বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৬ই জানুয়ারী, বুধবার, ১৯৭৪, ২রা মাঘ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি
দেশের অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সমূহে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পক্ষেত্রের সাফল্য ও ব্যর্থতা সমীক্ষা করে দেখা হয়েছে। শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পর্যালোচনা করে দেখা হয়েছে যে, ১৯৭৩-৭৪ অর্থ বছরের প্রথম ছ’মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহে উৎপাদনের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ভবিষ্যতেও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহে স্থিতিশীল অগ্রযাত্রার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। সমীক্ষায় জানা গেছে, চলতি অর্থ বছরের প্রথম ছ’মাসে দেশের বস্ত্র, সার, চিনি, কাঠ, কাঁচা রাবার, ভোজ্য তেল প্রভৃতি শিল্পে উৎপাদন বেড়েছে। তবে খুলনা নিউজপ্রিন্ট কারখানার একটি বয়লার অকেজো হয়ে পড়ায় নিউজপ্রিন্ট উৎপাদন কম হয়েছে। ইস্পাত ও ট্যানারী শিল্পেও উৎপাদন কমতির দিকে। ঔষধ শিল্প, গ্লাস শিট, ক্লোরিন, রেয়ন, হার্ডবোর্ড, সোডা, ব্লিচিং পাউডার, জুতো প্রভৃতি শিল্পের উৎপাদন সন্তোষজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশলাই উৎপাদনের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি হয়েছে, দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে দেশলাই বিদেশেও রপ্তানী করা যাবে। চলতি বছরে বারোশ’ স্বল্প ক্ষমতাসম্পন্ন পাওয়ার পাম্প উৎপাদন করা হয়েছে। এছাড়া জাহাজ নির্মাণ কারখানাগুলোতেও উল্লেখযোগ্য অর্থ লাভ হয়েছে বলে পর্যালোচনায় প্রকাশ করা হয়েছে। এই হারে যদি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহে অগ্রগতি সাধিত হতে থাকে, তা হলে উৎপাদনে সন্তোষজনক উন্নতি লাভ করতে খুব বেশী বেগ পেতে হবে না। জানা গেছে, বস্ত্র বয়নে এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। খুচরা যন্ত্রাংশের অভাব যদি না থাকতো তাহলে উৎপাদনের পরিমাণ স্বাভাবিক নিয়মেই আরো বাড়তো। সার, রসায়ন ও ভেষজ শিল্পের উৎপাদন কারিগরী সমস্যার কারণে বিঘ্নিত হয়েছে। চলতি বছরে চিনির উৎপাদনও সন্তোষজনক। আশা করা যাচ্ছে, চিনিশিল্প উৎপাদনে আরো উন্নতি ঘটবে।
দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহে উৎপাদন বাড়ানোর একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, শ্রমিকরা যে কর্মবিমুখ নয়, বরং কর্মতৎপর উৎপাদন বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এই চরম সত্যটি প্রত্যক্ষ করতে পেরেছি। দেশ পুনর্গঠনকে জোরদার করার জন্য এবং দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার জন্য কলে-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির একটা চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে সত্য, কিন্তু কতিপয় বাস্তব প্রতিবন্ধকতার কারণে আমরা বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়াতে পারছিনা। কাঁচামাল সংকট, যন্ত্রাংশের অপ্রতুলতা এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাটও আমাদের জাতীয় উৎপাদন ক্ষেত্রে নানা অসুবিধার সৃষ্টি করে থাকে। এই সব সমস্যাবলী যতোদিন পর্যন্ত না দূরীভূত করা সম্ভব, ততোদিন পর্যন্ত উৎপাদন ক্ষেত্রে নানা রকম অচলাবস্থা দেখা দেবেই। কাজেই আমরা যদি বাস্তব প্রয়োজনীয়তাকে না মিটিয়ে শুধু মুখে মুখে উৎপাদন বাড়ানোর কথা উচ্চারণ করি, তাহলে সমস্যা সমাধানের আশা দুরাশায় পরিণত হতে বাধ্য। সে জন্যেই সর্বাগ্রে আমরা কল-কারখানাকে সচল রাখার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাবলী গ্রহণের প্রতি জোর দিচ্ছি। কারণ, শ্রমিকরা আজ ধীরে ধীরে উৎপাদন বাড়ানোর কাজে নিয়োজিত হচ্ছে এবং নতুন উদ্যম নিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর জন্যে পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
আমরা জানি, উৎপাদনের উপরই আমাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ভরশীল। শিল্প কারখানায় উৎপাদন না বাড়লে ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের গতিরোধ করা যাবে না। উৎপাদন বাড়লে রপ্তানীও বাড়বে এবং এমনি করেই আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবো। এই চরম সত্যটি যদি আমরা উপলব্ধি করতে না পারি, তাহলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি কিছুতেই স্থিতিশীল হতে পারবে না। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকেও আমরা পুনর্গঠন করে সত্যিকার সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সক্ষম হবো না। চলতি অর্থ বছরের প্রথম ছ’মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে বিভিন্ন খাতের সাফল্য ও ব্যর্থতার যে সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে আমাদের আনন্দিত হওয়ার কারণ আছে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে উৎপাদন ক্ষেত্রে যে তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি সাধিত হয়েছে, তা যদি অব্যাহত এবং স্থিতিশীল থাকে, তা হলে আমরা খুশী হবো। আমরা আরো খুশী হবো যখন দেখবো শিল্প কারখানাগুলো কোনো রকম অসুবিধার সম্মুখীন না হয়ে স্বাভাবিকভাবে সচল রয়েছে এবং উৎপাদন ক্ষেত্রে কোনো রকম বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহে উৎপাদন বাড়তির যে চিত্র আমরা চলতি অর্থ বছরে পেয়েছে, আশা করি আগামী বছরগুলোতে এর চেয়েও বেশী অগ্রগতির চিত্র আমরা পাবো। কাঁচামালের অভাব, খুচরা যন্ত্রাংশের অপ্রতুলতা ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতাগুলো যেন দূর করার সম্ভাব্য সব রকম প্রচেষ্টা গৃহীত হয়, এটাই আমরা মনে করি।
চা শিল্পের আসল চিত্র কোনটি?
বাংলাদেশে চা শিল্প সংকটের মধ্যে ছিল বলে আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলাম। তারই প্রেক্ষিতে সরকারী সূত্রের বরাত দিয়ে বাসস জানিয়েছে যে, বাংলাদেশের চা শিল্প ধীরে ধীরে তার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠে আগামী বছরের মধ্যে স্বাধীনতা পূর্ব অবস্থায় ফিরে যাবে।
এই সূত্র জানাচ্ছে, চলতি বছরে বাংলাদেশ প্রায় ৬ কোটি পাউন্ড চা রপ্তানী করবে। এর ফলে প্রায় ১২ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে। চা রপ্তানী করে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ এ বছর তাহলে দ্বিগুণ দাঁড়াবে। এবং শুধু তাই নয়—১৯৭৪-৭৫ সালে চা উৎপাদন ৭ কোটি পাউন্ড ছাড়িয়ে যাবে।
দেশে একশত বায়ান্নটি চা বাগানের মধ্যে প্রায় ১৪৫টি চা বাগানে এরই মধ্যে পুরোদমে উৎপাদন শুরু হয়েছে। বিক্রয় মূল্য কমে উৎপাদন মূল্য বেড়ে যাবার ফলে চা শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে যে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে, তা পূরণের জন্যে সরকার এ বছর তাদেরকে প্রায় ৪ কোটি টাকা ভর্তুকি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই ভর্তুকি বিক্রয় মূল্যের শতকরা ৩০ ভাগ হারে দেওয়া হবে। এছাড়াও সরকার হ্রাসকৃত দামে সার সরবরাহ করবেন।
নিঃসন্দেহে এ সবই অত্যন্ত আশা ও সম্ভাবনার কথা। কিন্তু পরিবেশিত উক্ত সংবাদের পাশাপাশি যখন দেখা যায় বাক্স ইত্যাদির জন্য সংরক্ষণের অভাবে এবং সে ব্যাপারে সিলেট জেলার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গাফিলতির জন্যে প্রায় দু’কোটি টাকার চা বিনষ্ট হচ্ছে, তখন বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ থাকে বৈকি।
এই সংবাদ সূত্রটি পত্রিকান্তরের মাধ্যমে জানাচ্ছেন, কিছু সংখ্যক বাগানের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে প্রায় ১৫ লাখ পাউন্ড চা খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কথা হচ্ছে, চা বাক্সের অভাবে যদি এই চা সংরক্ষণের কাজ বিঘ্নিতও হয় এবং যদি কোনো কারণে এই চা বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুরাহা না করা যায়, তাহলে (সংবাদ সূত্রের সংবাদটি যদি সত্যই হয়) ঐ চা ফেলে না রেখে দেশের অভ্যন্তরে সরবরাহ করতে দোষ কি? দেশে চা-এর চাহিদাও আছে এবং দামও কম নয়। সেক্ষেত্রে এত বিপুল চা এভাবে অযত্নে ফেলে রেখে নষ্ট করার কোনো অধিকার কি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আছে? অতঃপর জাতীয় সম্পদ অপচয়ের এ দায় কাদের স্কন্ধে পড়বে?
আবার অন্য একটি খবরে জানা যাচ্ছে, ১৯৭৩ সালের ঋণের শতকরা ৭০ ভাগ পরিশোধ না করায় কৃষি ব্যাংক এ বছর নতুন করে ঋণ মঞ্জুর করেনি। ফলে সিলেট জেলায় ১৫টি চা বাগান বন্ধ হবার উপক্রম হ’য়েছে। আর ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কারণস্বরূপ বাগান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন যে, উৎপাদন মূল্যের তুলনায় বিক্রয় মূল্য কম হওয়ায় উৎপাদিত চা বিক্রি হয়নি। ফলে তাদের পক্ষে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।
তাহলে সামগ্রিক পরিস্থিতির চিত্র হ’লো তিন রকম। প্রথম চা শিল্পের উন্নতি, ৬ কোটি পাউন্ড রপ্তানী, ১২ কোটি টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা, চা শিল্প সংকটকে হ্রাস করার জন্যে বিক্রয় মূল্যের শতকরা ৩০ ভাগ ভর্তুকি বাবদ ৪ কোটি টাকা দান ও অল্প মূল্যে সার সরবরাহ করার আশ্বাস দান।
দ্বিতীয়, দেশে প্রচুর চা-এর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ১৫ লক্ষ পাউন্ড চা বাগানের খোলা মাঠে পড়ে পচছে। বাক্স নেই যে সংরক্ষণ করা হবে কিংবা রপ্তানী করা হবে।
তৃতীয়, উৎপাদন মূল্যের তুলনায় বিক্রয় মূল্য কম হওয়ার দরুণ যে অর্থ ঘাটতি পড়েছে তার জন্যে ১৯৭৩ সালের ব্যাংক ঋণ শোধ হয়নি। ফলে চলতি বছরে ঋণের অভাবে সিলেট জেলার ১৫টি চা বাগান প্রায় বন্ধের উপক্রম হয়েছে।
এই ত্রিবিধ সমাচারের কোনটি সত্যি আমরা তাই ভাবছি। পরিবেশিত সংবাদের মধ্যে এত বৈপরীত্যই বা কেন? সত্যি সত্যি চা শিল্পের ব্যাপারে কি ঘটছে তা আপাততঃ যেন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান একটি শিল্পই হলো চা। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের মাটিতে খুব উন্নত মানেরই চা উৎপাদিত হয়। এবং একটু যত্ন নিলে ও সক্রিয় থাকলে বাংলাদেশের উৎপাদিত চা দেশের চাহিদা মিটিয়েও যে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা এনে দিতে পারবে—সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
অতএব চা শিল্প নিয়ে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের খামখেয়ালিপনা আর চলতে পারে না। কিংবা হঠাৎ করে একটা মোটা অংকের টাকার রপ্তানী সমাচার শুনিয়ে আনুষঙ্গিক অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দিকগুলোকে ঘোলাটে করে রাখার প্রয়াসও প্রশংসার কথা নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের সব সম্পদই আমাদের। কাজেই এখন আর লুকোচুরি নয়-বা আলো-আধারীর খেলা নয়। সেটা আত্মবঞ্চনা তথা জাতীয় ক্ষতিরই সামিল। চা শিল্পকে সর্বতোভাবে রক্ষা করে জাতীয় অর্থনীতির মানকে উন্নত করার আপোষহীন শর্তে সংশ্লিষ্ট দপ্তর কাজ করে যাক এই আমরা দেখতে চাই।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক