বাংলার বাণী
১১ই মার্চ, ১৯৭৩, রবিবার, ২৭শে ফাল্গুন, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ
স্বপ্নের দেশ—সোনার বাংলা
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত নির্বাচনোত্তর এক বাণীতে দেশবাসীর প্রতি সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর স্বপ্ন ও সাধনার ধন ‘আমাদের স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলা’ গড়ার আহ্বান জানান। দেশের সবার জন্যে যাতে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যায় সে জন্যে তিনি দেশবাসীকে নতুন করে জাতীয় পুনর্গঠনের সুবিশাল কাজে আত্মোৎসর্গ করতে বলেন। তিনি আরো বলেন, ‘সমস্ত রকম শোষণ থেকে মুক্ত একটি সমাজ কায়েমের জন্যে আসুন এবার ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি।’
বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হবার পর জল্লাদ শিরোমণি ইয়াহিয়ার কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষ হয়েছে এবারে দেশ গড়ার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এদেশের দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর চৌদ্দটি মাস অতিবাহিত হতে চলেছে। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে বাংলার মানুষকে। তবুও বাংলার মানুষ যে চারটি রাষ্ট্রীয় মৌল নীতি—গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে বদ্ধপরিকর তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ হলো স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে দেশের একমাত্র সংগ্রামী রাজনৈতিক পার্টি আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে বাংলার মানুষ সারা বিশ্বকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের নয়নমণি শান্তিবাদী বঙ্গবন্ধুর পেছনে সকলেই আছেন। সকলের মুখেই এক কথা—বঙ্গবন্ধু যেখানে আমরা আছি সেখানে।
স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলাকে এখনো আমরা বাস্তবে রূপায়িত করতে পারিনি। যাত্রা আমাদের শুরু হলো মাত্র। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের প্রতি আস্থা প্রকাশ করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবেনা। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের কর্মসূচীকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্বও দেশপ্রেমিক জনসাধারণের। কোন সরকারের পক্ষেই এককভাবে কোন কিছু করা সম্ভব নয়। সোনার বাংলাকে গড়তে হলে আজকে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন সোনার মানুষ। যারা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি. ঘুষ. মুনাফাখোরী, চোরাচালান ও মওজুতদারীর ঊর্ধ্বে থেকে দেশের জন্য অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করে যাবেন। যারা ক্ষেতে খামারে কলে কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি করে মানুষের দুঃখ দুর্দশাকে লাঘব করবেন। বঙ্গবন্ধু বহুবার বলেছেন, আমাকে বেটে খাওয়ালেও সোনার বাংলা হবে না যদি না সোনার মানুষ পয়দা হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। শহীদের আত্মত্যাগ, মায়ের অশ্রু বিফল হয়ে যাবে যদি না আমরা শোষণমুক্ত সুখী ও সমৃদ্ধিশালী সমাজ গড়ে তুলতে পারি। আর এ দায়িত্ব আমার, আপনার, সকলের। আজ সকলকেই একটি মাত্র শপথ বাণীতে উদ্দীপ্ত হতে হবে আর সে বাণী হলো—কথা নয় কাজ চাই। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমরা সোনার বাংলাকে বাস্তবায়িত করবোই।
নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা
কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের মুখে শোনা যাচ্ছে এবারের সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় নাই, কারচুপি হয়েছে। কেউবা আবার কথার যৌক্তিকতা বিচার না করে নির্দ্বিধায় বলছেন, এ নির্বাচনে প্রশাসনিক যন্ত্রকেও ‘কারচুপি’ কাজে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এসকল উক্তির যথার্থতা বিচারের ভার জনতার উপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। কারণ জনতার ভোটেই নির্বাচন পর্ব শেষ হয়েছে। জনগণই ভোটদানে আওয়ামী লীগের জয় এনে দিয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগের এ অভূতপূর্ব সাফল্য ও জয় এসেছে। ২৮৮টি নির্বাচনী এলাকার তালিকাভুক্ত ভোটারদের শতকরা ৭৩ জন ভোটদান করেছে আওয়ামী লীগের পক্ষেই। শতকরা ৭৩ জন লোকের মানসিকতা কি ছিলো এবং কেনই বা তারা আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দান করলো? এ চিন্তার ভার দেশের সুধীজনদের উপরই ছেড়ে দেওয়া ভালো। এই ৭৩ ভাগ লোক কেত আর জোর জবরদস্তি করে ভোট দেওয়ান হয় নাই। তারা স্বেচ্ছায় ভোট দিয়েছে, তারা তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপায়ণে পছন্দমত দলকেই ভোট দিয়েছে। আওয়ামী লীগ দলকে ভোট দিয়েছে। তাই আওয়ামী লীগের এ বিরাট সাফল্য ও জয়। এ জন্য বদনাম আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার যৌক্তিকতা কোথায়! যিনাদের মনে এ ব্যাপারে সংশয়ের উদ্রেক হয়েছে তাদেরই যুক্তির বিশ্লেষণে এসব ভেবে দেখা উচিত।
নবজাত স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিকদের জন্য এটাই ছিলো প্রথম গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগের প্রথম প্রচেষ্টা নির্বাচনের মাধ্যমে। এই জনগণই দেশ স্বাধীন করেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ছায়াতলে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই জনগণের মধ্যে বাঙালী জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছে, পাকিস্তানী ঔপনিবেশিকতার কবল থেকে দেশকে মুক্ত করেছে স্বাধীন করেছে। আওয়ামী লীগের জন্ম রাতারাতি হয়নি। আওয়ামী লীগের জন্ম ১৯৪৮ সালে। এই জন্মকাল থেকেই আওয়ামী লীগ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সুখ-দুঃখের সাথে গভীরভাবে জড়িত। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরেই আওয়ামী লীগ জনগণের দুঃখ মোচনের জন্য সংগ্রাম করে আসছে। আওয়ামী লীগ ও বাংলার জনগণ দীর্ঘকাল থেকে পরস্পরের অস্তিত্ব ও স্বাধিকার পাওয়ার সংগ্রামের সাথে জড়িত। তাই যেমন আওয়ামী লীগ জনগণকে অস্বীকার করতে পারে না জনগণও আওয়ামী লীগকে ভুলতে পারেনি। এ কারণেই আওয়ামী লীগের বিজয় এবারের নির্বাচনে। জনগণের ভোটেই এ দলের এই বিরাট সাফল্য—অবিস্মরণীয় বিজয়।
সোজা কথায় বলতে হয়, রাজনীতির জয় ও পরাজয় নির্ভরশীল জনগণের ইচ্ছার উপর। আর এ সাফল্য যদি আওয়ামী লীগের প্রাপ্য হয়ে থাকে তবে এভাবে গালমন্দ দিলে সে গালমন্দ জনগণকেই দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে তথাকথিত মুষ্টিমেয় রাজনৈতিক দলগুলোর (অবশ্য নিজেদেরকে আখ্যায়িত করেছে ঐরূপে) জন্ম রাতারাতি—জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে সংশ্রব না থাকার দরুণই হয়ত এমন পরাজয় তাদের। আর এই রাজনীতির খেলায় হেরে গেলে ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট প্রদান হয় নাই ইত্যাদি—কথাগুলো বলে থাকে পরাজিত নায়কেরা। এটা যে আমাদের দেশেই হলো তা নয় পশ্চিমবঙ্গেও এমন কথা শোনা গেছে। সেখানে গত নির্বাচনে কংগ্রেসের কাছে হেরে গিয়ে সি.পি.এম-এর কন্ঠেও অনুরূপ কথা ধ্বনিত হয়েছে। বলতে হয় এসব উক্ত নিশ্চয়ই পরাজিতরা তাঁদের মুখ বাঁচানোর তাগিদেই বলে থাকেন। আমাদের দেশের পরাজিত ও জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত তথাকথিত নেতাদের মুখেও অনুরূপ কথা শোনা গেলো। সব কিছু দেশেশুনে বলতে হয় নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা।
বিশ্বজনমতে নির্বাচনের বিজয়
বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করেছে তার জন্যে বিশ্বের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিরাট প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বিশ্বের জনমত এ বিজয়কে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন বাণী পাঠিয়েছেন। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে। বিশ্বের যতগুলি শক্তিশালী পার্লামেন্ট রয়েছে বাংলাদেশের পার্লামেন্ট হবে তাদের মধ্যে অন্যতম। নির্বাচনে এতোবড় বিজয়ের অনন্য ঘটনা বিশ্বইতিহাসেও বিরল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একমাত্র দেশনন্দিত নেতা। বিশ্বের সকল দেশে তাঁর খ্যাতি আজ উত্তুঙ্গে। বিশ্বের অনেক দেশেরই ধারণা ছিলো স্বাধীনতার পর স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে যে সকল সমস্যার উদ্ভব হবে সরকার কোনক্রমেই তা কাটিয়ে উঠতে পারবে না। এমনকি অনেকের ধারণা ছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জনসমর্থনও অনেকখানি কমে গেছে। এবারের নির্বাচনে তাদের সে ভুল ভেঙেছে। এবং বিশ্বের সর্বত্র এর একটা প্রতিক্রিয়া সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বিশ্ববিখ্যাত পত্রিকা ‘টাইমস্’ তার সম্পাদকীয়তে বলেছে নির্বাচনের এই ম্যান্ডেটের পেছনে কতকগুলি সঙ্গত আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কারণ রয়েছে। এবং বিগত সত্তর সালের নির্বাচনের স্বায়ত্তশাসনের দাবীর ন্যায় এবারও কতকগুলো ওয়াদার ভিত্তিতে নির্বাচনের ডাক দেওয়া হয়েছিলো। উপমহাদেশীয় সমস্যা সমাধানেরও একটি বৃহৎ মনোভাব আওয়ামী লীগ নেতাদের রয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত ‘প্রাভদা’ পত্রিকায় বলা হয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জনগণ যে রায় দিয়েছে তার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো—দেশ প্রগতিশীল পথে স্বাধীনতা জোট ও গোষ্ঠী নিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন, দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণ ও এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। বিশ্বের আরও একটি প্রখ্যাত পত্রিকা ‘গার্ডিয়ান’ তার সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছে—শেখ মুজিবের বিজয় নৈরাশ্যবাদীদের ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। তাদের ধারণা ছিলো অসংখ্য মানবিক সমস্যা জর্জরিত বাংলাদেশ কয়েক মাসের মধ্যেই নৈরাজ্যের শিকার হবে। এ সকল ধারণার মুলোৎপাটন করে বাংলাদেশ আজ একটি গতিশীল নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক