You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966.06.07 | ৭ জুন ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবসের বিস্তারিত - সংগ্রামের নোটবুক

৭ জুন

ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস (এক)

৭ জুন ছয় দফা দিবস। বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য প্রতিবাদী আত্মত্যাগে ভাস্বর একটি দিন। এই দিনটি বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনকে নতুন পর্যায়ে জাগ্রত করে। এই দিনে আওয়ামী লীগ ৬ দফা দাবী এবং শেখ মুজিব সহ সকল নেতার মুক্তির দাবিতে হরতাল আহবান করিয়াছিল। সেই হরতালে ১২ জন নিবেদিত কর্মী নিজেদের জীবন উৎসর্গ করিয়াছিল। ছয় দফা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১১ দফা কেন্দ্রিক ছাত্র আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে আসে ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান থেকে আসে নতুন সরকার ও প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন, নির্বাচনের ফলাফলকে মূল্যায়ন না করায় শুরু হয় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বশেষ বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
৬ দফার ইতিহাস
৬ দফা লিখেন মুলত এক দল আওয়ামী সমর্থক আমলা ও বুদ্ধিজীবী। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা খ্যাঁত সিএসপি রুহুল কুদ্দুস, নুরুল ইসলাম, মোশারফ হোসেন, অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান ছিলেন এই দলে। বিচারপতি মোরশেদও এর সাথে ছিলেন বলে কোন কোন সুত্রে জানা যায়। খান বাহাদুর ওসমান আলীর(শামিম ওসমান এর দাদা) চাষারার বাসায় বসে এই ড্রাফট তৈরি করা হইয়াছিল।

 

লাহোর কনফারেন্স

৫-৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৬ লাহোরে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাবেক মুসলিম লীগ পরে নেজামে ইসলামী পার্টি সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসায় (বাড়ির লনে) তাসখন্দ চুক্তি ও কাশ্মির বিষয়ক অল পাকিস্তান ন্যাশনাল কনফারেন্স ডাকা হয়। আলোচ্য সুচিও তাসখন্দ চুক্তি ও কাশ্মীর ভিত্তিক। সকল বিরোধী দল এই চুক্তির বিপক্ষে। চুক্তি পাকিস্তানের প্রতিকুলে গিয়াছে এই ইস্যুতে নতুন করে আন্দোলন সুচনা করা। সম্মেলনে ৭৪৬ জন ডেলিগেট যোগ দেয় এরা অল পাকিস্তান গ্রুপ ভুক্ত। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ১৩ সদস্যর প্রতিনিধিদল সম্মেলনে যোগ দেয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ন্যাপ, জামাত, নেজাম সহ আরও ৮ জন যোগ দেয়। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে ছয় দফা উত্থাপন করেন এবং পরের দিন সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে যাহাতে এইটি স্থান পায় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু সম্মেলনে শেখ মুজিবের এ দাবি আয়োজক পক্ষ (সাবজেক্ট কমিটি) প্রত্যাখ্যান করে। কাউন্সিল মুসলিম লীগ জানায় ৬ দফা কনফেডারেশন এর প্রস্তাব। জামাতে ইসলামী বলে বিচ্ছিন্নতাবাদী। এমনকি নেজামে ইসলামী ও ন্যাপ বিভিন্ন কারন দেখাইয়া ৬ দফা প্রত্যাখ্যান করে। প্রতিবাদে শেখ মুজিব সম্মেলনের ২য় দিন যোগ না দিয়ে লাহোরে অবস্থানকালেই ১০ ফেব্রুয়ারী এক প্রেস কনফারেন্স এ আনুষ্ঠানিক ভাবে ৬ দফার কথা আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ করেন। ৬ তারিখ অল পাকিস্তান কনফারেন্স এর সভার সিদ্ধান্ত সমুহ ৭ তারিখে পত্রিকায় আসার কথা কিন্তু তা না আসিয়া ৬ দফার কথা পত্রিকায়(পশ্চিমে) প্রকাশ হইয়া যায়।

ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস (দুই)
ঢাকায় ৬ দফা

১১ ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন এবং এখানে আবার প্রেস কনফারেন্স করিয়া ৬ দফা প্রকাশ করেন এবং বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। ১৪ ফেব্রুয়ারী আবার প্রেস কনফারেন্স করে লাহোরের ঘটনা প্রবাহ সহ বিস্তারিত আবারো প্রকাশ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে ৬৫ সনের যুদ্ধ সময় হতেই দেশে জরুরী অবস্থা জারী ছিল। তারপর পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইন নামে আরেকটি আইন জারী ছিল। ২ আইনের আওতায় কঠোর প্রেস সেন্সর শিপ আরোপ ছিল। পত্রিকায় কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে যায় এমন সংবাদ প্রকাশ করা যাইত না। পূর্ব পাকিস্তানের ৭-৮ তারিখের পত্রিকায় কোন সংবাদ আসেনি। ৯-১০ তারিখের দিকে পত্রিকায় কাউন্সিল মুসলিম লীগের নেতাগন ৬ দফার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন সেটি আসিল। তারা তাদের বক্তব্বে বলেছেন ৬ দফা বিষয় মিটিং এ আসেনি তারা কেবল তাদের দাবি নামা বিচ্ছিন্ন ভাবে পেশ করিয়াছিল মাত্র। ঐ সময়ে অল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী নবাবজাদা নস্রুল্লাহ খান। তবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ অন্যান্য দলের মত মুল সংগঠনের শাখা সংগঠন ছিল না। দুই দলের মধ্যে একটি যোগসূত্র ছিল মাত্র। ৬ দফা বিতর্ক শুরু হলে নবাবজাদা নস্রুল্লাহ আওয়ামী লীগের বৈঠক ডাকেন সেই বৈঠকে শেখ মুজিবের কঠোর সমালোচনা করা হয়। সেই বৈঠকে ১৭ জেলার সব সভাপতি সাধারণ সম্পাদক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের থেকে পদত্যাগ করেন যা অবশ্য কার্যকরী ছিল না। অল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র ভাবে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। ২০-২১ মার্চ ঢাকায় কনভেনশন মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে আইউব এবং গভর্নর মোনায়েম অস্ত্রের ভাষায় ছয় দফা মোকাবিলার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আইউবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টো শেখ মুজিবকে ৬ দফার বিতর্কে আমন্ত্রন জানান পরে এপ্রিলের পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভার আকার দেখিয়া তিনি নিজেকে বিতর্ক থেকে প্রত্যাহার করিয়া নেন।
১৮-২০ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল করে শেখ মুজিব সভাপতি হন এবং তাজউদ্দিন সাধারন সম্পাদক হন। ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে ৬ দফা গৃহীত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত “আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা” পুস্তিকা ১৮ মার্চ বিতরণ করা হয়।
৬ দফার মর্মবাণী বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য শেখ মুজিব সারা দেশে ঝটিকা সফরে বের হন। শেখ মুজিব সারা দেশ সফর করে ছাত্র তরুনদের নিয়ে একটি নতুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন যে দলটি ৩ বছরেই ১৯৬৯ সালেই সমগ্র পাকিস্তানের একটি শীর্ষ রাজনৈতিক দলে পরিনত হয়। নস্রুল্লাহ পূর্ব পাস্কিস্তানে তাদের অনুসারীদের নিয়ে একটি আওয়ামী লীগ গঠন করেন। এই সংগঠনের সভাপতি হন মৌলানা তর্কবাগীশ। নস্রুল্লাহ তর্কবাগীশের আওয়ামী লীগ একটি পকেট রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। নস্রুল্লাহ উপায় না দেখে আওয়ামী লীগ থেকে বাহির হয়ে যাওয়া আরেকটি অংশ যারা পিডিএম জোটে ছিল তাদের সাথে তার দল অঙ্গীভূত করেন। আওয়ামী লীগ ছাড়িয়া যাওয়া সকল নেতা পর্যায় ক্রমে আওয়ামী লীগে যোগ দিলে একটি অখণ্ড আওয়ামী লীগ তার যাত্রা শুরু করে।
শেখ মুজিব সারা দেশে ঝটিকা সফরের মধ্যেই স্বৈরশাসক আইউব মোনায়েম শেখ মুজিবকে বারবার (৮ বার) গ্রেফতার করার মধ্যেই শেষ দফায় শেখ মুজিবকে এবং সাধারন সম্পাদক তাজউদ্দীন এবং ৪র্থ সহসভাপতি খন্দকার মোস্তাক আহমেদকে গ্রেফতার করে। জেলের বাইরে অবস্থিত আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের বাসভবনে সভা করে অহেতুক গ্রেফতার ও জেল জুলুমের প্রতিবাদে দেশব্যাপী হরতালের কর্মসূচী ঘোষণা করেন। একই সাথে ছয় দফার সমর্থনে ১৯৬৬ সালের ১৩ মে আওয়ামী লীগ আয়োজিত পল্টনের জনসভায় ৭ জুন হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। মাসব্যাপী ৬ দফা প্রচারে ব্যাপক কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়। । দৈনিক ইত্তেফাক ৬ দফা পন্থী হওয়ায় পত্রিকা প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়। পত্রিকার মালিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে কারারুদ্ধ করা হয়।

ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস (তিন)
কি ঘটেছিল সেই দিন

৭ জুন হরতাল কঠোর হতে পারে ভেবে স্বৈরশাসক আগের দিন রাতেই হরতালের বিপক্ষে প্রেস রিলিজ সকল পত্রিকায় পাঠায়। সরকার দমন নীতি গ্রহণ করে। সংবাদপত্রে হরতালের খবর প্রকাশের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে। ৫ জুন ঢাকা শহরে সমস্ত মিল এলাকা এবং দেশের বিভিন্ন শহরে পুলিশ ও ইপিআর মোতায়েন করা হয়। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ৬ জুন সন্ধ্যায় হরতালের সমর্থনে ঢাকা শহরে ছাত্রলীগ বিরাট মিছিল বের করে। সরকার যেকোন মূল্যে হরতাল বানচালের জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয়। অপর দিকে বাংলার উত্তাল মানুষ জীবন বাজি রেখে হরতাল সফল করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভোর থেকেই জনতা তেজগাও রেল স্টেশন অবরোধ করে চট্টগ্রাম গামী মেইল ট্রেন ভাংচুর করে। তেজগাঁওয়ে বেঙ্গল বেভারেজের শ্রমিক সিলেটের মনু মিয়া পাকিস্তান স্বৈরশাসকের গুলিতে প্রাণ হারান। এতে বিক্ষোভের প্রচণ্ডতা আরো বাড়ে। তেজগাঁওয়ে ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। আজাদ এনামেল এ্যালুমিনিয়াম কারখানার শ্রমিক আবুল হোসেন ইপিআরের গুলিতে শহীদ হন।
একই দিন নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনের কাছে পুলিশের গুলিতে মারা যায় আরো ৬ শ্রমিক। আহত ২ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরে মারা যায়। আন্দোলনের প্রচণ্ডতায় লাখো বাঙালি মাঠে নামে। সন্ধ্যায় জারি করা হয় কারফিউ। রাতে সারা দেশে হাজার হাজার আন্দোলনকারী বাঙালিকে গ্রেফতার করা হয়। এমনিভাবে ৬ দফা ভিত্তিক আন্দোলন সারাদেশে ছড়াইয়া পড়ে। শহীদের রক্তে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের আন্দোলন।
কারা ছিল আওয়ামী লীগ (৬ দফা) দলে?
১৯৬৬ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশন হয়। সেই কাউন্সিলে মওলানা তর্কবাগিশ অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। ‘সভাপতির পদ পাওয়ার আশায়’ সালাম খান দলে থাকিয়া যান এবং ৬-দফার পক্ষে বক্তৃতা দেন। পরে তিনি ৬-দফার বিরোধিতা করেন এবং দলত্যাগ করেন। এই কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। নতুন ওয়ার্কিং কমিটির কর্মকর্তা ও সদস্যগণ হইতেছেন।
সভাপতি : ১. শেখ মুজিবুর রহমান; সহ-সভাপতি : ২. সৈয়দ নজরুল ইসলাম; ৩. আবদুস সালাম খান; ৪. খন্দকার মোশতাক আহমেদ; ৫. ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী; ৬. মজিবর রহমান; ৭. শাহ আজিজুর রহমান; ৮. সাধারণ সম্পাদক : তাজউদ্দিন আহমদ; ৯. সাংগঠনিক সম্পাদক : মিজানুর রহমান চৌধুরী; ১০. শ্রম সম্পাদক : জহুর আহমদ চৌধুরী; ১১. সমাজসেবা সম্পাদক : কেএম ওবায়দুর রহমান; ১২. প্রচার সম্পাদক : আবদুল মমিন; ১৩. মহিলা সম্পাদক : আমেনা বেগম; ১৪. দফতর সম্পাদক : মাহমুদুল্লাহ; ১৫. কোষাধ্যক্ষ : হাফেজ মুসা; সদস্য : ১৬. লকিয়তুল্লাহ; ১৭. এবিএম নুরুল ইসলাম; ১৮. জহির উদ্দিন; ১৯. নুরুল ইসলাম চৌধুরী; ২০. আবদুর রহমান খান; ২১. এমএ রশিদ; ২২. রওশন আলী; ২৩. মোমেন উদ্দিন আহমেদ; ২৪. আতিউর রহমান; ২৫. রহিম উদ্দিন আহমদ; ২৬. সা’দ আহমদ; ২৭. জালাল উদ্দিন আহমদ; ২৮. আমজাদ হোসেন; ২৯. সোহরাব হোসেন; ৩০. হোসেন মুনসুর; ৩১. অধ্যাপক ইউসুফ আলী; ৩২. আবদুল মালেক উকিল; ৩৩. নুরুল হক; ৩৪. বাহাউদ্দিন চৌধুরী; ৩৫. শামসুল হক; ৩৬. শেখ আবদুল আজিজ; ৩৭. আফজাল হোসেন; ৩৮. জাকিরুল হক; ৩৯. মহিবুল সামাদ; ৪০. আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ; ৪১. মোল্লা জালাল উদ্দিন।
সহ সভাপতি সালাম খান, আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ, লকিয়াতুল্লাহ পরে পৃথক আওয়ামী লীগ গঠন করে পিডিএম জোটে যুক্ত হন। আমেনা বেগম ৬৯ সালে পিএনএল এ যোগ দেন।
লাহোরে যাওয়া ১৩ সদসসের প্রতিনিধি দলে এই কমিটি থেকেই সবাই ছিলেন

 

ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস (চার)

শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচীর পুস্তিকা— ১৯৬৬
আমার প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা
আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবিরূপে ৬ দফা কর্মসূচী দেশবাসী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি। শান্তভাবে উহার সমালোচনা করার পরিবর্তে কায়েমী স্বার্থের দালালরা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করিয়াছে। জনগণের দুশমনদের এই চেহারা ও গালাগালির সহিত দেশবাসী সুপরিচিত। অতীতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিতান্ত সহজ ও ন্যায্য দাবি যখনই উঠিয়াছে, তখনই এই দালালরা এমনিভাবে হৈ-হৈ করিয়া উঠিয়াছেন। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, পূর্ব-পাক জনগণের মুক্তি সনদ একুশ দফা দাবি, যুক্ত নির্বাচন প্রথার দাবি, ছাত্র-তরুণদের সহজ ও স্বল্প ব্যয় শিক্ষা লাভের দাবি, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবি ইত্যাদি সকল প্রকার দাবির মধ্যেই এই শোষকদের দল ও তাহার দালালরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছেন।
আমার প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবিতেও এরা তেমনিভাবে পাকিস্তান দুই টুকরা করিবার দূরভিসন্ধি আরোপ করিতেছেন। আমার প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবিতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত-বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোনও সন্দেহ নাই। খবরের কাগজের লেখায়, সংবাদে ও সভা-সমিতির বিবরণে, সকল শ্রেণীর সুধীজনের বিবৃতিতে আমি গোটা দেশবাসীর উৎসাহ-উদ্দীপনার সাড়া দেখিতেছি- তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল আসিয়াছে। সর্বোপরি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ জাতীয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ আমার ৬ দফা দাবি অনুমোদন করিয়াছেন। ফলে ৬ দফা দাবি আজ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় দাবিতে পরিণত হইয়াছে। এ অবস্থায় কায়েমী স্বার্থ শোষকদের প্রচারণায় জনগণ বিভ্রান্ত হইবেন না, সে বিশ্বাস আমার আছে।
কিন্তু এও আমি জানি, জনগণের দুশমনের ক্ষমতা অসীম, তাদের বিত্ত প্রচুর, হাতিয়ার এদের অফুরন্ত, মুখ এদের দশটা, গলার সুর এদের শতাধিক। এরা বহুরূপী। ঈমান, ঐক্য ও সংহতির নামে এরা আছেন সরকারী দলে। আবার ইসলাম ও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়া এরা আছেন অপজিশন দলে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুশমনীর বেলায় এরা সকলে একজোট। এরা নানা ছলাকলায় জনগণকে বিভ্রান্ত করিবার চেষ্টা করিবেন। সে চেষ্টা শুরুও হইয়া গিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিষ্কাম সেবার জন্য এরা ইতোমধ্যেই বাহির হইয়া পড়িয়াছেন। এদের হাজার চেষ্টাতেও আমার অধিকার সচেতন দেশবাসী বিভ্রান্ত হইবেন না তাহাতেও আমার কোন সন্দেহ নাই। তথাপি ৬ দফা দাবির তাৎপর্য ও উহার অপরিহার্যতা জনগণের মধ্যে প্রচার করা সমস্ত গণতন্ত্রী, বিশেষত আওয়ামী লীগ কর্মীদের অবশ্যই কর্তব্য। আশা করি, তাহারা সকলে অবিলম্বে ৬ দফার ব্যাখ্যায় দেশময় ছড়াইয়া পড়িবেন। কর্মী ভাইদের সুবিধার জন্য ও দেশবাসী জনসাধারণের কাছে সহজবোধ্য করার উদ্দেশ্যে আমি ৬ দফার প্রতিটি দফাওয়ারী সহজ-সরল ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও যুক্তিসহ এই পুস্তিকা প্রচার করিলাম। আওয়ামী লীগের তরফ হইতেও এ বিষয়ে আরও পুস্তিকা ও প্রচারপত্র প্রকাশ করা হইবে। আশা করি, সাধারণভাবে সকল গণতন্ত্রী, বিশেষভাবে আওয়ামী লীগের কর্মিগণ ছাড়াও শিক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানী মাত্রেই সব পুস্তিকার সদ্ব্যবহার করিবেন।
(ভাষণটি পুস্তিকার অংশ, এই পুস্তিকা লিখেছেন সিরাজুদ্দিন আহমদ, প্রকাশ করেছেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আব্দুল মমিন, ছাপা হয়েছে পাইওনিয়ার প্রিন্টিং প্রেস থেকে মুল ৬ দফা ছাপা হয়েছিল সেগুন বাগান প্রেস থেকে)

ঐতিহাসিক ৬ দফা হচ্ছে-

প্রস্তাব-১ : শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি
দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনি হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে ফেডারেশন ভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি লাহোর প্রস্তাব। আইন পরিষদের ক্ষমতা হবে সার্বভৌম এবং এই পরিষদও নির্বাচিত হবে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারণের সরাসরি ভোটে।
প্রস্তাব- ২ : কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা
কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দুটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে যথা- দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।
প্রস্তাব- ৩ : মুদ্রা ও অর্থ সম্বন্ধীয় ক্ষমতা
মুদ্রার ব্যাপারে নিম্ন লিখিত যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারে :(ক) সমগ্র দেশের জন্য দুইটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।
অথবা
বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্য কেবলমাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসু ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এ ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাঙ্কিং রিজার্ভের পত্তন করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক ও অর্থ বিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।
প্রস্তাব- ৪ : রাজস্ব, কর ও শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা
ফেডারেশনের অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির সব রকম করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।
প্রস্তাব- ৫ : বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা
(ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের বর্হিবাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।
(খ) বর্হিবাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গ রাষ্ট্র গুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে।
(গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত হারে অঙ্গ রাষ্ট্র গুলিই মেটাবে।
(ঘ) অঙ্গ রাষ্ট্র গুলির মধ্যে দেশজ দ্রবাদির চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা কর জাতীয় কোন বাধা-নিষেধ থাকবে না।
(ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গ রাষ্ট্র গুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্বস্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
প্রস্তাব- ৬ : আঞ্চলিক বাহিনীর গঠন ক্ষমতা
আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা-সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।