ভাষা আন্দোলনে কি বঙ্গবন্ধু জড়িত ছিলেন? শুনুন তাঁর নিজের কণ্ঠে।
১৯৫২ সালের বাঙালি আর ১৯৭১ সালের বাঙালির মধ্যে পার্থক্য আছে
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১
ঢাকা, কেন্দ্ৰীয় শহীদ মিনার
আজ মহান ২১শে ফেব্রুয়ারি। শহীদ দিবসে আপনারা এখানে এসেছেন, ১২টা ১ মিনিটের সময় আমরা মাজারে গিয়েছি, সেখান থেকে সোজা এখানে চলে এসেছি। বাঙালিরা বহু রক্ত দিয়েছে। ১৯৫২ সালে যে রক্ত দেয়া শুরু হয়েছে সে রক্ত আজো শেষ হয় নাই, কবে শেষ হবে তা জানি না। আজ শহীদ দিবসে শপথ নিতে হবে, যে পর্যন্ত না ৭ কোটি মানুষ তার অধিকার আদায় করতে না পারবে সে পর্যন্ত বাংলার মা-বোনেরা বাংলার ভাইয়েরা আর শহীদ হবে না, গাজী হবে।
আমরা জানি, যে ষড়ষন্ত্রকারীরা ১৯৫২ সালে গুলি করে আমার ভাইদের শহীদ করেছিল, তারা আজো তাদের কাজ শেষ করে নাই। ষড়ষন্ত্র আজও চলছে। ষড়ষন্ত্র ভবিষ্যতে চলবে, কিন্তু বাংলাদেশের চেহারা তারা দেখে নাই। এ আন্দোলন ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ তারিখে শুরু হয়। ১৯৫২ সালে আমাদের ভাইয়েরা রক্ত দিয়ে প্রমাণ করে বাংলা ভাষাকে অমর্যাদা করতে আমরা দেবো না। রক্তের বিনিময়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করবো, ইনশাল্লাহ বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। যারা আজ বাংলার স্বাধিকারকে দমাতে চায়, যারা আজ বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার মানুষকে আজ লুট করতে চায়, কলোনি করতে চায়, বাজার করতে চায়, এত বড় বিজয়ের পরে যারা ষড়ষন্ত্র করতে চায়, তাদের জেনে রাখা উচিত যে ১৯৫২ সালের বাঙালি আর ১৯৭১ সালের বাঙালির মধ্যে পার্থক্য আছে। তাই আপনাদের কাছে আমার আবেদন আজ পবিত্র দিন। আজ আমি বেশি কিছু বলতে চাই না। আপনাদের কাছে এইটুকু বলতে চাই, আমাদের বাংলাদেশের ভাইয়েরা, বোনেরা রক্ত দিয়ে দেখায়ে গেছে, যে দরকার যদি হয় আমরা বাংলার মানুষ রক্ত দিতে জানি। আজ তাই এই শহীদ দিবসে শহীদদের আত্মার কথা মনে করে, যারা শহীদ হয়েছে ১৯৫২ সালে, ৫৪ সালের অত্যাচার, ৫৮ সালের অত্যাচার, ৬২ সালের শহীদ, ৭ই জুনের শহীদ, গত গণ আন্দোলনের শহীদ যাদের চিনি না নাম না জানা অজানা কত ভাই রক্ত দিয়েছে। বাংলার ঘরে ঘরে আজ শহীদ হছে মানুষ। শুধু গুলি খেয়ে শহীদ হচ্ছে না। না খেয়ে শহীদ হচ্ছে। কাপড় পায় না, পেটে খাবার নাই, শোষণ করে নিয়ে যাচ্ছে, বাংলার মানুষকে বাজার করেছে, বাংলার সম্পদ লুট করেছে, বাংলার মানুষকে পথের ভিখারি করেছে। আমরা কারো ওপর বে-ইনসাফ করতে চাই না। পাঞ্জাবি তার অধিকার পাক, সিন্ধ তার অধিকার পাক, পাঠান তার অধিকার পাক, বেলুচ তার অধিকার পাক, আমিও বাঙালি আমিও আমার স্বাধিকার চাই। এখানে আপোষ নাই।
তাই আপনাদের কাছে আজকে আমি অনুরোধ করবো বাংলার ঘরে ঘরে যান প্রস্তত হয়ে যান বাংলাদেশের ভায়েরা আর শহীদ নয়। বাংলার ছেলেদের গাজী হয়ে মার কোলে ফিরে যেতে হবে। শহীদ নয় গাজী। আর নয়, আমাদের ভায়েদের কথা আমরা তুলতে পারি না। যাদের মা আজও কাঁদে। যাদের বাপ আজও কাঁদে। যাদের ছেলে-মেয়ে আজো বাপ মা করে চিৎকার করে বেড়ায়। তাদের আত্মা বাংলার ঘরে-ঘরে বাংলার দুয়ারে-দুয়ারে আজকে আঘাত করছে। বলছে, বাঙ্গালি তুমি কাপুরুষ হযো না, বাঙালি তুমি জানের জন্য ভয় কোরো না, বাঙালি তুমি সংগ্রাম করে এগিয়ে যাও। তাই শহীদ দিবসে আজ আমরা শপথ নিয়েছি, রক্ত দেবো, দাবি ছাড়বো না, দাবি আদায় করে ছাড়বো।
তাই আপনাদের কাছে আমার আবেদন রইল ভায়েরা, সামনের দিন আরো কঠিন হবে বলে আমার মনে হচ্ছে। ষড়ষন্ত্রকারীরা ধামে নাই। তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা সকলের সহানুভুতি, ভ্রাতৃত্ব কামনা করি তার অর্থ এই নয় যে আমার ৭ কোটি মানুষকে কেউ গোলাম করে রাখবে। তার অর্থ এই নয় আমার দেশকে কেউ বাজার বা কলোনি করে। রাখবে। যে রক্ত দিয়ে বাংলার মানুষ একদিন আগরতলা থেকে আমাকে বের করে নিয়ে এসেছিল আমি ওয়াদা করতে পারি তোমাদের কাছে এই শহীদ দিবসে আল্লাহর নামে আমার রক্ত দিয়ে তোমাদের রক্তদান আমি নিশ্চয়ই শোধ করতে চেষ্টা করবো।
তাই আজ আপনাদের কাছে বলে যাচ্ছি, জীবনে মানুষ পয়দা হয় মৃত্যুর জন্য। বেঁচে আছি এ তো একটা এক্সিডেন্ট। আজ ঘুরছি কালও মরে যেতে পারি। যারা মরে গেছে তারা পথ দেখিয়ে গেছেন। যারা শহীদ হবেন তারাও পথ দেখিয়ে যাবেন। ভবিষ্যৎ বংশধর তারা মুখ উচু করে দাঁড়ায়ে দুনিয়া আসরে বলতে পারবে- আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমার স্বাধিকার আছে, আমার অধিকার আছে।
তাই আজকে শহীদ দিবসে আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ ঘরে ঘরে আপনারা দুৰ্গ গড়ে তোলেন। আমরা সকলের সহানুভূতি, ভালোবাসা চাই। কারো প্রতি আমাদের হিংসা নাই। কেউ যদি অন্যায় করে আমাদের ওপর শক্তি ব্যবহার করতে চায় নিশ্চয়ই এদেশের মানুষ আর সহ্য করবে না। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল- যতদিন পর্যন্ত বাংলা থাকবে, বাংলার আকাশ থাকবে, বাংলার মাটি থাকবে ততদিন পর্যন্ত আমার একুশের শহিদের কথা কেউ ভুলতে পারবো না। কারণ ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে এই ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না আমার বাংলার মাটিতে ছাড়। এ আন্দোলনের সঙ্গে আমিও জড়িত ছিলাম। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ তারিখে আমি গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাই। ১৯৫২ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আমি জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘট করি আর আমার ভাইদের সঙ্গে আমি পরামর্শ করে ঠিক করি তারা ২১ শে থেকে আন্দোলন শুরু করবে। ২৭ তারিখে আমাকে স্ট্রেচারে করে বের করে দেয়া হয় জেলের থেকে, আমি মরে যদি যাই জেলের বাইরে যেন মরি। এই আন্দোলনের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। আজও জড়িত আছি। জানি না কতদিন থাকতে পারবো। আমি প্রস্তত আছি। তবে আপনাদের কাছে আমার এইটুকু বলার রইল যে এই বাংলার মানুষ যেন আর অপমানিত না হয়। আর শহীদ যারা হয়ে গেছে এদের রক্তের সঙ্গে আমরা বেইমানি যেন না করি। মনে রাখবেন আপনারা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন এবং জানেন শহিদের রক্ত কোনদিন বৃথা যায় নাই, আর যাবেও না ইনশাল্লাহ। তাই আপনাদের কাছে বিদায় নিচ্ছি এই রাত্রিবেলা। জানি না কবে দেখা হয় আপনাদের সঙ্গে। আপনারা প্রস্তত হয়ে যান। ইনশাল্লাহু যখন রক্ত দিতে শিখেছি, বাঙালি তার দাবি আদায় করবে।
আসসালামু আলাইকুম।
শহীদ স্মৃতি- অমর হোক,
শহীদ স্মৃতি- অমর হোক,
শহীদ স্মৃতি- অমর হোক।
জয় বাংলা।
Reference:
পিপলস ভয়েস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, প্রকাশনা – শেকড় সন্ধান
বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র, সংগ্রামের নোটবুক