বাংলার বাণী
১লা জুলাই, রবিবার, ১৯৭৩, ১৬ই আষাঢ়, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
বৃক্ষ রোপণ পক্ষ
আজ ১লা জুলাই। বৃক্ষ রোপণ পক্ষের শুরু হচ্ছে। একে সফল করে তোলার জন্য সর্বস্তরের জনগণের প্রতি যেখানেই সম্ভব বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে বৃক্ষ রোপণ পক্ষকে সফল করার আবেদন জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বৃক্ষ রোপণ পক্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, সরকারের এই প্রচেষ্টাকে সফল করে তোলার জন্যে প্রত্যেক নাগরিকের আরো গাছ লাগানো উচিত এবং জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এত বড় কাজ সরকারী কর্মচারীদের পক্ষে এককভাবে করে ওঠা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই আজ বনজ সম্পদ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সেই জন্য বৃক্ষরোপণ পক্ষের এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও আছে। প্রধানমন্ত্রী সেদিকে লক্ষ্য রেখেই জনগণের প্রতি বৃক্ষ রোপণের আবেদন রেখেছেন।
মূলতঃ অনার্য অধ্যূষিত বাংলাদেশ এককালে জল-জঙ্গলে নাব্য ছিলো। এদেশের নরম পলিমাটির বুকে অসংখ্য গাছ-পালা ছিলো। অতঃপর নগর সভ্যতার সূচনা থেকেই এদেশে চলেছে গাছ কাটার অভিযান। বিগত পঁচিশ বছরের শাসনামলেও তারই জের চলেছে।
একটা দেশের উন্নয়ন ও পুনর্গঠনমূলক কাজে প্রচুর কাঠ প্রয়োজন হয়। গত পঁচিশ বছরের কথাই ধরা যাক—রাস্তা-ঘাট, শিল্প, কল-কারখানা ইত্যাদির জন্যে প্রচুর বন সম্পদ ব্যবহৃত হয়েছে, অথচ পাকিস্তানীদের অবহেলা ও অযত্নের ফলে সুপরিকল্পিতভাবে কিছুই করা সম্ভব হয়নি।
এছাড়াও বন সম্পদ দেশের আবহাওয়া, ঝড়-ঝঞ্ঝা, প্লাবন, ভূমির উর্বরতা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এছাড়া নদী ও খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে এবং আবহাওয়া শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে। সেই জন্যে বলা যায়—গাছ-গাছালি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের জীবন ধারণের সহায়ক।
বিশেষজ্ঞের মতে, একটি দেশের ভূমি আয়তনের শতকরা পঁচিশ ভাগ বন সম্পদ থাকলে ভালো হয়। সেখানে আমাদের দেশে আছে মাত্র দশ ভাগ। এই বন-জঙ্গল আবার অধিকাংশই রয়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এবং পূর্ব দিকের পাহাড় অঞ্চলে। ফলে প্রয়োজনের সময় এই কাঠ সংগ্রহ করতে প্রচুর অর্থ ও শ্রম ব্যয় হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো বঙ্গবন্ধু যেখানেই সম্ভব বৃক্ষরোপণ করে এই পক্ষের মহান লক্ষ্যকে সাফল্যমন্ডিত করার কথা বলেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সরকার বনাঞ্চল উন্নয়নে বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন পরিকল্পনা নিচ্ছেন।
বৃক্ষরোপণ পক্ষ সম্বন্ধে একটি কথা দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, পাকিস্তানী শাসন আমলেও বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ বা পক্ষ উদযাপিত হয়েছে। দেশ স্বাধীন হবার পরও হয়েছে। কিন্তু তারপর যেন সব উদ্যম ও উদ্যোগের পালা চুকে যায়। সমবেত কর্মতৎপরতার অভাবে সমগ্র পরিকল্পনা প্রাথমিক স্তরেই সীমাবদ্ধ থাকে—সফলতার সোপানগুলো অতিক্রম করতে পারে না। ফলে বন সম্পদ বুদ্ধি না পেয়ে ক্রমশঃই হ্রাস পাচ্ছে।
বৃক্ষরোপণ পক্ষকে সফল করার উদ্দেশ্যে এবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তরফ থেকেই সরকারী ও বেসরকারী ব্যক্তিদের নিয়ে ছোট ছোট কমিটি গঠন করেছেন। আমরা আশা করবো—এবারের বৃক্ষরোপণ পক্ষ একটি সমবেত প্রয়াসের ফলশ্রুতিতে অধিকতর সার্থকতা লাভ করবে এবং বৃক্ষরোপণ পক্ষের যথার্থ তাৎপর্যের পরিপ্রেক্ষিতে বন সম্পদ বর্ধন, সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের দিকেও সজাগ দৃষ্টি দেওয়া হবে। অন্যথায় এ মহতী উদ্যোগের মূল্য বহুলাংশে কমে যাবে।
আমও যাবে ছালাও যাবে
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আরেকটি সংঘর্ষ বাঁধলে তিনি পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবেন—এ বক্তব্য রেখেছেন ইরানের শাহ।
সংবাদে প্রকাশ, ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র নয়াদিল্লী সংস্করণের আবাসিক সম্পাদক মিঃ গিরিলাল রৈণ তেহরানে গৃহীত ইরানের শাহের এক বিশেষ বিশেষ সাক্ষাতকারে বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, শাহ আশ্বস্ত করতে চান যে, যদি পাকিস্তানকে আক্রমণ না করে তাহলে ভারত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনভাবেই ইরানী অস্ত্রের সম্মুখীন হবে না।
মিঃ গিরিলাল আরো লিখেছেন, শাহ তাঁর বক্তব্যে এমন কোন কথা বলেননি যে, তিনি পাকিস্তানকে অস্ত্র দেবেন না বরঞ্চ তিনি বলেছেন, তাঁর দেশের স্বার্থের পক্ষে যেভাবে মঙ্গলজনক হবে মনে করবেন সেভাবে অস্ত্র ব্যবহার করার নীতিগত অধিকার তাঁর রয়েছে।
কথায় বলে, খুটার জোরে নাকি পাঠা কুঁদে। ইরানের শাহ মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র প্রাপ্তির পর ঠিক সেই রকম একটি ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হয়েছেন। পারস্য উপসাগরে পরোক্ষভাবে মার্কিন স্বার্থরক্ষা করা এবং অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুল পাকিস্তানকে মদদ জোগানো—এ দু’টো কাজই ইরানের শাহ করে যাচ্ছেন। আর তাই তিনি বোলচাল ছেড়েছেন ঘন ঘন। ইতিপূর্বেও তিনি হুংকার ছাড়ছিলেন পাকিস্তানকে খন্ড-বিখন্ড করা যাবে না। এমনকি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষ স্বাধিকারের দাবীতে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলো তখন ইরানের শাহ পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়েও নাক গলা উদ্যত হয়েছিলেন। ঠিক সেই নাক গলানোর বাসনা নিয়েই আবার তিনি হুংকার ছেড়েছেন।
‘যদি’ বা ‘কিন্তু’র কথা নয়। কথাটা অত্যন্ত স্পষ্ট। ভারত পাকিস্তানকে আক্রমণ করলে ইরান অস্ত্র সাহায্য দেবে একথা যেমন সত্য তেমনি সত্য হলো পাকিস্তান অন্যায়ভাবে ভারত আক্রমণ করলেও একই প্রকারের সাহায্য পাবে। এটা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট। স্পষ্ট বলেই পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বিগত একাত্তরের ডিসেম্বর যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করা সত্ত্বেও আবার মার্কিন ও চৈনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়েছে। আবার ভারতের সঙ্গে একটা সংঘর্ষ বাঁধিয়ে এ উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে চলেছে।
একই কারণে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে পাকিস্তান এখনো মেনে নিচ্ছে না। গত বছর ঠিক এমনি দিনে সিমলায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো সাহেব বৈঠকে বসেছিলেন। চুক্তিও একটা স্বাক্ষরিত হয়েছিলো কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আর বেশী দূর এগুতে পারেননি ভুট্টো সাহেব। তারপর থেকে আরম্ভ হয়েছে টালবাহানা।
এ উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি লক্ষ্য রেখে বাংলাদেশ-ভারত যে যুক্ত ঘোষণা প্রকাশ করেছিলেন তাতেও পাকিস্তান সাড়া দেয়নি। অথচ বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণা এ উপমহাদেশের উত্তেজনা হ্রাস করতে সক্ষম হবে বলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও পত্র-পত্রিকাগুলো মতামত প্রকাশ করেছেন।
সম্প্রতি মার্কিন মুল্লুকের ‘নিউইয়ক টাইমস’ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ঘোষণা এমন একটি নিষ্পত্তির প্রস্তাব দিয়েছেন যার মাধ্যমে উপমহাদেশের উত্তেজনা অনেকটা কমবে।
বিশ্বজনমত বা পত্র-পত্রিকা যাই বলুক না কেন পাকিস্তান কিন্তু এ সাধু বাক্য ও সৎ-পরামর্শ কানে নিতে নারাজ। কেননা পাকিস্তানের গাঁটছড়া আজ মার্কিন মুল্লুক আর চীনের সঙ্গে বাঁধা। সেখান থেকে গ্রীন সিগন্যাল না পেলে এগুনো মুশকিল।
ইরানের শাহ বা পাকিস্তান যাই-ই বলুক বা করুক না কেন এ উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে বিঘ্নিত করা সম্ভব হবে না। হয়তো উত্তেজনাকে জিইয়ে রাখা যাবে কিন্তু মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পৌঁছানো যাবে না। কেননা একথা সত্য যে, পাকিস্তান যদি ইরান, মার্কিন মুল্লুক বা চীনের উস্কানিতে যুদ্ধের আগুনে আবার ঝাঁপ দেয় তাহলে পাকিস্তানের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হবে। ইরানের শাহের মদদেও তাকে ঠেকানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত আমও যাবে ছালাও যাবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক