You dont have javascript enabled! Please enable it! এ. কে. শামছউদ্দিন - সংগ্রামের নোটবুক
এ. কে. শামছউদ্দিন
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ ছিলেন এ, কে, শামছউদ্দিনের নানা। ১৯৪৩ সালের ২ আগস্ট টাঙ্গাইল শহরে অবস্থিত নানার বাড়িতে শামছউদ্দিন জন্ম নেন। যদিও তার পৈতৃক নিবাস টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার গয়হাটা গ্রামে। তার বাবার নাম আফাজউদ্দিন আহমদ এবং মায়ের নাম রাবেয়া খাতুন। আফাজউদ্দিন আহমদ ডাক ও তার বিভাগে চাকরি করতেন। ছয় ভাই-বােনের মধ্যে শামছউদ্দিন সবার বড়। তার ডাকনাম খােকা। শামছউদ্দিন গয়হাটা মাইনর স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ঢাকার নবাবপুর সরকারি হাই স্কুলে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে প্রথম বিভাগে ১৭তম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৬০ সালে নটরডেম কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর পাকিস্তান সরকারের ইন্টার উইং স্কলারশিপ নিয়ে লাহাের গভর্নমেন্ট কলেজে রসায়নশাস্ত্র পড়তে যান। কৃতিত্বের জন্য বাঙালিদের মধ্যে তিনিই প্রথম ‘সায়গল স্কলারশিপ অর্জনের বিরল গৌরবে ভূষিত হয়েছিলেন। এ স্কলারশিপ ওই সময় শুধু পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। লাহাের কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে তিনি বি, এসসি. (অনার্স) পাস করেন। পরবর্তীকালে এম, এসসি, পরীক্ষায়ও তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশােনা শেষে তিনি প্রথমে আণবিক শক্তি কমিশনে চাকরি করেন। কিছুদিন পর এ চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯৬৮ সালে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যােগ দেন। এ পরীক্ষায় তিনি সমগ্র পাকিস্তানে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।
সি, এস, পি, হওয়ার পর শামছউদ্দিন ১৯৬৯ সালে ফরিদপুরে এন, ডি, সি, এবং এরপর ১৯৭০ সালে সিরাজগঞ্জে এস, ডি, ও, নিযুক্ত হন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি সিরাজগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মহকুমা প্রশাসকের (এস, ডি. ও.) দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। সরকারি উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রত্যক্ষভাবে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করেন। তাঁরই নেতৃত্বে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সিরাজগঞ্জে মুক্তিযােদ্ধারা সংগঠিত হয়। শুধু সিরাজগঞ্জ নয়, বগুড়া, পাবনা, রংপুর জেলার সঙ্গেও তিনি যােগাযােগ স্থাপন করেন।
১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল আরিচা ঘাটে উপস্থিত হয়। ওয়ারলেসের মাধ্যমে এ সংবাদ পেয়ে যান শামছউদ্দিন। সংবাদ পেয়ে তিনি সিরাজগঞ্জ কলেজে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পাওয়া মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ট্রেজারিতেরক্ষিত রাইফেল তুলে দেন। এরপর তাঁর নেতৃত্বে বাঘাবাড়ী ঘাট ও নগরবাড়ী ঘাটে মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পাওয়া এই যােদ্ধাদের সঙ্গে ই. পি. আর. (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) বাহিনীর একদল বাঙালি সেনাও ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা তখন তাকে কর্নেল উপাধি দেন। কাশীনাথপুরের ডাব বাগান, বাঘাবাড়ী ঘাট, উল্লাপাড়ার ঘাটিনা সেতুর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পাবনা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের মুক্তিযােদ্ধারা সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ শুরু করেন। এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহকুমা প্রশাসক এ. কে. শামছউদ্দিন। এমনকি মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার ঘাটিনা রেলওয়ে ব্রিজের কাছে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হন।
২৪ এপ্রিল বাঘাবাড়ী ঘাটে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জিপ ও একটি ট্রাক এলে তার নির্দেশে মুক্তিবাহিনী হামলা চালায়। এতে পাকসেনারা পালিয়ে যায়। ২৬ এপ্রিল পাকবাহিনী ট্রেনযােগে ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জে আসার পথে উল্লাপাড়ার ঘাটিনা সেতুর কাছে মুক্তিযােদ্ধারা যে আক্রমণ করেন, তা তাঁরই নির্দেশ অনুসারে সংঘটিত হয়েছিল। এক পর্যায়ে সিরাজগঞ্জের প্রতিরােধ ভেঙে পড়ে। এ. কে, শামছউদ্দিন তাঁর অধীনস্থ প্রতিরােধযােদ্ধাদের ভারতের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন এবং তিনি নিজে প্রথমে আত্মগােপন করেন। তারও ভারতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ সময় তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ঢাকার ১০৮ ফকিরাপুলে তাঁদের নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। স্ত্রীকে দেখার জন্য তিনি গােপনে ঢাকায় আসেন। ওই বাসা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৭ মে তাকে আটক করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায়। সেখানে একদল সেনাসদস্য তার ওপর অকথ্য অত্যাচার ও অমানুষিক নির্যাতন চালায়। নির্যাতনের একপর্যায়ে তার শরীর থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত টেনেও বের করে নিয়েছিল। বন্দি হওয়ার দুদিন পর ১৯ মে সেনারা এ. কে. শামছউদ্দিনকে হত্যা করে। এ, কে, শামছউদ্দিনকে বনানী সামরিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তার সমাধি সংরক্ষিত এবং সেখানে নামফলক রয়েছে। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর গয়হাটা গ্রামে তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে ‘শহীদ শামছউদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। শহীদ হওয়ার পাঁচ মাস পর তার একটি ছেলে সন্তান জন্মায়।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা