শেখ মুজিব ও স্বাধীনতা (একটি পুরানো লেখা)
সাপ্তাহিক বিচিত্রা ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৩
[ মুক্তিযুদ্ধে যখন মুক্তিবাহিনী ক্রমশঃ দুর্বার গতিতে জয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন একটি মহল ইয়াহিয়ার সাথে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্যে বিভিন্ন ধুয়া তুলতে থাকেন, তারা বললেন, বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুর রহমানকে ফিরে পেতে হলে ইয়াহিয়ার সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে। তারা বঙ্গবন্ধুর নাম জড়িয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে সে সময় কলকাতার গণবার্তা পত্রিকায় ২৭ নভেম্বর, ১৯৭১ তারিখে অনামে নীচের লেখাটি লিখেছিলেন শ্রী নির্মল সেন । লেখাটি এখানে পুনমুদ্রিত হল ]
সংঘর্ষ না সমঝোতা ? বাংলাদেশের স্বাধীনতা, না এক পাকিস্তানের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান ? সার্বভৌম বাংলা, অধিকতর স্বায়ত্তশাসনসহ পাকিস্তানের মধ্যে বাংলাদেশের অতিতের স্বীকৃতি। বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত সাফল্য সত্বেও আবার এই প্রশ্নগুলি বার্থসংশ্লিষ্ট মহল থেকে তোলা হচ্ছে। একদিকে আওয়াজ উঠেছে —আঘাতের পর আঘাত হেনে খান সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করা, বাংলাদেশকে হানাদার বাহিনী মুক্ত করো। অপরদিকে একই সঙ্গে গোপনে প্রচার চলেছে —মুক্তিবাহিনীর দুর্বার আঘাতে ইয়াহিয়া সরকারকে রাজনৈতিক আলোচনায় বসতে বাধ্য করো। মুক্তিবাহিনীর সাফল্য, সমগ্র রণাঙ্গনে তীব্র চাপ সৃষ্টি, এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে মুক্তিফৌজের। অনমনীয়তার ফলে প্রকাশ্যে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আপসের কথা বলা। এই মহলের পক্ষে সম্ভব না হলেও এই মহলটি যেকোন প্রকারে হোক হাজার হাজার মুক্তিপাগল তরুণের রক্তের বিনিময়ে একটি সমঝোতায় পৌছবার জন্যে হন্যে হয়ে উঠেছে। এদের বক্তব্যে মনে হচ্ছে যেন বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করতে নয়, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্যে ইয়াহিয়াকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতেই মুক্তিবাহিনী এই মরণপণ সংগমে লিপ্ত হয়েছে। আবার মুজিবের নামে বিভক্তি এই মহলটি তাদের এই ষড়যন্ত্র সফল করতে এবার শেখ মুজিবুর রহমানের নামে আর একটি অপপ্রচার শুরু করেছে। ইতিপূর্বে তারা বলেছিলেন স্বাধীন বাংলা দেশ পেতে হলে শেখ মুজিবকে পাওয়া যাবে না শেখ মুজিবের বিনিময়েই স্বাধীন বাংলাদেশ পেতে হবে। অর্থাৎ তাদের বক্তব্যের সরলার্থ ছিল— স্বাধীনতা চান তো শেখ মুজিবকে হারাবেন, এক পাকিস্তানের ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান চাইলেই ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের জীবনহানি ঘটাবেন না। সে সময়কার ঘটনাগলি একটু গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই মহলটির তৎকালীন আচারআচরণের সঙ্গে ইয়াহিয়া সরকারের কার্যকলাপের একটি তাৎপর্যপূর্ণ সামঞ্জস্য ছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জানেন যে শেখ মুজিবের নামের সঙ্গে একটি আবেগ জড়িয়ে আছে ; তাই প্রকাশ্যে এবং গোপনে শেখ মুজিবের জীবনহানির সম্ভাবনা আছে এমন একটি প্রচারণা চালিয়ে সংগ্রামী বাঙ্গালিদের মনে বিভান্তি সৃষ্টি করা সম্ভব। তাই দেখা গেল আগস্ট মাসে যখন মুক্তিবাহিনী জোর আকমণ চালাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন এই পূর্বকথিত মহলটি প্রচার শুরু করল যে সংগ্রাম তীব্রতর করলে শেখ মুজিবের জীবনহানির সম্ভাবনা আছে। আর সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঘোষণা করা হলো যে ১১ই আগস্ট শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে। বিভিন্ন পত্রিকায় জল্পনাকল্পনা শুরু হলো যে শেখ মুজিব আদৌ বেচে আছেন কিনা সন্দেহ। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। যখনই মুক্তিবাহিনী কোন ব্যাপক আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে তখনই পত্রিকায় হঠাৎ সংবাদ প্রকাশ হতে শুরু হয়েছে। শেখ মুজিবের বিচার পুনরায় শুরু বিদেশী পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, শেখ মজিবকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে, ইত্যাদি। ফলে মুক্তিবাহিনীতে বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু, প্রাণপাত চেষ্টা করে শেখ মুজিবের জীবনের প্রশ্ন নিয়ে আবেগ সৃষ্টি করার কাজে এই মহলটি প্রথমদিকে খানিকটা সফল হলেও শেষ পর্যন্ত কোন প্রকারেই তাদের প্রচার ধোপে টেকেনি। ও বিভান্তি সৃষ্টির নূতন কৌশল। শেখ মুজিবের জীব হানির প্রদ তলেও আপোষের পথে এগনো যাবে না, একথা বুঝতে পেরে এ মহলটি এবার এক নতুন পথ ধরেছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে—বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের নতুন করে কিছু বলার নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে তারা আর সেই ইয়াহিয়ার পুরনো পাকিস্তানে ফিরে যেতে পারেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপোষ নেই। কি, এ মহলটি এইটকে বলেই শেষ করেনি। সম্প্রতি এই বক্তব্যের সঙ্গে তার এক নূতন বক্তব্য সংযোজন করেছে যে-~বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের নতুন কোন কথা বলার অধিকার না থাকলেও একজন মানুষ এ প্রশ্নে ভিন্ন কথা বলতে পরিন। তিনি হচেছন শেখ মুজিবুর রহমান। কারণ শেখ মুজিব নাকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলেননি, এ প্রশ্নে তার কোন প্রতিশ্রুতি নেই। তাই তিন কথা কার অধিকারী তিনিই। শুধুমাত্র এই মহলটিই নয়, সম্প্রতি পশ্চিম জার্মানি সফরকালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীও এ ধরনের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে শেখ মুজিব প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নন। শ্রীমতী গান্ধী একথা বলার পর থেকে বাংলাদেশের সরকারী মহল থেকেও এমন একটি কথা প্রচার করা আর তারই সুত্র ধরে মাকিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন নাকি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেবার জন্যে ইয়াহিয়াকে চাপ দেবার কথা ভাবছন। মস্কো-প্যারিস হতেও একই সুর ধনিত হচেছ। ওয়াশিং টন স্টার পত্রিকা খবর দিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একটি সমঝোতায় রাজী আছেন, তবে তার গোয়ার জেনারেলরা কোন কথা শনিতে চাইছেন না। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী লোকসভায় বলেছেন—প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঈদবাণীতে শান্তির কথা থাকলেও শেখ মুজিবকে মুক্তিদানের কথা নেই। অর্থাৎ এই সকল মহলের প্রচার অনুযায়ী: যে লোকটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ব্যতীত অন্য পথে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করতে পারতেন সে মানুষটিকে (শেখ মুজিবকে) মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না । তাই রাজনৈতিক সমাধানের সভাবনা সূদুরপরাহত হয়ে উঠেছে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মানুষ নন। বাংলাদেশ সমস্যার একটি ত্বরিত সমাধান তার কাম্য একথা বুঝতে কারো কষ্ট হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের যে মহলটি আজও শেখ মুজিব প্রতিশ্রুতিবিদ্ধ নন বলে প্রচার করছে তাদের কাছে একটি কথা। জিজ্ঞাস্য~-৭ই মার্চ-এর ঢাকা রেসকোর্সে প্রদত্ত যে ভাষণটি প্রতি দিন স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারিত হয়, তার সত্যিকারের অর্থ একথা সহজেই অনুমেয় যে শেখ মুজিবুর রহমান চাইলেও এ মহলটি কোনদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি। আর চায়নি এলেই আয় বিভিন্ন সময়ে। বিভিন অপপ্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশের সংগ্রামে বিচান্তি সৃষ্টির প্রয়াস পেয়ে চলেছে এবং চলছে। আজ মুক্তিবাহিনীর দুবার আঘাতে ইয়াহিয়ার মসনদ ভেঙে পড়ার উপক্রম হওয়ায় এই মহল চিন্তিত হয়ে উঠেছে। তারা প্রমাদ গুনছে। কারণ তারা জানে যে মুক্তিবাহিনী যদি সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করে তাহলে এরা আবর্জনার মহল আস্তাকড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। বাংলাদেশের সংগ্রামে সারিতে অনুপ্রবেশকারী ‘এক’ পাকিস্তান-এর এই অঘোষিত দালাল মহলটির কাছে আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে শেখ মুজিৰ প্ৰতিশ্রুতিবদ্ধ নন বলে প্রচার করে আপনারা যারা বাঙ্গালিদের পুনরায় ইয়াহিয়ার পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেবার অপচেষ্টা করছেন, হিম্মত থাকে তো আপনারা লক্ষ লক্ষ সর্বহারা শরণার্থীর কাছে পেশ করুন আপনাদের প্রস্তাব। স্বজনহারা গৃহহারা, সাবেক ইপিআর আর বেঙ্গল রেজিমেন্টের মৃত্যুর পথে দাড়ানো বাঙালিদের কাছে প্রকাশ্যে আপনাদের কথা তুলে ধরুন। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক পড়ুসা লক্ষ তরণ মুক্তিযোদ্ধার কাছে বয়ান করুন আপনাদের অভিলাষ । আমরা জানি, তাদের কাছ থেকে একটি জবাবই আসবে, সংগ্রামী বাহিনীর কণ্ঠে একটি আওয়াজই ধ্বন্বিত ও প্রতিধ্বনিত হবে-স্বজনহারা, গৃহহারা কেউ আর পিতৃপুরুষের ভিটেতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে সমঝোতা করে ফিরে যাননা। স্বাধীনতার প্রশ্নে আজ আর কোন বিতর্কের অবকাশ নেই। মুক্তি বাহিনীর দুর্বার আঘাত ইয়াহিয়ার মসনদের সঙ্গে আপোষ কামিদের নিশ্চিহ্ন করবে। পিতার আর্তনাদ আর ইজ্জতের বিনিময়ে কোন আপোষ নয়। বঙ্গবন্ধুর নামে অপপ্রচার চালিয়ে তাঁকে হেয় করা সম্ভব, মুক্তি সংগম ব্যাহত করা সম্ভ নয় । শেখ মুজিবের মুক্তি প্রতিটি বাঙ্গালির কাম্য। কিন্তু ইয়াহিয়ার সঙ্গে আপোষের নাম করে শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি দাবী করার পেছনে যে হীনমন্যতা বিরাজ করছে, সে হীনমন্যতা শেখ মুজিবের রাজনৈতিক মৃত্যুরই পরোয়ানা। তাই আপোসের শর্তে নয়, স্বাধীনতার শর্তেই শেখ মুজিবুর রহমান মত হবেন—আপোষকামীদের শেষ অপচেষ্টা ব্যর্থ হবে।
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/02/1973.12.18-bichitra.pdf” title=”1973.12.18 bichitra”]