You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.07.03 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | অশুভ শক্তির মোকাবেলায় কঠোর হোন | তরুণ সমাজের প্রশংসনী ভূমিকা | | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
৩রা জুলাই, মঙ্গলবার, ১৯৭৩, ১৮ই আষাঢ়, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

অশুভ শক্তির মোকাবেলায় কঠোর হোন

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত পরশুদিন নাটোরের উত্তরা গণভবনে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু নিজে। সভায় কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। খুনী, রাজনৈতিক ডাকাত, সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারীদের নির্মূল করার জন্যে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া যারা হিংসাত্মক কার্যকলাপ দ্বারা শান্তিকামী মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন—‘যে সকল দুষ্কৃতিকারী জনগণের দুর্দশা বাড়িয়ে তুলছে তাদেরকে দেশের মাটি থেকে নির্মূল করতে হবে।’ জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন ও সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করার জন্যেও তিনি নির্দেশ করেছেন। এছাড়া বি.ডি.আর.দের প্রতিও তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার নির্দেশ দান করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় আরও উল্লেখ করেছেন দেশের স্বার্থকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ার জন্যে একাগ্রতা, দেশপ্রেম ও সততার সাথে প্রশাসন যন্ত্রকে কাজ করে যেতে হবে। এ ব্যাপারে প্রশাসন যন্ত্রের দায়িত্ব অনেক বলেও তিনি জানান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বন্যা দুর্গত এলাকায় সফরে গিয়েছিলেন। সফরকালে তিনি উত্তরা গণভবনে অবস্থান করেছেন। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল সহ দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তিনি উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে মিলিত হন।
উক্ত বৈঠকে সমাজ দেহ থেকে দুষ্কৃতিকারী, রাজনৈতিক টাউট ও ডাকাতদের সমূলে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু প্রশাসন যন্ত্রকে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানিয়েছেন। বস্তুতঃপক্ষে, বাংলাদেশের বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এক দারুণ বিপর্যয়ের মধ্যে এসে পৌঁছেছে। এ ব্যাপারে অবিলম্বে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত বলে আমরা মনে করি। ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময় আমরা দেশের আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্যে কার্যকরী ব্যবস্থা নেবার কথা সরকারকে বলেছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনার আহ্বান জানিয়েছি। প্রকৃত প্রস্তাবে বাস্তব অবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে থেকে মোটেই ফায়দা নেই আমাদের। দেশের শত্রুশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে যে উঠেছে—এটা নিতান্তই সত্য কথা। তারা দেশের মাঝে অরাজকতা সৃষ্টি উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়। দেশের স্বাধীনতা নস্যাতেরও তারা সু-পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। এ ষড়যন্ত্রকে সকল শক্তি দিয়ে রুখতে হবে। সরকার এ ব্যাপারে যত বেশী বিলম্ব করবেন ততবেশী অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে আমরা মনে করি। দেশের ভিতরের এবং বাইরের একটি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি স্বাধীনতার শত্রুদের সমন্বয়ে মাথা উঁচু করে উঠবার প্রয়াস চালাচ্ছে। এই মুহূর্তেই সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমরা সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।

তরুণ সমাজের প্রশংসনী ভূমিকা

সর্বদলীয় ছাত্র সংগঠনের কর্মতৎপরতায় এ পর্যন্ত সোয়া লক্ষের অধিক ভুয়া রেশন কার্ড উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। গত পঁচিশে জুন থেকে তিরিশে জুন পর্যন্ত ঢাকা শহরের ডি-চার এবং ডি-পাঁচ রেশনিং এলাকায় মোট দু’শ’ এগারোটি রেশন দোকানের মধ্যে একশ’ একাত্তরটি দোকান থেকেই এ পর্যন্ত এক লক্ষ আটাশ হাজার পাঁচশ’ ছিষট্টিটি ভুয়া রেশন কার্ড উদ্ধার করা হয়। উল্লেখ্য যে, ঐ সব এলাকাতে ভুয়া রেশন কার্ড অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে, সামাজিক জীবনের দুর্নীতি উচ্ছেদকল্পে কিছুকাল আগে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিলো। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ডাকসু, নগর ছাত্র পরিষদ-এর সদস্যবৃন্দ সবাই একমত হয়েই এই কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে যে কোন সমাজবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে দশ-দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়বার শপথ গ্রহণ করেছিলো।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মতৎপরতার পরিচয়ও আমরা পেয়েছি। পরীক্ষায় দুর্নীতি দমন ও অবসরকালীন সময়ের সদ্ব্যবহার করে তাঁরা যৌথভাবে উল্লেখযোগ্য ও সক্রিয় ভূমিকা নেন। সমাজের সর্বস্তরে তা ব্যাপকভাবে অভিনন্দিত হ’য়েছিলো। সম্প্রতি ভুয়া রেশন কার্ড উদ্ধারের অভিযানেও এই তরুণ সমাজ আশাতিরিক্ত সাফল্য লাভ করেছেন। বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার জন্যে এবং জাতীয় মুক্তি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার জন্য কোনরূপ হুমকি ও ভয়ভীতিকে আমল না দিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাঁদের দশ-দফা কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাবার দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা করেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, সমাজ জীবনে আজ যে সকল অনাচার, দুর্নীতি ও সার্বিক বিশৃঙ্খলা তথা সব রকম অপরাধ প্রবণতা দেখা দিয়েছে, তার মোকাবেলা করার জন্যে তরুণ সমাজের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সর্বতোভাবে সহায়তা করার এই মনোভাব নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য। দেশের আপামর জনসাধারণের সঙ্গে এদের যোগাযোগ অতি ঘনিষ্ঠ। কাজেই সর্বস্তরে কাজের অভিযান চালনা করার সুযোগও তাদেরই সবচেয়ে বেশী। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার শুভবুদ্ধিকে আমরা স্বাগতম জানাই।
স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র কায়েমের পথে পদে পদে যে বাঁধা আসছে, তা যেমন বিভিন্নমুখী তেমনি বিস্তৃত। দেশের আভ্যন্তরীণ নানা গোলযোগই তার প্রমাণ। এই গোলযোগে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন আজ বিপর্যস্ত। আর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ঐসব ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা অত্যাবশ্যক। সেই কাজেও বাংলাদেশের অগ্রবর্তী শিক্ষিত তরুণ সমাজই চূড়ান্ত সহযোগিতা করতে পারবে বলে আমাদের ধারণা। কাজেই দেশ গড়ার কাজে তাঁদের শ্রম, সৎচিন্তা ও ঐকান্তিক কর্ম আজ আমাদের বিশেষ প্রয়োজন।
উন্নয়নমুখী প্রগতিপন্থী কর্মকর্তাদের এখন তরুণ সমাজের সঙ্গে খোলাখুলি পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করার কথা চিন্তা করতে হবে। গত স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বর্তমান কর্মপ্রেরণার ভিত্তির নিরিখেই তরুণ সমাজের ভূমিকা সম্বন্ধে আমরা আজ এই কথা বলতে পারছি।
বয়সে তরুণ এই ছাত্রসমাজের মধ্যে একটা সৎ, সতেজ, কলুষমুক্ত ও দেশপ্রেমিক মনকে আমরা প্রত্যক্ষ করছি। যার উদ্বোধন ঘটেছে সামাজিক দুর্নীতি দমনের তৎপরতার মাধ্যমে। এঁদের এই উদ্যমকে কাজে লাগিয়ে দেশের সার্বিক কল্যাণ সাধনের মহালগ্ন আজ উপস্থিত। তাই কাজের যথার্থ মর্যাদা দিয়ে তরুণ সমাজকে আজ উৎসাহিত ও অভিনন্দিত করতে হবে। তার ফলে তাদের কাছ থেকে সোনার বাংলা গড়ার কাজে অপরিমিত ও স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা পাওয়া যাবে। আর এই যৌথ প্রয়াসের মাধ্যমে যে সমঝোতা ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে তার মধ্য দিয়েই একদিন বেরিয়ে আসবে শোষণ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। সে শুভ দিনের প্রতীক্ষাই আমরা করছি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন