টু স্যার, উইথ লাভ
ফাতেহ আলী চৌধুরী
ইতিহাসের পাতায় জনৈক ক্যাপ্টেন হায়দারের নাম থাকবে কিনা জানি না। বর্তমান রাজনৈতিক ডামাডােলের ইতিহাসে হয়ত এই মহান মুক্তিযোদ্ধার স্থান নেই। তার প্রয়োজনও নেই। ইতিহাস কোনো রাজনৈতিক প্রচারপত্র নয়। তাই ইতিহাস কখনো সমকালীন হয় না। ইতিহাস কখনো বোধহয় লেখা যায় না। যা লেখা হয় তা হচ্ছে documentation বা রাজনৈতিক প্রচারপত্র। মেজর হায়দারের নাম লেখা হয়নি সমকালীন কোনো গাথায়। তবে হায়দার আছে সেক্টর-২ এর হাজার সহযোদ্ধার হৃদয়ে, তাদের লোকমুখে। আমার লেখাটি হায়দারের স্মৃতি ঘিরে তার সহযোদ্ধাদের oral htstroy এর সামান্য একটি আলেখ্য মাত্র। এটি তার প্রতি আমার শ্রদ্ধার্থ। কোনো প্রচারপত্র নয়, কোনো ক্ষোভ নয়, কোনো দুঃখ নয়। আমি, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (মায়া), বীর বিক্রম; কাজী কামাল বীর বিক্রম; গাজী দস্তিগীর বীর প্রতীক; সিরাজ আরো অনেক দল বেধে চললাম স্বাধীনতার সন্ধানে। হাজির হলাম আগরতলায়। ঘটনাচক্রে এখান থেকে মেজর আখতার বীর প্রতীক-এর সাহায্যে হাজির হলাম মতিনগর ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কর্তৃত্বাধীন সেক্টর -২ হেড কোয়ার্টার (তখন অবশ্য সেক্টর-২ গঠিত হয়নি) -এ। সেখানে দেখা হলো বাদল; আজিজ, বীর প্রতীক; আলম বীর প্রতীক, সহ ঢাকার অনেক ছেলেদের সাথে। সবাই বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ বা প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় বা বিভিন্ন কলেজের ছাত্র। তখন ক্যাম্প হয়নি খাবার দাবারের ঠিক নেই। গাছতলায় থাকি। যাহোক তবুও কী যে অভূতপূর্ব শিহরণ। পরদিন সকালে সবাই হাজির পাহাড়ের নিচে। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছি। কমান্ডের বা নেতৃত্বের অপেক্ষায়। হঠাৎ পাহাড় থেকে নেমে এল মেজর খালেদ মোশাররফ। কমান্ডিং অফিসার বিদ্রোহী ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। অবাক বিস্ময়ে দেখছি সুদর্শন বিদ্রোহী বীরকে। তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে কিছু বললেন। এর পরিচয় করিয়ে দিলেন জনৈক ক্যাপ্টেন হায়দারের সাথে। হাত ভাঙ্গা sling এ ঝুলানো। কুমিল্লা কান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসার সময় অথবা কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ ব্রিজের Demolition- এ হাত ভেঙেছেন বা কেন যেন হাতে গুলি লেগেছে। শক্ত চেহারা, গ্রিক Sculpture-এর মতো। অনলাম পাকিস্তানের বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্ত কমান্ডো বাহিনীর সদস্য। এই মেজর খালেদই হবেন সমগ্র ঢাকা এরিয়ার কমান্ডিং অফিসার এবং ক্যাপ্টেন
৩৬
হায়দারের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন সুবেদার/ হাবিলদাররা আমাদের বিভিন্ন অস্ত্রের ট্রেনিং দেবে। আমাদের ট্রেনিং শুরু করালেন ক্যাপ্টেন হায়দার মতিনগরে। মুনীর ওস্তাদ, তরু ওস্তাদ ও আরও অনেকে ক্যাপ্টেন হায়দারের তত্ত্বাবধানে। আমাদের খাওয়া, তাবু তৈরি, জংগল কাটা থেকে ঐনিং, সবই ক্যাপ্টেন হায়দারের নিজের তত্ত্বাবধানে করতেন। কী অমানুষিক পরিশ্রম করতেন ক্যাপ্টেন হায়দার। অসম্ভব শক্তিশালী এই মানুষটিকে আমি কোনোদিন ক্লান্ত হতে দেখিনি। ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে গড়ে উঠে অদ্ভুত এক সম্পর্ক ক্যাপ্টেন হায়দারের সাথে। যেমন ভয় পেতাম তেমনি ভালোবাসতাম এই যুদ্ধের গুরুকে, স্যারকে। ট্রেনিং শুরু হলো। প্রথম দিন ৩০৩ দিয়ে ফায়ারিং কালো। প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। অস্ত্রের নমুনা দেখে বেশ হতাশ হয়ে গেলাম। হায়দার স্যারকে ভয়ে কিছু বলতে পারি না। তার পরদিন স্টেন পান দিয়ে ফায়ারিং করালো। বেশ লাগলো। এভাবে আমাদের হায়দার স্যার নানা রকম Explosive ব্যবহার দেখালেন। একদিন আমাদের ৭৩৭ সে লোডিং রাইফেল (এসএলআর) দিয়ে ফায়ারিং করালো বাংলাদেশের ভিতর। পাকিস্তানি শক্রর উপর আক্রমণ এটা অবশ্য এক ধরনের Mock Fight ছিল। সে কি গর্ব এবং আনন্দ আমাদের। | মাও-এর গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি বা চে-এর Box Abush ইত্যাদি রেফার করতেন ট্রেনিং-এর সময়। শক্ত যখন পলায়নরত তখন আক্রমণ করে, শত্রু যখন তোমাকে ধাওয়া করবে তুমি পালাবে, শ যখন বিশ্রাম করবে তখন তাকে আক্রমণ করবে যাতে বিশ্রাম নিতে না পারে। ট্রনিং শেষ। একদিন Movement order এল। আমরা মনিপর থেকে মেলাঘর এলাম সারারাত হেঁটে। হায়দার আবার শুরু করলেন মেলাঘরে নতুনভাবে নতুন ছেলেদের ট্রেনিং। যাদের সর্বপ্রথম মতিনগরে ট্রেনিং হয়ে গেছে তাদের যুদ্ধে যাবার পালা। ১৭ জন নিয়ে গঠিত একটি দল ঢাকায় পাঠিয়ে গেরিলা যুদ্ধ করার প্রস্তুতি ছিল হায়দারের দুঃসাহসিক যুদ্ধ পরিকল্পনা। যে রাতে ১৭ জনের দল প্রথম ঢাকা আক্রমণে পাঠাবেন স্যার ছিল ভীষণ উত্তেজিত—যা তিনি কখনো প্রকাশ করছেন না কিন্তু যা প্রকাশ হয়ে পড়লো তা হচ্ছে বিষন্নতা। ঢাকায় এসে যোগাযোগ হলো মাসুদ সাদেক (চুল্লু) সামাদ বীরপ্রতীক, স্বপন বীরবিক্রমদের সাথে। ধীরে ধীরে আমাদের দল বড় হয়ে উঠলো। চললো অপারেশন ঢাকা শহরে। আলম ছিল এই দলের coordination-এ। পরবর্তীতে এটাই ক্র্যাক প্লাটুন বলে পরিচিত হয়। প্রথম নিজের হাতের ট্রেনিংপ্রাপ্ত বাছাই ছেলেদের নিয়ে গঠিত এই দলটি। ২৯ আগস্ট ১৯৭১ সাল। ক্র্যাক প্লাটুনের কোনো এক অসর্তক মুহূর্তে কেউ একজন ধরা পড়ে। তার ফলে পুরো দল ঘেরাও হয় ঢাকার বিভিন্ন স্থানে। ধরা পড়ে শহীদ হন আলতাফ মাহমুদ রুমি বীর বিক্রম, বদি বীর বিক্রম, বাকের বীর প্রতীক, জুয়েল বীর বিক্রম ও আরো অনেকে। ধরা পড়ে বেঁচে যায় মাসুদ সাদেক চুন্ন সামাদ বীর প্রর্তীক, আলভী।
৩৭
আমি মায়া, গাজী, মানু, আলম, জিয়া, শাহাদাৎ চৌধুরী ও সিরাজসহ কয়েকজন বেঁচে যাই। আমি প্রথমে মেলাঘরে হায়দার স্যারকে রিপোর্ট করি। হায়দার স্যার কথাটা শুনে প্রথমে থতমত খেয়ে দৌড়ে ক্যাম্পে চলে আসেন। বাদল দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে। হঠাৎ শুনলাম হায়দার স্যার কঁদছেন। কিছুদিন পরে আমরা মায়ার নেতৃত্বে ক্র্যাক প্লাটুনের বিরাট দল নিয়ে আবার ঢাকার দিকে রওনা হলাম। তিনটা সেকশনে ভাগ করা হলো দলটি মায়া, গাজী ও আমি সেকশনের কমান্ড-এ থাকলাম। হায়দার স্যার ভারত সীমান্তে দাঁড়িয়ে আমাদের ইন্ডাক্ট করতে আসলেন। স্যারের মুখ গম্ভীর ও উত্তেজিত। হায়দার হঠাৎ আমার দিকে তাকালেন। আমাকে কাছে ডাকলেন ফাতেহ কাছে এসো। এলাম। হায়দার স্যার আমার পিঠে হাত দিয়ে বললো “মনে আছে তোমাকে কেন যেন জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো কাকো তুমি বলেছিলে নিজের জীবন। আমি বলেছিলাম তবে যুদ্ধে এলে কেন? তুমি বলেছিলে সেই জীবনটা। বাংলাদেশকে দিতে।” বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন ভীষণ চেপে। তারপর স্যার বললেন জেনারেল প্যাটনের একটা কথা— No bastards can win a war by dying for his country a bastard bastard can only can win a war by making other poor bastard dying for his country একটু হেসে বললাম That poor Pakistani bastards may make me die for my country। এবার আমাদের ঢাকা শহরে পাঠানো হলো না। পাঠানো হলো আশে পাশে। থানাগুলোতে অড়িাইহাজার, বৈদ্যের বাজার ও রূপগঞ্জ। শেষে ঢাকার পাশেই ইছাপুর, বাডড়ায় হিমোহনী অবস্থান নিলাম। তখন বোধহয় ১১-১২ তারিখ- লে. কর্ণেল শফিউল্লাহ কমান্ড-এ ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুড়াপাড়ার আশেপাশে অবস্থান নিলো। আমরাতো অবাক ২য় ইস্ট বেঙ্গল (এস ফোর্স) এল কেমন করে। যাহোক, আমরা আশা করেছিলাম সেক্টর-২ এর কে ফোর্স-এর কোনো ইউনিট আসবে। আমাদের একটু মন খারাপ। এমনি একদিন দুপুরে দেখলাম রূপসা নদীর পাড় ধরে হেটে আসছে মেজর হায়দার। তখন তিনি মেজর পদে পদোন্নতি পেয়েছেন সাথে দুজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা। সারারাত জেগে পুরো ক্র্যাক প্লাটুন পর্যায়ক্রমে পাহারা দিল আমাদের প্রাণপ্রিয় কমান্ডারকে। সেকি উত্তেজনা ও গৌরব। মেজর সমস্ত পথ অতিক্রম করে এসেছে তার প্রিয় ক্রাক প্লাটুন এর কাছে। স্যার ১ দিন বা ২ দিন ছিলেন আমাদের কাছে। ঠিক মনে নেই—বোধ হয় বিগ্রেডিয়ার সাবেগ সিং ভারতীয় ডেলটা বা ডি সেক্টর কমান্ডার হেলিকপ্টারে মুড়াপাড়া এল তারপর মেজর হায়দারকে নিয়ে ঢাকায় চলে গেল। ১৬ই ডিসেম্বর জানলাম মেজর হায়দার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আসবে—তোড়জোর করে ঢাকায় চলে আসলাম। যাহোক, আমরা ঢাকায় ঢুকে মেজর হায়দারের কমান্ডে শান্তি রক্ষার চেষ্টা চালাই। আমি, আলম পরদিন রেডিও অফিসে যাই। ৮-৪৫ মি, রেডিও খুলে দেয়া হয় এবং মেজর হায়দার বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বক্তব্য দেয়। আমি, আলম ও জিয়া ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেট মেজর হায়দারের নির্দেশে খুলে দেই। আমরা সন্ধ্যায় টিভি ভবন
৩৮
ঘেরাও করি। মেজর হায়দার বাংলাদেশ আর্মিয় পক্ষ থেকে বক্তব্য আর কিছু নির্দেশাবলী প্রচার করেন। তারপর হায়দার লেডিস ক্লাবে অফিস নেয়। সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় সৎ, আদর্শবাদী সাহসী মেজর হিসাবে ঢাকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার। তারপর হায়দার আস্তে ধীরে ফিরে যান তার নিজের প্রিয় আমি -এর কাজে। তারপর মাঝে স্যারের সাথে দেখা হতো ঢাকায়। এল ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫। এক সামরিক অভুত্থানে নিহত হলেন মেজর হায়দার। হোমারের ইলিয়ডের ট্রয়ের দেশপ্রেমিক বীর হেক্টরের মতো করুণ অসহায় মৃত্যু। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জঞ্জালে ভরে গেছে। ইতিহাসের পরগাছা একদিন নিজেই বিলীন হয়ে যাবে। বেরিয়ে আসবে দেশের জন্য যে সব বীর আত্মাহুতি দিয়েছিল সে সব বীরদের কথা। এক অভাগা জাতির জন্য, আমাদের পরবর্তী প্রজনে বীরগাথার প্রয়োজন। এই বীরদের উদ্দেশ্যে আমার যা বলতে ইচ্ছে করছে- “In blossom today tomorrow scattered Life is such like a beautiful flower How can you expect the fragrance To last for ever -Admiral Tajikito Ohinishi Commander of Kamikaze Operation Second World War (Japanese Navy) He later committed Hara-kiri ফাতেহ আলী চৌধুরী জন্ম: ২ জুন ১৯৪৮, খুলনা। শিক্ষা : ঢাকা গ্রাজুয়েট হাই স্কুল, ঢাকা কলেজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। থেকে ইংরেজিতে অনার্স এবং মাষ্টার্স। অনার্সের শেষ বর্ষের ছাত্র হিসেবে মেজর খালেদ। মোশাররফের অধীনে বিপুৱার মহিনগর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ফতেহ এবং আরো কয়েকজনকে প্রথম ঢাকা শহরে অপারেশনের জন্য পাঠানো হয়। তাদের দলটির নাম দেয়া হয় ক্র্যাক প্লাটুন’। ফতেহ আলী চৌধুরীরা তিন ভাই ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ এর যোদ্ধা। অপর দুই ভাই শাহাদৎ চৌধুরী এবং ডা. মোর্শেদ চৌধুরী।