বাংলার বাণী
৫ই জুলাই, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ২০শে আষাঢ়, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য এবং আচরণ বিধি
সভ্য সমাজে প্রতিটি মানুষকেই একটা আচরণ বিধি মেনে চলতে হয়। এ আচরণ বিধি কারো দ্বারা আরোপিত নয় বরং শিক্ষা, রুচি এবং মনন তাকে এই আচরণবোধে উদ্বুদ্ধ করে। সাধারণ মানুষের বেলায় এটা যতটুকু সত্য রাজনৈতিক নেতাদের বেলায় এটা ততোধিক সত্য। কারণ তারা সমাজে নেতৃত্ব দেন, দেশের নানাবিধ ক্রিয়াকর্মের পরিচালক এবং নিয়ন্ত্রক তারা। এটা আমরা বলছি গণতান্ত্রিক সমাজের কথা যেখানে জাতীয় কর্মকান্ডে ‘পলিটিক্যাল অথোরিটি’ স্বীকৃত।
ময়দানে কিন্তু অসঙ্গত ভাষা প্রয়োগ এবং অভদ্রোচিত কুৎসা রচনা আমাদের দেশের রাজনীতিতে কোন নতুন ঘটনা নয়। এটা চলে আসছে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই। স্বাধীনতাত্তোরকালে যার অবসান আশা করা গিয়েছিলো তাই অধিকতর কুৎসিতরূপ ধারণ করেছে। অত্যন্ত অশ্লীলভাবে গালাগাল বর্ষণ অথবা মূর্খের মতো দেশে বিরাজমান নানা সমস্যা নিয়ে শূন্যগর্ভ ভাষণ দান এটা একশ্রেণীর রাজনীতিকের এখন প্রাত্যহিক কর্ম।
জাতীয় সংসদে এ নিয়ে কথা উঠেছে। কথা উঠেছে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় সংসদ সম্বন্ধে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক আ.স.ম. আবদুর রবের একটি উক্তিকে কেন্দ্র করে। পল্টন ময়দানে তার দলের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি অত্যন্ত কদর্য ভাষায় জাতীয় সংসদকে আক্রমণ করেন। চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য জনাব নুরুল ইসলাম চৌধুরী আ.স.ম. আবদুর রবের এহেন আপত্তিজনক উক্তি জাতীয় সংসদের প্রতি চরম অবমাননাকর বলে অভিহিত করেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংসদ তথা সমগ্র জাতিকে হেয় প্রতিপন্ন করাই এ অসংযত উক্তির মূল উদ্দেশ্য বলে তিনি উল্লেখ করেন। জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির চীফ হুইপ জনাব শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌম সংসদ সম্পর্কে কোন ভদ্র, শিক্ষিত, রুচিবান ব্যক্তি এ ধরনের জঘন্য অশালীন উক্তি করতে পারেনা। এই অশালীন উক্তিকে তিনি সমগ্র দেশ ও জাতির প্রতি আঘাত স্বরূপ বলে উল্লেখ করেন এবং এর প্রতিরোধে সব্বাইকে এগিয়ে আসবার আহ্বান জানান। বিষয়টিকে অতঃপর জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিকার কমিটিতে পাঠানো হয় এবং মাননীয় স্পীকার জনাব মুহম্মদ উল্লাহ সংসদ সদস্যদের অনুরোধে তিনদিনের মধ্যে কমিটিকে উক্ত প্রস্তাব সংসদের প্রেরণের আহ্বান জানান। স্বাধীনতা লাভের পর দেড় বৎসরাধিককাল অতিবাহিত হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম রাজনৈতিক নেতারা অতঃপর একটা স্বাধীন দেশের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপযোগী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। অনেক আশার মতো আমাদের সে আশাও পূরণ হয়নি। রাজনৈতিক নেতারা সাধারণ আচরণ বিধি মেনে চলবার মতো মানসিকতা অর্জন করেনি। এর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় প্রায় প্রতিটি জনসভায়। পরমত অসহিষ্ণুতা, রাষ্ট্রীয় মূলনীতির পরিপন্থী প্রচারণা আজ আর কিছু অস্বাভাবিক বলে মনে হয়না। বরঞ্চ গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় একটা যাচ্ছে তাই ভাব ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। এর অবসান কাম্য। যত তাড়াতাড়ি আমরা এই ব্যাধি থেকে মুক্তি পাবো ততই আমাদের মঙ্গল। সরকারী ব্যবস্থা এ ব্যাপারে যথেষ্ট বলে আমরা মনে করিনা। দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক সচেতন জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধভাবে এর প্রতিরোধে এগিয়ে আসবেন। এবং এভাবেই সম্ভব লক্ষ্য অর্জনে আমাদের চলার পথকে নিষ্কন্টক করা।
সরকারকে অথবা জাতীয় সংসদের যে কোন সদস্যকে সমালোচনা করবার অধিকার সব্বার রয়েছে। কিন্তু বাংলার আপামর জনসাধারণ তাদের রায় প্রয়োগের মাধ্যমে যে সংসদের উপর তাদের আস্থা জ্ঞাপন করেছেন তাকে কটুকাটব্য করা সাধারণ আচরণ বিধিরও বাইরে। এতে করে শুধু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকেই খাটো করা হয়না বরং যে জনসাধারণ সেই সংসদকে নির্বাচিত করেছেন তাদের প্রতিও চরম অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়। ভবিষ্যতে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা তাদের বক্তব্য রাখতে সতর্ক হবেন, সংযত হবেন। আমরা যেন আমাদের উত্তরসূরীদের কাছে এমন কোন ট্র্যাডিশন রেখে না যাই যা আমাদের তাদের কাছেই একদিন হাস্যাস্পদ করে তুলবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আসন বৃদ্ধি সম্পর্কে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আসন সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। চলতি শিক্ষা বছরে প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণীর বিভিন্ন বিভাগে বর্ধিত সংখ্যা নিয়ে বর্তমান সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দু’হাজার ছ’শ’ বাহান্ন।
পূর্ব নির্ধারিত আসন সংখ্যা থেকে বিভাগওয়ারী বর্ধিত আসন সংখ্যা হয়েছে অর্থনীতি বিভাগে দু’শ থেকে তিন শ’, সমাজ বিজ্ঞানে দেড় শ’ থেকে দু’শ’, বাংলায় এক শ’ থেকে দু’শ’, হিসাব বিজ্ঞানে পঁচাত্তর থেকে দেড় শ’, ব্যবস্থাপনায় পঁচাত্তর থেকে দেড় শ’, মনোবিজ্ঞান বিভাগে ষাট থেকে আশি, ভেষজ বিজ্ঞানে ত্রিশ থেকে চল্লিশ, ভূ-তত্ব বিজ্ঞানে বিশ থেকে বত্রিশ, পদার্থ বিজ্ঞানে নব্বুই থেকে এক শ’ এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে পঞ্চাশ থেকে ষাট ও লোক প্রশাসন বিভাগে পঞ্চাশ থেকে ষাট। অর্থাৎ যে ক’টি বিভাগে আগে ছিলো ৮২৫টি আসন, এক্ষণে তা বেড়েছে হয়েছে ১১৩২।
প্রত্যেক বছরই ছাত্রভর্তির সময় বিশেষ করে ছাত্র সমাজ এবং অভিভাবকদের পক্ষ থেকে ভর্তির আসন বৃদ্ধির দাবী উঠে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষিতের হার যেখানে বিশ থেকে বাইশ, সেখানে উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে আসন সংখ্যা বৃদ্ধির দাবী একটি শুভ লক্ষণ এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শুভ লক্ষণের বিপরীত দিকটা সম্পর্কেও আমাদের ভেবে দেখা উচিত। এ যাবৎ পর্যন্ত আমাদের যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে তাতে বুদ্ধিজীবী মহল থেকে শুরু করে সকলেই প্রায় একই অভিমত পোষণ করেছেন—প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের দেশে যুগোপযোগী নয়। এর ফলে বছর বছর শিক্ষিতের সংখ্যা (হার নয়) বেড়ে যাচ্ছে সত্য, কিন্তু সে সব শিক্ষিত ব্যক্তিরা দেশ ও জনগণের কল্যাণে তেমনভাবে কাজে লাগছেন না, তাদেরকে যথাযথ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ফলে ক্রমান্বয়ে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই কেবল দিন দিন অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। একটা উন্নয়নগামী দেশে বেকার সমস্যা যে কি মারাত্মক ব্যাধির মতো সেকথা বলা বাহুল্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আসন সংখ্যা বৃদ্ধির খবরে সকলেরেই খুশী হবার কথা। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে রাজধানী শহর ঢাকার দিকে জনসমাগমের চাপ বৃদ্ধি পেয়ে আবাসিক সমস্যা যে মারাত্মকরূপ ধারণ করেছে সেক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসিক ব্যবস্থা না করে কেবল ভর্তির আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করে ভর্তি সমস্যার সমাধান ঘটবে কিনা সে বিষয়ে ভাববার অবকাশ আছে। শুধু তাই নয়, সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসে বসবার স্থান সংকুলান, অধিক সংখ্য শিক্ষার্থীদের জন্যে পর্যাপ্ত ভালো শিক্ষকদের ব্যবস্থা, শিক্ষকদের আবাসিক সংকট দূর করা, পাঠাগারে এবং গবেষণাগারে প্রয়োজনীয় বইপত্র এবং যন্ত্রপাতি সরবরাহ ইত্যাদি সবকিছুর ব্যাপারেই সুষ্ঠু ব্যবস্থার প্রয়োজন। নইলে কেবলমাত্র ভর্তির সুযোগ দানের জন্যে ভর্তির আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করে দায়সারা করলেই কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব শেষ হবে না।
সুতরাং সমগ্র অবস্থার কথা স্মরণ করে আমাদের বক্তব্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি সমস্যার ব্যাপারে যে অবস্থা বিরাজ করছে সেই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি করবেন জানিনা। তবে প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্যা একই রকম। সুতরাং—সত্যিকার জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালানোর জন্যে উচ্চশিক্ষা লাভের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে গোটা সমস্যাটিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করে সমাধানে সচেষ্ট থাকতে হবে। নইলে উচ্চ শিক্ষার নামে প্রসহনই সৃষ্টি হবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে আরো বক্তব্য, প্রচলিত যে শিক্ষা ব্যবস্থা বিজ্ঞান ভিত্তিক যুগোপযোগী নয় তা যথাসম্ভব সত্বর বাতিল করে রাষ্ট্রীয় চার মৌল আদর্শ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে দেশ ও জনগণকে কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে শিক্ষা বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ আরো কর্মতৎপর হবেন দেশবাসীর সঙ্গে আমরাও সেটাই আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক