You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.07.31 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | শহরের সঙ্গে গ্রামের এ ব্যবধান ঘুচে যাক | সুচিকিৎসার সুযোগ ঘটুক প্রতিটি মানুষের | মানবতার প্রতি এটা অপমানকর | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
৩১শে জুলাই, মঙ্গলবার, ১৯৭৩, ১৫ই শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

শহরের সঙ্গে গ্রামের এ ব্যবধান ঘুচে যাক

গ্রাম প্রধান এই বাংলাদেশ। আমাদের দেশের শতকরা নব্বুইজন মানুষই গ্রামে বসবাস করে। কিন্তু আমাদের গ্রাম বাংলার দিকে যদি একবার দৃষ্টিপাত করি, তাহলে আমরা কি দেখতে পারো? আমাদের গ্রামগুলোর চেহারাতে কোন জৌলুস নেই। গ্রামের মানুষগুলোর ভাগ্যেও যেন সুপ্রসন্ন নয়। কৃষকদের অর্থনৈতিক জীবন পর্যুদস্ত। গ্রামে গ্রামে শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিতান্ত অপ্রতুল। কৃষি ব্যবস্থাও অতিশয় মধ্যযুগীয় এবং সনাতন। আধুনিক যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কৃষি কাজের অগ্রগতি এখনো দুর্লঙ্ঘ। সার্বিকভাবে আমাদের এই বাংলার গ্রামীণ প্রতিচ্ছবিটি নিতান্তই জরাজীর্ণ, হতশ্রী এবং মারাত্মক রকমের অনুন্নত। অথচ কে না জানে যে, গ্রামই বাংলার প্রাণ এবং গ্রামের কোন রকম উন্নয়ন সাধিত না হলে দেশের উন্নতি সুদূরপরাহত।
আমাদের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী গত রোববার বাংলাদেশ জাতীয় পল্লী উন্নয়ন সমবায় সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে ‘গ্রামের মানুষকে শহরমুখীনতা পরিত্যাগ করে গ্রামোন্নয়নের প্রয়োজন’ বলে অভিমত প্রদান করেছেন। রাষ্ট্রপতি শহর ও গ্রামের মধ্যে শতাব্দীর প্রাচীন ব্যবধানের অবসান ঘটিয়ে শহর ও পল্লীর মধ্যে একটি সেতুবন্ধনের মাধ্যমেই পল্লীবাসীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। শহর এবং গ্রামের মানুষের জীবন যাত্রার মধ্যে যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে, তার প্রতি আর অঙ্গুলী সংকেতের দরকার করে না। কি ইংরেজ আমলে, কি পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনামলে, আমাদের গ্রামগুলোর প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলার কোন সীমা ছিলোনা। তাই আমাদের গ্রামগুলোর অবস্থা এতো নাজুক। এই নাজুক পরিস্থিতি অবশ্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বিরাজ করছে। তবে আশার কথা এই যে, এখন গ্রামের দুরবস্থা দূরীকরণের জন্যে নানা সময়ে নানা মুখে নানা কথা উচ্চারিত হচ্ছে। খুবই শুভ লক্ষণ সন্দেহ নেই। সম্প্রতি আমাদের রাষ্ট্রপতি পল্লীউন্নয়ন সমবায় সমিতির অনুষ্ঠানে যে সব বক্তব্য পেশ করেছেন তাতে তিনি গ্রামোন্নয়নের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, শহরের সঙ্গে যেনে গ্রামের কোন প্রভেদ না থাকে। আমরা বলি, গ্রাম এবং শহরের মধ্যে যদি জৌলুস এবং জনগণের জীবনযাত্রার মানগত বৈষম্যের চিত্রটি দিনের পর দিন প্রকট হয়ে ওঠে তাহলে মানুষ হতশ্রী, জরাজীর্ণ, কংকালসার গ্রাম থেকে পালাবে না কেন? গ্রামে গ্রামে যদি শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকে, যদি সামান্য চিকিৎসার জন্যেও গ্রামবাসীদের শহরাভিমুখে যাত্রা করতে হয়, তাহলে মানুষ গ্রামের প্রতি সমস্ত সহানুভূতি হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হবে; পালিয়ে যাবে শহরের চাকচিক্যময় জগতে। তাই গ্রামগুলো যে তিমিরে ছিলো এখন আর সেই তিমিরে থাকলে চলবে না। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, সুপরিকল্পিত কর্মসূচীর মাধ্যমে গ্রামগুলোকে গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু গ্রামগুলোকে গড়বে কে? সরকার না জনগণ? শুধু সরকার কিংবা শুধু জনগণ এই সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবেন না। সরকারী কর্মসূচীগুলো কেবল তখনই বাস্তবায়িত হবে, যখন জনসাধারণের কাছ থেকে সার্বিক সাহায্য পাওয়া যাবে। বর্তমান সরকার গ্রামের প্রতি উদাসীন নন। গ্রামীণ জীবনের উন্নয়ন এবং গ্রামের মানুষের সুখ ও সমৃদ্ধি সাধনের জন্যে দেশপ্রেমিক ত্যাগী কর্মী মানুষের একেবারে আকাল পড়ে যায়নি নিশ্চয়ই। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গ্রামের অন্ধকার জীবনে ধীরে ধীরে আলো বিকীরিত হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
আমরা জানি, গ্রাম বিধাতার সৃষ্টি, শহর মানুষের। কিন্তু বিধাতা-সৃষ্ট গ্রাম-বাংলার দিকে আজ আর দু’চোখ মেলে তাকানো যায় না; চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। গ্রামে গ্রামে আজ হাহাকার। মাঠে ফসল নেই। রোগের চিকিৎসা নেই। কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর আধুনিক ব্যবস্থা নেই। কুসংস্কারবশতঃ গ্রামের মানুষ এখনো জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রতি ভয়াতুর। হাজারো সমস্যাকীর্ণ গ্রামবাসীরা তাই আজ গ্রামে তাদের অভাব পূরণ করতে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে শহরের দিকে ছুটে আসছে। গ্রামবাসীদের মধ্য থেকে এই প্রবণতা দূর করতে হবে এবং এটা দূরীভূত সেদিনই হবে, যেদিন শহর ও গ্রামগুলোর মধ্যে ঐক্যবন্ধন প্রতিষ্ঠিত হবে।
গ্রামবাংলার সার্বিক উন্নয়ন এবং গ্রামভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্যে সরকার যে বাস্তবমুখী কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন, তা বাস্তবায়িত করার জন্যে জনগণের প্রতি রাষ্ট্রপতি আহ্বান জানিয়েছেন। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, এ ধরনের কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্যে শুধু আহ্বান জানানোটাই যথেষ্ট নয়, সরকারকে সত্যিকারভাবে গ্রামোন্নয়নে নিয়োজিত হতে হবে। গ্রামের উন্নয়ন এবং গ্রামবাসীদের অভাব অভিযোগ যদি পূরণ করা না হয়, তাহলে আমাদের গ্রামীণ জীবনযাত্রা একেবারে ভেঙে পড়বে। হতভাগ্য গ্রামবাসীদের প্রাণের প্রদীপ নিভে যাবে।

সুচিকিৎসার সুযোগ ঘটুক প্রতিটি মানুষের

স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেছেন, অদূরভবিষ্যতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইন্সটিটিউটকে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করা হবে। তিনি ইন্সটিটিউটের ছাত্র-শিক্ষকদের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে এই তথ্য প্রকাশ করেছেন এবং ছাত্রদেরকে আশ্বাস দিয়েছেন।
মন্ত্রী সাহেবের এই আশ্বাসবাণীকে আমরা সাধুবাদ জানাই। সাধুবাদ জানাই এই জন্যে যে, তাঁর বক্তব্যের মধ্যে বাংলাদেশে চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্বের কথাই ব্যক্ত হয়েছে।
খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা এগুলো হচ্ছে মানুষের মৌলিক প্রয়োজন। সত্যি বলতে কি আজ বাংলাদেশে এগুলোর অভাব এমন মারাত্মকরূপ ধারণ করেছে যে, তা লিখে জানানোর অবকাশ রাখেনা। এমতাবস্থায় এই মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিলে স্বভাবতঃই জনগণের আশ্বস্ত হবার কথা। বাংলাদেশে আজও সুচিকিৎসার অভাবে হাজার হাজার মানুষের অকালমৃত্যু ঘটছে। কেবল ঔষধপত্রের অভাবই নয়, চিকিৎসকের অভাবও এদেশে কল্পনাতীত। সুতরাং অধিক সংখ্যক চিকিৎসক সৃষ্টির ব্যবস্থা সরকারকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে যে ক’টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে এবং প্রতি বৎসর যে সংখ্যক চিকিৎসক সৃষ্টি হচ্ছেন তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। উপরন্তু সেইসব চিকিৎসকদের আরো উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নেই। সুতরাং অদূরভবিষ্যতে চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থাকল্পে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইন্সটিটিউটকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার খবরে স্বভাবতঃ আপামর জনগণ ভবিষ্যত সুচিকিৎসার আলোই দেখতে পাচ্ছেন।
জনগণের সঙ্গে আমরাও আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাহেব ছাত্রদেরকে যে আশ্বাস বাণী শুনিয়েছেন তা শুধু আশ্বাসবাণী হয়েই থাকবে না বরং তা বাস্তবায়িত হবে যথাসময়ে। আমরা আরো প্রত্যাশা করি, প্রগতিশীল বর্তমান যুগে অন্যান্য বিষয়ের মতো চিকিৎসা বিজ্ঞানেও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ভবিষ্যতে এমন একটি স্থান করে নেবে যার মাধ্যমে এদেশের মর্যাদা ও গর্ব পৃথিবীব্যাপী প্রসারিত হবে এবং সেই গর্বের সুফলে এদেশের হাজার হাজার মানুষ আজ যারা সুচিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছেন তাঁরা আর তেমনি করে মরবেন না। বরং তাদের বংশধররা প্রকৃত চিকিৎসার সুযোগ ভোগ করে নীরোগ দেহ-মনে অপার হাসি-আনন্দ এবং সুখ-শান্তিতে ভরিয়ে তুলবেন তাদের পরিবার। সোনার বাংলার প্রতিটি ঘর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তিতে ভরে উঠবে আমরা সেটাই কামনা করি আন্তরিকভাবে।

মানবতার প্রতি এটা অপমানকর

গত ২৯শে জুলাই ফ্রান্স আবার একটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। কয়েকদিন পূর্বে ফ্রান্স তার প্রথম বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটায়। দ্বিতীয় বোমাটি বিস্ফোরণের সংবাদ দিয়েছে বি.বি.সি.। ইতিমধ্যেই নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান এই বিস্ফোরণের জন্যে নিন্দা প্রকাশ করেছেন। ১৯৪৫ সালেও এমনিভাবে নাগাসাকিতে বোমা বিস্ফোরিত করা হয়েছিলো। তার জন্যে যে অসংখ্য জীব ও সম্পদের ক্ষতি সাধিত হয়েছিলো তা ইতিহাসে অম্লান হয়ে আছে। সেদিনও ফ্রান্সের নিকট এমনিভাবে প্রতিবাদ জানানো হয়েছিলো। আণবিক বোমা বিস্ফোরণ না করার প্রশ্নে বিশ্বের সকল জনমত এক। তবু বিশ্ব জনমত উপেক্ষা করেই ফ্রান্স দুই দুই বার আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বোমা বিস্ফোরণ করা হয়েছে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে। জানা গেছে, এই বোমা বিস্ফোরণে যে তেজষ্ক্রিয় ভস্মের সৃষ্টি হয়েছে তাতে বায়ুমন্ডল দূষিত হবে এবং তা আশঙ্কাজনক। শান্তি বিঘ্নিত ও সম্পদ বিনষ্টের সকল আশঙ্কাকে উপেক্ষা করে ফ্রান্স বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বিশ্বের প্রায় সকল জাতির ইচ্ছাকে উপেক্ষা করেই এ কাজ করেছে তারা। এমনকি জাতিসংঘ কর্তৃক ফ্রান্সের প্রথম বোমা বিস্ফোরণের ব্যাপারে আপত্তি বা দ্বিমত পোষণ করা হলেও দ্বিতীয়বারেও আবার বোমা বিস্ফোরণ করা হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ মানবতাবিরোধী এবং বিশ্বশান্তির প্রতি একটি প্রত্যক্ষ হুমকি। ফ্রান্সের এই একগুঁয়েমি নীতিকে আমরাও ‍ঘৃণা করি। মানবতার স্বপক্ষে সংগ্রাম জোরদার করা এবং বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করার এই শতাব্দীতে আণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর কাজ নিঃসন্দেহে মানবতা ও বিশ্বশান্তির পরিপন্থী। আজকের সভ্য জগতে এটা কোনক্রমেই মেনে নিতে পারে না। বোমা বিস্ফোরণের কারণে যদি বায়ুমন্ডল তেজষ্ক্রিয় পদার্থের দ্বারা দূষিত হয়ে থাকে এবং তাতে করে যদি জীবন ও সম্পদের বিনষ্ট হয় তবে তা মারাত্মক। বিশ্ব মানবতার প্রতি ফ্রান্সের এই আচরণকে অবমাননাকর বলে মনে করি। বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষও আমাদের সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করেন বলে আমাদের বিশ্বাস।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন