বাংলার বাণী
২রা জুলাই, সোমবার, ১৯৭৩, ১৭ই আষাঢ়, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
নয়া আমদানী নীতি
নয়া আমদানী নীতি ঘোষিত হয়েছে। এই আমদানীর শতকরা বিরাশি ভাগ রাখা হয়েছে সরকারী খাতে এবং বাকী শতকরা আঠারো ভাগ বেসরকারী খাতে। পুরো আমদানীর যে বিরাশি ভাগ রাখা হয়েছে সরকারী খাতে তার ঊনচল্লিশ ভাগ আমদানী করবে টি.সি.বি. এবং তেতাল্লিশ ভাগ আমদানী করবে বিভিন্ন সেক্টর কর্পোরেশন। সেক্টর কর্পোরেশনসমূহ কাঁচামাল, খুচরো যন্ত্রাংশ আমদানী এবং টিসিবি ভোগ্যপণ্য এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানীতে মুখ্যতঃ নিয়োজিত থাকবে। গত বছর আমদানী তালিকায় যে ভোগ্যপণ্য এবং কাঁচামাল ছিলো তার বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়নি বলে বাণিজ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন।
বিলাসদ্রব্যের উপর আগের মতোই নিষেধাজ্ঞা রেখে ভোগ্যপণ্যসহ কয়েকটি পণ্যের আমদানীর ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব এবং অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই অগ্রাধিকার প্রাপ্ত পণ্যসমূহের তালিকায় রয়েছে বস্ত্র-সূতা, ঔষধপত্র, চিনি, ভোজ্য, তৈল, তৈলবীজ, নারকেল তৈল, কয়লা, সিমেন্ট, বই, সাময়িকী এবং কাপড় ধোয়ার সোডা। কাপড় আমদানীর জন্য এবারকার আমদানী মওসুমেও ও.জি.এলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
সার্বিকভাবে এ নয়া আমদানী নীতি কল্যাণকর। জনসাধারণের মুখ্য চাহিদাগুলোর দিকে বিশেষ দৃষ্টি রেখেই এবারকার আমদানী নীতি প্রণীত হয়েছে। আমদানীর শতকরা বিরাশি ভাগ সরকারী খাতে রেখে সরকার সমাজতান্ত্রিক নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। ঔপনিবেশিক এবং পুঁজিবাদী একটি শাসন থেকে বেরিয়ে আসবার আঠারো মাসের মধ্যে আমদানী বাণিজ্যের শতকরা বিরাশি ভাগ রাষ্ট্রায়ত্তকরণ বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে।
ও.জি. এল. এ কাপড় আমদানীর ব্যাপারটা সাময়িককালের জন্যেই গ্রহণ করা হয়েছে। কাপড়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত সূতা আমদানীর ব্যবস্থাও রয়েছে। আভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা অতি শীঘ্রই বস্ত্র সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবো বলে বাণিজ্যমন্ত্রী যে আশাবাদ পোষণ করেছেন তা আমদানী নীতির প্রেক্ষিতে যু্ক্তিযুক্ত বলেই আমাদের মনে হয়েছে। কারণ আভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজনে বস্ত্রমিল এবং তাঁত শিল্পের জন্যে অগ্রাধিকারভিত্তিতে কাঁচামাল আমদানীর প্রশ্নটি বাণিজ্যমন্ত্রীর নজর এড়িয়ে যায়নি।
নয়া আমদানী নীতিতে সাধারণ মানুষের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে এটাই সব চাইতে আশার কথা। আশঙ্কা যতটুকু (অন্ততঃ আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা যেমন তিক্ত) তা টি.সি.বি. নিয়ে। তাদের উপর অধিকতর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। সরকার তার গোয়ালের এই দুষ্ট গরুটার দিকে একটু কড়া নজর রাখবেন বলে আশা করি।
আমদানীর একটা সিংহ ভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত করে সমাজতান্ত্রিক নীতি অনুসরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হলো অথচ তা জনগণের কল্যাণ সাধনে ব্যর্থ হলো—এমন আত্মবিধ্বংসী কাজ যাতে না চলতে পারে। ভুয়া আমদানীকারক এবং ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এটা যদি কার্যকরী হয় তবে কামরুজ্জামান সাহেব জনসাধারণের প্রীতিভাজন হবেন। রোগে মানুষের চিকিৎসার মতো ঔষধ মিলবে, গায়ে জড়ানোর জন্যে মিলবে কাপড়। মন্ত্রী মহোদয়ের কাছ থেকে মানুষ আপাততঃ এর চাইতে খুব একটা কিছু বেশী আশা করে না—কারণ সম্পদের এবং সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে সরকার এবং সরকারী কর্মকর্তাদের চাইতে জনসাধারণ কম ওয়াকিবহাল নয়।
তবুও ওষুধ মিলছে না
রোগীর জীবন বাঁচানোর জন্যেও ওষুধ পাওয়া যায় না। আর যদি বা কিছু পাওয়া যায়, তার দাম ক্রেতা সাধারণের ঊর্ধ্বেই থাকে। ফলে চিকিৎসা চালানো দুষ্কর হয়ে পড়ে এবং রোগীকে অনিবার্যভাবে মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিতে হয়।
একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, মহামারীর ভয়াবহ প্রকোপ অন্যদিকে জীবন ধারণের জন্যে উপযোগী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ঊর্ধ্বগতি ও দুষ্প্রাপ্যতা জনজীবনকে চূড়ান্ত দুর্গতির দিকে ঠেলছে। এমন দুঃসময়ে ওষুধও যথাসময়ে মেলে না।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত শনিবার জাতীয় সংসদে জানান যে, সারাদেশে এ পর্যন্ত চার কোটি টাকার ওষুধ ন্যায্যমূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে। এখন আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে এই ওষুধগুলো যায় কোথায়? ন্যায্যমূল্যের দোকানে চাহিদা মাফিক ওষুধ নির্ধারিত মূল্যে পাওয়াই বা যায় না কেন?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও জানান, ন্যায্যমূল্যে ওষুধ সরবরাহ করার জন্যে দেশের প্রতিটি জেলায় ও মহকুমায় ডিলার নিযুক্ত করা হয়েছে। স্বভাবতই আশা করা গিয়েছিলো এই ডিলারদের মারফত দেশের সর্বত্র ওষুধ বিতরিত হবে এবং ন্যায্যমূল্যের দোকান থেকে ক্রেতা সাধারণ তাঁদের প্রয়োজনের সময় ন্যায্যমূল্যেই তা পাবেন। কিন্তু এমন বহু অভিযোগ এসেছে যে, ন্যায্যমূল্যের দোকানে নিয়মমাফিক ওষুধ সরবরাহ করা হয় না। সংশ্লিষ্ট মহল দাবী করছেন—তাঁরা চার কোটি টাকার ওষুধ ডিলারদের মারফতে ন্যায্যমূল্যে সরবরাহ করেছেন—অথচ জনসাধারণ তা পান না। তার পরিবর্তে খোলা বাজারে চরম দামে তা বিক্রি হয়। জীবন বাঁচানোর জন্যে অগত্যা তাই ওষুধ কিনতেও হয় ক্রেতাকে। কিন্তু সেই কিনবার ক্ষমতা আছে ক’জনার? এই যদি অবস্থা তবে ন্যায্যমূল্যের দোকানের এই প্রহসন কেন? এক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে সংশ্লিষ্ট মহল ও ক্রেতাদের মধ্যবর্তী যোগাযোগ স্তরে মধ্যস্বত্ব ভোগী এরা কারা? কাদের কারসাজিতে ওষুধগুলো যথাস্থানে গিয়ে জনজীবন রক্ষা না করে মুনাফাখোরদের খপ্পরে পড়ছে? আর আজরাইলের চেয়েও নিষ্ঠুর ঐসব ব্যক্তি কেমন করে সমাজের বুকে সশরীরে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াতে পারছে?
বাংলাদেশের ওষুধের অভাব আছে একথা সত্য। সব রকম ওষুধ আমরা তৈরী করতে পারছিনা—এও ঠিক। বিদেশ থেকে যে পরিমাণ ওষুধ আমদানী করা হচ্ছে তাও হয়তো পর্যাপ্ত নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ওষুধ তৈরীর কারখানাগুলোর ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়েছিলো হানাদার বাহিনীর হাতে—সে কথাও সর্বজনবিদিত। এ সকল কৈফিয়তের সবই যথার্থ। ওষুধের অভাব জনগণের মনকে উল্লিখিত কারণগুলোর প্রেক্ষিতে সান্ত্বনা জোগাতে পারে। এরই পটভূমিতে সংশ্লিষ্ট মহল বিদেশ থেকে যতটুকু প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র আমদানী করলেন এবং জনগণের দুর্দশা মোচনের জন্যে সমগ্র দেশে ন্যায্যমূল্যের দোকানে সরবরাহের ব্যবস্থা করলেন। তা সত্ত্বেও জনগণের দুঃখ ঘুচলো না। ওষুধ তাদের হাতে পৌঁছুলো না। এর সান্ত্বনা কোথায়? দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে মরসুমের আমদানী নীতিতে বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। অন্নবস্ত্রের মতো এও জনগণের অন্যতম একটি মূল চাহিদা। তবে ওষুধ আমদানী করলেই চলবে না—এবং সরবরাহ করা হয়েছে বললেই সংশ্লিষ্ট মহলের দায়িত্ব শেষ হবে না। জনগণের হাতে প্রয়োজনের সময় সহজে ও সুলভে যেন সেই ওষুধ পৌঁছায় সেদিকে প্রখর দৃষ্টি দিতে হবে। সেই সঙ্গে খোলা বাজারে যে সকল মধ্যস্বত্ব ভোগীরা ঊর্ধ্বমূল্যে অবাধে ওষুধ বিক্রি করে মানুষের প্রাণের বিনিময়ে মুনাফা লুটছে, তাদেরও শায়েস্তা করতে হবে। ‘ওষুধ পাওয়া যায় না’ জনগণের এ অসহায় আর্তনাদকে মুখের কথায় নয়, সততা, কর্ম ও নিষ্ঠা দিয়েই শান্ত করতে হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক