বাংলার বাণী
১৬ই জুলাই, সোমবার, ১৯৭৩, ৩১শে আষাঢ়, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
বিশ্ব আদালতে পাকিস্তানী আব্দার নাকচ
শেষাবধি হেগ আন্তর্জাতিক আদালতে পাকিস্তানী আব্দার নাকট হয়ে গেলো। ভারতে বন্দী ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বাংলাদেশে প্রেরণের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন ইনজাংকশন জারী করার জন্য পাকিস্তান গত ১১ই মে হেগ আন্তর্জাতিক আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছিলো। মামলায় আব্দার জানানো হয়েছিলো যে, ভারত যেন পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে বাংলাদেশের কাছে সোপর্দ না করে। বিশ্ব আদালত গত পরশু রাতে হেগে একটি দ্বিবিধ সিদ্ধান্তের পর ঘোষণা করে যে, পাকিস্তানী আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। বিশ্ব আদালত আরো অভিমত প্রকাশ করেছে যে, যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত সমস্যার প্রশ্নে আদালতের এখতিয়ার আছে কিনা তা স্পষ্ট করে জানার আগে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারীর সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। তাছাড়া, পাকিস্তানী আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতও এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আদালতের এখতিয়ারকে চ্যালেঞ্জ করেছিলো। আগামী ২৪শে জুলাই ইসলামাবাদে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব আদালতের বর্তমান সিদ্ধান্ত প্রকাশ না করার জন্যও পাকিস্তান আর্জি পেশ করেছিলো। কিন্তু এ আর্জিও শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকলো না। পাকিস্তান গত ১১ই জুলাই আন্তর্জাতিক আদালত সমীপে ইনজাংকশনের আবেদনটি স্থগিত রাখার জন্যে লিখিতভাবে নতুন করে আবেদন জানালে আদালত অভিমত প্রকাশ করে যে, এতে জরুরী বিষয় হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন ইনজাংকশন তার গুরুত্ব হারিয়েছে।
মামলার ব্যাপারে বিশ্ব আদালতের এখতিয়ার আছে কি নেই, সে সম্পর্কে আদালত পাকিস্তানকে আগামী ১লা অক্টোবরের মধ্যে বক্তব্য পেশের নির্দেশ দিয়েছে। এ ব্যাপারে ভারতীয় বক্তব্য পেশের জন্যে সর্বশেষ সময় ১৫ই ডিসেম্বর তারিখ নির্ধারিত করা হয়েছে। পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালতে স্বীয় দাবী উচ্চকিত করেছিলো এই বলে যে, বাংলাদেশে গণহত্যার দায়ে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের বিচারের অধিকার একমাত্র পাকিস্তানেরই রয়েছে। অতএব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অধিকার বাংলাদেশের নেই। গণহত্যা সংক্রান্ত জেনেভা কনভেনশনের ভিত্তিতে পাকিস্তান হেগ আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করেছিলো। পাকিস্তান আদালতে ধর্ণা দিয়ে বলেছিলো যুদ্ধাপরাধী বিচারের ব্যাপারটির প্রতি যেন অন্তর্বর্তীকালীন ইনজাংকশন জারী করা হয়। কিন্তু হেগ আন্তর্জাতিক আদালন পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ হতাশ করে দিয়েছে। আদালত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বাংলাদেশের কাছে তুলে দেবার বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন ইনজাংকশন জারী করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছে এবং বিষয়টি তাদের এখতিয়ারভুক্ত কিনা সে ব্যাপারে সবার আগে নিশ্চিত হতে হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতের ঘোষণা স্থগিত রাখার জন্যে পাকিস্তান অনুরোধ করেছিলো, কিন্তু হেগ আদালত সে অনুরোধে কর্ণপাত করেনি, বরং পাকিস্তানের এ অনুরোধে মামলার গুরুত্ব খর্ব করেছে বলে অভিমত পোষণ করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে ভালোই হয়েছে। পাকিস্তান যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে যে রাজনৈতিক দাবার খেল দেখাতে চাচ্ছে তাতে খানিকটা শিক্ষা সে হয়তো ইতিমধ্যেই কড়ায় গন্ডায় পেয়ে গেছে। উপমহাদেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রচনাকল্পে পাকিস্তানী উটকো নীতিই মূলতঃ বাতাস কলুষিত করে রেখেছে। এ উপমহাদেশের শান্তির পথটিকে পাকিস্তানই যে দিন দিন কন্টকিত করে চলেছে, তাতে আজ আর কারো দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই। বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে সম্প্রীতি যদি সত্যি সত্যিই পাকিস্তানের কাম্য হতো তাহলে ভুট্টো সাহেব এতো হরেক রকম টালবাহানার অবতারণা করতে পারতেন না। আসলে পাকিস্তানের মনোভঙ্গি উদার নয়, আন্তরিক নয়। আর এজন্যেই বারংবার পাকিস্তানকে নানা উছিলায় নানা রকম কান্ড কারখানার জন্ম দিতে হচ্ছে। হেগ আন্তর্জাতিক আদালতে পাকিস্তান ধর্ণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত একটা কূল কিনার সন্ধান পেলো না। বরঞ্চ এমনি করে পাকিস্তান হতাশার পংকেই নিমজ্জিত হচ্ছে। কাজেই কুট কারসাজিতে পাকিস্তানকে এবার হতোদ্যম না হলেই নয়। কারণ, উদ্যমগুলোকে ন্যায়ানুগ কাজে সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করতে না পারলে শেষ রক্ষা করা যাবে না। হেগ আন্তর্জাতিক আদালত যে পাকিস্তানের আবেদন নাকচ করে দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত ও অন্যান্য শুভবুদ্ধি সম্পন্ন দেশের অভিনন্দন কুড়োবে, তা আমরা প্রথম থেকেই আঁচ করেছিলাম। আমাদের ধারণা সত্যে পরিণত হয়েছে এবং আমরা হেগ আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্তকে সর্বান্তকরণে অভিনন্দিত করছি।
চা শিল্পকে বাঁচাতে হবে
সিলেটের ১২টি চা বাগান স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকে বন্ধ থাকার ফলে ৭ হাজার শ্রমিক বর্তমানে অনাহার অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। বর্তমান অর্থনৈতিক যে বিপর্যয় সারাদেশে বিরাজ করছে এই সময়ে যারা চাকুরীররত থাকা সত্ত্বেও উপার্জনের কোন পথ পাচ্ছেন না তাদের অবস্থা যে কি দুঃসহ সে কথা বলাই বাহুল্য।
খবরে প্রকাশ, কর্তৃপক্ষের অবহেলার দরুণ এই চা বাগান ক’টি ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে। আরো জানা যায়, এই সব চা বাগানে কোন কোন ক্ষেত্রে মালিকানা নিয়ে বিরাজ করছে ঝগড়া, আবার কোনটিতে রয়েছে মালিকের অবহেলা। আবার কোন কোন বাগানে কাজ হলেও শ্রমিকরা ঠিক মতো পারিশ্রমিক না পাবার ফলে বিরাজ করছে শ্রমিক অসন্তোষ।
আমরা জানি, আমাদের দেশে যে সব দ্রব্য বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়ে থাকে চা হচ্ছে তাদের মধ্যে অন্যতম। এবং সে কারণেই চা শিল্পকে বাঁচাবার জন্যে অনেক আগেই চা বোর্ড গঠিত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম বিশেষ দ্রব্য এই চা শিল্প যখন ধ্বংসের মুখে তখন চা বোর্ডের কর্মকর্তারা কি করছেন আমরা বুঝতে পারছি না।
স্বাধীনতার পরে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পতিত হওয়ার বিভিন্ন শ্রেণীর অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠেছে। ফলে বিভিন্ন কল-কারখানার শ্রমিকরা স্বভাবতঃই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও অধিক বেতন প্রাপ্তির জন্যে কর্তৃপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করছেন বিভিন্ন উপায়ে। ফলে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ চলছে না এবং সে কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে সকলকে। কিন্তু শ্রমিকদেরকে যেমন একথা সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের অধিক চাহিদা প্রাপ্তির পথ করতে হবে অনুরূপ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার আলোকে শ্রমিকদের দাবী পূরণে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কেবলমাত্র উভয়পক্ষের মধ্যে রেষারেষি বা বাদানুবাদের মাধ্যমে কোন সমস্যার সমাধান যেমন সম্ভব নয় তেমনি এটা কারো কাম্যও নয়। সুতরাং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যে কোন উপায়ে ধ্বংসোন্মুখ চা শিল্পকে বাঁচাতে হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিশিষ্ট স্থান সৃষ্টি করে নিতে হবে। তা হ’লে সেটা সামগ্রিকভাবে দেশেরই কল্যাণ হবে, জনগণ তার সুফল ভোগ করতে পারবেন।
অতএব কর্তৃপক্ষ এবং শ্রমিক সমাজ উভয়ের কাছে আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা, দেশের বৃহত্তর স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে চা শিল্পকে বাঁচিয়ে তোলার জন্যে তাঁরা সকলে আন্তরিকভাবে তৎপর হবেন। নইলে বিদেশী মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদেরকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, আন্তরিকতা থাকলে কোন সমস্যারই সমাধান অসম্ভব নয়।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক