায় নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির। তার এই প্রতিবাদী লেখাগুলাে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের ভালাে লাগেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় এরই মূল্য দিতে হয়েছে। তাকে, বুকের রক্তে। এস, এ. মান্নান লাডু ভাইয়ের জন্ম ১৯২৮ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাসে।
তাঁর বাবা ছিলেন কলকাতার পার্ক সার্কাস জামে মসজিদের ইমাম। তারা ছিলেন চার ভাই ও তিন বােন। ভাইদের মধ্যে তিনি সবার বড়। ছাত্রজীবনে তিনি ফুটবলসহ অন্যান্য খেলাধুলায় যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। জানা যায়, পার্ক সার্কাস ময়দানে তিনি ফুটবল খেলতেন। কলকাতা এরিয়ান্স’ ও ‘মােহামেডান স্পােটিংয়ে খেলাধুলায় তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। ১৯৪৮ সালে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় তল্কালীন খ্যাতনামা ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসাবে। বাংলাদেশে আসার আগে পর্যন্ত দৈনিক আজাদের কলকাতা অফিসে কাজ করেছেন তিনি। ১৯৫০ ও ‘৫১ সালে ফুটবল লীগের দ্বিতীয় বিভাগে “দৈনিক আজাদের আজাদ স্পাের্টিং ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। জিমখানা ফুটবল লীগেও তিনি কিছুদিন খেলেছেন। এ ছাড়া জিমখানা রেসকোর্সেও যুক্ত ছিলেন। দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় দীর্ঘ ১৫ বছর কাজ করার পর তিনি পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকায় যােগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এখানেই কাজ করছিলেন। লাডু ভাই ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান। এ কারণে বাবা-মায়ের কাছে অনেক বেশি আদরের ছিলেন তিনি। তিনি মাকেও ভীষণ ভালােবাসতেন। দীর্ঘদেহী, প্রশান্ত ও সৌম্যদর্শী লাডু ভাই ছিলেন বন্ধুবৎসল। বিয়ে করেননি, বন্ধুবান্ধব নিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন। আর খেলাধুলাই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। জানা যায়, রাজনৈতিক আলােচনাতেও সেভাবে অংশ নিতেন না। একমাত্র ভাবনা ছিল, কীভাবে খেলার মান বাড়ানাে যায়; পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি খেলােয়াড়দের অংশগ্রহণ জাতীয় পর্যায়ে কীভাবে বাড়ানাে যায়।
এস. এ. মান্নান পূর্ব পাকিস্তান স্পাের্টস ফেডারেশন’, ‘ফুটবল ফেডারেশন, ‘অলিম্পিক অ্যাসােসিয়েশন’, ‘ঢাকা মােহামেডান স্পােটিং ক্লাব’, ‘চ্যানেল ক্রসিং কমিটি’, ‘ক্রীড়া লেখক ক্লাব’ প্রভৃতি সংস্থার সদস্য ছিলেন। ফুটবল ফেডারেশন ও ‘ঢাকা মােহামেডান স্পােটিং ক্লাবে’ তাঁর বলিষ্ঠ সাংগঠনিক ভূমিকা ছিল। পাকিস্তান আমলে ক্রীড়াজগতের মানােন্নয়নের ভাবনা থেকে এবং নতুন কিছু করার তাগিদে “খেলার খবর’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। যদিও টাকার অভাবে তিনি বেশিদিন এই পত্রিকা টিকিয়ে রাখতে পারেননি। এস. এ. মান্নান লাডু ভাই সেই যুগে ক্রীড়া সাংবাদিকতা করতেন, যখন সংবাদপত্রে খেলার খবর দেওয়ার প্রয়ােজনীয়তাই বােধ করতেন না সম্পাদকরা। পুরাে পত্রিকায় হয়তাে একটি কলাম খেলার খবরের জন্য দেওয়া হতাে। খেলার জন্য দায়িতপ্রাপ্ত নির্দিষ্ট কোনাে সাংবাদিকও সে সময় পত্রিকাগুলােতে ছিল না। বিভিন্ন প্রতিবেদক ঘুরতে ঘুরতে বিকেলের দিকে স্টেডিয়ামে গিয়ে নােট বইয়ে লিখে নিতেন ফুটবল ম্যাচের ফলাফল- কত গােল হয়েছে আর কে কয় মিনিটে গােল করেছে।
এস, এ. মান্নানরা ঠিক এই জায়গাটিতেই পরিবর্তন এনেছিলেন। নিজে একসময় কলকাতার ময়দানে খেলেছেন, সেখানকার ক্রীড়া সাংবাদিকতার ধরনের সাথেও পরিচিত ছিলেন। ঢাকায় এসে সেই অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষা কাজে লাগালেন লাডু ভাই। সেই সঙ্গে খেলাধুলা সম্পর্কিত জ্ঞান ও প্রচুর পড়াশােনা তাকে দুর্দান্ত এক ক্রীড়া সাংবাদিক হিসাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। ষাটের দশকে তারা সম্পাদকদের বােঝাতে পেরেছিলেন, খেলাও পত্রিকার জনপ্রিয়তা বাড়ানাের একটি মাধ্যম হতে পারে। এস, এ, মান্নানকে ষাটের দশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল অবজারভার পত্রিকার খেলার পাতার। সে সময় অবজারভারই অন্যতম পত্রিকা, যারা খেলাকে গুরুত্ব দিয়ে গােটা একটি পাতা ছেড়ে দিয়েছিল খেলার খবর, ফিচারের জন্য। তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে ‘অবজারভারের খেলার পাতাকে নিয়ে গিয়েছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। বেড়েছিল। পত্রিকাটির প্রচারসংখ্যা। নিয়মিত খেলা দেখতে হবে, সারা দুনিয়ার খেলার খবর রাখতে হবে- ক্রীড়া সাংবাদিকদের অপরিহার্য কাজগুলাে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। এস, এ. মান্নান ক্রীড়া সম্পাদক হয়েও প্রতিটি বিকেল কাটাতেন স্টেডিয়াম পাড়ায়। লীগ, টুর্নামেন্টের খেলাগুলাে দেখতেন। খেলােয়াড়দের সঙ্গে কথা বলতেন। তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানতেন।
রাজনীতির মানুষ না হলেও অবজারভারের খেলার পাতাকে দিয়েই তিনি। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কীভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তান। জাতীয় দলে পাঞ্জাবি খেলােয়াড়দের আধিক্য, বাঙালি খেলােয়াড়দের প্রতি অবহেলার তথ্য অনুসন্ধানী লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরতেন ‘অবজারভারের খেলার পাতায়। এই সােচ্চার ভূমিকাই তাকে শক্ত করে তুলেছিল পাকিস্তানি জান্তাদের চোখে। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে (সঠিক তারিখ জানা যায়নি) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশীয় দোসররা তাঁকে তাঁর পুরানা পল্টনের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তার আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার লাশের খোঁজে মিরপুর, রায়েরবাজারসহ অনেক জায়গায় হন্যে হয়ে ঘুরেছেন তাঁর ছােট ভাই এস, এ. আব্বাস। কিন্তু কোথাও মেলেনি তাদের প্রিয় বড় ভাইয়ের সন্ধান।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা