You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.07.29 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | দেশে আইন-শৃঙ্খলার অস্তিত্ব আছে কি? | এ অশুভ তৎপরতা প্রতিরোধ করুন | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
২৯শে জুলাই, রবিবার, ১৯৭৩, ১৩ই শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

দেশে আইন-শৃঙ্খলার অস্তিত্ব আছে কি?

যদি বলি উদ্বেগজনক, তাহলে কিছুই বলা হলো না। রীতিমতো আতঙ্কজনক খবরগুলোই অধুনা একটার পর একটা এসে জমা হচ্ছে। দিন যতোই গড়িয়ে যাচ্ছে, ব্যাংক এবং থানা লুন্ঠিত হবার খবর ততোই পত্রিকার পাতায় পাতায় প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সন্দেহ নেই, সমগ্র দেশব্যাপী আজ এক অরাজক অবস্থা বিরাজ করছে। আইন শৃঙ্খলার অস্তিত্ব আছে বলে আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সারাদেশের মানুষ আজ নিদারুণ উৎকন্ঠার মধ্যে দিনের কাজ-রাতের আরাম হারাম করে পৈতৃক প্রাণটুকু টিকিয়ে রেখেছেন। চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুন্ঠন, গুম-খুন এমন ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে যে, দুর্বৃ্ত্তদের দৌরাত্ম্যে দেশের মানুষ এখন প্রবল ভয়-ভীতির মধ্যে কাল হরণ করছেন। মানুষের জীবনের যেন আজ কাল কোন মূল্যমানই নেই। জীবনের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত। দেশে নাকি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ছাড়া এ পর্যন্ত কোন উন্নয়নই করতে পারেনি। বরঞ্চ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সারাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অধঃপতন ঘটছে।
গত কিছুদিন ধরে ব্যাংক ডাকাতিকে ছাড়িয়ে গিয়ে দুর্বৃত্ত দলগুলো নতুন ফন্দি আবিষ্কার করে থানা লুণ্ঠন করতে শুরু করেছে। বলা বাহুল্য, থানা লুন্ঠন করার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে অস্ত্রশস্ত্র দুষ্কৃতিকারীদের হস্তগত করা। এই সব লুণ্ঠিত অস্ত্র দিয়ে দুষ্কৃতিকারীরা সে দেশব্যাপী সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্য কায়েম করতে প্রয়াসী হবে, তাও আমাদের অজানা নয়। কিন্তু এই দুর্বৃত্তদলের কবল থেকে নিষ্কৃতিলাভের কি কোন পথ নেই? আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশের এই নাজুক পরিস্থিতি প্রতিরোধকল্পে কি কোন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন? একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে আইন শৃঙ্খলা নামে যদি কিছু ‍না থাকে, তাহলে সেই দেশের পুনর্গঠন কাজতো দিল্লী দূর অস্ত, সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচানোই দায় হয়ে পড়ে।
গত বৃহস্পতিবার মুন্সীগঞ্জ মহকুমার লৌহজং থানার পুলিশ বাহিনীকে কুপোকাত করে থানার সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দুষ্কৃতিকারীরা নৌকাযোগে পদ্মা নদী দিয়ে চম্পট দিয়েছে এবং থানার ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডে তিনটি লাল তারকা খচিত পতাকাও উত্তোলিত করেছে। এই সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী দলটি শুধু থানা লুন্ঠন নয়, পূবালী ব্যাংকের লৌহজং শাখায় হানা দিয়ে সমুদয় অর্থ নিয়েও লাপাত্তা হয়েছে। সশস্ত্র ব্যক্তিরা রাতের প্রথম প্রহরেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সর্বপ্রথমে লৌহজং থানা ঘেরাও করে। সঙ্গে সঙ্গে বেপরোয়া গুলিও বর্ষণ করে। থানার পুলিশ অবশ্য গুলির জবাব গুলিতেই দেয়। কিন্তু ডাকাত দলটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে না উঠায় পালিয়ে ‘চাচা আপন পরাণ বাঁচা’ করে।
পূবালী ব্যাংকের লৌহজং শাখা থেকে দুর্বৃত্তরা দু’লাখ সাতান্ন হাজার ছয়শ’ ঊনসত্তর টাকা সাফল্যজনকভাবে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। একযোগে লৌহজং থানা এবং পূবালী ব্যাংক লুটের এই চাঞ্চল্যকর খবর আমাদের বিব্রত এবং বিচলিত না করে পারে না। থানা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা থেকেই আমাদের সরকারের উপলব্ধি করা উচিত যে, একটি সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতিকারীদল সুপরিকল্পিতভাবে সমগ্র দেশব্যাপী সন্ত্রাস ও আতংকের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে অশুভ ‍উদ্যোগ নিয়েছে। প্রকাশিত খবরের বিবরণে জানা গেছে যে, দুর্বৃত্তদলটি রাষ্ট্রবিরোধী শ্লোগান দিতে দিতে একটি লাল চিহ্নযুক্ত পতাকাও লৌহজং থানায় উত্তোলন করে।
দুর্বৃত্তদলটি লৌহজং থেকে লুন্ঠিত বিপুল আস্ত্রশস্ত্র দিয়ে অদূরভবিষ্যতে নতুন করে আবার কোথায় অভিযান পরিচালনা করবে তা কেউ নিশ্চিত করে না বলতে পারলেও, লুন্ঠন অভিযান যে এরা অব্যাহত রাখবেই, তাতে আর কারো মতান্তর থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরাই যদি এভাবে ক্রমাগত দৃর্বৃত্ত দলের হাতে চরম পরাজয় এবং ব্যর্থতার নজির স্থাপন করতে থাকে, তাহলে সাধারণ জনজীবনের নিরাপত্তা বোধের গ্যারান্টি দেবে কারা?
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত আর এক প্রতিবেদনে জানা গেলো যে, জনসংখ্যানুপাতে ঢাকা শহরের ২৫০০ জনের জন্যে একজন পুলিশ নিয়োজিত রয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, রাজধানী ঢাকা শহরেরই যখন এহেন অবস্থা, তখন দেশের অন্যান্য স্থানে কী মর্মান্তিক অবস্থা হতে পারে। আমাদের ধারণা, দেশে পুলিশের সংখ্যা এতোই অপ্রতুল যে, তারা দুর্বৃত্তদের কোন আক্রমণই প্রতিহত করতে সক্ষম নয়। ফলে থানা লুটের মতো মারাত্মক এবং আজব সব কান্ডকারখানা বাংলাদেশের বুকে নিত্যনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতি আমাদের আবেদন সুশিক্ষিত পুলিশের সংখ্যা বাড়ান। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি রোধ করে জনজীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনুন। মানুষের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুন।

এ অশুভ তৎপরতা প্রতিরোধ করুন

ভুট্টো যে কথাগুলো বলেছিলেন তাই নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছেন আমাদের দেশের কিছুসংখ্য ‘বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিক-চিন্তাবিদ’। পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের দুরবস্থার মানবিক আবেদনকে পুঁজি করে যারা এ কথা সে কথার জাল বুনে চলছিলেন তাদের থলি থেকেও টিক সময়মতো আসল বিড়ালগুলো বেরিয়ে আসছে। উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিশ্ব জনমত যখন দিনের পর দিন আমাদের বক্তব্যের প্রতি সমর্থন বাড়িয়ে চলেছে, পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের ব্যাপারে যখন চাপ সৃষ্টি হচ্ছে পাকিস্তান সরকারের উপর এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণার আলোকে খোদ পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে তখন বাংলাদেশ থেকেই একটি সংস্থা যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসলো বাংলাদেশ সরকারের কাছে। লক্ষ্য করা যেতে পারে যে, বঙ্গবন্ধু যখন বিদেশ সফরে রওয়ানা হচ্ছেন তার পূর্ব মূহূর্তেই এই দাবী জানানো হয়।
ইতিমধ্যে একটা আম-জলসাও হয়ে গেছে। প্রাক্তন মুসলিম লীগের জনৈক প্রখ্যাত নেতা এই আম-জলসায় শরীক থেকে যুদ্ধাপরাধীদের অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার দাবী জানিয়েছেন। যদিও এরা জনসাধারণের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র একটা অংশ কিন্তু তাদের বক্তব্য বাংলাদেশের বিরোধী শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহার করবার যে মওকা লাভ করবে তা অস্বীকার করবার উপায় কোথায়। আর জেনে শুনে আমাদের সেই বিরোধী শিবিরকে যারা শক্তি যুগিয়ে চলেছে তাদের উদ্দেশ্যটাই বা কি?
একটা অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবার জন্যে পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের দুরবস্থার মতো মানবিক আবেদনকে পুঁজি করা হয়েছে। বিশেষ সমিতির কার্যক্রম এবং বিশেষ করে সাম্প্রতিককালের বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে এখন তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা বৈঠকে আমাদের মিত্রশক্তিকে দুর্বল করে দেয়া এবং বর্তমানে বিদেশে সফররত বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে প্রশ্ন তুলবার মতো যে সুযোগ এই বাংলাদেশেই অবস্থানরত একশ্রেণীর লোক সৃষ্টি করে চলেছে তারা যে দূরলক্ষ্য হিসেবে আরো হীন কোন উদ্দেশ্য স্থির করে রাখেনি এটাই বা কিভাবে বিশ্বাস করা চলে। সরকার বা সরকারে অধিষ্ঠিত নেতৃবৃন্দকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকবার কোন সুপারিশ আমরা করতে চাইনা। কারণ এমন সুপারিশ স্বাধীনতাউত্তরকাল থেকে আজ পর্যন্ত কোন কাজে লেগেছে বলে আমাদের মনে হয়নি। তারা দেশসেবা, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের মর্যাদা, ত্রিশ লক্ষ শহীদের আদর্শ এবং আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের মতো ছোট কাজে মনোযোগ না দিয়ে অন্যান্য যে সব কাজে লিপ্ত আছেন তাতেই ব্যস্ত থাকুন। আমরা সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন জানাবো দুরভিসন্ধিমূলক এই তৎপরতা যাতে অবাধে চলতে না পারে। সময় থাকতেই এ সবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন