জাপানী মুক্তি ফুকিউরা
তাদামাসা ফুকিউরা যুক্ত ছিলেন আন্তর্জাতিক রেডক্রসের সঙ্গে। ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে দুর্গতদের সাহায্যের জন্য রেডক্রস একটি দল গঠন করে পাকিস্তান পাঠায়। ফুকিউরা ছিলেন সেই টিমে। টিমটি যখন করাচি পৌছে তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ফলে তারা তখন আর বাংলাদেশে ঢুকতে পারেন নি। অনেক দেন দরবারের পর সেপ্টেম্বর মাসে তারা বাংলাদেশে পদার্পণ করলেন। ফুকিউরা জানতেন যুদ্ধের কথা। তার ডিউটি ছিল হাতিয়া, সন্দ্বীপ ও নোয়াখালীতে। যুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে এবং জাপানীদের সরিয়ে নেয়া হচ্ছে; তখন ফুকিউরা জাপান ফিরলেন না। হারিয়ে গেলেন। জাপানী পত্রিকায় নভেম্বরে খবরও বেরিয়েছিল যে একজন ত্রাণকর্মি নিখোঁজ। আসলে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ছিলেন হাতিয়া, সন্দ্বীপ ও নোয়াখালিতে। এই পুরোটা সময় তিনি সহায়তা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। সে কারণে তার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘জাপানি মুক্তি।’ ত্রাণ বিতরণ ও দুর্গতদের সাহায্য করার জন্য উপকূল অঞ্চলে যান ফুকিউরা। সন্দ্বীপ, হাতিয়া, নোয়াখালির বিভিন্ন জায়গায় তাবু গেড়ে কাজ করতেন এবং এই সময়ই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা তার তাবুতে আসতেন চিকিৎসা ও ওষুধপত্র নিতে। মাঝে মাঝে মুক্তিযোদ্ধারা এসে খবর দিয়ে যেতেন যে, অমুক গ্রামে ঐ দিন পাকিস্তানীরা বা তাদের সহযোগীরা আক্রমণ করতে পারে বলে তারা খবর পেয়েছেন। ফুকিউরা ঐ দিন ঐ গ্রামে গিয়ে তাবু গাড়তেন। এখন রেডক্রসের প্রতিনিধির সামনেতো আর গুলি চালানো, বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, হত্যা বা ধর্ষণ করা যায় না। এর ফলে, পাকিস্তানী সৈন্যরা তার ওপর বিরক্ত হয়ে উঠছিল কিন্তু কিছুই বলতে পারছিলনা। নভেম্বর মাসে তিনি নোয়াখালির এক গ্রামে, সকালে এক কিশোর এসে খবর দিল, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খবর পেয়েছেন, পাশের গ্রামটিতে পাকিস্তানীরা আক্রমণ করবে। সেখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়েছেন। এখন যে সরে যাবে তারও উপায় নেই। ফুকিউরা তখনই তাবুটা নিয়ে ঐ গ্রামের দিকে যাত্রা করলেন। দুপুর দু’টোয় সেখানে পৌছে তাবু গাড়লেন এবং ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ শুরু করলেন। বিকেল চারটের দিকে গ্রামবাসীরা খবর দিল, দুটি গানবোট আসছে। সতর্ক রইলেন তারা।
পাকিস্তানী অফিসার তার তাবুতে এসে হাজির। ক্রোধে তিনি অগ্নিশর্মা কিন্তু করার কিছু নেই। ফুকিউরা বিখ্যাত জাপানী কায়দায় তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। রাগের চোটে পাকিস্তানী অফিসার গানবোট নিয়ে ফেরত গেলেন। অনেক ঘটনার মধ্যে এটি একটি ঘটনা মাত্র। মুক্তি বাহিনী ফুকিউআর কোড নাম দিয়েছিল জাপানি মুক্তি। মুক্তিযোদ্ধাদের ওষুধ পাঠানোর জন্য তারা একটি ব্যবস্থা করেছিলেন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তার সঙ্গে আগে যোগাযোগ করতেন। বিকেল চারটের দিকে দেখা যেত তার ক্যাম্পের সামনে একটি রিকশা দাঁড়িয়ে। ফুকিউরা তখন কিছু ত্রাণ সামগ্রী ও ওষুধের কার্টুন নিয়ে এগোতেন, ভাবটা যেন কোথাও যাচ্ছেন এগুলি বিলাতে। তারপর জিরোবার জন্য একটু থামতেন। ফের চলা শুরু করতেন কিন্তু ভুলে যেতেন ওষুধের কার্টন নিয়ে যেতে। রিকশাওলা তথা মুক্তিযোদ্ধা যখন দেখতেন আশেপাশে দেখতেন কেউ নেই তখন কার্টন রিকশায় উঠিয়ে চলে যেতেন।| ফুকিউরা তার বইয়ে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। যুদ্ধ তীব্র হয়ে উঠলে তাকে ঢাকায় চলে আসতে হয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তারা অবস্থান করছিলেন। সেখানে তিনি একমাত্র জাপানী ফুজিতা আকিরার দেখা পেলেন। আকিরা ছিলেন আশাহী শিম্বুনের প্রতিবেদক।২৭ নভেম্বর আকিরা তাঁকে জানালেন, ক্যান্টনমেন্টের কাছে এক গ্রামে ২০০ মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ঘাঁটি গেড়েছে। ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করবেন। তাদের কমান্ডার রাশেদ যিনি আজিজ ভাই নামে পরিচিত তার সঙ্গে আকির একটি সাক্ষাৎকার নেয়ার বন্দোবস্ত হয়েছে। আকিরা খুব উত্তেজিত। ২৮ তারিখ সকালে তার সূত্র তাকে নিয়ে যাবেন নির্দিষ্ট জায়গায়। আকিরা সাক্ষাঙ্কার নিয়ে ফিরলেন। তার প্রতিবেদন ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ ও ৪ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে অশাহী শিমুনে প্রকাশিত হয়েছিল। যা’ হোক ২৮ তরিখ রাত একটায় তার রুমে টোকা। তিনি ভাবলেন, আকিরা বা হোটেলের কেউ কোনো দারোয়ান তার কাছে এসেছে। তিনি দরজা খুললেন। দেখেন চশমা পড়া একজন রুম বয় দাড়িয়ে। তিনি কিছু বলার আগেই রুম বয় ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে জানালেন, তিনি ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র, নাম, শাহজাহান মিয়া। তিনি মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে আছেন, হোটেলে তার পরিচিত লোকজন আছে। তাদের সাথেই এই পোশাকে তিনি হোটেলে ঢুকেছেন, উদ্দেশ্য একটা। তার প্রচুর পরিমাণে টেট্রাসাইক্লিন, পেনিসিলিন, বেনাজিন, ব্যান্ডেজ দরকার। ফুকিউরা বললেন, এতরাতে তিনি ওষুধ পাবেন কোথায়, আগামী কাল সকালে চেষ্টা করে দেখবেন। শাহজাহান বললেন, সম্ভব নয়। তাহলে অনেক মানুষ মারা যাবে। হঠাৎ, পাকিস্তানী
বাহিনী গ্রামটি আক্রমণ করে, তাদের হামলায় আহত নিহতের সংখ্যা ১০০। এ ছাড়া সেখানে আরো ২০০ মুক্তিবাহিনী আছেন। ফুকিউরা জিজ্ঞেস করলেন, তাদের কমান্ডার আজিজ ভাই কিনা। শাহজাহান বললেন, হ্যা, এবং আজিজ ভাইও আহত। ব্যাপারটা খোলাসা হলো। সকালে আকিরা যখন ঐ গ্রামে যান তখন পাকিস্তানী গোয়েন্দারা তাকে অনুসরণ করে। এবং হানাদার বাহিনীকে জানায়। তারাও আর কালক্ষেপণ না করে আক্রমণ করে। ঐ গভীর রাতে ফুকিউরা তাদের দলনেতা মি, রাম্বলকে ফোন করে ঘুম থেকে ওঠালেন। তারপর তারা আলোচনা করে ঠিক করলেন, ওষুধপত্র তার দেবেন। প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য হাপাম ও আরো তিনজন রওয়ানা হয়ে গেলেন হলিফ্যামিলি হাসপাতালের দিকে। সেখানে সব ওষুধপত্র রাখা ছিল। রাত আড়াইটায় তারা ওষুধপত্র নিয়ে ফিরে ফুকিউরাকে দিলেন। ফুকিউরা শাহজাহানকে তা দিলে তিনি পেছনের দরজা দিয়ে রমনাপার্কে হারিয়ে গেলেন।পরদিন বেলা ১১টায় একজন এসে তাকে একটা চিঠি দিল। শাহজাহানের চিঠি। তিনি জানিয়েছেন, ওষুধপত্র নিয়ে তিনি গ্রামে পৌঁছেছেন তবে কমন্ডার আজিজ ভাইকে বাঁচানো যায় নি।মুক্তিযোদ্ধাদের এরকম নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ ফুকিউরাকে অভিভূত করেছিল। জাপানি ফিরেছিলেন তিনি বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার পর, রেসকোর্সে তার বক্তৃতা শুনে। দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি একটি বই লিখেছিলেন, এক ‘চিতে দোরো তো বাংরাদের দোকুরিসুননা হাজেকি’ বা ব্লাড অ্যান্ড মাড ট্র্যাজেডি অব বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্স’। মুক্তিযুদ্ধের ওপর জাপানী ভাষায় লেখা প্রথম বই। Sheikh Ahmed Jalal, Japanese Contribution in the Independence of Bangladesh.
Source: মুক্তিযুদ্ধের ১৩ নম্বর সেক্টর – মুনতাসীর মামুন